চিন, জাপান, হল্যান্ড, ব্রিটেন: চায়ের বহু গল্প (দুই)

সময়ভ্রমণ - ৪৩
আগের পর্বে

একান্ত বাণিজ্যিক কারণে চা-গাছ সংগ্রহ করতে গেলেও রবার্ট ফরচুনের লেখায় বারবার উঠে এসেছে চিনের নিসর্গচিত্র। তাছাড়া, চায়ের সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে চিনের ইতিহাস এবং সংস্কৃতিও। এমনকি চা পানের উপকারিতা, অপকারিতা ও চা-গাছ নিয়ে নানা রকম আগ্রহ ছিল ইউরোপেও। শুধুই ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি নয়, চা-গাছ সংগ্রহের জন্য গিয়েছেন ফ্রান্স, চিন, হল্যান্ডের বণিকরাও। তবে ফরচুনের আগে কেউই চিনের ভিতরের গভীর প্রান্তরে প্রবেশ করতে পারেননি। এইসমস্ত অভিযানে পাশাপাশি চা নিয়ে রয়েছে অসংখ্য গল্পকথা।

ওভিংটনের লেখা ছোট বইটা ব্রিটেনে চা ব্যাপারটাকে 'সমাজচল' করতে সাহায্য করে অনেকটাই। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি লন্ডনের মুদিখানায় ও ওষুধের দোকানে চা বিক্রি শুরু হচ্ছে, রাজপরিবার সহ অভিজাতবংশীয়দের মধ্যে চা সম্পর্কে আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। অথচ বস্তুটি তখনো মহার্ঘ, সহজলভ্যও নয়। ধারণা হিসেবেও 'চা' নিতান্তই বাইরের, চিন-জাপান-হল্যান্ড ঘুরে ঝাপসা অস্পষ্ট কিছু কথা লোকের কানে আসছে ঠিকই, লকের মতো দিশি বিদ্বজনেরাও চা নিয়ে বলছেন। আরো কথার, স্বচ্ছতর ধারণার প্রয়োজন ছিলো। ওভিংটনের বই সেই কথা ও ধারণা জনসমক্ষে হাজির করলো, সংক্ষেপে, অথচ খুব পরিপাটি করে, গুছিয়ে। 

চা কোথায় জন্মায়, কখন তোলা হয়, কীভাবে বানানো হয়, কত জাতের চা হয়, তাদের স্বাদগন্ধ কেমন, দাম কত, চা খেলে কী কী উপকার, এ সবই 'চায়ের প্রকৃতি ও গুণাবলী নিয়ে প্রবন্ধ' পুস্তিকায় বলা হল। ওভিংটন নিজে চিন জাপান যাননি, মান্দারিন বা জাপানি ভাষায় চা নিয়ে লেখাজোখা তিনি পড়েছিলেন বলেও জানা যায় না। সুরাতের বানিয়াদের সঙ্গে কথা বলে বলে এত বিশদ তথ্য তিনি যোগাড় করলেন কী করে, ভাবলে আশ্চর্য লাগে। ইতিপূর্বে সুরাত ও তৎকালীন ভারতের পশ্চিম উপকূল এলাকার সমাজজীবন ইত্যাদি নিয়ে তাঁর '১৬৮৯সনে সুরাত ভ্রমণ'(প্রকাশিত হচ্ছে ১৬৯৩-এ) বইয়ের বিশেষ কদর হয়েছিলো। সে বইতেও ওভিংটন এশীয়দের চা-অভ্যাস বিষয়ে বলেছেন। দুটো লেখাতেই চিন ও জাপানের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলতে চাইছিলেন 'চা' বস্তুটি সুপ্রাচীন, সমবৃদ্ধ এইসব সভ্যতার অংশ, দান, যা গ্রহণ করা গৌরবের। ইংরেজদের সুরাপানের অভ্যাসের সঙ্গে এশীয়দের চা-অভ্যাসের তুলনা টেনে চা বিষয়ক পুস্তিকায় ওভিংটন বলছেন, সুরাপান মানুষকে মুর্খ বানায়, ভুলের পথে নিয়ে যায়। তুলনায়, চা :

‘...প্ৰযত্ন করিতে থাকে যাহাতে মনুষ্যগণ সংযমী এবং সুস্থ হইয়া উঠে, যেইকালে তাহাদিগের মস্তিষ্ক আবৃত হয় অতিরিক্ত সুরাপান সঞ্জাত অসংযমে, যুক্তিবুদ্ধি বিস্মৃত হইয়া মানসিক বিকার জন্মে। যাহাদিগের এইরূপ বিকার জন্মিয়াছে, সংযমের সকল সীমা যাঁহারা লঙ্ঘন করিয়াছেন, তাঁহাদিগের আশু কর্তব্য আপন আপন শিরায় এই তরল সঞ্চারণপূর্বক আপনাদিগকে সংযমধারায় ধৌত করা, যদ্যপি তাঁহারা আপনআপন পথভ্রষ্ট চিন্তাসকলকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিতে ইচ্ছুক...বহু গুণের মধ্যে ইহা ন্যূনতম নহে যে মায়াপাত্রের সম্মোহন এই (পুত তরল) প্রতিরোধ করিতে সক্ষম, পশুদিগকে মনুষ্যে রূপান্তরিত করিতেও…’

চিন ও জাপানের অনুসরণে, চা খাবার নেহায়েৎ জৈবিক প্রক্রিয়া ব্রিটেনেও ক্রমে হয়ে উঠল সংস্কৃতি ও নৈতিকতার অঙ্গ, একাধারে চিন্তাবর্ধক, যৌক্তিক ও ব্যাধিশত্রু। ক্রমে, অভিজাত বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে চা প্রবেশ করলো মধ্যবিত্ত গেরস্থালির অন্তঃপুরে, সেখান থেকে সমাজের দরিদ্রতম অংশেও। চাহিদা বাড়তে থাকায়, চায়ের যোগান ও বৈচিত্র্য দুইই বাড়ল। বিভিন্ন অংশের খদ্দেরদের জন্য বাজারে আসতে শুরু করল নানান ধরণের, বিভিন্ন দামের চা। 

আরও পড়ুন
চিন, জাপান, হল্যান্ড, ব্রিটেন : চায়ের বহু গল্প (এক)

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরাসরি চিন থেকে চা আনতে শুরু করল ১৭০০ সন নাগাদ। ষোড়শ শতাব্দীতে যেখানে ব্রিটেনে মোট চা-আমদানি সাকুল্যে লাখ দেড়েক পাউন্ড, সতেরো শতকের গোড়ার পাঁচ বছরে চা ঢুকলো দু লক্ষ পাউন্ডেরও বেশি। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ থেকেই চা কেনার বরাত নিয়ে কোম্পানির জাহাজ চিনে পৌঁছোতে শুরু করেছে, জাহাজের কর্তাদের(যাঁদের বলা হত 'সুপারকার্গো') বিশেষ ভাবে বলে দেওয়া হচ্ছে, কী চা, কতটা পরিমাণে কিনতে হবে। বেশি চাহিদা ছিলো সিংলো(ফরচুনের সাংলো) সবুজ চা, বোহে(ফরচুনের বো-হিয়া) কালো চা ও 'ইম্পিরিয়াল' ওরফে বিং পাতা চায়ের। যা বরাত থাকত সেই অনুযায়ী মাল পাওয়া যেত না, 'স্যায়না ও ধূর্ত' চিনে ব্যাপারিরা(যাবতীয় সুপারকার্গোদের ও কোম্পানি কর্মচারিদের 'চিনে ধূর্তামি' বিষয়ে সদাসতর্ক থাকতে বলা হতো) সব মাল একসঙ্গে বের করত না। মাল যা পাওয়া যেত তা কবে দেশে পৌঁছোবে কেউ জানত না। ১৭০২-এর একটা হিসেব থেকে বিষয়টা বোঝা যাবে। ৯০০০০ পাউন্ড সিংলো, ২৪০০০ পাউন্ড বোহিয়া এবং ১২০০০ পাউন্ড ইম্পিরিয়ালের বিপুল বরাত নিয়ে কোম্পানির তিন জাহাজ--কেন্ট, ইটন আর স্ট্রেথাম--ক্যান্টন রওনা হয়ে গেল। ক্যান্টনে থানা দিয়ে বসে থেকে থেকে সুপারকার্গোরা অস্থির, চা যোগাড় হয় না। ধুত্তোর, যা পাওয়া যায় তা-ই সই বলে মাল তুলে দেশে ফিরতে ফিরতে আরো দুতিন বছর কাটল। যা বরাত ছিল, তার ষাট ভাগ মালও উঠল না, ইম্পিরিয়াল তো পাওয়া গেলই না, বোহিয়া খুব কম পরিমাণে। 

আরও পড়ুন
দার্জিলিং এবং চিন: চায়ের রকমফের (চার)

ঠিক জাতের পছন্দসই চা পাওয়া যাক আর না-ই যাক, লন্ডনে, ব্রিটেনে, ইউরোপে, চা-আমদানি বাড়ছিলই। ১৭৫০ সালে ক্যান্টন বাজার থেকে মোট ইউরোপীয় আমদানি ৭০ লক্ষ পাউন্ড, ১৭৭০-এ তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ২ কোটি পাউন্ডে। সাময়িক শুল্ক-হ্রাসের সুযোগ নিয়ে ১৭৬৭-৭২-এর মধ্যে লন্ডন চা-বাজারে বিক্রি বাড়ছে ৭৫ শতাংশ। 

আরও পড়ুন
দার্জিলিং এবং চিন: চায়ের রকমফের (তিন)

অষ্টাদশ শতাব্দী জুড়ে চায়ের ওপর(আমদানির ওপর, খুচরো ও পাইকারি বিক্রির ওপর) এত বেশি কর চাপানো হয়েছে যে আইনি পথে যত চা ব্রিটেনে ঢুকত, তার সমপরিমাণ বা বেশি চা আসত চোরাপথে। ইংল্যান্ডের বিস্তীর্ণ উপকূল জুড়ে চোরাচালানকারীদের প্রতাপ ও রাজত্ব, বিশেষত বিপজ্জনক পাথুরে সমুদ্রতটে, অসমতল ভূভাগ পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে যেখানে সমুদ্রে মিশছে। ১৭৮৩-র এক সরকারি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, চোরাচালানকারীদের হাতে অন্তত ২৫০টা বিশ টনের বা তার চাইতেও বড় (কিছু ৩৫০ টনেরও) জাহাজ, সেগুলো রীতিমতো সশস্ত্র, কামানবন্দুক তো থাকতই, তদুপরি এক একটা জাহাজে জনা চল্লিশ বন্দুকধারী নাবিক। সে তুলনায় সরকারি শুল্ক বিভাগের হাতে মেরেকেটে ৪২টা জাহাজ। সুতরাং, চালানকারীরা সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরেই থাকত সচরাচর, প্রায়শই সরকারি শুল্কসিপাইদের মেরেধরে তাড়িয়ে দেওয়া হত। 

আরও পড়ুন
দার্জিলিং এবং চিন: চায়ের রকমফের (দুই)

ফলে, ব্রিটেনের সর্বত্র সব শ্রেণির মানুষ চা খেতে শুরু করলেন বটে, তবে তাতে না বাড়ল সরকারি তহবিলে জমা, না লাভ হল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। সস্তার চা, যেটা বেশি বিক্রি হত, তার ওপর শুল্ক চাপানো ছিলো ১১৯ শতাংশ! ব্রিটেনের শহরে-গ্রামের গরিব মানুষ সে চা কিনবেন কী করে, তাঁরা চোরাপথে আসা চা-ই কিনতেন। কোম্পানি এবং সরকার, দু তরফের কাছেই অবস্থা ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছিল। 

অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়ে এলেন তরুণ উইলিয়াম পিট। তাঁর প্রধান কাজ হল, চা-ব্যবসার 'গণতন্ত্রীকরণ', চোরাচালান ও সরকারি শুল্কের গোলমেলে চৌহদ্দির বাইরে চা-কে নিয়ে আসা। সেইমতো, ঘরে-বাইরে তীব্র বিরোধিতা সত্বেও পিট নতুন আইন চালু করে চা-ব্যবসায় যাবতীয় চালু শুল্ক প্রত্যাহার করলেন। সরকারি কোষাগারের ঘাটতি মেটানোর জন্য বাড়ির জানলাপিছু নতুন কর বসল, পিট হিসেব করে দেখালেন, চায়ের দাম কমলে প্রত্যেক পরিবারের সঞ্চয় বাড়তে বাধ্য, নতুন জানলাকর দেবার পরেও। চা হেন 'অপ্রয়োজনীয় বিদেশি বিলাসদ্রব্য(কিম্বা পাপ)' চালানের দায় কেন গরিব দেশবাসীর ঘাড়ে চাপবে, এ তর্ক খাটল না। ১৭৮৫-তে নতুন চা আইন(আইনের পোশাকি নাম ছিল কমিউটেশন বা বিনিময় আইন--চায়ের শুল্কের পরিবর্তে জানলাকর, সেই বিনিময় আরকি) আসার পর চোরাচালানকারীরা বেমালুম জাহাজবন্দুক সমেত উবে গেল, আম চা-বিক্রেতা ও চা-ওলারা সব্বাই বৈধ বাজারে ঢুকে পড়লেন। নতুন আইনে কোম্পানিকে বাধ্য করা হল বছরে চার বার প্রকাশ্যে চা-নিলাম করতে, বলা হল এখন থেকে কোম্পানির আড়তে অন্ততঃ এক বছরের মতো চা মজুদ রাখতেই হবে, যাতে বাজারে চায়ের আকাল না ঘটে। 

লাও তো বটে, কিন্তু করে কে? কোম্পানির হাতে অত চা ছিল না, চিনা বাজার থেকে হট করে যোগাড় করাটাও মুশকিল। যোগান ঠিক রাখার জন্য প্রথম দিকটায় কোম্পানিকে ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের(যথা ওলন্দাজ ভক) কাছ থেকে চা কিনতেও হল। অবশ্য সেটা কিছুদিনের জন্যই।  চিনা চা-বাজারের বেশিরভাগটা দ্রুত কোম্পানিকবজায় চলে এল। কোম্পানি-কেরানি রবার্ট উইসেটকে উদ্ধৃত করে এলিস ও সহ-লেখকেরা জানাচ্ছেন, আইন-পূর্ব সময়ে, অর্থাৎ ১৭৮৪ সালে ক্যান্টন থেকে মোট চা-রফতানির মোটে ৪০ ভাগ কোম্পানির। আইন-পরবর্তী নব্বুইয়ের দশকে তা ৯০ শতাংশ। ফরাসি ও ওলন্দাজ কোম্পানি শতাব্দীশেষ অবধি টিঁকল না, ১৮০৪ নাগাদ সুইডিস কোম্পানিও চিনে জাহাজ পাঠানো বন্ধ করে দিল। 

খোলা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী আমদানির ধরণেও বদল এল। ১৭৮৪-র আগে কোম্পানি মোট কালো চা যা বিক্রি করত, ওজন হিসেবে তার শতকরা ৯০ ভাগ বোহিয়া। ভালো জাতের কনগু চা বিক্রি হত কম, মোট বিক্রির সাত শতাংশ। ১৭৯০-এর পর, বোহিয়া বিক্রি হচ্ছে ১৩ শতাংশ, কনগু ৭৬! চাহিদা আর বিক্রি বেড়ে যাবার ফলে কনগু-র দাম কমে গেল অনেকটাই।  চাহিদা বাড়ার প্রধান কারণ, লন্ডনের বাইরের অঞ্চলগুলোয় যেখানে যেখানে চোরা চা ঢুকত, লোকের অভ্যাসই হয়ে গিয়েছিলো কনগু খাওয়া। বোহিয়া খাচ্ছিলেন যত লোক, তদপেক্ষা অনেক বেশি চা-খোরদের পছন্দ কনগু। বাজার খুলে গেল যখন, কনগু-র খদ্দেরও বেড়ে গেল বহুগুণ। 

খোলা বাজারে নানান নামের চা বিক্রি হচ্ছিল ঠিকই, তবে সে সব নামের সঙ্গে চায়ের জাত যে সব সময় মিলত, তা নয়। ক্যান্টনের বাজারে যে চা উঠত, তার গুণ/জাত নিয়ে ধন্দ থেকেই যেত - ঠিক চা দিচ্ছে তো চিনারা? কোন জাতের চা চিনের কোথায় তৈরি হচ্ছে, সে বিষয়েও নির্ভরযোগ্য তথ্য ছিল না, আধা-জানার ওপর ভিত্তি করে চায়ের নামকরণ হত। অধিকন্তু ছিল ভেজাল। চিনে তো বটেই, চায়ের সঙ্গে নানাবিধ ভেজাল মিশত ব্রিটেনের বাজারেও। ১৭৮৪-তে হাউস অব কমন্সে পেশ করা এক রিপোর্ট অনুযায়ী, কোম্পানির আমদানি করা প্রায় ৬ লক্ষ পাউন্ড, চোরাচালান হয়ে আসা সাড়ে সাত লক্ষ পাউন্ড, এর সঙ্গে যোগ করতে হবে চার লক্ষ পাউন্ড নকল চা। শুকনো গাছগাছালি, ধূলোমাটি, হাড়ের ও চামড়ার গুঁড়ো, বাজে রং ইত্যাদি যা ইচ্ছে মিশিয়ে সেই 'চা' তৈরি হত, তা খাদ্য হত গরিবদের। চায়ে ভেজাল দেবার রেওয়াজটা উনিশ শতকের বৃটেনেও থেকে গিয়েছিল, হয়তো তার পরেও। ভারত যথা উপনিবেশগুলোয় ভেজাল চায়ের চল অদ্যাবধি আছে, যাঁরা চা খান তারা প্রায় কেউই চায়ের জাতকূল নিয়ে মাথা ঘামান না। নকল হোক আসল হোক, চায়ের সঙ্গে দুধ জাতীয় কিছু মিশিয়ে দু তিন চামচ চিনি ঢেলে যা তৈরি হয় সেটা খাবার, তাতে রুটি পাউরুটি ভিজিয়ে খাওয়া যায়, আর কিছু না হোক, চিনির কারণে শরীরে কিছু শক্তিসঞ্চারও হয়। চা ভালো না খারাপ, চায়ের ওপর শুল্ক বসানো ঠিক না ভুল এসব নিয়ে যখন ব্রিটেনের রাজনৈতিক ও সমাজজীবন তোলপাড় হচ্ছে, সমাজসচেতন ধর্মযাজক ডেভিড ডেভিস তাঁর 'শ্রমজীবী সম্পর্কে' বইতে বলছেন:

‘তথাপি আপনারা বলিয়া থাকেন, চা বিলাসদ্রব্য মাত্র। ...ইহা দরিদ্রবর্গের ক্ষেত্রে সত্য নহে ...ঝর্ণা বা নদীর জলে দুই-চারিটি চা-পর্ণ ভিজাইয়া, পাটল শর্করা দ্বারা মিষ্ট করিয়া, এই বিলাস নির্মিত হইয়া থাকে। ইহা বন্ধ করিয়া দেওয়া হইলে, উহাদিগকে জল ও রুটি মাত্র খাইয়া থাকিতে হইবেক। 

এই বই প্রকাশিত হচ্ছে ১৭৯৫-তে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি, ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ব্রিটেনের শিল্পপ্রধান এলাকায় শ্রমজীবীদের মধ্যে ঘুরছেন। তিনি দেখছেন সবচাইতে গরিব যে স্থানান্তরিত আইরিশ শ্রমজীবীরা, তাঁদের নোংরা কুটিরেও উনুনে চায়ের কেৎলি বসানো। 'ইংল্যান্ডের শ্রমজীবী শ্রেণীর অবস্থা' বইতে এঙ্গেলস মন্তব্য করছেন, 'যে বাড়িতে চায়ের চল নেই, সেখানে ভয়ঙ্করতম দারিদ্র্যের রাজত্ব।'

চায়ের চাহিদা বাড়ল ব্রিটেন(১৮০০ সালে দেশের নতুন নাম হয়েছে 'যুক্তরাজ্য') জুড়ে, চা-র ওপর কোম্পানির একচেটিয়া দখলেরও অবসান হল। খোলা পুঁজিবাজারের নিয়মানুযায়ী, চায়ে সরকারি শুল্কের পরিমাণ ক্রমশ কমতে থাকল, উনিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধে, উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোনের জমানায়, চায়ে সরকারি কর কমে দাঁড়াল পাউন্ড পিছু মাত্র ছ পেনি। গ্ল্যাডস্টোন সংস্কারের দু দশকের মধ্যে চা-আমদানি বাড়ল হুহু করে, ১৮৮১ নাগাদ ব্রিটেনে চা ঢুকছে মোট ১৮ কোটি পাউন্ডেরও বেশি! পাইকারি চা-বাজারে পাউন্ডপিছু চায়ের দাম কমে দাঁড়াল মাত্র এক শিলিং। 

গোটা উনিশ শতক ধরে ব্রিটেনের চা-সাম্রাজ্য তৈরি হয়ে উঠছে। কোম্পানি উঠে গেছে, কিন্তু চিনের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ তো হয়ইনি, উল্টে আফিং চালান বৈধ হয়েছে। ফরচুনের চিন সফরের পর, কোথায় ভালো চা তৈরি হয় সে তথ্য সায়েবদের নখদর্পণে, দ্বিতীয় আফিং যুদ্ধের পর থেকে চিনা সম্রাট আরো নখদন্তহীন নির্বিষ, সায়েবরা যাইচ্ছে তাই করতেই পারে। অথচ চিন থেকে চা আনানোর প্রয়োজন কমছে, আসামে, দার্জিলিংয়ে, নীলগিরিতে, পশ্চিমঘাটে, সিংহলে, মালয়ে ব্রিটিশ চা-চাষ শুরু হয়ে গেছে, নতুন, বাষ্পচালিত ও দ্রুতগামী ক্লিপার জাহাজে করে সেই চা শুধু ব্রিটেনে নয়, পৃথিবীর সর্বত্র পৌঁছোচ্ছে। চিনের নিজস্ব চা-ব্যবসা বন্ধ হবার মুখে, রাশিয়া ও  প্রাচ্যে যে চা যেত, সে বাজারেও ঢুকে এসেছে ব্রিটিশরা। চিনের চা ব্যবসার উত্থানপতন সহ চায়ের বিস্তারিত ইতিবৃত্ত ২০০৯-এ প্রকাশিত অন্য একটি বইতে বলা আছে। চিন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ভিক্টর এচ মেয়ার এবং এরলিং হো-র লেখা  ট্রু হিস্ট্রি অব টি বইটাও বহু তথ্য ও গল্পে ঠাসা। তা থেকেও কিছু গল্প পরেরবার।

Powered by Froala Editor