সময়ভ্রমণ - ৪৪
আগের পর্বে
ব্রিটেনে চায়ের জনপ্রিয়তা বাড়ার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল ওভিংটনের লেখা ছোট বই। তাতে চিন ও জাপানের সভ্যতায় চায়ের ঐতিহ্যের বর্ণনার পাশাপাশি ছিল চা পানের গুণাগুণ এবং চায়ের শ্রেণীবিভাগ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা। অথচ ওভিংটন নিজে কখনও চিনে বা জাপানে যাননি। সুরাতের বানিয়াদের কাছেই তিনি সবটা শুনেছিলেন। এরপর অভিজাতদের পাশাপাশি নিম্নবিত্ত মানুষদের মধ্যেও চায়ের কদর বাড়তে থাকে। শুরু হয় চোরাকারবারি। আবার অভিজ্ঞতার অভাবে চিনের ব্যবসায়ীদের কাছেও ঠকে যেতেন ব্রিটিশরা। উনিশ শতকজুড়ে গড়ে উঠেছে চায়ের সাম্রাজ্য। এমনকি শ্রমজীবি মানুষদের মধ্যেও দৈনিক পানীয় হয়ে ওঠে চা। আর এই বাজারকে অনেকটাই প্রশস্ত করেছিল ভারতের চা চাষ।
ভিক্টর এচ. মেয়ার ও এরলিং হো-র লেখা ট্রু হিস্ট্রি অব টি বইয়ের কথা হচ্ছিল। প্রাচীন চিনের ইতিহাস, লোককাহিনি ও ধর্মচিন্তা ইত্যাদি নিয়ে অনেকদিন ধরে কাজ করছেন মেয়ার, চা বিষয়ে তাঁর আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। যে বইয়ের কথা হচ্ছে, তার শেষাংশে মেয়ার বলছেন, দার্জিলিং-এর রম্য পরিবেশে তাঁর দীর্ঘ সময় কেটেছে, দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে তিনি বারবার ফিরে গেছেন পূর্ব হিমালয়ের সুউচ্চ পাদশৈল-শহরে, ভেজা কুয়াশার গভীরে যেখানে শ্রেষ্ঠ সুগন্ধ চা জন্মায়।
মেয়ার ও হো-র বইতে অবশ্য দার্জিলিং চা নিয়ে বিশেষ কিছু বলা নেই। লেখকদের বক্তব্য, চা আদতে হিমালয়ের ভূমিসন্তান, উত্তর-পূর্ব ভারত, বার্মা ওরফে মায়ানমার, এবং চিনের ইউনান-লাগোয়া সিচুয়ান অঞ্চল মিলিয়ে পূর্ব হিমালয়ের যে বন্য পাদশৈল এলাকা, চা সেখান থেকে চিনে ও ভারতে ছড়িয়েছে, এবং বিশ্বের অন্যত্র। এলিস ও সহ-লেখকদের যে বইয়ের গল্প ইতিমধ্যে বলা হয়েছে, সেখানেও ভারতীয় চা বলতে আসামি চা-কেই বোঝানো হয়েছে। দুই বইয়ের কোনোটাতেই দার্জিলিং চায়ের শুরুর গল্পটা বলা হয়নি, হয়তো অন্য বহু জায়গার অসংখ্য গল্প বলতে গিয়ে সে বিষয়ে মন দেওয়া যায়নি।
ভারতববর্ষের সায়েবি চা-করদের সংগঠনের অন্যতম ইন্ডিয়ান টি য়্যাসোশিয়েসন বা আইটিএ, তাদের ওয়েবসাইটেও দেখা গেল, ঠারেঠোরে বলা হচ্ছে, ভারতীয় চা বলতেই অহমিয়া চা, ভূমিসন্তান। চিনে চা নাকি ১৭৮০ সাল থেকে কোম্পানিভারতে লাগানোর চেষ্টা চলছে। সেই সময়ই কর্নেল রবার্ট কিড দিল্লি শহরের বাইরের দিকে চা গাছ লাগাচ্ছেন। আসামেও লাগানো হয়েছিল, কিন্তু সব মরে যায়।
কথাটা পুরো উড়িয়ে দেবার মতো নয়। আঠেরো শতকের শেষ কোম্পানিকর্তা ও আমব্রিটিশদের কাছে চা রীতিমতো, হয়তো বা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাবস্তু, চা নিয়ে সবাই মাথা ঘামাচ্ছেন। ওয়ারেন হেস্টিংস চিনে চায়ের বীজ জর্জ বোগলকে পাঠাচ্ছেন আঠেরো শতকের শেষের দিকে। এই তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায়, ১৭৮০-র প্রথম দিকে হেস্টিংসের বোগলকে লেখা চিঠিতে। দ্বিতীয়বার ভুটান হয়ে তিব্বত যাবার জন্য বোগল তৈরি হচ্ছেন, রংপুরের কাজ মিটিয়ে রওনা দেবেন। হেস্টিংস চিঠির সঙ্গে নানারকমের বীজ পাঠাচ্ছেন, একবার পাঠালেন চিনা হাইসন চায়ের বীজও, 'আমাদের বিশ্বের বিলাসবৈভব তুমি ভুটানে পৌঁছে দেবে, এই আশায়।' কোম্পানির তরুণ অফিসার ও হেস্টিংসের বিশেষ প্রিয়পাত্র জর্জ বোগলের যাবতীয় লেখাপত্র ও দলিলদস্তাবেজ সমেত আদি-ঔপনিবেশিক পর্বের পূর্ব হিমালয়ের ইতিহাস সংঙ্কলিত করেছিলেন স্যর ক্লিমেন্টস মারখ্যাম। পাহাড়লাগোয়া যে অঞ্চলকে এখন আমরা উত্তরবঙ্গ বলে জানি, তা নিয়ে প্রথম সায়েবি বয়ান পাওয়া যাচ্ছে বোগলের লেখা থেকে। সে গল্প পরে কখনো করা যাবে।
আরও পড়ুন
চিন, জাপান, হল্যান্ড, ব্রিটেন: চায়ের বহু গল্প (দুই)
রবার্ট কিড দিল্লির আশেপাশে কোথায় চা গাছ লাগিয়েছিলেন, জানা গেল না। তবে কিড সেসময়ে কোম্পানির প্রধান উদ্যানকার, শিবপুরের বাগানের, অর্থাৎ বটানিক্সের স্থপতি ও প্রথম অধ্যক্ষ। ভারতবর্ষে চা চাষের অমিত সম্ভাবনা নিয়ে কিড ভাবনাচিন্তা করতেন, ফলে শিবপুরের বাগানে তিনি যে চা লাগানোর চেষ্টা করেছেন, ধরে নেওয়াই যায়( নিশ্চিত হওয়া যায় না)। কলকাতা বটানিক্সের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত(১৮৮৮, বিশে সেপ্টেম্বর) একটি লেখায় বটানিক্সের তৎকালীন অধ্যক্ষ ড: জর্জ কিং-এর লেখা এক রিপোর্ট উদ্ধৃত করে উল্লেখ করা হচ্ছে, কিড না থাকলে ভারতে চায়ের চাষ শুরু হত কিনা সন্দেহ।
আরও পড়ুন
চিন, জাপান, হল্যান্ড, ব্রিটেন : চায়ের বহু গল্প (এক)
চা নিয়ে গবেষণা ও প্রশিক্ষণের জন্য 'চা গবেষণা সংস্থা' নামের একটি সরকারি সংস্থা আছে। তাঁদের সাইটে বলা আছে আসামে চিনা ও অহমিয়া দু ধরণের গাছেরই চাষ শুরু করা হয়েছিল। চিনা গাছের(ক্যান্টন থেকে আনা) চারাবীজই সরকারি উদ্যোগে কাংড়া, কুমাউ ও নীলগিরির বিভিন্ন জায়গায় লাগানো হয়। পরে অহমিয়া চা আরো বেশি করে সর্বত্র লাগানো হতে থাকে। এখানেও, দার্জিলিং প্রসঙ্গে কিছু বলা নেই।
আরও পড়ুন
দার্জিলিং এবং চিন: চায়ের রকমফের (দুই)
আসামে চিনা চা যে লাগানো হচ্ছিল, জয়িতা শর্মার গবেষণাকাজ থেকে সে বিষয়ে প্রভূত তথ্য পাওয়া যায়। সমসাময়িক সরকারি ও অন্যান্য সূত্র উল্লেখ করে শর্মা দেখাচ্ছেন, ১৮৪০ থেকে ১৮৬০ পর্যন্ত আসামের সায়েবি বাগানে চিনে কুলি দিয়ে কাজ করানোর চল ছিল। কুলি যোগাড় হতো ক্যান্টন থেকে, সিঙ্গাপুর ও পেনাং থেকেও। সায়েবদের তখনো অবধি স্থির ধারণা অন্য জাতের কুলিরা চা ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারবে না। মানে এই নয় যে সায়েব চা-কররা চিনে কুলিদের সম্মান করতেন। সায়েবদের ধারণা ছিল, বেশিরভাগ চিনে বেয়াদপ ও অবাধ্য, হঠাৎ হঠাৎ তারা কাজ ছেড়ে দিতে চায়। নিজেদের দেশ থেকে বহুদূরে এসে, উপর আসামের জঙ্গুলে চা বাগানে কুলি হয়ে কাজ করাটা চিনেদের কেমন লাগছে, সে প্রশ্ন সায়েবরা করেননি। তাঁরা চিনেদের স্থানীয় বিকল্প খুঁজছিলেন। আসাম সংলগ্ন উত্তর পূর্ব ভারতের যে সব এলাকায় বুনো চা গাছ জন্মায় সেখানকার মানুষদের বুঝিয়েবাঝিয়ে কুলি বানানোর চেষ্টা কার্যকরী না হওয়ায় সায়েবরা মধ্য ভারত থেকে কুলি চালান শুরু করলেন। সে বর্বরতা ও অত্যাচারের গল্প বহুশ্রুত, বহুকথিত, এখানে না বললেও চলবে।
আরও পড়ুন
দার্জিলিং এবং চিন: চায়ের রকমফের (এক)
চিন দেশের চা, এবং উপনিবেশে তৈরি হওয়া সায়েবদের চা, এই দুইয়ের ফারাকটা বস্তুগত ও ধারণাগত, মনে হতে পারে। চিনে চা নিতান্তই দেশজ, সে দেশের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে তার নাড়ির যোগ ও গূঢ় সম্পর্ক, যে সম্পর্কের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। চিন নিয়ে ফরচুনের লেখায় দেখা যাচ্ছে, সাধারণ চাষিরা চা-চাষ করছেন, সে চাষে যুক্ত থাকছেন সমগ্র পরিবার। অথবা, চা-বাগান দেখভাল করছেন ধর্মযাজকেরা, পুরোহিতরা। ঔপনিবেশিক সায়েবদের চা সে তুলনায় জবরদস্তিতে আধারিত; হয় যুদ্ধ বিগ্রহ করে অসম বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে চিন থেকে চা আমদানি করা হচ্ছে, নয় উপনিবেশগুলোয় চাষজমি বা জঙ্গল দখল করে, বাইরে থেকে ভুলিয়েভালিয়ে বা জোরজুলুম করে কুলি এনে তাদের দিয়ে চাষ করানো হচ্ছে। চাষের সঙ্গে যে মানুষেরা যুক্ত হচ্ছেন তাঁরা নিতান্তই কম মাইনের বা পেটচুক্তির মজদুর, ফলে ভূমি-সম্পর্কে এবং শ্রম-সম্পর্কে এই জায়গাটায় একটা দূরপনেয় ফারাক ঘটে যাচ্ছে।
আসামে সরকারি উদ্যোগে যে চাষ শুরু হয়েছিল, তাতে স্থানীয় চাষিদের যুক্ত করার চেষ্টা হয়েছিল কিনা জানা নেই। দার্জিলিং-এ এবং পশ্চিম হিমালয়ে 'নেটিভ' চাষিদের চা চাষ শেখানোর চেষ্টা হয়েছিল। দ্বিতীয়বার চিনভ্রমণ সেরে ফরচুন যখন ভারতে আসছেন, তাঁর নিশ্চিত ধারণা ছিল, চিনের মডেল এখানেও কাজ করবে, অর্থাৎ দিশি চাষিরা তাঁদের জমিতে স্বেচ্ছায় চা-চাষ শুরু করবেন। সরকারের কাজ এখান উভয়ত সহায়ক ও তত্ত্বাবধায়কের। নতুন বীজ, চারা, প্রযুক্তি ও চাষ-বিষয়ক তথ্য সরবরাহ করবে সরকার, ফসল বিক্রিতেও সাহায্য করবে দরকারমতো। এই প্রক্রিয়ায় ভারতীয় চাষিদের লাভ, কোম্পানির লাভ আরো বেশি।
হায়, ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান সতত বড়ো গোলমেলে, যা দেখাশোনা যায় তা সবসময় সত্যি হয় না। ফরচুন এবং তাঁর সমসাময়িক (বা কিছু আগেকার) ঔপনিবেশিক সায়েবরা চিন দেখেছিলেন বাইরে থেকে। ক্ষেতে পারিবারিক চা-চাষ চলছে, দুর্গম পাহাড়ি উপত্যকায় চা তৈরি করছেন বৌদ্ধ মন্দিরের পুরোহিতকুল। চিনে চা-চাষ কী করে শুরু হল, এত চাষি কীভাবেই বা চা লাগাতে শুরু করলেন, তা নিয়ে সায়েবরা মাথা ঘামাননি, ঘামানোর কথাও নয়। মুখ্যত চিনা সূত্রের উপর ভিত্তি করে বলা মেয়ার-কথিত ইতিহাসে চিনে চা-চাষ শুরুর বিষয়ে চমকপ্রদ সব তথ্য পাওয়া গেল।
চিনের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায় থেকে উদাহরণ দিয়ে মেয়ার এবং হো জানাচ্ছেন, চিনে চা-চাষ এলাকা বেড়েছে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, অনুজ্ঞায়, অত্যাচারে। চিনা শাসকেরা বিশেষ প্রজাবৎসল ছিলেন না, দেশের চাষিসমাজের প্রতি তাঁরা করুণাদ্রব ছিলেন, এমনও নয়। চাষিদের চা-চাষে বাধ্য করা হত। দেশে চা কম তৈরি হলে রাজত্ব টিঁকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ত। চা-চাষের সঙ্গে রাজত্ব থাকা না থাকার সম্পর্কটা ঠিক কীরকম?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মেয়ার এবং হো বলছেন ঐতিহাসিক চা-ঘোড়া ব্যবসার কথা। সে সময়ের(চিনের ক্ষেত্রে এই সময়টা কমবেশি খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-অষ্টম শতকের তাং রাজত্ব থেকে অষ্টাদশ-উনবিংশ শতকের কিং রাজত্ব পর্যন্ত) আর দশটা ব্যবসার মতো, চা-ব্যবসাও চলতো বিনিময়ের মাধ্যমে। চিনা রাষ্ট্র চা দিয়ে ঘোড়া নিতো। বিশাল চিন সাম্রাজ্যের সীমায়, বাইরে যে সব যুদ্ধবাজ যাযাবর জনগোষ্ঠীর বাস, তাদের কাছে যে যে জাতের ঘোড়া পাওয়া যেত, তার সমতুল কিছু চিনে ছিলো না। অথচ ভালো ঘোড়া না থাকলে যুদ্ধ জেতা যায় না, বিশেষ করে অশ্বারোহী যাযাবর সৈন্যদের সঙ্গে তো নয়ই।
চা-ঘোড়া ব্যবসা শুরুর আগে, তাং রাজত্বের সময় থেকেই চা নিয়ে দেশের চাষিদের উপর রাষ্ট্রীয় জবরদস্তি শুরু হয়ে যায়। লিউ উ-র পছন্দের চা জন্মাতো তাই হ্রদের পশ্চিম পাড়ের গুঝু পর্বতে। তাং সম্রাট দাই জং ৭৭১ সালে এই পাহাড়ে চিনের প্রথম রাজকীয় চা বাগানের পত্তন করেন। ৭৮৫ সালের মধ্যেই সে বাগানে প্রায় ২৫০০০ পাউন্ড চা তৈরি হচ্ছে, চা তোলার কাজে বাধ্যতামূলক শ্রম দিতে হচ্ছে ৩০ হাজার শ্রমিককে। ইসিং অঞ্চলের চাষিদের দুরবস্থার কথা ধরা আছে য়ুয়ান গাও-এর 'চা পাহাড়' কবিতায়:
‘চাষিরা পালিয়েছে তাদের লাঙল-কাস্তে ছেড়ে/সবাই গিয়েছে চা-তোলার তেতো কাজের জেরে/...যে মানুষ একবার বেগার খাটতে যায়/তার ঘরগেরস্তি ছত্রভঙ্গ, হায়…’
৭৮২ সাল নাগাদ, চা ব্যবসা এতটাই লাভজনক যে চায়ের উপর ১০ শতাংশ কর চাপছে। বারম্বার প্রজাবিদ্রোহ সত্ত্বেও দশম শতাব্দীর শুরু অবধি চায়ে কর চাপানো চলেছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, সং বংশের রাজত্বের শেষপর্বে দেশের মোট জেলার এক তৃতীয়াংশ জুড়ে চা-চাষ শুরু হয়ে গেছে। চা-চাষি ও চা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে রাষ্ট্ৰ রীতিমতো তোলা তুলত। বার্ষিক কর চাষিদের দিতে তো হতই, উপরন্তু, সরকারের কাছে জলের দরে চা বেচতেও হত। সেই চা ব্যবসায়ীদের বেচা হত তিনগুণ বেশি দামে। পরিমাণমতো চা জোগাতে না পারলে চাষিদের উপর চলত নির্মম অত্যাচার। চা-চাষের চাপে সাধারণ চাষিদের অর্থনৈতিক অবস্থা এতই খারাপ হয়ে পড়ে যে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে ওঠে, দেনা বাড়তেই থাকে। কর্জ মেটাতে গিয়ে লোকে বাড়িঘর বেচে দিতেও বাধ্য হয়।
দ্বাদশ শতাব্দীতে যাযাবর জুরছেনরা চিন আক্রমণ করে। অশ্বারোহী সৈন্যদের মুহুর্মুহু হামলা আটকানোর কোন উপায় সং রাজাদের জানা ছিল না, তাঁরা রাজধানী ছেড়ে পালালেন। পরে, প্রচুর ভেট দিয়ে জুরছেনদের সঙ্গে সন্ধি করতে হল। জুরছেন প্রধানকে দেওয়া ভেটের মধ্যে ফুজিয়ানের শ্রেষ্ঠ জাতের চা-ও ছিল।
জুরছেনরা চায়ে দ্রুত আসক্ত হয়ে পড়ে। তেরো শতকের গোড়ায় মোঙ্গলরা চিন আক্রমণ করে। জুরছেন ও সং, দুই রাজত্বই আক্রান্ত, অথচ চা খাবার অভ্যাস রাজাপ্রজা কেউই ছাড়তে পারে না, রাজবংশীয় অভিজাত ভিন্ন অন্য কেউ চা খেলেই কঠিন শাস্তি পাবে এই বিধানেও চা খাওয়া বন্ধ হয় না।
বাধ্যতামূলক চা-চাষ চলছে রাষ্ট্রের খাস তদারকিতে, আমমানুষের জীবনে গেঁড়ে বসেছে চায়ের অভ্যাস। সেটা শুধু চিনেদের মধ্যে নয়, সীমান্তবর্তী প্রতিবেশীদের মধ্যেও; তিব্বতি, উইঘুর, খিতান, মোঙ্গল, জুরছেন প্রভৃতি যাবতীয় যাযাবর ও আধা-যাযাবর জনগোষ্ঠীর মধ্যে চা-আসক্তি জন্মায়। দশম শতাব্দীর শুরুর দিককার একটি দলিলে বলা আছে, উইঘুরেরা ঘোড়া দিয়ে চা নিয়ে যেত। একাদশ শতাব্দীর শুরুতে খিতানরা সং রাজার কাছ থেকে সন্ধিচুক্তির অংশ হিসেবে ভেট নিচ্ছে প্রায় সাতাশ হাজার পাউন্ড চা। খিতানদের হাতে সেসময় ১৮ লক্ষ রণঅশ্ব, সংদের কাছে বড়জোর দু লাখ। উপায়ান্তর না দেখে সং রাজা ঘোড়া কেনার জন্য তিব্বতিদের শরণাপন্ন হলেন। সং সরকার 'চা এবং ঘোড়া দপ্তর' তৈরি করে সিচুয়ান অঞ্চলের চাষি ও ব্যবসায়ীদের উপর চাপ বাড়াতে থাকল, যাতে ঘোড়া কেনার মতো উপযুক্ত পরিমাণ চা পাওয়া যায়। এক একজন কুলি ঠেলাগাড়িতে ৫২০ পাউন্ড করে চা চাপিয়ে দুর্গম পথ দিয়ে কয়েকশো মাইল দূরে নিয়ে যেতো। ১০৮৬ সালের এক সরকারি দস্তাবেজ উদ্ধৃত করে মেয়ার বলছেন, কর্দমাক্ত পিছল পথে কুলিরা মাল টানতে পারত না, পালিয়ে গিয়ে বেঘোরে মারা পড়ত। পথের চা গুদামগুলোকে বলা হত মৃত্যুফাঁদ।
ঘোড়া বিক্রি করতে আসা তিব্বতিদের কিন্তু খাতিরযত্ন করা হত। ১০৭৮ নাগাদ এক একটা তিব্বতি ঘোড়া বিক্রি হচ্ছিল একশো বস্তা চায়ে। ১০৮৫তে এক সিচুয়ান থেকেই প্রায় তিন কোটি বস্তা চা আসে। এত বেশি চা তৈরি হচ্ছিল যে ১১২১ নাগাদ ঘোড়ার দাম গিয়ে দাঁড়ায় ১৭৪ বস্তা চায়ে।
চায়ের দাম কমছিলই। ১১৬৪তে, সাড়ে তেরো হাতের একটা ঘোড়ার দাম ৭০০ বস্তা চা। চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মারাত্মক মোঙ্গল হামলার সময়ে এবং চিনে মোঙ্গল রাজত্ব চলাকালীন চা-ঘোড়া ব্যাপার বন্ধ ছিল বটে, তবে তাতে চাষিদের অবস্থার বদল ঘটেনি। চা-ঘোড়া ব্যবসা আবার শুরু হয় মিং রাজাদের সময়ে(১৩৬৮-১৬৪৪)।
মিং দরবার সিচুয়ান থেকে ফি বছর দশ লক্ষ বস্তা চা নিত জবরদস্তি। সমস্ত খালি জমিতে চা চাষ বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। মিং সম্রাট হংহু-র আমলে ভালো জাতের ঘোড়া ১২০ বস্তায় বিক্রি হত। ১৩৯২-এ, সরকারিভাবে দশ হাজার ঘোড়া কেনা হচ্ছে তিন লাখ বস্তা চা দিয়ে--ঘোড়াপিছু তিরিশ বস্তা। হংহু-র পরে যে সম্রাট এলেন তিনি খোলা বাজারে চা বেচার অনুমতি দিলেন, ফলে ঘোড়ার দাম বেড়ে গেল অনেকটাই। মিং রাজত্বের পরের দিকে পরিকল্পিত ভাবে যুদ্ধবাজ যাযাবরদের চা ধরানোর চেষ্টা করা হয়, চা না পেলে তারা পাগলের মতো হয়ে যাবে, এই ভেবে।
Powered by Froala Editor