সময়ভ্রমণ - ৪২
আগের পর্বে
রবার্ট ফরচুন যখন চিনে পৌঁছেছিলেন, তখন রাজার নির্দেশে আফিম সেবন নিষিদ্ধ। অথচ দেশের অভিজাত সম্প্রদায়ের হাত ধরে ব্যবসা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি চিনের রাজাও যে আফিম সেবন করেন না, সে-কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। এমনটাই অভিমত ফরচুনের। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ আফিম কত যত্ন নিয়ে বানানো হয়, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাও দিয়েছেন তিনি। তবে তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল চা গাছ সংগ্রহ করা। কোনো বিদেশির কাছে চা চাষের গোপন রহস্য ফাঁস করবেন না চিনারা। তাই মাথা মুড়িয়ে তিনিও চৈনিক সাজলেন। পৌঁছে গেলেন হুয়েই-চাও জেলায়। সেখানে চায়ের সন্ধান পেলেন না। পাহাড়তলির চাও উৎকৃষ্ট নয়। চায়ের সন্ধানে মন্দিরেও দিন কাটিয়েছেন ফরচুন। একসময় পাহাড়ের মধ্যে এক বদ্ধভূমিতে পথ হারালেন। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে আসতেই চোখে পড়ল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সারি সারি চায়ের গাছ। চোখ জুড়িয়ে গেল ফরচুনের।
চিনের চা-অঞ্চলের নিসর্গে রবার্ট ফরচুন যে অলৌকিকের স্পর্শ পাচ্ছিলেন, তা এমনি নয়। উ-ই-শানের শ্রেষ্ঠ নিসর্গ ও শ্রেষ্ঠ চা, এ দুইই যে দূর পাহাড়চূড়ার মন্দিররাজিকে বেড় দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার পিছনে চিনা সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশের দীর্ঘ ইতিহাস উপস্থিত ছিল। লিউ উ যেমন দেখিয়েছেন, সেই ইতিহাসের অন্যতম উপাদান (বা আকর) চা ও চা-চর্চা। চা যতটা মানুষী, ততটাই কি তারো বেশি স্বর্গীয় রহস্যগূঢ় অলৌকিক, যে নিসর্গে চা গাছ বেড়ে ওঠে তা থেকে শুরু করে শুকনো চা তৈরি ও তা জলে ভিজিয়ে চিনামাটির পাত্রে ধরে খাওয়া অবধি, প্রকৃতি ও প্রকৃতির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত ঈশ্বরেচ্ছার অমোঘ বেষ্টনিতে এই সমগ্র প্রক্রিয়া প্রোথিত ও আধারিত, স্বয়ং 'স্বর্গীয়' সম্রাট(চীন সম্রাটকে স্বর্গীয় বা সেলেশিয়াল অভিধায় ভূষিত করা হত) সেখানে যেমন হাজির, তেমনই সাধুসন্ত পুরোহিত, অভিজাত মান্দারিন, নগণ্য চা-চাষি, পাহাড় থেকে সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত চা বয়ে নিয়ে যাওয়া কুলি। সমাজের বিভিন্ন অংশকে, বিপুল চিন সাম্রাজ্যের বহু ভূগোলকে, হাজার হাজার বছরের ইতিহাসকে এক সুতোয় গেঁথে রেখেছিল চা, তার মোহিনী শক্তিকে অস্বীকার করার সাধ্য বেনিয়া লুঠেরা ঔপনিবেশিক সায়েবদের ছিল না।
চা নামের খাদ্যদ্রব্য, তার বিবিধ ভেষজ ও পুষ্টি গুণ (অথবা ঘোরতর অপকার - যে যেমন দেখে), চা গাছের বা পাতার প্রাকৃতিক ধর্ম, এসব নিয়ে সুসভ্য পশ্চিমী দুনিয়ার কেন্দ্রে, অর্থাৎ খোদ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোয় আগ্রহের অন্ত ছিল না। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত যে ঔপনিবেশিক কালপর্ব, সে সময়ে পশ্চিমী ব্যাপারি, পাদ্রিবাবা, সৈন্যসামন্ত, রাজপুরুষ ও নেহাৎই ভাগ্যান্বেষীদের নিয়ে একের পর এক জাহাজ দীর্ঘ সাগরপাড়ি দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে(কিম্বা যাচ্ছে না--বহুবিঘ্ন কণ্টকিত পথ) দূর ও নিকট প্রাচ্যের বন্দরে, মাল বোঝাই করে তারা ফিরে আসছে অথবা আসছে না। মালের সঙ্গে সঙ্গে আসছে নতুন জ্ঞান, অজানা ভূগোলের, সমাজ-সংস্কৃতির, প্রকৃতির। এবং খাবারের। ঔপনিবেশিকরা তাঁদের খাবার যেমন উপনিবেশে নিয়ে গিয়েছেন, সেখানকার খাবার দেশে আমদানিও করেছেন। সেইভাবে চিনা চা-ও ইউরোপে পৌঁছোয় সম্ভবত সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ায়। শতাব্দীশেষ, অষ্টাদশ শতকের শুরু, চা হয়ে উঠছে অন্যতম, ক্রমে প্রধানতম আমদানিযোগ্য পণ্য। শুধু ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নয়। ওলন্দাজ কোম্পানির, জর্মন ও পর্তুগিজদের। সেই চা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে শহরে ও গ্রামে, শুধুই অভিজাত, ধনী ও রাজবংশীয়দের বিলাসদ্রব্য হয়ে না থেকে তা হয়ে উঠছে গরিব আমমানুষের খাবার। চা এবং তার বৈধ ও অবৈধ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন হাজার হাজার মানুষ। চা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন বৈজ্ঞানিক, উদ্ভিদবিৎ ও রাজনৈতিক নেতারা, কবিরা কবিতা লিখছেন। এবং, চা উপলক্ষ করে, চায়ের জন্য, বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর একটা বিশাল অংশের ইতিহাস ভূগোল সমাজ সংস্কৃতি।
চা-কে ঘিরে এই যে সমাজ অর্থনীতি রাজনীতির উথালপাথাল, সে তরঙ্গের পরত সরিয়ে সরিয়ে, চা নিয়ে বহুকাল ধরে জমে ওঠা অসংখ্য ছোটোবড়ো গল্প(এবং সে সব গল্প কিভাবে লতায় পাতায় জড়িয়ে, সে গল্পও) পড়তে চেয়েছেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক: মার্কম্যান এলিস, রিচার্ড কোল্টন, ম্যাথিউ মেজর, তাঁদের এম্পায়ার অব টি বা চা-সাম্রাজ্য বইতে। ২০১৫-তে প্রকাশিত এই বই যাবতীয় চা-খোর গপ্পোবাজদের('চায়ের টেবিলের গল্প' ব্যাপারটা কি করে শুরু হল, তা নিয়েও বিস্তারিত বলা আছে) অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। চিনে ফরচুনের অভিযান, ভারতে কোম্পানির চা-চাষ শুরু এবং দার্জিলিং চা নিয়ে বিশেষ নতুন কিছু যে আছে, তা নয়। কিন্তু তার আগের দুশো বছরের গল্প ধরা হয়েছে খুব যত্ন নিয়ে। যেহেতু সে গল্প ঐতিহাসিকদের লেখা, বহু নতুন তথ্যের সমাবেশ ঘটেছে, চা-য়ের ঔপনিবেশিক ইতিহাসের বহু নতুন আকরেরও সন্ধান দেওয়া আছে।
বড়ো বই, সেখানে নানান কথা, অনেক গল্প। সেসব নিয়ে এখানে বিশদ গপ্পো ফাঁদা যাবে না। ফরচুনের চিন-যাত্রার যে গল্পে আমরা ছিলাম, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দু চারটে বলি।
আরও পড়ুন
দার্জিলিং এবং চিন: চায়ের রকমফের (চার)
ফরচুনের আগে কোন ইউরোপীয় চিনের নিষিদ্ধ অন্তঃস্থলে সেভাবে ঘুরে বেড়াননি, চা-এলাকা তো দূরস্থান। তবে কেউই একেবারে চিনের কোথাও যাননি, তা নয়। এম্পায়ার অব টি বইটা শুরু হচ্ছে লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের ডারউইন কেন্দ্রে রাখা 'উদ্ভিজ্জ' বা 'ভেজিটেবল সাবস্ট্যান্স' সংগ্রহের ৮৫৭ নম্বরে প্রদর্শিত বস্তুটি থেকে। অনেক বছর ধরে এই 'উদ্ভিজ্জ' সংগ্রহ গড়ে তুলেছিলেন ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর আইরিশ চিকিৎসক ও প্রকৃতিতত্ত্ববিৎ, সর জেমস স্লোন। ৮৫৭ নম্বরের বস্তুটি--বাজারে বিক্রির জন্য বানানো চৈনিক চা--সংগৃহীত হয়েছিল সম্ভবত ১৬৯৮ সালে। স্লোন সংগ্রহের দুই তৃতীয়াংশ নষ্ট হয়ে গেছে, যেটুকু আছে তার বিশদ তালিকা সম্প্রতি প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছে, ফলে সংগ্রহে যা যা আছে তাদের বিষয়ে আলাদা করে জানা যাচ্ছে। এলিস ও তাঁর সহ লেখকেরা খোঁজ নিয়ে দেখলেন, ৮৫৭ নম্বরে অন্তত তিনশো বছরের পুরোনো যে শুকনো, কুঁকড়ে যাওয়া চা রাখা আছে, তা এসেছিলো জনৈক শ্রী কানিংহ্যাম মারফত। ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে রাখা স্লোনের চিঠিপত্র ঘেঁটে দেখা গেল, কানিংহ্যাম বলতে জেমস কানিংহ্যাম, স্কটদেশীয় এক জাহাজের চিকিৎসক হয়ে কমপক্ষে দুবার তিনি চিনে গিয়েছিলেন, গিয়েছিলেন চুসান অঞ্চলেও(যেখানে ফরচুনও গিয়েছিলেন)। স্লোনের মতোই, কানিংহ্যামের গাছপালায় বিশেষ আগ্রহ ছিলো, চুসানের বনে তিনি বন্য চা গাছ খুঁজে পেয়েছিলেন। স্লোন সংগ্রহে থাকা চা-টা কোত্থেকে ঠিক এসেছিল, জানা যায় না। তবে চা ও চা গাছ বিষয়ে কানিংহ্যাম আগ্রহী ছিলেন, বলা যেতেই পারে।
আরও পড়ুন
দার্জিলিং এবং চিন: চায়ের রকমফের (তিন)
কানিংহ্যাম থেকে গল্প শুরু করে চা-সাম্রাজ্যের লেখকেরা ঢুকতে চেয়েছেন চা-য়ের গভীরে: প্রথমত চৈনিক ধারণায়, সমাজে চা, সেখানকার মানুষ কী করে চা খায়, চা নিয়ে কী ভাবে। দ্বিতীয়ত 'চা' নামের বস্তু, দ্রব্য, পণ্য, যা কেনা বা বিক্রি করা যায়, যা নিয়ে ব্যবসা, ঝগড়া, এমনকি যুদ্ধও হতে পারে। চা নামক চিনা ধারণা, ভাবনা, বস্তু, আক্ষরিক অর্থেই নানান বন্দর ঘুরে যুরোপে পৌঁছোচ্ছে, চিন থেকে জাপানে, সেখান থেকে হল্যান্ডে, প্রুশিয়ায়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চিনে বাণিজ্য করতে যাবার আগেই ওলন্দাজ আর পর্তুগিজরা সেখানে পৌঁছেছে; নিছক ধারণামাত্র নয়, অভিজাত ও ধনীদের খাবার( বা ওষুধ) হিসেবে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে আসার আগেই ইউরোপের একাধিক দেশে পৌঁছে যাচ্ছে চা। চিন থেকে ব্রিটেনে চা পৌঁছোনোর যাত্রাপথ ধরে এলিস ও সহ-লেখকদের যাত্রা, তাঁদের বক্তব্য, এতদিন অবধি চায়ের ইতিহাস বলতেই বোঝাত উনিশ শতকের আগ্রাসী ঔপনিবেশিকতা, উপনিবেশের বিভিন্ন প্রান্তে নতুন চা-বাগান গড়ে তোলার ইতিহাস। সেই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে এলিসরা বুঝতে চেয়েছেন কিভাবে বহুদূরের একটা ধারণা/জিনিস ইউরোপে, বিশেষত ব্রিটেনের সমাজজীবনে, রাজনীতি-অর্থনীতিতে এইভাবে ঢুকে পড়ল। উনিশ শতকের পুরোটা ও বিশ শতকের অর্ধাংশ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে চা-উপনিবেশ তৈরি হল, তা কি ঘটত যদি ব্রিটেনে ও ইউরোপে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ চা খেতে না শিখতেন, ফলে চাহিদা না বাড়ত হুহু করে?
আরও পড়ুন
দার্জিলিং এবং চিন: চায়ের রকমফের (দুই)
'চা' বলে যে কিছু একটা আছে, সে খবর যুরোপে এসে পৌঁছোচ্ছে ষোড়শ শতাব্দীতেই। ১৫৩৩ নাগাদ ভেনিস শক্তিশালী নগর-রাষ্ট্ৰ, সে রাষ্ট্রের দশজন নগরপরিচালকদের অন্যতম, যুগপৎ ব্যবসায়ী ও পণ্ডিত, জিওভান্নি বাতিস্তা রামুসিও তাঁর 'নাভিগেসিওনি এ ভিয়াজ্জি' বা 'যাত্রা ও ভ্রমণ' বইয়ের দ্বিতীয় খন্ডে পারস্যনিবাসী জনৈক হাজ্জি মহাম্মদের সঙ্গে বার্তালাপের উল্লেখ করছেন। মহাম্মদ রামুসিওকে ফিসফিসিয়ে জানাচ্ছেন, ''ক্যাথে(চিনকে প্রাচীনকালে ক্যাথে বলা হত) দেশের সর্বত্র লোকে একটা গাছ, বলা ভালো তার পাতা, ব্যবহার করে থাকে, যাকে ডাকা হয় 'চিয়াই কাতাই' বলে। ...এই রহস্যময় পাতা শুকনো করে বা কাঁচা অবস্থায় একটা পানীয় তৈরি হয়, যতটা গরম গলায় সয় ততটাই গরম করে সেটা খাওয়া হয়, ফলে মাথা ও পেটের নানান পীড়ার উপশম ঘটে।" রামুসিও-র সমসময়ে বা কিছু আগেপরে পর্তুগিজ ও ইতালিয় পাদ্রিরা(বিশেষত জেসুইটরা) চিনে ঘুরছেন। তন্মধ্যে অন্যতম গ্যাসপার দা ক্রুজ ও ইতালিয় জেসুইট মাত্তেও রিসি। এঁরা দুজনেই তাঁদের ভ্রমণবৃত্তান্তে চিন দেশে চা-য়ের বহুল প্রচলনের কথা বলছেন। রিসি চা পাতা তোলার বর্ণনাও দিয়েছেন।
আরও পড়ুন
দার্জিলিং এবং চিন: চায়ের রকমফের (এক)
ইউরোপে চা বস্তুটি প্রথমবারের মতো ঢুকছে জাপান থেকে। ষোড়শ শতাব্দীর বিখ্যাত ওলন্দাজ ব্যাপারি ও অভিযাত্রী জ্যান হ্যাইগেন ভ্যান লিনশ্চকোটেনের(আরো অসংখ্য বিদিশি নামের মতো, এ নামের উচ্চারণটি যারপরনাই গোলমেলে, বাংলায় বলা, লেখা দুটোর কোনটাই সম্ভব নয়) লেখা ‘ইস্ট ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে যাত্রা বিষয়ে সন্দর্ভ’ বইতে (প্রথম ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হচ্ছে ১৫৯৮-এ), জাপানবাসীদের খাদ্যাভ্যাস ও আচার-আচরণ নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে, লেখক বলছেন, জাপানের লোক খাবার পর একটা পাত্রে গরম জল রেখে সেখানে কোন একটা গুল্মের গুঁড়ো ফেলে সে জল পান করে, সেই জলটাকে বলা হয় 'চা'। জ্যান হ্যাইগেন জলপথ খুঁজে বার করা ও মানচিত্র রচনায় পটু ছিলেন, হল্যান্ড ও জাপানের মধ্যে যাতায়াতের সহজ পথ তিনি খুঁজে বার করেন, গোয়ার পর্তুগিজ উপনিবেশেও অনেক ঘোরাঘুরি করেন। চা-সাম্রাজ্যের লেখকদের আন্দাজ, জাপান থেকে হল্যান্ডের আমস্টারডামে প্রথম চা আসে ১৬১০ সালে, সম্ভবত রুদ লিউ মেত পিলেন(উচ্চারণ 'রু দেলে মেত পেলে' গোছের), অর্থাৎ 'তির সহ লাল সিংহ' জাহাজে করে। ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, যাকে সংক্ষেপে ভি ও সি বা ভক বলা হতো, তার চমকপ্রদ উত্থানের(১৬০২ সালে ভকের পত্তন) সঙ্গে এই জাহাজ জড়িয়ে, ফলে তা এখনো ইতিহাসবস্তু। জাপানের হিরাদো মেছোবন্দরে জাহাজটি নোঙর করেছিলো ১৬০৯ সালে। আরো বছর ছয় বাদে, ১৬১৫ নাগাদ, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মরত রিচার্ড উইকহ্যাম হিরাদো থেকেই তাঁর মিয়াকো(হালের কিয়োতো)বাসী বন্ধু উইলিয়াম ইটনকে চিঠি লিখে এক কৌটো উৎকৃষ্ট জাতের 'চ' পাঠাতে লিখছেন। এই চিঠিটা ব্রিটিশ সায়েবদের চা-অভ্যাস বিষয়ে প্রথম লিখিত নিদর্শন, ধরে নেওয়া যায়।
সারা রোজের বইতে বলা আছে, ব্রিটেনে চা ঢুকেছিল পর্তুগাল থেকে, রাজা দ্বিতীয় চার্লসের নববিবাহিত রানি ক্যাথরিন ডি ব্রাগাঞ্জার যৌতুক হিসেবে। এলিস ও সহলেখকেরা বলছেন এটি খোসগল্প মাত্র, যা শুরু করেছিলেন উনিশ শতকের রাজকীয় ঐতিহাসিক অ্যাগনেস স্ট্রিকল্যান্ড। হল্যান্ড হয়ে ব্রিটেনে চা পৌঁছে গেছে ক্যাথরিন আসার আগেই, একাধিক অভিজাতবংশীয়, বৈজ্ঞানিক ও কবিরা চা খাওয়া রীতিমতো অভ্যাস করে ফেলেছেন, যাঁদের মধ্যে অন্যতম স্যামুয়েল হার্টলিব নিজে, মাউন্টজয় ব্লাউন্ট ওরফে লর্ড নিউপোর্ট, সর চার্লস হারবার্ট(যিনি হল্যান্ডে বেশ কয়েক বছর কাটিয়েছেন) এবং কবি এডমান্ড ওয়ালার। ১৬৫৭-য় হার্টলিব লিখছেন 'থি অথবা টি' নামের গুল্মের কথা, যা নাকি চিন ও জাপানে সর্বরোগহর ভেষজ হিসেবে স্বীকৃত। আমস্টারডাম থেকে চা আনাতে খরচ পড়ত পাউন্ডপ্রতি ৬ পাউন্ড স্টার্লিং(হালের হিসেবে ৮৪৭ পাউন্ড, অর্থাৎ প্রায় ৮৫০০০ টাকা!), তবে সর হারবার্ট দশ শিলিং-এ জোগাড় করে দিতে প্রতিশ্রুত।
১৬৬০ সালের লন্ডনে চা খাওয়ার কথা লিখে গেছেন স্যামুয়েল পেপিস। সমসাময়িক বিজ্ঞাপন মারফত জানা যাচ্ছে, ওই সময় থেকেই শহরের কফিশালায় শুকনো চা এবং তৈরি করা চা পাওয়া যেতে থাকে। অবশ্য সে চায়ের দাম তখনো আকাশছোঁয়া, পাউন্ডপ্ৰতি শুকনো চায়ের দাম পড়ত তিন পাউন্ড স্টার্লিং মতো। মোটামুটি ওই সময়েই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও চা নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ১৬৬৪ সাল নাগাদ কোম্পানির কর্তারা রাজদরবারে ভেট পাঠাচ্ছেন চা। রানি ক্যাথরিনের কল্যাণে দরবারে ও রাজগৃহে চা ততদিনে পরিচিত সামগ্রী, মহার্ঘ্য খাদ্যদ্রব্য, বিলাসবৈভবের প্রতীক। রাজবংশীয় ও অন্যান্যদের চা দরকার, কিন্তু সে চা আসবে কোত্থেকে? চিনের সঙ্গে তখনো অবধি কোম্পানির ব্যবসাবাণিজ্য শুরু হয়নি, ফলে চা আনাতে হত হল্যান্ড থেকেই। ১৬৬৬-তে প্রায় ৫৭ পাউন্ড দামে কোম্পানি ২২ পাউন্ড চা কিনছে। পরের দিকে জাভার ওলন্দাজ ব্যাপারিদের কাছ থেকে কোম্পানি চা কিনতে শুরু করে, ১৬৬৯-৭০ নাগাদ সোয়া দুশো পাউন্ড চা লন্ডনে আমদানি হয়। প্রাচ্যে কোম্পানির ব্যবসা বলতে তখন মূল্যবান বস্ত্রাদি, রেশম, মসলিন, ভেলভেট, সেসঙ্গে মশলাপাতি আর দুষ্প্রাপ্য ধাতু। সে ব্যবসায় চায়ের ভাগ নামমাত্র। তার কারণও ছিল। সব ধরণের চায়ে পাউন্ডপ্রতি কর লাগত ৫ শিলিং। অথচ খারাপ জাতের চা বিক্রি হতো বড়জোর দু-আড়াই শিলিং দামে।
ওদিকে রাজঅন্তঃপুরে ও সমাজের অভিজাত অংশে চায়ের চল বাড়ছিলই। চায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ব্রিটিশ সমাজের মাথারা। রাজকবি এডমান্ড ওয়েলার ক্যাথরিন এবং চা নিয়ে পদ্য লিখে ফেললেন--
রাণীদের মধ্যে সেরা, গুল্মশ্রেষ্ঠ চা, তারা/
এলো কোথা হতে? বেপরোয়া দেশ রাস্তা দেখাল/
সুন্দর সেই দেশে যাবার, যেখানে সূর্য ছড়ায় আলো/
অপরূপ সব দ্রব্যাদি আসে, মহার্ঘ্য আর ভালো/
কবির বন্ধু, চা, খেলে ভাবনা বাঁধনহারা/
মাথার মধ্যে যত, বিষ বাষ্পেরা জমে/
তাহাদের সিধা রাখে, আত্মা শান্ত করে...
বেপরোয়া জাতি বলতে পর্তুগিজ, সূর্যের দেশ বলতে চিন। চিনে যাবার পথ খুলেছিল পর্তুগিজরা, সে কথাই পদ্যে বলা হয়েছে। ওয়েলার নিজে চা খাচ্ছিলেন ১৬৫০ থেকে। পদ্যটা ১৬৯০-এর, রানি তখন গতাসু। চা নিয়ে নানারকম লেখাজোখা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, জন লকের মতো খ্যাতনামা দার্শনিকও চা-ভক্ত হয়ে উঠেছেন, বিশেষত হল্যান্ডে যাবার পর থেকে। চা ভালো না খারাপ, স্বর্গীয় না শয়তানি ষড়যন্ত্র, এসব নিয়ে দীর্ঘদিন পর্যন্ত যুরোপের পন্ডিতমহলে যে কাজিয়া চলেছে, তার শুরুও হল্যান্ডে। সেদেশে চা নিয়ে বইপত্র প্রকাশ হচ্ছিল নিয়মিত, তাতে উৎসাহিত হয়ে লকও চা নিয়ে অনেক লিখেছেন, চায়ের গুণ, জাতবিচার, চা-বানানো, চা-আচরণ ইত্যাদি। চিনা ও জাপানি অভিজাত সমাজের চা-আচরণ যুরোপের অভিজাত ও বিদ্বানদের প্রভাবিত করেছিল, দূর প্রাচ্যের পণ্ডিতদের মতো তাঁরাও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, চা বস্তুত স্বর্গীয় ও রহস্যময়, মানবমন ও শরীরের ওপর তার বহু, বিবিধ প্রভাব, যেমনতেমন করে এ জিনিস খাওয়া যায় না।
১৬৯৯-এ, সুরাতপ্রবাসী ব্রিটিশ পাদ্রী জন ওভিংটনের লেখা, 'চা বিষয়ক প্রবন্ধ' প্রকাশিত হয়। পর্তুগিজ দখলে থাকা সুরাত ১৬৬২ সালেই ব্রিটিশদের কাছে আসে, রানি ক্যাথরিনের যৌতুকের অংশ হিসেবে। সেকালের গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী সুরাত, তার সঙ্গে বর্হিবাণিজ্য চলত চিনের, জাপানের, সিয়াম বা শ্যামদেশের। সেই বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত গুজরাতি বানিয়াদের সঙ্গে ওভিংটনের বিশেষ সখ্য, তাদের কাছ থেকে এশীয় দেশগুলোর সমাজজীবন ও খাদ্যাভ্যাস প্রসঙ্গে বহু খবর ও তথ্য তিনি সংগ্রহ করেন, চায়ের খবরও।
Powered by Froala Editor