সময়ভ্রমণ - ৪০
আগের পর্বে
চিন সম্পর্কে রবার্ট ফরচুনের কোনো গভীর ধারণা ছিল না। চা গাছ সম্পর্কেও না। তবে উদ্ভিদবিদ্যার সাধারণ বিষয়গুলি তাঁর জানা ছিল। অন্যদিকে আফিম যুদ্ধের মাধ্যমে চিনের উপকূলবর্তী কিছু অঞ্চল ব্রিটিশ শাসকদের দখলে এলেও মূল ভূখণ্ডে তাঁদের প্রবেশ প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। এই অবস্থায় কোনো প্রশাসনিক কর্তাকে চিনে না পাঠিয়ে রবার্ট ফরচুনকেই পাঠানো হল, তাও নামমাত্র মজুরির ভিত্তিতে। ফরচুনের চিন ভ্রমণ বৃত্তান্তে বারবার উঠে এসেছে নিসর্গ ও প্রকৃতির কথা। তবে এসবের পরেও অস্বীকার করা যায় না, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিক। চিন থেকে চা ও ধুপি গাছ নিয়ে এলেন দার্জিলিং-এ। পাহাড়ের ঢালে ঢালে তৈরি হল বাগান। বাইরে থেকে শ্রমিকদেরও নিয়ে আসা হল। এভাবেই দ্রুত গতিতে বদলে যেতে থাকল পাহাড়ের ছবিটা।
রবার্ট ফরচুন, এবং ভালো জাতের চায়ের সন্ধানে তাঁর চিন অভিযান নিয়ে সারা রোজের যে আখ্যানের কথা বলেছি, তা মোটামুটি ফরচুন-লিখিত দুটি বইয়ের উপর নির্ভরশীল, ১৮৪৭-এর থ্রি ইয়ার্স ওয়ান্ডারিংস এবং ১৮৫২-র এ জার্নি টু দি টি কান্ট্রিস। রোজ লিখছিলেন জনচিত্তহর ঐতিহাসিক আখ্যান, যাকে আজকাল ন্যারেটিভ হিস্ট্রি বলে, ফলে লেখাটার মধ্যে রোমাঞ্চ তৈরি করার কিঞ্চিৎ ঝোঁক আছে; ফরচুনকে চিনে গিয়ে কী ভয়ঙ্কর সব বিপদের মধ্যে পড়তে হয়েছে, সেই গল্প বিস্তারিত বলা হয়েছে কিছু বেশি। ফরচুনের নিজের লেখা পড়তে গিয়ে দেখলাম, বিপদ-আপদ বা বিবিধ অসুবিধার বিষয়ে বলা আছে বটে, তবে পুরো কাহিনি তা নগণ্য অংশ।
বিপদ-আপদ অবশ্য হবারই কথা। চিনের মতো এত বড়ো একটা দেশ, সেখানকার পথঘাট লোকজন কিচ্ছু চেনা নয়, ভাষাও জানা নেই। জাহাজ যতদূর যায়, আফিংবেচা কোম্পানিসায়েবদের জ্ঞানের দৌড় সেই উপকূলবর্তী বন্দর শহরগুলো অবধি। ফলে কোথায় নদীপাহাড়, কোথায় সমুদ্র, কোথায় কী গাছপালা(এবং সবচাইতে যেটা জরুরি, কোথায় চা), এসব জানার জন্য ফরচুনকে নির্ভর করতে হয়েছিল হংকং, সাংহাই বা ক্যান্টনস্থিত ব্রিটিশ ব্যবসায়ী ও রাজপুরুষদের ওপর, কার্যত তাঁদের দিশি মুৎচ্ছুদ্দিদের ওপর। মুশকিল হচ্ছে, ফরচুনের মতে দিশি মানে চিনেদের ওপর ভরসা করা যায় না, এক তো তারা অবরেসবরে সত্যি বলে ভুল করে(মিথ্যে বলাটাই রেওয়াজ), দ্বিতীয়ত তাদের সময়জ্ঞানও নেই। তদুপরি, 'নিম্নশ্রেণীর' গরিবগুর্বো হোক, বা অভিজাত মান্দারিন, বেশিরভাগ চিনে যে স্বভাবধূর্ত ও প্যাঁচালো বুদ্ধির, সে কথা ফরচুনের লেখায় ফিরে আসছে বারবার। বিদেশি ফিরিঙ্গিদের সম্পর্কে চিনে অভিজাতদের সহজাত অবজ্ঞার কথাও। উপকূল ছেড়ে বেশি দূরে যাওয়ায় বিদেশিদের নিষেধও ছিল, সবেমাত্র যুদ্ধ শেষ হয়েছে এবং চিন সম্রাটকে অপমানজনক সন্ধিপত্রে সই করতে হয়েছে, ফলে চিনেদের সায়েবপ্রীতির কোনো কারণ ছিল না। সব মিলিয়ে, চিনের ভিতরে ভিতরে ঘুরে বেড়ানোর মতো পরিস্থিতি ছিলই না।
যাবতীয় প্রতিকূলতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ফরচুন খুব গোলমেলে দুই দিশি সঙ্গী নিয়ে ভিতর-চিনে ঢুকে পড়লেন। প্রথমবার খুব দূরে যাননি, নিংপো(এখনকার নিংবো, চিনে উচ্চারণে নি-পা) অঞ্চল বা চুসান(চিনে উচ্চারণে চু-সা) দ্বীপপুঞ্জ অবধি। সে যাত্রার জন্যও ফরচুনকে সায়েবপোষাক ছেড়ে মান্দারিনসুলভ চিনা বস্ত্রাদি ধারণ করতে হয়েছিল, মানে চিনে সাজতে হয়েছিল। তারপর তিন বছর ধরে যা যা হল, সেই গল্প ফরচুন অনায়াস দক্ষতায় পেশ করেছেন। সে গল্পে যত না রোমাঞ্চ, তদপেক্ষা অনেক বেশি ঈষৎ বাঁকা হাসি, সায়েবভাষ্যে যাকে বলা হয় রাই(wry) উইট, কখনো কখনো রোমান্টিক নিসর্গবর্ণন। বাকিটা বৈজ্ঞানিক, ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক কেজো কথাবার্তা, এবং চিনেদের নিয়ে নিছক রঙ্গব্যঙ্গ।
ঘোর চা-সৌখিন বাঙালিদের মধ্যেও কেউ রবার্ট ফরচুনের লেখা পড়েছেন কি? পড়ার কথা নয়, নিতান্তই বছর দশ আগে রোজের বইটা বেরুনোর আগে অবধি ফরচুনের নাম জানত কজন? সাম্রাজ্যবিস্তার, বেনিয়াগিরি ও আরো বহুবিধ কারণে দূর ও নিকট প্রাচ্যে, এবং রহস্যময় আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সায়েব ভ্রামণিকরা ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন কমবেশি তিন শতাব্দী ধরে, সেই সব ভ্রমণকাহিনির কিছু এখনো পঠিত, বেশিটাই হারিয়ে গেছে। ফরচুনের লেখাও হারানো গল্পের মধ্যেই পড়বে, যদিও গত দশ বছরে তাঁর লেখাপত্র কিছু আবার নতুন করে ছাপা হয়েছে, খোঁজ নিয়ে দেখা গেল(এছাড়া, বিশ্বজ্ঞানভান্ডার এক জায়গায় এনে ফেলবার গুগলিয় মতলব বদ প্রকাশকদের চক্রান্তে ব্যর্থ হয়েছে বটে, তবে কপিরাইটহীন পুরোনো বইটই--তন্মধ্যে ফরচুনের লেখা গুটি কয়েক বই-- গুগল কোম্পানির দয়ায় ইদানিং সহজলভ্য)। যাই হোক, চা, চিন ও অন্যান্য বিষয়ে ফরচুনের কিছু লেখার উল্লেখ না করলেই নয়।
আরও পড়ুন
দার্জিলিং এবং চিন: চায়ের রকমফের (দুই)
ফরচুনের প্রথম চিন যাত্রার প্রাকমুহূর্ত পর্যন্ত তামাম চা-খোর ও চা-ব্যাপারি পাশ্চাত্য বিশ্বের ধারণা ছিল, সবুজ চা ও কালো চা পাওয়া যায় দুটো আলাদা প্রজাতির গাছ থেকে, কালোটার নাম থিয়া বোহিয়া(চিনের বোহিয়া পার্বত্য অঞ্চল অনুসারে), সবুজটা থিয়া ভিরিদিস। নিংপোর সবুজ চা এলাকা ঘুরে দেখে ফরচুন মিন নদীতীরে ফু-চাও-ফু(হালের ফু-ঝাও) শহরের দিকে যাচ্ছেন, তাঁর নিশ্চিত ধারণা:
আরও পড়ুন
দার্জিলিং এবং চিন: চায়ের রকমফের (এক)
“...ফোকিয়েন(ফুকিয়েন, হালের ফু-জ্যান) রাজ্যের চায়ে ঢাকা পাহাড়গুলোয় যে থিয়া বোহিয়া বা অন্য জাতের গাছটা দেখতে পাওয়া যাবে এ বিষয়ে আমি নিঃসংশয় ছিলাম। কে না জানে থিয়া বোহিয়া গাছ থেকেই কালো চা পাওয়া যায়? তারপরে আবার যেখানে বোহিয়া পাহাড়ও, যেখান থেকে গাছের নামটা এসেছে, এই রাজ্যেই? কী আশ্চর্য, হাঁ করে শুধু দেখে যেতে হলো ফু-চাও-এর কাছাকাছি সব কটা পাহাড়েই অবিকল উত্তরের পাহাড়ের সেই গাছ। তাহলে দাঁড়াল গিয়ে কালো চায়ের জন্য খ্যাত পাহাড় সবুজ চায়ের বাগানে ভর্তি, কোত্থাও একটাও থিয়া বোহিয়া গাছের নামগন্ধ নেই। তদুপরি, যে সময়টায় আমি গিয়েছিলাম, নেটিভরা সবাই কালো চা তৈরিতে ব্যস্ত…
আরও পড়ুন
দার্জিলিং ও তার চায়ের গল্প (দুই)
সবুজ আর কালো, দু রকম চা-ই তাহলে একটাই গাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে।...তলিয়ে দেখলে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। তদুপরি, মনে রাখতে হবে আমাদের আগেকার ধারণাটা তৈরি হয়েছিল ক্যান্টনের চিনেদের কথা শুনে, যারা নিজেদের সুবিধামতো যা ইচ্ছা তাই বলে থাকে, যা বলছে সেটা সত্যি না মিথ্যে তা পরখ করার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করে না।
আরও পড়ুন
দার্জিলিং ও তার চায়ের গল্প (এক)
ফরচুন যে সময়ে চিনে গিয়েছিলেন, সেখানে চা-চাষ করতেন মুখ্যত ছোটো চাষিরা:
চা-খামারগুলো ছোটো ছোটো, এক একটার আয়তন চার-পাঁচ একরের মতো। সত্যি বলতে কী, প্রত্যেকটা কুঁড়ের সঙ্গে লাগোয়া নিজস্ব বাগান রয়েছে, যা উৎপাদন হয় তাই দিয়ে পরিবারের প্রয়োজন মেটে, যেটুকু উদ্বৃত্ত, তা বিক্রি করে দু চার ডলার আয় হয়। চিনে চাষ বলতে প্রায় সবটাই এরকম, তুলো, রেশম বা ধান, সবটাই চাষ হয় ছোট ছোট খামারে। চিনের ভিতরমহলে, নিজেদের ক্ষেতে একটা পুরো চিনা পরিবারের সবাই মিলে চা-পাতা তুলছে, বা অন্য কৃষিকাজ করছে, এর চাইতে সুখপ্রদ দৃশ্য আর কী হতে পারে! ওই যে বৃদ্ধটি, হয়তো কোন পিতামহ, অথবা প্ৰপিতামহ, মাতব্বরের মতো তাঁর বংশধরদের দিয়ে ক্ষেতের কাজ করাচ্ছেন। যারা কাজ করছে তারা হয় নবযুবক, নয় শিশু। সবার মাঝখানে বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে, বয়সের ভারে ন্যুব্জ, অথচ সবার কাছেই শ্রদ্ধার্হ, ভালোবাসার পাত্র…
সবুজ আর কালো, দু রকমের চা-ই একটাই চা-গাছ থেকে তৈরি হচ্ছে, এটা সম্যক বোঝার পর ফরচুনের মনে প্রশ্ন জাগল, ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে যে সবুজ চায়ের কদর, তার উজ্জ্বল সবুজ রংটা তাহলে আসছে কোত্থেকে? নিংপো অঞ্চলের সিকিয়াং-এ সবুজ চা তৈরির পুরো ব্যাপারটা খুঁটিয়ে দেখে ফরচুন ভাবলেন, এই চা তো সেই চা নয়, যা ইংল্যান্ডে রফতানি হয়। এখানকার চা-টা সবুজ, তবে কিছু ম্রিয়মাণ প্রাকৃতিক সবুজ, এতে সেই 'সুন্দর প্রভা' কোথায়? খোঁজখবর নিয়ে দেখা গেল, 'সুন্দর প্রভা'ময় সেই চা তৈরি হচ্ছে ক্যান্টনে, প্রুশিয় নীল ও জিপসাম মিশিয়ে তৈরি একটা রং লাগিয়ে। চিনারা কদাচ রং দেওয়া চা খায় না। তবে রং দেওয়া হয় কেন? না, 'বিদেশি বর্বরকূল"কে খুশি করতে, চকচকে সবুজ না হলে তাদের পছন্দ হয় না। চিন নিয়ে ফরচুনের দু নম্বর বই, এ জার্নি টু দি টি কান্ট্রিজ-এ চায়ে রং মেশানোর পদ্ধতিপ্রকরণ নিয়ে বিস্তারিত বলা আছে।
১৮৪৬ নাগাদ, চিন থেকে ব্রিটেনে রফতানি হচ্ছে প্রায় ৬ কোটি পাউন্ড চা, সবুজ-কালো মিলিয়ে। আমেরিকায় যাচ্ছে দু কোটির মতো। ইউরোপে যাচ্ছে পাঁচ লক্ষের কাছাকাছি। এছাড়া, ব্রিটেন থেকে অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছে ৪০ লক্ষ পাউন্ড, রাশিয়ায় ৫০ লক্ষ। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে, সিয়াম, বর্নিও ও চিন সাগরের অন্যত্র যে বিপুল পরিমাণ চা চিনে জাহাজে চড়ে পৌঁছোয়। চিনেরা নিজেরাও প্রভূত চা খেয়ে থাকে:
“একজন চিনেম্যান জল খায় কালেভদ্রে: তেষ্টা পেলে সে চা খায়, দিনের সব খাবারের সঙ্গেও চা খাওয়া হয়। ইংল্যান্ডের যেমন প্রচুর সরাইখানা আর বিয়ারদোকান, এখানে তেমনই চা বিক্রির জায়গা...প্রত্যেক শহরের প্রত্যেক রাস্তা আর গলিতে চা-ঘর, দিনের কিছু কিছু সময়ে সেগুলো ভর্তি হয়ে থাকে চিনে খদ্দেরে। শুধু শহর কেন, গ্রাম্য পথের পাশে, পাহাড় ডিঙিয়ে যাওয়া গিরিপথে, বৌদ্ধ মন্দিরে, এমনকি দেশের প্রত্যন্ততম অঞ্চলেও, তৈরি করা চা বিক্রির জন্য রাশি রাশি চা-ঘর। এক কাপ চায়ের দাম এক, বড়জোর দু 'পয়সা'(ফরচুন লিখেছেন 'ক্যাশ')। একশো পয়সা মানে মাত্র সাড়ে চার পেনি, এটা মনে রাখলে বোঝা যায় আমাদের টাকায় এক ফারদিঙ খরচা করে একজন চিনা চাষি কাপ চারেক তার পছন্দসই চা খেয়ে ফেলতে পারে...”
চিনের মোট চা-খোর জনসংখ্যার আন্দাজি হিসেব করে ফরচুন দেখেছিলেন, ৩০ কোটি মানুষ যদি বছরে ৬ পাউন্ড করে চা খায়, তাহলে এক চিন দেশেই চা লাগছে ১৮০ কোটি পাউন্ড! এর সঙ্গে যোগ করতে হবে সাড়ে ন কোটি পাউন্ড রফতানি। সব মিলিয়ে ১৯০ কোটির মতো। ফরচুনের বক্তব্য ছিল, চিনের নিজস্ব যে প্রয়োজন, তার তুলনায় বর্হিবাণিজ্য বা রফতানি নগণ্য, যুরোপের বাজারে চিনা চায়ের চাহিদা কমলেও খুব একটা কিছু আসবে যাবে না। অন্যদিকে, চাহিদা যদি বেড়েও যায়, যে সব পাহাড়ে এখন ঝাঁটিজঙ্গল আর বাঁশ, সেখানে অনায়াসে চা চাষ শুরু করে দেওয়া যাবে, চা-চাষের মোট এলাকাও সেইমতো বাড়বে, ফলে উৎপাদনও।
এই অবধি বলে ফরচুন নজর দিচ্ছেন ভারতবর্ষে, হিমালয়ে। ফরচুনের প্রথম বইটা নিয়েই কথা হচ্ছিল, যা প্রকাশিত হচ্ছে ১৮৪৭এ। ভারত বলতে তখন কোম্পানিভারত, সেখানে হিমালয় বলতে মূলত পশ্চিম হিমালয়, অর্থাৎ গাড়োয়াল-কুমাউ বা পাঞ্জাব। চিনে ঘোরাঘুরি করে ফরচুন বুঝতে পেরেছিলেন ভালো জাতের কালো চা পেতে হলে তা লাগাতে হবে এমন পাহাড়ে, সমুদ্রতল থেকে যা অন্তত দু-তিন হাজার ফুট উঁচু। চিনে যে ধরণের জলহাওয়া, মাটি, উঁচু পাহাড় ইত্যাদি মওজুদ, ভারতের হিমালয়েও তাই। সাহারানপুরের যে বিখ্যাত কোম্পানিবাগান, ১৮৩১এ সেখানকার অধ্যক্ষ থাকাকালীন উদ্ভিদবিৎ ড: রয়্যালের সুপারিশ ছিল, কুমাউ, গাড়োয়াল এবং সিরমোর-এ চা-চাষ শুরু করা হোক। তাঁর বক্তব্য উদ্ধৃত করে ফরচুন বলছেন, রয়্যালের ধারণা ছিলো একদিন এই পাহাড় এলাকার পুরোটা জুড়েই চায়ের চাষ হবে, সেই চা স্বাদেগন্ধে দিশি অহমিয়া চায়ের চাইতে বহুগুণ ভালোও হবে। সেইমতো, ১৮৩৬ নাগাদ, ফ্যালকনার সাহেবের তত্ত্বাবধানে আলমোড়া ও দেরাদুন অঞ্চলে চা-চাষ শুরু হয়। এজন্য চিনের ক্যান্টনের কাছাকাছি অ্যানকয় জেলা থেকে বীজ আনানো হয়, আসামে জনকয়েক চিনা চা-করিয়েদের আগেই নিয়ে আসা হয়েছিল, তাঁদেরও নিয়ে আসা হল। ফ্যালকনার বদলি হয়ে কলকাতার বাগানে গেলেন, তাঁর জায়গায় এলেন ড: জেমিসন। তাঁর তদারকিতে হিমালয় পাহাড়ে ভারতীয় চা বাড়তে থাকল। বছর কয় পরে(সম্ভবত ১৮৪৬-এ), সেই চা পরম যত্নে মোড়কবন্দি করে কোম্পানির তরফে পাঠানো হল লন্ডনের অভিজ্ঞতম চা-ব্যবসায়ীদের কাছে। তাঁরা সব্বাই একবাক্যে বললেন, হিমালয়ের চা শুধু ভালো নয়, খুব ভালো, ইউরোপের বাজারে চিনা চায়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামার উপযুক্ত।
চায়ের চাষে কোম্পানি যাকে বলে 'শরীরের শেষ রক্তবিন্দু ঢেলে' ঝাঁপাতে চাইছিল। ১৮৪৭-এ ভারতের লাট লার্ড হার্ডিঞ্জ। কোম্পানির পরিচালক সমিতির চাঁইদের কাছে চিঠি লিখে তিনি বলছেন, ইউরোপের বাজারে ভারতীয় চা চিনা চায়ের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দেবে, ইংল্যান্ডকে কে এত দরকারি একটা জিনিসের জন্য অন্য দেশের উপর উপায়হীন ভাবে নির্ভর হয়ে থাকতে হচ্ছে, এই অবস্থাটাও বদলাবে।
রোজ বলছেন, বদলাতেই হত। বিশ্ববাজারে চিনা চায়ের(শুধু চা কেন, যাবতীয় চিনা ব্যবসাতেই)রফতানিতে কোম্পানির একচেটিয়া দখল অনেকদিন অবধি ছিল বটে, কিন্তু ভারতীয় ব্যবসার উপর তাদের একচেটিয়া দখলদারি আইনত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ১৯১৩তেই। কোম্পানির একচেটিয়া চিনা ব্যাপার নিষিদ্ধ হল ১৮৩৪-এ, ব্রিটিশ সংসদে নতুন আইন এনে। মুক্ত বাণিজ্যের সমর্থকেরা কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করছিলেন, অর্থনীতিবিদ য়্যাডাম স্মিথ তাঁদের পুরোধা ছিলেন। ফলে, কোম্পানি চোখে সর্ষেফুল দেখছিল। চিনের ব্যবসায় একচেটিয়া দখল গেছে, আফিং-যুদ্ধে জয়ের পর রাজনৈতিক অবস্থাটা খানিক শুধরেছে বটে, কিন্ত চিনেরা কখন কী করে বলা কঠিন। এমতাবস্থায়, ভারতে যদি প্রচুর পরিমাণে চা তৈরি করা যায়, চায়ের ব্যবসাটা পুরো কোম্পানির হাতে চলে আসবে। ১৮৪৬-এ, হার্ডিঞ্জ অর্থাৎ কোম্পানির চা-বাগান ছিলো মাত্র ৬০০ একরে। কিন্তু আরো এক লাখ একর তৈরি করে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে যা চা হবে, তা বেচে কোম্পানির ঘরে বছরে কমপক্ষে ৪০ লাখ টাকা(একালের হিসেবে প্রায় ৫০০ কোটি পাউন্ড স্টার্লিং, বা ৫০০০০ কোটি টাকা) উঠবে।
উঠবে তো বটে, তবে কী করে? ভারতে যে চাষ হচ্ছে তা শ্রেষ্ঠ জাতের চিনা চায়ের নয়, হিমালয়ের চা ভালো হলেও সে চায়ের সে অনুপম গন্ধ নেই, যা একমাত্র শ্রেষ্ঠ বোহিয়া চায়েই পাওয়া যায়। সেই চায়ের হাজার হাজার বীজ যদি ভারতে এনে ফেলা যায় কোনোক্রমে? বোহিয়া পাহাড়ের চা যদি হিমালয়ের ঢালে জন্মায়? কী করে তা সম্ভব হতে পারে? কি করে আনা যাবে অত বীজ? এক যদি না... আবার...
ফরচুনের শরণাপন্ন হলেন কোম্পানির লোকজন।
Powered by Froala Editor