চিন, জাপান, হল্যান্ড, ব্রিটেন: চায়ের বহু গল্প (চার)

সময়ভ্রমণ - ৪৫
আগের পর্বে

ভারতে চা চাষের অন্যতম স্থপতি ছিলেন শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রথম অধ্যক্ষ রবার্ট কিড। তিনি নাকি দিল্লির আশেপাশে কিছু জায়গায় ও আসামে চা চাষের চেষ্টা করেছিলেন অষ্টাদশ শতকের শেষভাগেই। কিন্তু সেইসব গাছ বাঁচেনি। মেয়ার ও হো-এর মতে চায়ের চাষ নাকি শুরু হয়েছিল বার্মা অঞ্চলে। সেখানে থেকে তা ছড়িয়ে পড়ে চিন ও ভারতে। যদিও ভারতে চা চাষের সেই ইতিহাস কীভাবে হারিয়ে গেল, তা বোঝা শক্ত। চিনের মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে কিন্তু জড়িয়ে পড়েছিল চা। চাষিদের গোটা পরিবার মিলে বাগানের পরিচর্যা করত। এমনকি বাগান সামলাতেন ধর্মযাজকরাও। রাজার কাছেও চা ছিল অতি মূল্যবান। চা-এর বিনিময়ে তিব্বতী যাযাবরদের থেকে ঘোড়া কিনতেন তাং রাজারা।

মেয়ার এবং হো-র বইতে চিন ছাড়া অন্য বহু দেশ, জায়গা, সমাজের কথা বলা আছে। মধ্য এশিয়া হয়ে চিন থেকে লম্বা পাড়ি দিয়ে চায়ের ক্যারাভান এসে পৌঁছোত রাশিয়ায়। মধ্য এশিয়া হয়েই চা পৌঁছোয় মধ্যপ্রাচ্যের মরু অঞ্চল এবং উত্তর আফ্রিকায় : ইরানে, মরোক্কোয়, বিভিন্ন আরব রাজ্যে। চিন থেকেই চা প্রথম জাপানে গিয়েছিল বটে, তবে সে দেশের নিজস্ব চা-সংস্কৃতি(ও চা বাগান) তৈরি হয়ে ওঠে দ্রুত। চা খাবার অভ্যাসের সঙ্গে জেন বৌদ্ধমত যুক্ত হয়ে কিভাবে জাপানে নতুন সামাজিক অভ্যাস তৈরি হচ্ছে, মেয়ার এবং হো তা'ও বিস্তারিতভাবে বলেছেন। হায়, ইতিহাস, দর্শন এবং পুরাকথার আশ্চর্য মিশেলে ভরপুর সে সব কাহিনির কিছুটাও এখানে বলা যাবে না।  জাপানি চা-অভ্যাস নিয়ে দু একটা টুকরো--অথবা আঙুল পরিমাণ--গুঁড়ো-- গল্প অবশ্য করা যায়। 

জাপানি চা-অভ্যাসকে ঘিরে যে সংস্কৃতির উদ্ভাস ও বিকাশ ঘটে, তাকে বলা হয় 'চানয়ু'। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ, মুখ্যত ষোড়শ শতক জুড়ে একাধিক জেন বৌদ্ধ সাধক এই সংস্কৃতির শরীর তৈরি করেন। চা পান ঘিরে জাপানি শাসক, সামুরাই যোদ্ধা, অভিজাতবর্গীয় ও ধনীদের যে উশৃঙ্খল প্রমত্ততা ও বৈভব প্রদর্শনী, তার একেবারে উল্টোপথে গিয়ে চানয়ু ফিরতে চাইল চায়ের প্রাকৃতিক উৎসে, সরলতায়, বৈভবহীনতায়, হয়তো বা রিক্ততায়ও। যতদূর জানা যায়, পঞ্চদশ শতাব্দীর বিদ্রোহী জেন সাধক ইক্কয়ু সোজুন, তাঁর শিষ্য মুরাতা সুকো চায়ের এই নতুন, গরিব অভ্যাস প্রচার করেন। সুকোর শিষ্যদের অন্যতম, জুসিয়া সোগো, এবং বিশেষ করে তাঁর শিষ্য তাকেনো জু-র মাধ্যমে চানয়ু-র বিশেষ দুই নন্দনধারণা মূর্ত হয়ে ওঠে। প্রথম ধারণা 'ওয়াবি', যা শুরুতে বোঝাত ব্যর্থ প্রেমিকের হতাশা ও নিঃসঙ্গতা, গৃহ থেকে বহু দূরে নির্বাসিত রাজকর্মচারীর হাহাকার। চানয়ুর যে ওয়াবি, তা মূলত অনতিক্রম্য অপূর্ণতার, হল না, হল না, হয়ে উঠল না। বলা হয়, জাপানি মানুষদের আত্মার গভীরে এই অপূর্ণতার বোধ দিনরাত জেগে থাকে। জু-র বিশেষ পছন্দের একটি কবিতা:

চোখ যতদূর যায়,
না দেখা যায় চেরিফুল
না মেপলের রঙিন পাতা;
সাগরের পাড়ে শুধু খড়ে ছাওয়া কুঁড়েঘর,
হেমন্তবিকেল, গোধূলি, সন্ধ্যা

সমুদ্রের পাড়ে রঙহীন খড়ে ছাওয়া কুঁড়ে সেই রিক্ত, দরিদ্র, বিশেষ পরিসর, যেখানে চানয়ু ঘটবে। ওয়াবির অন্তঃস্থলে সতত জেগে থাকা এই বিবর্ণ শূন্যতাকে যে আত্মস্থ করে একমাত্র সে-ই জু-র দ্বিতীয় ধারণা, 'ইসিগো ইসি'র মর্ম বুঝতে পারে। ইসিগো ইসির মানে, 'একবারই, একবারই দেখা করা'। জু মনে করতেন চানয়ুর অ-পূর্ব, অদ্বিতীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে গড়ে উঠছে এক আশ্চর্য সংযোগ ও বন্ধন, যেমনটি এ জীবনে আর একবার ঘটবে না। প্রত্যেক চানয়ু যে অনুভুতিমালার জন্ম দেয়, যা গড়ে তোলে, তা বিশেষ, পৃথক, অনবদ্য, অনুষ্ঠান শেষ হবামাত্র চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে, কোনদিন ফিরে আসবে না। জু ভাবতেন, এইভাবে, প্রত্যেক চানয়ুর মধ্য দিয়ে শিল্প ও জীবন একবিন্দুতে এসে দাঁড়াচ্ছে, অথবা জীবন স্বয়ং শিল্পকর্ম হয়ে উঠছে, কবিতার, ছবির, গানের মতো। 

আরও পড়ুন
চিন, জাপান, হল্যান্ড, ব্রিটেন: চায়ের বহু গল্প(তিন)

জীবন আর শিল্প এক জায়গায় এসে দাঁড়ালে, এক হয়ে গেলে কী হয় আর কী হতে পারে, বলা খুব মুশকিল। ষোড়শ শতকের সেন রিকুয়ু, যাঁর মাধ্যমে চানয়ু একটি গোটা জাতির সংস্কৃতি হয়ে ওঠে, তাঁর জীবন দেখলেই তা বোঝা যায়। জু-র কাছে রিকুয়ু ওয়াবি শিখেছিলেন নাড়া বেঁধে। রিকুয়ু ও জু-কে নিয়ে একটা গল্প আছে: একদিন জু রিকুয়ুকে বললেন 'রোজি'(চানয়ু যেখানে ঘটবে সেই কুঁড়ের লাগোয়া বাগান) ঝাট দিতে। গুরুর আদেশ পালন করতে গিয়ে রিকুয়ু দেখেন, বাগান পরিষ্কার তকতকে, জু আগেই ঝাট দিয়ে রেখেছেন। গুরু কি চাইছেন অন্তরের প্রজ্ঞায় তা বুঝে নিয়ে রিকুয়ু বাগানের একটা গাছ ধরে নাড়ালেন, কিছু পাতা মাটিতে এসে পড়লো। শোনা যায়, জু যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন। 

আরও পড়ুন
চিন, জাপান, হল্যান্ড, ব্রিটেন: চায়ের বহু গল্প (দুই)

ষোলো শতকের দ্বিতীয় পাদে রিকুয়ু প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে গভীর যত্নে চানয়ুর শরীর তৈরি করেন। কে কে অনুষ্ঠানে আসবেন, কীভাবে ঘরে ঢুকবেন, বসবেন, বেরোবেন, ঘরে কী আসবাব ও সরঞ্জাম কোথায় থাকবে, কী কথাবার্তা হবে, কী পাত্রে চা তৈরি ও খাওয়া হবে, কী জাতের চা ব্যবহৃত হবে, এই যাবতীয় বিষয়ে রিকুয়ু যে বিস্তারিত বিধান দেন, তা অদ্যাবধি জাপানি সমাজে মান্য। রিকুয়ুর চানয়ুতে যে চা খাওয়া হতো তা আসত উজি অঞ্চল থেকে। উজির চা সে সময় জাপানের ক্ষমতাবান ও অভিজাতদের পছন্দের পানীয়, ষোড়শ শতাব্দীতে জেসুইট পাদ্রী হোয়াও রডরিগেজ তার 'জাপানদ্বীপ' লেখায় বলছেন, ফি বছর উজি থেকে প্রায় ৪০ হাজার পাউন্ড চা জাপানের সর্বত্র যেত। 

আরও পড়ুন
চিন, জাপান, হল্যান্ড, ব্রিটেন : চায়ের বহু গল্প (এক)

রিকুয়ুর খ্যাতি ছড়াতে থাকে, তৎকালীন জাপানি সমাজের মাথা যে সব যুদ্ধবাজ, তাঁরা তাঁকে ডাকাডাকি করতে থাকেন। মাৎসুনাগা হিসাহিদে-র চা-পরবে রিকুয়ু যান, হিসাহিদেকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন যে ওদা নবুনাগা, তাঁর সঙ্গেও চানয়ু করেন তিনি। নবুনাগা যখন যুদ্ধে যেতেন, রিকুয়ু তাঁর শিবিরে উপস্থিত থাকতেন নিয়মিত। নবুনাগার মৃত্যু হয় যে তয়োতমি হিদেওসি-র হাতে, তাঁর চা-কর্তা হিসাবে রিকুয়ু নিয়োজিত হন। এই সময়েই চানয়ু বিষয়ে তাঁর ভাবনাকে একত্র করে সংহত তত্বে পরিণত করা হয়। জাপানি শাসকেরা রাজনৈতিক এবং সামরিক কারনে চা-অনুষ্ঠানকে ব্যবহার করতেন, আড়ম্বর, বৈভব-প্রদর্শনী ও উপস্থিত ব্যক্তিদের সামাজিক মর্যাদার নিরিখে অনুষ্ঠানের সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ধারিত হত। রিকুয়ুর মতো চা-বেত্তা যে যুদ্ধবাজ শাসকের অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন বা সে বিষয়ে উপদেশ দিতেন, তিনি প্রতিপক্ষের থেকে এগিয়ে থাকতেন সহস্র যোজন। হিদেওসি ও অন্যান্য যুদ্ধবাজদের চা ভিন্ন অন্য বিষয়েও পরামর্শ দিতেন রিকুয়ু। চা-অনুষ্ঠানের বিপুল সমারোহের বাইরে আলাদা কক্ষে, পরিসরে, তাঁর নিজস্ব নিভৃত চানয়ু সমাবেশ চলত নিজের ছন্দে। 

আরও পড়ুন
দার্জিলিং এবং চিন: চায়ের রকমফের (চার)

হোজো বলে এক যুদ্ধবাজের দুর্গ অবরোধ করে হিদেওসি বসে আছেন, সঙ্গে রিকুয়ুও। কথিত আছে, হিদেওসি মজা করার জন্য হোজোর দুর্গে তিন বস্তা চাল পাঠিয়েছিলেন, যার জবাবে তিনটি বাঁশের টুকরো হোজো ফেরত পাঠান। এই বাঁশ দিয়ে নিজস্ব চানয়ুর জন্য যেসব ফুলদানি তিনি বানিয়েছিলেন, তাদের একটাকে দেখতে বাঁশির মতো, অন্য আর একটা দোতলা। প্রথমটা এক খণ্ড বাঁশে তৈরি। বাঁশির মতো দেখতে পাত্রটা বংশানুক্রমে হাত বদল হয়ে হয়ে ১৯১৮-য় ৮৬০০ ব্রিটিশ পাউন্ডে(আজকের টাকায় তিন লক্ষ পাউন্ড মতো) নিলাম হয়। 

১৫৯১-র ফেব্রুয়ারি মাসে হিদেওসির নির্দেশমাফিক রিকুয়ুকে ক্রুশে বিঁধিয়ে মারার তোড়জোড় শুরু হয়। কেন তার সঠিক কারণ জানা নেই। ২৫শে ফেব্রুয়ারি, রিকুয়ুর কিয়োতো শহরের বাড়ি ঘিরে তিন হাজার সৈন্য, বাইরে তুমুল শিলাবৃষ্টি, ঝড়। হিদেওসির আদেশ, ক্রুশে না মরে রিকুয়ু নিজের পেট থেকে নাড়িভুঁড়ি বের করে আত্মহত্যার, বা সেপ্পুকু করার সুযোগ পাবেন, । ফুলদানিতে ফুল সাজিয়ে, শিষ্যদের জন্য শেষ চানয়ু করে, রিকুয়ু দুটি কবিতা লিখেছিলেন, তার একটি চিনা ভাষায়। জাপানি কবিতাতে বলা ছিল, এই কোষবদ্ধ তরবারি, যা আমার শরীরের অংশ ছিল এতকাল, বার করে আমি ছুঁড়ে দিচ্ছি স্বর্গের মুখে। 

চা, যা কিনা বস্তুত ঈশ্বরপ্রেরিত, প্রাকৃতিক ও দেবভোগ্য, তা বিভিন্ন দেশের লোভী ও ক্ষমতালিপ্সু শাসকদের পাল্লায় পড়ে হয়ে উঠছে ক্ষমতার বাহক, সামাজিক বৈষম্য ও অত্যাচারের প্রতীক। চা, যার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তাও ধর্মের মৌলিক সরলতা, জেন ধর্মানুচরণের নিস্পৃহা, ওয়াবির রংহীনতা ও অস্তিত্বগভীর থেকে উঠে আসা নেতি, তা অনায়াসে জুড়ে যাচ্ছে সাম্রাজ্যবিস্তার, যুদ্ধবিগ্রহ, রক্তপাত এবং শোষণ-বঞ্চনার এক বা বহু দীর্ঘ দীর্ঘ ইতিহাসের সঙ্গে, যা দেশকালের সীমাকে তুচ্ছ করে সর্বদেশে, হয়তো বা সর্বকালে প্রসারিত। 

লিউ য়ু দেখছেন পাহাড়ে অরণ্যে পাথর ফাটিয়ে বেরিয়ে আসা নির্ঝরের জলে মানুষের সৃষ্টি মিশে সেরা চা তৈরি হচ্ছে। জাপানের জেন কবি দেখছেন রিক্ত ধূসর সাগরতটে একাকী হেমন্তগোধূলি, গড়ে উঠছে চিরবিষণ্ণ চানয়ু। কোম্পানিভৃত্য ফরচুন চিনের উয়ি পর্বতমালার চা অঞ্চলের নিসর্গে দেখছেন প্রকৃতির আশ্চর্য অলৌকিক। অনেক অনেক পরে আমাদের খুব চেনা কার্সিয়াং-এর চা বাগানে অবনীন্দ্রনাথ দেখছেন রঙের পরে এসে পড়ছে রং আরো রং। দেড়হাজার, দুহাজার, তিনহাজার বছর ধরে নিসর্গ, নিসর্গের দর্শন, আমাদের ভালো লাগা না লাগা, সুন্দর অসুন্দর, নন্দন অ-নন্দন তৈরি হচ্ছে। যা সবসময় বুঝে ওঠা যায় না, অথচ, না বুঝলেও এই তামাম নিসর্গসৌন্দর্য ও ভালো লাগার(অথবা না লাগার) কেন্দ্রে যা সবসময়, কোনো-না-কোনোভাবে হাজির থাকে, তা মানুষ, মানুষের শ্রম।

যে গল্পই আমরা বলি, বলতে চাই, শুনি, পড়ি বা যে ছবিই আমরা দেখি, ভালো লাগাই, শ্রম না থাকলে তার কিছুই হয়ে ওঠে না। চায়ের গল্প হচ্ছে, নিসর্গেরও, চা-কে কেন্দ্র করে বহুকাল ধরে গড়ে ওঠা বিচিত্র, একাধারে বর্ণময় ও ফ্যাকাশে, বৈভবশালী ও দরিদ্র বহু ধারণারও। সেসব গল্প শ্রমেরও গল্প। আমাদের দেখাশোনাপড়ার সমস্তটা শ্রম দিয়েই নির্ধারিত হয়, অথচ সে শ্রম আমরা না দেখি না বুঝি; শ্রম বলতেই কালিঝুল মাখা মেশিন, জিভ বার করা চিরগরিব অন্ত্যজ মানবকুলের, কিম্বা গরুগাধামহিষঅশ্ব ইত্যাদি পশুকুলের যেসব ছবি চোখের সামনে ভিড় করে, তার সঙ্গে সবুজে ছাওয়া বনে ঢাকা পাহাড়শ্রেণী, তার শরীরের খাঁজে বিচূর্ণ কুণ্ডলিত মেঘমালা, তার উপত্যকায় রৌদ্রসিঞ্চিত স্রোতস্বিনী, ঢেউ খেলানো মাঠ জুড়ে চায়ের তরঙ্গ, এই সব চমৎকার, ভালো, অপরূপ, সুন্দর, মনোরম ছবির কি সম্পর্ক? একটার কথায় অন্যটা এসে পড়বেই কেন, কান টানলে যেমন মাথা?

Powered by Froala Editor