সময়ভ্রমণ— ৪৬
আগের পর্বে
মেয়ার এবং হো-এর লেখা থেকে জানা যায়, চিনের বাইরেও নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল চায়ের সংস্কৃতি। চিন থেকে ক্যারাভেনবন্দি হয়ে চা পৌঁছে যেত রাশিয়ায়। রাশিয়া থেকে চা ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিম এশিয়াতেও। চিন থেকেই চা পৌঁছেছিল জাপানে। তবে সে-দেশে গড়ে উঠেছে এক আলাদা সংস্কৃতি। এর মধ্যে মিশেছে জেন বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব। শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্যেও বারবার উঠে এসেছে চায়ের কথা। জাপানে চায়ের জনপ্রিয়তার বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল সম্ভবত যোদ্ধা সেন রিকুয়ু-র। তাঁর জীবনের সঙ্গে, বহু যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে চায়ের গল্প।
হালের, একান্তই ব্যক্তিগত একটা গল্প বা প্রসঙ্গ উত্থাপন করা যাক। এক বন্ধু থাকেন ইংল্যান্ডের ডরসেটের আধা-গ্রামে, সায়েবরা যাকে আদর করে কান্ট্রিসাইড বলে। দুচারটে ঘরবাড়ি দোকানটোকান বাদ দিলে বাকি জায়গাটা গ্রীষ্মে সবুজ, বাদামি, নীল, হলদে, লাল : ঘাসে ভরা তরঙ্গায়িত মাঠ, যেখানে গরুভেড়া চরে, বড়ো বড়ো গমক্ষেত, গমের ডগা ঘন বাদামি, মাঝে মাঝে এক আধটা পুরোনো বাড়ি, তার সীমানায় হলদে পাতার ঝোপ, পথপ্রান্তের ঘাস থেকে ঘনলাল পপিফুল উঁকি দিচ্ছে। মাঠঘাট ভেঙে খানিক এগুলে টুকরো কিম্বা কিছু বড় বন, বা বনের মতো গাছের জটলা। মাঠের ঢেউ শেষ হচ্ছে অনুচ্চ টিলায় পৌঁছে, সেই টিলার চূড়ার কাছাকাছি গোল চৌকো রেখা, সেসব জায়গায় পুরোনো রোমকদের ডেরা ছিল, বা প্রাগৈতিহাসিক, প্রাক-রোমক মানুষদের, যাঁরা বড়ো বড়ো পাথর দিয়ে স্টোনহেঞ্জ বানিয়েছিলেন। টিলার পর টিলার পর টিলা, মধ্যের মাঠবনক্ষেত, এসব উঁচু হয়ে পৌঁছচ্ছে সমুদ্রের সবুজ ঘেসো পাড়ে, উপর থেকে উঁকি মেরে দেখা যায় বহু নিচে ক্ষয়ে যাওয়া খয়েরি-কালো পাথর, সেখানে ঢেউ আছড়াচ্ছে। আঠেরো শতকের চা চোরাচালানকারিদের ঘাঁটি ছিলো ডরসেটের উপকূল, সরকারি লোকজন ঢুকতে ভয় পেত।
সে যাক। এখনকার ডরসেট খুব শান্ত, ঠান্ডা, সুন্দর ও নিরূপদ্রব জায়গা, দিব্যি হেঁটে বেড়ানো যায়। আমার বন্ধুটির লম্বা পা, তিনি প্রত্যেক দিন গড়ে দশ-বারো কিলোমিটার হেঁটে থাকেন। ডরসেটের গ্রীষ্মকালীন নিসর্গের কিছু ছবি তিনি ইমেলে পাঠিয়েছেন, দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। তার মধ্যে কিছু ছবি বেশি রঙিন, বনের মধ্যে গাছের তলায় ব্লুবেল ফুলের চোখ জুড়িয়ে দেওয়া গাঢ় নীল, বড় গাছের সবুজ-হলুদ পাতার নিচে নীলের প্লাবন। ব্লুবেল ইংল্যান্ডের নিজস্ব ফুল, বছরের বিশেষ কিছু দিনে ফোটে, দ্রুত ঝরে যায়। বছর কয়েক আগে বন্ধুর সঙ্গে ডরসেটের মাঠেবনে অল্প ঘোরাঘুরির সুযোগ ঘটেছিলো, সরু সরু বিচ গাছের বনে নেহাৎই এলেবেলে দেখতে কিছু গুল্ম দেখিয়ে তিনি বললেন, এই দেখো ব্লুবেল গাছ। গাছে ফুল এলে পুরো জায়গাটা জাদুমন্ত্রের মতো বদলে যাবে। তাঁর পাঠানো ছবিতে সে জাদুর ছোঁয়া পেলাম। উৎসাহিত হয়ে তাঁকে দু ছত্র লিখে পাঠালাম, তৈরি করা, বানানো নিসর্গের মধ্যে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো বিশুদ্ধ, নিষ্কলুষ প্রকৃতি খুঁজে পেলে বড়ো ভালো লাগে। বনজঙ্গলপ্রকৃতিনিসর্গের ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে বন্ধু অনেকদিন ধরে কাজ করছেন, তিনি যা জানালেন, সেটা তাঁকে না জানিয়েই এখানে তুলে দিচ্ছি:
“ব্লুবেল বলো আর অর্কিড(অর্কিডের ছবিও এসেছিলো), ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চলের যে যে সুন্দর ব্যাপারগুলো...দীর্ঘদিন ধরে মানুষের সঙ্গে তারা বেড়ে উঠেছে, বদলেছে, বিবর্তিত হয়েছে। ভগবান করুন, কোথাও 'বিশুদ্ধ' প্রকৃতি-টকৃতি নেই! বনে ভরা চারণভূমি, বড় গাছ কাটার পর তার কান্ড থেকে বেরুনো ছোট গাছ(কপিস), নদীর পাড়ের বন, সবটাই মানুষের তৈরি। তুমি লিখেছো) 'বানানো নিসর্গের' মধ্যে খন্ড প্রকৃতি টিঁকে আছে, ব্যাপারটা সেরকম আদৌ নয়, পুরো নিসর্গটাই শুরু থেকে শেষ অবধি 'বানানো'। পৃথিবীর সর্বত্রই এমন, মায় আমাজনের বন। কথাটা হচ্ছে, 'কে' বানাচ্ছে? তুমি কি অলিভার রাকহ্যামের লেখা 'ইংরেজ গ্রামাঞ্চলের ইতিহাস' বইটা পড়েছ?
তৈরি করা বিচবনেও ব্লুবেল ফোটে। যে ছবিটা এবার দিচ্ছি সেটা অনেক বছর আগে মে মাসের এক বিকেলে তোলা...ওই জায়গায় এবার ব্লুবেল হয়ইনি। কোভিদ ও অন্যান্য কারণে বনবিভাগের লোকজন এসে সাফসাফাই করতে পারেনি, গাছের তলা আগাছায় ছেয়ে গেছে।”
আরও পড়ুন
চিন, জাপান, হল্যান্ড, ব্রিটেন: চায়ের বহু গল্প (চার)
এর উত্তরে যা লিখেছিলাম, তার খানিকটা বলি:
আরও পড়ুন
চিন, জাপান, হল্যান্ড, ব্রিটেন: চায়ের বহু গল্প(তিন)
“ঠিক, 'বিশুদ্ধ' প্রকৃতি বলে কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। তবে কিনা আমার মনে হয় না, সব ধরনের প্রকৃতিতৈরিতে শুদ্ধতা ব্যাপারটা নষ্ট হয়ে যায়। পুরোনো জুমিয়াদের কথাই ধরো--ঔপনিবেশিক সায়েবদের লেখা ঘাঁটছিলাম, হঠাৎ দেখি সায়েব প্রশাসকদের(পরে যাঁরা পাগলের মতো বনজঙ্গল সব সাফ করে দিয়ে মর্জিমতো জমি দখল করবেন, যাতে চা বাগান গোছের বাণিজ্য হতে পারে) মধ্যেও কেউ কেউ এই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁরা জুমিয়াদের কৌমজীবনের প্রাকৃতিক ছন্দের কথা বলছেন, যৌথ সমাজের গড়নধাঁচকে পছন্দ করছেন। যে প্রকৃতি আগে থেকেই ছিলো, এ ধরণের প্রকৃতি তৈরি তাকে নির্মূল নিশ্চিহ্ন করেনা, স্বভাবতই(চাষ হয়ে গেলে) বন ফিরে আসে। উপনিবেশীকরণ অর্থে বিলোপ, যা ছিল তার সবটাকে নির্মম ভাবে কোতল করা। ব্রিটিশরা যে নিসর্গ বানাল, তাতে বনের জায়গায় এল খালি মাঠ, তাতে এদিকে ওদিকে কিছু গাছ। এর ভিতরে 'অন্য' প্রকৃতির 'টুকরো'ও যদি সহসা খুঁজে পাওয়া যায়, মন ভালো হয়ে ওঠে। ...আমাদের নিসর্গটা ব্রিটিশদের হাতে তৈরি, এমন করে তৈরি, যা দেখে তাঁদের 'ঘরের' কথা মনে পড়ত, তোমার পাঠানো ডরসেটের ছবিগুলোয় যে নিসর্গ যে ঘর ধরা পড়েছে। ...বানানোর পুরো ব্যাপারটাই দীর্ঘ, বহুস্তর, জটিল; বারবার তৈরি আর ধ্বংস হতে হতেও প্রকৃতি আমাদের চমকে দিতে পারে।”
আরও পড়ুন
চিন, জাপান, হল্যান্ড, ব্রিটেন: চায়ের বহু গল্প (দুই)
এই চিঠিচালাচালির দিন কয়েক পর, পুরোনো দলকাঝাড়, অর্থাৎ কিনা অধুনা বাগডোগরার অত্যাচারিত ফাঁকা ফাঁকা খালি খালি শালবনের মধ্য দিয়ে পানিঘাটার দিকে যাচ্ছি। সবে বৃষ্টি হয়ে গেছে, আকাশ নীল, শালের পাতায় তরুণ সবুজের বান, ঝোরাগুলো টলটলে জলে ভর্তি। কদমা মোড় হয়ে পানিঘাটার পথে যেতেই বাঁদিকে চোখ পড়ল। কার্সিয়াং আর নেপালের দিগন্তবিস্তৃত হিমালয় পাহাড়ের মাথায় থোকা থোকা সাদাকালো মেঘ, সেই মেঘ ফেটে শেষ বিকেলের রোদের আবছা তীর এসে পড়েছে নিচের মাঠে। সে মাঠ সবুজে সবুজ, চা গাছে ভর্তি, মাঝে মাঝে শিরিষ গাছ। দাঁড়িয়ে এই ছবি দেখলাম। তুললামও। তার একটা বন্ধুকে পাঠিয়ে লিখলাম, এই দেখো ঔপনিবেশিকদের বানানো, ঠিক ছবির মতো নিসর্গ। বন্ধু উত্তরে লিখলেন:
আরও পড়ুন
চিন, জাপান, হল্যান্ড, ব্রিটেন : চায়ের বহু গল্প (এক)
“খাসা! এই ধরনের ছবিগুলোয় কিভাবে শুধু মানুষজন নয়, অজস্র পুরোনো নতুন শ্রম সম্পর্কগুলোও অনুপস্থিত থাকে, ভাবলে অবাক হতে হয়। অথবা হয়তো সবটাই আমাদের চোখের অভ্যাস, দেখার গন্ডগোল। দক্ষিণ থাইল্যান্ডের জেলেদের কথা ধরো--চুনাপাথরের দ্বীপ এবং সাদা বেলাভূমির যে ছবিগুলো হামেশা দেখতে পাওয়া যায়, তারা সেখানে 'ছবির মতো' কিছুই খুঁজে পাবে না।”
উত্তরে লিখলাম, ঠিক। ছবিতে লোকজন থাকলেও তাঁরা 'ছবির' অংশ হয়ে যেতেন, অন্তত আমাদের মতো ছবিদারদের কাছে। সায়েবদের কাছে সায়েবি নিসর্গে অসায়েবি মানুষ বলতেই অতিপ্রয়োজনীয় 'সস্তা শ্রম', চিপ লেবর।
অর্থাৎ, শুধু শ্রম হলে চলবে না, সে শ্রম সস্তাও হতে হবে। চিন থেকে উন্নত জাতের কালো চা এবং সবুজ চায়ের চারাবীজ, তৎসহ আরো অসংখ্য ভিন্ন গোত্রজাতের গাছ সংগ্রহ করে ফরচুন দেশে থুড়ি ভারতবর্ষে পাঠালেন। চায়ের চারাবীজ কলকাতার বাগান হয়ে সাহারানপুরের বাগান, সেখান থেকে কুমাউ পৌঁছল। বীজ গেলো আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াতেও, তাঁর চিন্তা জাগল, কোম্পানির চা কালক্রমে চৈনিক চা-কে ছাপিয়ে বিশ্ববাজারে এক নম্বর হতে পারবে কিনা। ফরচুন ভেবে দেখলেন, বাণিজ্যিক প্রয়োজনে চা-চাষ করতে গেলে ঠিকঠাক গাছ, বীজ, জলহাওয়া, মাটি এসব তো লাগবেই। তবে আসল হলো শ্রম, সস্তা শ্রমের যোগান। অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় চা চাষ প্রসঙ্গে ফরচুনের মন্তব্য:
“এসব চেষ্টা ব্যর্থ, বিফল হতে বাধ্য। জলহাওয়া আর মাটি যথাযথ হলেই চা-গাছ জন্মাবে। ব্যাপারটা যদি শুধু গাছ লাগানোর হত... আপত্তির কিছু থাকত না। কিন্তু বাণিজ্যিক সম্ভাবনার বিষয় হিসেবে যদি চা-কে দেখা যায়, তাহলে শুধু জলহাওয়া বা মাটি নয়, শ্রমের দামটাও খেয়াল রাখতে হবে। চিনে শ্রম সস্তা। চা-অঞ্চলের মজুররা দিনে দু-তিন পেন্সের বেশি পায় না। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে, বা অস্ট্রেলিয়ায় এত কম দামে মজুর পাওয়া যাবে কি? যদি এই দামে, বা তার কাছাকাছি দামে মজুর ভাড়া না পাওয়া যায়, কী করে ওইসব জায়গার চা চিনের চা-য়ের সঙ্গে বাজারে টক্কর দেবে?”
Powered by Froala Editor