সময়ভ্রমণ - ৩৯
আগের পর্বে
চিনে চা চাষের গোড়ার কথা জানা যায় লিউ য়ু-র বই থেকে। সে ইতিহাস খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৭৭ সাল আগে পর্যন্ত বিস্তৃত। চিনে তখন সম্রাট সেনঙ-এর রাজত্ব। চা চাষের সঙ্গে ইতিহাসের পাশাপাশি জড়িয়ে আছে দর্শনও। এমনকি চা তৈরির পাত্রে আঁকা থাকে নানা ধরণের ছবি। তার মধ্যে আছে ফিনিক্স, বাঘ বা মাছের ছবিও। এই সবই প্রকৃতি ও মানুষের নিবিড় সম্পর্কের প্রতীক। চা চাষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও নানা ধরণের গল্প। সারা রোজ তাঁর বইয়ে লিখেছেন চায়ের গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে গৌতম বুদ্ধের কাহিনিও। তাঁর ভ্রূ থেকেই নাকি জন্ম নিয়েছিল চা গাছ। রবার্ট ফরচুন সেই গাছ শিকার করতে পৌঁছে গেলেন চিনে।
রবার্ট ফরচুন যখন প্রথমবার গাছ-শিকারি হিসেবে চিনে যাচ্ছেন, চা সম্পর্কে যে তাঁর আদৌ বড় একটা ধারণা ছিল, ভাববার কারণ নেই। চিন সম্বন্ধে যে ছিল, এমনও নয়। তবে চা বা চিন চিনুন না চিনুন, গাছ ব্যাপারটা ফরচুন বুঝতেন। প্রথানুগ উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাননি, ইস্কুলের পাঠ গ্রামের পাঠশালা ছাড়িয়ে এগোয়নি। ক্ষেতমজুর বাবার সন্তান রবার্ট পরের জীবনে যা শিখেছেন, জেনেছেন, নিজের চেষ্টায়। প্রথমে এডিনবরার বটানিক্সে, পরে চিসউইকের রাজকীয় পুষ্পচর্চা সমিতির(রয়্যাল হর্টিকালচারাল সোসাইটি) বাগানে ফরচুন কৃতিত্ব ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন বেশ কিছু বছর।
হর্টিকালচার বা পুষ্প/উদ্যান চর্চার জগতে ফরচুনের খ্যাতি দ্রুত ছড়াতে থাকে। রালগ ভিকটোরিয়ার রাজত্বকাল, উনিশ শতকের মাঝামাঝি, ব্রিটেনের সাম্রাজ্য এক দেশ থেকে অন্য মহাদেশে বিস্তৃত হচ্ছে, চেনা ও অচেনা পৃথিবীর দূরতম প্রান্ত থেকে রাজকীয় পুষ্পোদ্যানে ক্রমাগত এসে পৌঁছোচ্ছে নতুন নতুন ফুলের গাছ আর বীজ, বিরল বন্য অর্কিড, সুরম্য ফার্ন। সেই সব গাছ আর বীজ যত্নে ভিন্ন মাটিতে পোঁতা, অন্য জলহাওয়ায় তাদের বাঁচিয়ে রাখা, শ্রেণিবিন্যাস ও তালিকা তৈরি করা, কাজের অন্ত নেই। দ্রুত সব কাজ শিখে নিলেন ফরচুন, রীতিমতো বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলেন। সেসময়ে চিকিৎসাবিদ্যায় প্রথাগত শিক্ষা না থাকলে কাউকেই উদ্ভিদবিৎ হিসাবে গণ্য করা হত না, ফরচুনের কপালে জুটলো স্রেফ পুষ্পচর্চা বিষয়ক একটি শংসাপত্র বা সার্টিফিকেট। অথচ উচ্চাভিলাষী তরুণ ফরচুন চাইছিলেন উদ্ভিদবিৎ, বিশেষজ্ঞ হিসেবে গণ্য হতে। শিক্ষা অর্থাৎ ডিগ্রি নেই, কি করে তা সম্ভব? এক যদি না দেশ ছেড়ে বেরুনো যায়, খুঁজে না বার করা যায় নতুন সব গাছ আর ফুল? সেসময়ে স্কটদেশে অথবা ইংল্যান্ডে এটাই রেওয়াজ ছিল, দেশের ভিতরে যাঁদের বিশেষ কিছু হবার নেই, তাঁরা সাগরপাড়ি দিয়ে বিভিন্ন উপনিবেশে পৌঁছোতেন। তবে, বললেই তো যাওয়া যায় না। ঠান্ডা, ভেজা ব্রিটেন এবং প্রান্তিক ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোর মধ্যে দুস্তর সমুদ্র, ঝড়, জলদস্যু, জ্বরজারি। তারপরে, কোনোক্রমে গিয়েও যদি বা পড়া যায়, তাহলেই বা কি হবে? কাজ না করলে পেট চলবে না, কিন্তু কাজ আসবে কোত্থেকে?
দেশের বাইরে যাবার, কাজ করবার এবং বিখ্যাত হবার সুযোগ ফরচুনের কাছে বাড়ি বয়ে এসে উপস্থিত হল। ১৮৪২ সাল, প্রথম আফিংযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে, কোম্পানির হাতে অতিরিক্ত কিছু শহর এসেছে বটে, কিন্তু সেগুলো সব উপকূলবর্তী, চিনের ভিতরটা তখনো বিদেশিদের কাছে নিষিদ্ধ, অগম্য। ঠিক সেই নিষিদ্ধ অঞ্চলে নয়, উপকূলের কাছাকাছি যে চিন, সেখান থেকে নতুন গাছপালা সংগ্রহ করে আনার জন্য ফরচুনকে পাঠানো মনস্থ করল রাজকীয় পুষ্প সমিতি। ফরচুন জন্মে দেশের বাইরে পা রাখেননি, চিন তো অনেক দূরের ব্যাপার। সেকালের নিয়মমাফিক, আরো দশটি এ জাতীয় সমিতি ইত্যাদির মতো, পুষ্প সমিতি বা হর্টিকালচারাল সোসাইটি ভদ্র ও অভিজাতবংশীয়দের খাসতালুক, সেখানে ফরচুনের মতো কারুর ঠাঁই হবার কথা নয়। এতদসত্বেও, ফরচুনকেই চিন পাঠানো ঠিক হল। বছরে একশো পাউন্ড(একালের হিসাবে, প্রায় সাত-সাড়ে সাত লক্ষ টাকা) মজুরিতে তিন বছরের কড়ারে(এর মধ্যে মাইনে বাড়বে না) ফরচুন কাজে লাগলেন। কাজের দায়িত্ব ও বিপদ ইত্যাদির কথা মাথায় রাখলে, টাকার পরিমাণটা তেমন কিছু নয়, বরং কমই। মাইনে বাড়ানোর আর্জি সমিতিকর্তারা নাকচ করলেন, এই বলে যে এত বড় একটা অভিযানের ক্ষেত্রে টাকাপয়সার বিষয়টা তুচ্ছ। 'ভাবো একবার তোমার নামডাক মানমর্যাদা কত বেড়ে যাবে, অন্য কোন ভাবে এটা হতই না', ফরচুনকে জানানো হল।
ফরচুন না ভদ্দরলোক না বিষয়সম্পত্তির মালিক, তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবার মতো অন্য কিছুই দেওয়া হল না, যথা বন্দুক পিস্তল টোটা বারুদ। সমিতিকর্তারা বললেন, কাজ তো গাছ আনা, বন্দুক দিয়ে কী হবে? ফরচুন বললেন, গাছের জন্য নয়, নিজের জীবন রক্ষার্থে তিনি বন্দুক পিস্তল চাইছেন। অনেক টালবাহানার পর, বন্দুক মঞ্জুর হল।
আরও পড়ুন
দার্জিলিং এবং চিন: চায়ের রকমফের (এক)
প্রথম যাত্রায় ফরচুন চিনে কাটান তিন বছর। অসংখ্য সুন্দর সুগন্ধি ফুল যোগাড় করে দেশে পাঠাতে থাকেন : শীতে ফোটা জ্যাসমিন, পাখার মতো ছড়িয়ে পড়া চিনা পাম, সবুজ পাতা আর ছোট সাদা পাঁপড়ির ভিতরে রক্তলাল ব্লিডিং হার্ট, সাদা উইস্টেরিয়া, এক ধরণের লাইল্যাক, 'একের মধ্যে দুই' হলুদ গোলাপ, যা যোগাড় করতে এক মান্দারিনের বাগানের ১৫ ফুট উঁচু দেওয়াল ফরচুনকে ডিঙোতে হয়েছিল। ফুল ছাড়াও ফলের গাছও নানারকম, তন্মধ্যে ছোট কমলালেবু কুমকুয়াত, সাইট্রাস ফরচুনেলা। মান্দারিন অরেঞ্জ বলে কমলালেবুর অন্য যে জাতটা বিখ্যাত, ফরচুন না নিয়ে এলেও সেটাও যুরোপে পৌঁছোয় চিন থেকে। কুমকুয়াতের সঙ্গে মান্দারিন এবং আরো দু তিন জাতের লেবুর মেলবন্ধনে যে বহুরকম লেবু তৈরি হয়েছে গত দেড়-দুশো বছরে, তাদের সবাইকেই এখন ফরচুনেলা গোত্রে ফেলা হয়। যদিও তাঁর আবিষ্কৃত অসংখ্য গাছের বৈজ্ঞানিক নামে ফরচুনের নাম জড়িয়ে যায়, ফরচুন অমরত্ব লাভ করেন লেবুতেই--ফরচুনেলা নামটা অদ্যাবধি চালু। দার্জিলিং পাহাড়ে যে ছোটো কমলালেবুর চাষ হয়, তার কতটা ফরচুনের আনা লেবু থেকে, তা অবশ্য বলা মুশকিল।
আরও পড়ুন
দার্জিলিং ও তার চায়ের গল্প (দুই)
প্রথম চিন ভ্রমণের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে ফরচুন যে বইটা লেখেন, তার নাম থ্রি ইয়ার্স ওয়ান্ডারিংস ইন দি নর্দার্ন প্রভিন্সেস অব চায়না, বা চিনের উত্তর প্রদেশসমূহে তিন বছরের ঘোরাঘুরি। ১৮৪৭ সালে এই বই প্রকাশের পর থেকেই আবিষ্কারক, অভিযাত্রী ও সুলেখক হিসেবে ফরচুনের খ্যাতি বাড়তে থাকে। বইটাও জনপ্রিয় হয়। দ্বিতীয় চিন যাত্রার পর ফরচুন সে ভ্রমণবৃত্তান্ত নিয়ে আর একটা বই লেখেন, যার সংক্ষিপ্ত নাম এ জার্নি টু দি টি কান্ট্রিস অব চায়না, বা চিনের চা-দেশে যাত্রা। এই বই প্রকাশিত হয় ১৮৫২-য়। ফরচুন তৃতীয়বার চিনে ফেরেন সেই বছরই। ১৮৫২ থেকে ১৮৫৬ অবধি চিনে বসবাস ও ভ্রমণ নিয়ে ফরচুন লিখিত তৃতীয় চিন বিষয়ক গ্রন্থ, সংক্ষেপে, এ রেসিডেন্স য়্যামঙ্গ দি চাইনিজ, বা চিনেদের মধ্যে বাস, প্রকাশিত হচ্ছে ১৮৫৭ সালে। ১৮৫৬ থেকে শুরু হচ্ছে দ্বিতীয় অহিফেন যুদ্ধ, চলবে ১৮৬০ পর্যন্ত। প্রথম যুদ্ধ ছিল চিন আর ব্রিটিশদের মধ্যে। দ্বিতীয় যুদ্ধে ব্রিটিশদের সঙ্গী ফ্রান্স, পরের দিকে আমেরিকা। প্রথম যুদ্ধের সময়কালে কোম্পানি আফিং বেচে চা কিনত। ১৮৫৬-য় হিমালয়ের একাধিক জায়গায়, এবং দার্জিলিং-এ, ফরচুনের আনা চিনা চায়ের চাষ শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে। ফলে চায়ের জন্য নয়, নিছক আফিং বেচা ও সাম্রাজ্যবিস্তারের উদ্দেশ্য নিয়েই দ্বিতীয় যুদ্ধটা চালানো হল। সামরিক শক্তিতে দুর্বল চিন যুদ্ধে হেরে যাবার পর, রীতিমতো লেখাপড়া সইসাবুদ করে আফিং ব্যবসাকে আইনসম্মত ঘোষণা করা হল। চিনের একাধিক উপকূলবর্তী অংশে কায়েম হলো পাকাপাকি সায়েবরাজত্ব।
আরও পড়ুন
দার্জিলিং ও তার চায়ের গল্প (এক)
চিন নিয়ে ফরচুনের লেখাগুলো সুখপাঠ্য, ফরচুন লিখতে জানতেন। তবে, আজকের 'উত্তর-ঔপনিবেশিক' সময়ে এই সব লেখা পড়তে বসে ভোলা সম্ভব নয় লেখক সাধারণ ভ্রমনার্থি হয়ে চিনে জাননি, প্রথমাবধি তাঁর ভূমিকা অনুগত সাম্রাজ্যসেবকের। চিনের মহনীয় পর্বতমমালায়, বিশাল বিস্তৃত নদী উপত্যকা ও গ্রামশহরে ঘুরে ঘুরে যে সব গাছগাছড়া ফরচুন এবং তাঁর মতো গাছ-শিকারিরা সংগ্রহ করেছেন, তা আগাগোড়া পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে, প্রয়োজনে। চিনের অনেক কিছুই ফরচুনের পছন্দ হয়েছিলো: সাধারণ মানুষের সরলতা, অভিজাতবংশীয়দের সম্ভ্রম-উদ্রেককারী আচারআচরণ, উজ্জ্বল ও নরম চোখ-ধাঁধানো রেশমবস্ত্র, চিনামাটির তৈরি বিবিধ ও অনুপম সরঞ্জাম, জেডপাথরের আশ্চর্য সব মূর্তি, যত্নে গড়া সাজানো বাগান, প্রাচীন স্থাপত্য, মনোহর প্রাকৃতিক নিসর্গ, এবং সর্বোপরি, চা। এতদসত্বেও চিনা সভ্যতাকে তিনি পশ্চিমি সভ্যতার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর মনে করেননি। বরং উল্টোটা--চিনাদের বলা হচ্ছে আধা-সভ্য, তাদের শ্রেষ্ঠ সময় তারা অতীতে ফেলে এসেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প ও সমরে শ্রেষ্ঠতর, অনেক বেশি এগিয়ে, পাশ্চাত্য অর্থাৎ পশ্চিম, তারা যেখানে যা-ই করুক, ন্যায্য, সে অন্যায় আফিং ব্যবসা হোক, বা যুদ্ধের বাহানায় পরদেশ দখলের নির্লজ্জ চেষ্টা। ফরচুনের লেখা পড়তে পড়তে মনে হল, তাঁর প্রথম চিন ভ্রমণের সময় থেকে প্রায় দুশো বছর অতিক্রান্ত। সায়েবরাজত্বকাল শেষ হয়েছে, চিন হোক বা ভারত, এককালের উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশগুলো এখন আপাত সার্বভৌম, স্বাধীন। অথচ বিশেষ কিছুই বদলায়নি; সাম্রাজ্যের ভূগোল-অর্থনীতিতে হয়তো কিছু হেরফের ঘটেছে, উপনিবেশ তৈরি করার পদ্ধতি খানিক অন্যরকম হয়েছে। বাকিটা, অর্থাৎ ন্যায়-অন্যায়, সভ্য-অসভ্যের সেই পুরোনো দুর্গন্ধ দ্বিত্ব, একই থিকথিকে ঘনত্বে প্রবহমান। পুরোনো হোক বা নতুন, ভ্রমণকথা পড়তে আজকাল সেকারণে ভয় লাগে। লাগলেও, পড়তেই হয়। পুরোনো নতুন অনেক গল্প জানা হয় না নাহলে।
আরও পড়ুন
দার্জিলিং-এর গপ্পোগাছা - হুকার, ক্যাম্পবেল ও পাগলা দেওয়ান
চিনে তাঁর প্রথম যাত্রায়, ফরচুন অবাক ও মুগ্ধ হয়ে নিসর্গ শোভা দেখছেন। ১৮৪৪ সালের মে মাস, সাংহাইস্থিত ব্রিটিশ কনসাল শ্রী থম ও আরো দুই সঙ্গী সমভিব্যাহারে, ফরচুন সবুজ চায়ের জন্য খ্যাত নিংপো জেলার দিকে যাচ্ছেন। তিন তুং(তিন মানে স্বর্গ, এবং তুং হচ্ছে বালক, দুইয়ে মিলে তিন তুং, বা স্বর্গীয় বালকদিগের মন্দির) নামে এক প্রসিদ্ধ মন্দিরে রাত্রিবাস করার কথা, নদীপথ ছেড়ে, বাঁশের ডান্ডায় ঝোলানো কাঠের টুকরো দিয়ে বানানো চেয়ারে বসে পাহাড় চড়ে সেখানে পৌঁছতে হয়। গোটা পথ তুমুল বৃষ্টি, সবাই ভিজে একসা, যেতে যেতে রাত হল। মন্দিরের পুরোহিতরা আতিথ্যে ত্রুটি রাখলেন না, ভেজা কাপড় শুকোনোর জন্য আগুন এল, গরম খাবার সেই সঙ্গে। শোবার জন্য শ্রেষ্ঠ ঘরের ব্যবস্থা করা হল। সকালে উঠে চারপাশের দৃশ্য থেকে চোখ জুড়িয়ে গেল সবার :
‘পাহাড়ের একেবারে বুকের মধ্যে উর্বরা উপত্যকা, তার মাথার দিকে মন্দির। পাহাড় থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ জলধারায় পুষ্ট ধান্যক্ষেত্র। সমস্ত পাহাড়ের নিচের অংশে ছড়িয়ে আছে চায়ের ঘন সবুজ ঝোপ। মন্দিরে আসার দীর্ঘ পথের দুদিকে চিনা পাইন গাছের সারি।...মন্দিরের দুধারে আর পিছনে, হাজার-দু হাজার ফুট উঁচু গিরিশিরার জটলা...পাহাড়গুলোর চুড়ো অবধি বিভিন্ন ঝোপঝাড় আর গাছের ঠাসবুনোট ক্রান্তীয় জঙ্গল।...পাহাড়ি খাদে চিনদেশের সবচাইতে ভালো বাঁশগাছ জন্মায়, পাহাড়ের গায়ে, ঘনরঙের সব বিপুলদেহী পাইনগাছ। এখানেই দেখতে পাওয়া গেল নতুন ধরনের খুব সুন্দর এক জাতের ফার গাছ(ক্রিপ্টোমেরিয়া জাপোনিকা), তার বীজ চারা সংগ্রহ করাও হল। চিসউইকের পুষ্পোদ্যানে সে সব গাছ এখন বাড়ছে।’
থমকে দাঁড়াতেই হল। ক্রিপ্টোমেরিয়া জাপোনিকা, অর্থাৎ আমাদের খুব চেনা ধুপি, দার্জিলিং ও সিকিম হিমালয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যা লাগানো হয়েছে? সে গাছ কি রবার্ট ফরচুন মারফত দার্জিলিং-এ পৌঁছেছিল তাহলে? বনজঙ্গল বনের ইতিহাস এসব নিয়ে অনেকদিনের নাড়াঘাটা, জানা ছিল দার্জিলিং অঞ্চলে ধুপির নিয়মবদ্ধ বাগিচা প্রথম শুরু হয় আঠেরোশো ছেষট্টিতে, কার্সিয়াঙের ধুপিঝোরায়। গাছটা সায়েবি দার্জিলিং-এ এসে গিয়েছিলো আঠেরোশো পয়তাল্লিশেই। এই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে বাংলার বনজঙ্গল নিয়ে সরকারি দস্তাবেজের আদিতম সংগ্রহের একটি থেকে--স্লিচ সাহেবের(স্লিচ বলতে সর উইলিয়ম স্লিচ, যিনি তখন অবিভক্ত বাংলার--বাংলা বিহার আসাম উড়িষ্যা মিলিয়ে সেকালের 'বেঙ্গল' --দায়িত্বপ্রাপ্ত বনপাল) লেখা ও সংকলন করা রেভেন্যু রিপোর্ট অব ফরেস্ট য়্যাডমিনিষ্ট্রেশন অব বেঙ্গল, ১৮৭২-৭৩, থেকে। কোন গল্প কোথায় এসে যায়, কোথাকার ইতিহাস ভূগোল কোথায় গিয়ে পড়ে। ১৮৪৩ সালে ফরচুন ক্রিপ্টোমেরিয়া জাপোনিকার চারা বীজ সংগ্রহ করছেন চিনের নিংপো প্রদেশ থেকে। সে চারা বীজ ইংল্যান্ডের চিসউইক পুষ্পোদ্যানে এসে পৌঁছচ্ছে সম্ভবত ১৮৪৫ নাগাদ। সেই বছরেই যদি দার্জিলিংয়ে সে গাছ এসে পৌঁছোয়, ধরে নিতেই হয় তা সোজাসুজি হংকং থেকে কলকাতার গঙ্গাপাড়ের বটানিক্সে পাঠানো হয়েছিল। খুঁজে দেখলাম, এডিনবরার রাজকীয় উদ্ভিদ উদ্যানের ওয়েবসাইটে সে কথাই বলা আছে। কলকাতার বাগান সে সময় ওয়ালিচের তত্ত্বাবধানে। পাহাড় অঞ্চলের গাছ পাহাড়ে ভালো হবে এই বিবেচনাতেই নিশ্চয় দার্জিলিংয়ে পাঠানো হয়েছিল ধুপির চারাবীজ। সেখানে নিশ্চয় ক্যাম্পবেল তার বাগানে সে গাছ লাগিয়েছিলেন, যেমনভাবে তার আগেপরে চা-ও লাগিয়েছিলেন। ১৮৪৮-এ, হুকার দার্জিলিং অঞ্চলে ঘুরছেন, অসংখ্য গাছের কথা উল্লেখ করছেন, লেবঙে ও ক্যাম্পবেলের নিজের বাগানে লাগানো চা গাছের কথাও। ফরচুন বা ক্রিপ্টোমেরিয়া জাপোনিকার নাম হুকারের আখ্যানে নেই, হয়তো অজস্র গাছের ভিড়ে তা হারিয়ে গিয়েছিল, চোখে পড়েনি। ভবিষ্যতে পাহাড়ের বেশির ভাগ জায়গায় ধুপি ছাড়া যে অন্য গাছ আর থাকবেই না, কে জানত তখন?
চিন থেকে রবার্ট ফরচুন চা নিয়ে এলেন, ধুপিও। সেই চা আর ধুপির আবাদ করার জন্য দার্জিলিং পাহাড়ের প্রায় সমস্ত পুরোনো বন কেটে পুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলা হল। বাগিচায় কাজ করার জন্য অন্য জায়গা থেকে কুলি নিয়ে আসা হল, যেমন সিঙ্কোনার ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। সস্তা শ্রম, দখলদারি, মুনাফা বাড়ানো ও উপনিবেশের আপাত অপ্রতিরোধ্য রাজনৈতিক অর্থনীতির তলায় চাপা পড়লো পুরোনো পাহাড়।
পড়ছি, বেড়াচ্ছি, ভাবছি, সবটাই শাসনের স্থাপত্য, শোষণের নির্মাণ। ভূগোল ইতিহাস প্রকৃতি মানুষ, এসবের দেশান্তরন ঘটছে নাগরদোলার অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে, এত দ্রুত যে মাথা ভোঁ ভোঁ করে, সব গুলিয়ে যায়। যে গল্পটার মধ্যে এখন আমরা আছি, সেটার কথাই ধরা যাক। আফিং আর চায়ের ব্যবসা করবে বলে কোম্পানিসায়েবরা চিনে গিয়ে হুড়োযুদ্ধ বাঁধাল, ভারতবর্ষে এসে পুরোনো ভূগোল ইতিহাস ভেঙেচুরে তছনছ করে দিল। স্কটিশ শ্রমজীবী পরিবারের সন্তান ফরচুন চিনে গেলেন, তাঁর আনা চা ও ধুপি গাছ ছেয়ে ফেলল বহুদূরের সিকিম/দার্জিলিং পাহাড়। আরো দূর আন্দিজ পর্বত থেকে এলো সিঙ্কোনা। ক্যাম্পবেল ও সিঙ্কোনা চাষের ভারপ্রাপ্ত অ্যান্ডারসন, যিনি বাংলার প্রথম বনপালও বটে, দুজনেই স্কটিশ। অ্যান্ডারসনের পর বাংলার বনপাল হচ্ছেন স্লিচ, তিনি আসছেন জর্মনি থেকে। দার্জিলিংয়ের প্রথম প্ল্যান্টারদের মধ্যে আছেন ওয়েরনিকে-স্টোলকে পরিবার, মরাভিয়ান মিশনারীদের বংশধর। পৃথিবীটা যেন বিশাল একটা কড়াই, সেখানে মানুষ না-মানুষ দেবতা দৈত্য পাহাড় বন নদী সাগর সব একসঙ্গে মেখে ঝাঁকানো, নাড়া হচ্ছে। কতদিন হয়ে গেল, ঝাঁকানো নাড়ানো বন্ধ হল না।
Powered by Froala Editor