সময়ভ্রমণ - ৩৮
আগের পর্বে
এইচ এম কক্স বলেছিলেন দার্জিলিং-এ এখন যেসমস্ত গাছ দেখা যায়, সেগুলির বীজ আসাম থেকে আনা। অবশ্য রবার্ট ফরচুনের হাত ধরে যে উৎকৃষ্ট চৈনিক চায়ের চাষ শুরু হয়েছিল, তাই দার্জিলিং-এর ইতিহাস। ১৮৫২-৫৩ সাল নাগাদ ফরচুন এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এর আগেই ক্যাম্পবেল চা বাগান তৈরি শুরু করেছিলেন। তাঁর উদ্যোগে এক দশকে বেশ কিছু নিম্ন প্রজাতির চৈনিক চা এবং আসাম থেকে আনা চারা রোপন করা হয়। ১৮৫৩-৭২ সালের মধ্যে পাহাড় ও তরাইয়ে ১০০-র বেশি বাগান তৈরি হয়। তবে দার্জিলিং চায়ের অধিকাংশই সঙ্কর প্রজাতির। তার মাঝে মাঝে কিছু পুরনো চৈনিক প্রজাতির গাছ এখনও থেকে গিয়েছে। হয়তো বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়েছে তাদের পাতা উৎপাদনের ক্ষমতা।
লিউ য়ু-র বইয়ের কথা বলেছি। লিউ য়ু অষ্টম খ্রিষ্টাব্দের মানুষ। চায়ের যে ইতিহাস তাঁর বইয়ের অন্যতম উপজীব্য, তা দূর অতীতের রহস্যাচ্ছন্ন গভীরে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৭৭ অবধি বিস্তৃত, চিনে যখন সম্রাট সেনঙ-এর রাজত্ব। লিউ য়ু-র বয়ানে দেখা যাচ্ছে, চিনের ইতিহাসের এমন কোন পর্ব ছিল না, যেখানে চায়ের ভূমিকা নেই, রাজা মহারাজা সামন্তপ্রভু সন্তসাধক ঋষির দল চা নিয়ে কোন মন্তব্য করেননি। চায়ের কুলুজিকার লিউ য়ু-র বই লেখা হয় তাং বংশের রাজত্বকালে। চিনের হুবেই রাজ্যের তিয়েনআনমেন থেকেই সে বইয়ের কতগুলো সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ইয়ত্তা নেই--ষাটটার কথা জানা গেছে, খোঁজ পাওয়া গেছে পঞ্চাশটার। অসংখ্য ভাষায় এ বই অনূদিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। আমি যে অনুবাদটা দেখেছি সেটা হালের, ২০১৫-য় তিয়েনআনমেনের পৌর সরকারের উদ্যোগে করা। সেই অনুবাদের ভূমিকায় বলা আছে, 'চা' কথাটার ধারণাছবি বা আইডিওগ্রাফ(চিনা ভাষায় আক্ষরিক অর্থেই ছবি লেখা হয়) দেখলেই বোঝা যায়, সমস্ত ব্যাপারটায় একটা পরিবেশদর্শন নিহিত আছে। ছবির মাথার দিকের অংশে ঘাস, নিচের অংশে কাঠ, মধ্যিখানে একজন মানুষ। অনুবাদকদের বক্তব্য, এ থেকেই স্পষ্ট যে 'চা'-র অর্থ বা দর্শন অনুযায়ী, মানুষ প্রকৃতির অচ্ছেদ্য ও অঙ্গাঙ্গি অংশ, ঘাস আর গাছ যেমন, তেমনই, প্রকৃতির সঙ্গে মিলে মিশে না বাঁচলে মানুষ সুখে থাকতে পারে না।
চা বানানোর যে সব সরঞ্জামের কথা বলেছেন লিউ য়ু, সেখানেও 'চা'-এর সঙ্গে মিশে আছে ধর্ম, দর্শন, প্রকৃতি। ধরা যাক, চা সেঁকবার তেপায়া তোলা উনুন। তিনটে পায়ার প্রত্যেকটায় সাতটা করে একুনে মোট একুশটা প্রাচীন চিনা অক্ষর লেখা আছে। প্রথম পায়ে লেখা, 'উর্ধে অপ, নিম্নে বায়ু, মধ্যে অগ্নি'। দ্বিতীয় পায়ে, 'পঞ্চভূতের ভারসাম্যে সকল ব্যাধি দূরীভূত হইবেক'। তৃতীয় পায়ে লেখা '৭৬৪ সনে নির্মিত, তাং-এর হস্তে হু-এর পরাভব ঘটিবার কালে'। 'হু' অর্থে বিদেশি হানাদার। উনুনের মধ্যে তিনটে তারজালি, প্রত্যেক জালিতে একটি করে ছবি খোদাই করা। প্রথমটিতে ফিনিক্স পাখি, ছাই থেকে পুনর্জন্ম হয় যার, অগ্নির প্রতীক। দ্বিতীয়টিতে বাঘ, জীবজগতের রাজা, বায়ুর প্রতীক। তৃতীয়টিতে, একটি মাছ, অপ অর্থাৎ জলের প্রতীক। ছবির ওপরে লেখা, যথাক্রমে 'লি'(অগ্নি), 'সুন'(বায়ু) ও 'কান'(অপ)। এতে এই ত্রিভূতের আন্তঃসম্পর্ক বোঝা যাচ্ছে--বায়ু পুষ্ট করছে অগ্নিকে, অগ্নিদ্বারা তপ্ত হচ্ছে অপ। বাকি দ্বি-ভূত, ধাতু ও মৃত্তিকা, পাওয়া যাচ্ছে উনুনের মধ্যেই। চা-য়ের মধ্যে পঞ্চভূতের সংমিশ্রণ ঘটছে, চা মানবস্বাস্হ্যে সঞ্চারিত করছে সেই স্বর্গীয় সমন্বয়।
শুধু সরঞ্জামই বা কেন? লিউ য়ু বলছেন, চা পাতা তোলার পর তাকে শুকিয়ে, গুঁড়িয়ে, পাকিয়ে যে চা-খণ্ড বানানো হয়, তার উপরিতলে নানা রকমের ভাঁজ পড়ে, নানা ভাবে পাতা কুঁচকোয়, গোল হয়ে গুটলি পাকায়। সেই দেখে চায়ের জাতধর্ম গুণাগুণ বোঝা যায়। কোনো চায়ের ভাঁজ তাতার ঘোড়সওয়ারদের পায়ে চামড়ার জুতোর মতো, কোনোটা মহিষের গলকম্বলের মতো কুঁচকোনো, কোনো পাতা পাকিয়ে আছে যেন খাদের অতল থেকে উঠে আসা কুয়াশার কুণ্ডলি, কোনটার উপরে হালকা ঢেউ, নদীতে আলগা হাওয়া দিলে যেমন হয়, এক্ষুণি যেন শুনতে পাওয়া যাবে ছলাৎছল। কিছু চা পাতা দেখতে হয় রেশমমসৃণ আর ঝকঝকে, ঠিক যেন কুমোরের ঘরের অসংখ্যবার ছেঁকে নেওয়া মাটিতে জল মিশিয়ে নরম করা হয়েছে। কিছু পাতা ঠিক উল্টো--খড়খড়ে, কর্কশ, যেন সদ্যচষা ক্ষেত ধুয়ে গেছে তুমুল বৃষ্টিতে। ভালো জাতের চায়ে এমন সব চিহ্ন বা লক্ষণ থাকে।
লক্ষণ ও গুণানুযায়ী, চায়ের আট রকমের জাত হয়। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন য়ু। যে পাতার রস ওপরের দিকে উঠে আসে, তা দেখতে চকচকে, রঙিন হবে। শুকনো পাতাকে দেখতে লাগবে কর্কশ, রুক্ষ। রাতে তোলা হয় যে চা তাতে রাত্রির ছায়াপাত ঘটবে, একদিনেই বানিয়ে ফেলা চা হবে হলদেটে।
আরও পড়ুন
দার্জিলিং ও তার চায়ের গল্প (দুই)
পাতা তুলবার পর সে পাতাকে অনেকক্ষণ ধরে যত্ন নিয়ে থেঁতো করতে হবে। নেহাৎ গায়ের জোর দিয়ে এ কাজ হবে না। থেঁতো করা চা পাতা হবে দানাহীন, নরম। কতটা নরম? ঠিক যেন শিশুর ফোলাফোলা বাহু, বলছেন লিউ য়ু।
আরও পড়ুন
দার্জিলিং ও তার চায়ের গল্প (এক)
অষ্টোত্তর শত না হোক, চায়েরও বহু নাম। সেই সব নামেও প্রকৃতি। নাম দিয়ে চায়ের জন্মস্থান চেনা যায়। শুধু তা-ই নয়, বোঝা যায় সে চা বড় গাছ না ঘাস, নাকি এ দুয়ের মাঝামাঝি, ঝোপমতো। অনুবাদকেরা জানাচ্ছেন, চা যেখানে ঘাস বা গুল্মসুলভ, তার ধারণাছবিতে তা ধরা পড়ে। ঘাস বা গুল্মসুলভ উদ্ভিদের ক্ষেত্রে 'চা' কথাটা প্রথম ব্যবহৃত হচ্ছে 'কাইয়ুয়ান(উচ্চারণ 'কাই য়ুয়ান ওয়েন জি ইন ই') রাজত্বের সময়কালে অক্ষর/শব্দের অর্থ ও উচ্চারণ' বইতে। চা যেখানে বড় গাছ, ধারণাছবি দেখাচ্ছে 'মু', অর্থাৎ কাঠ, যেমন 'সেনঙ(উচ্চারণ 'বেন চাও') লিখিত চিকিৎসা ও ঔষধি বিষয়ক সন্দর্ভ' বইতে। চা যেখানে উভয়ত গুল্মসুলভ ও বড় গাছ, তাকে বলা হচ্ছে 'তু', যার ধারণাছবি প্রথম পাওয়া যাচ্ছে এর ইয়া লিখিত অভিধানে। চা-র অন্যান্য নামের মধ্যে অন্যতম 'জিয়া', 'তে', 'মিং' আর 'সুয়ান'।
আরও পড়ুন
দার্জিলিং-এর গপ্পোগাছা – হুকার, ক্যাম্পবেল ও পাগলা দেওয়ান (দুই)
লিউ য়ু বলছেন, যে চা নিজে নিজে অন্যান্য গাছের মতোই প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে ওঠে, বাগানে চাষ করা চায়ের তুলনায় তা সমস্ত অংশে ভালো। রোদ পায় পাহাড়ের যে দিক, বড় বড় গাছের ছায়ায় সেখানে যে চা গাছ জন্মায়, গুণগত বিচারে তা সর্বোৎকৃষ্ট। রঙের কথা যদি আসে, লালচে-গোলাপি পাতা সবুজ পাতার চাইতে দামি। যে কুঁড়ি বাঁশের কচি চারার মতো দেখতে, খুলে যাওয়া পাঁপড়ির চাইতে তা শ্রেষ্ঠতর। আবার, গুটিয়ে থাকা পাতা সবসময়ই খোলা ও সমতল পাতার চাইতে ভালো।
আরও পড়ুন
দার্জিলিং-এর গপ্পোগাছা - হুকার, ক্যাম্পবেল ও পাগলা দেওয়ান
বনের মধ্যে, পাহাড়ের ঢালে চা গাছ জন্মাল, কিম্বা তা চাষ করা হল। উপযুক্ত সময়ে সেই চা তুলে, শুকিয়ে, পুড়িয়ে বা গরম করে, থেঁতো করে, মণ্ড বানানো হল, বা পাকিয়ে রাখা হল। চা-খন্ড বা পাকিয়ে রাখা পাতা তারপর জলে ভেজাতে হবে, খেতে হবে। পাত্রে জল গরম হবে, হাতায় চা উঠবে পাত্র থেকে, চিনামাটির বাটিতে খাওয়া হবে। পাত্র কি ধাতুতে তৈরি, জল কোন কলকণ্ঠ ঝর্ণা থেকে উৎসারিত, চিনামাটি আসছে কোন অঞ্চল থেকে, এ সবই দেখেশুনে বিচার করে নিতে হবে। জিন বংশের সময়কালে দিউ য়ু রচিত প্রাচীন 'চা-এর উদ্দেশ্যে গাথা'-য় যেমন বলা আছে, ডংওউ-এর চিনামাটি সবচাইতে ভালো। ডংওউ বলতে বোঝানো হচ্ছে ইউয়েঝাউ-কে, যেখানকার চুল্লিতে সেরা চিনামাটি তৈরি হয়। ঝেজিয়াঙ আর হুনান, এই দুই জায়গার ইউয়েঝাউ-তেই যে চিনামাটির বাসন হয়, তাতে সবজে-নীল দ্যুতি থাকে, ফলে সে বাসনে চা ঢালা হলে চায়ে গোলাপি আর দুধসাদা রং ধরে। আবার, জিংঝাউ-এর চুল্লি থেকে যে বরফসাদা পাত্র বেরোয়, তাতে চায়ে লালচে রং লাগে। সাউঝাউ-এর চা খাবার বাটি খানিক হলদেটে, চা সেখানে লালচে-গোলাপি। হঙঝাউ-এর পাত্র বাদামি, ফলে চা ঘোলাটে দেখায়। গোলমেলে বাজে রঙের চিনামাটির বাসন যে সব চুল্লি থেকে আসে, চা-র জন্য তারা আদৌ উপযুক্ত নয়।
সব জলে চা ভালো হয় না। শ্রেষ্ঠ জল আসে পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে, কিম্বা নদী থেকে। চুনাপাথরের স্তম্ভ থেকে চুঁইয়ে পড়া, বা পাথুরে খাঁড়ির মধ্যে ধীরে ধীরে বয়ে চলা জল দিয়ে চা ভেজাতে হবে। হুড়মুড়িয়ে নামা প্রপাত, খরস্রোতা পাহাড়ি নদী বা ঘূর্ণি, চা-য়ে এসবের জল অচল। অনেকদিন ধরে জমে থাকা, বদ্ধ জলও কদাচ ব্যবহারের যোগ্য নয়।
ঠিকঠাক জল পাওয়া গেলে, এরপর তা ফোটাতে হবে। জল গরম হতে সবে শুরু করেছে, মাছের চোখের মতো ছোট ছোট বুদবুদ দেখা দেবে জলে, শোনা যাবে ঈষৎ, নম্র মর্মর। এর পরের ধাপে জল ক্রুদ্ধ হিসহিস করবে, পাত্রের কিনারায় লাফিয়ে উঠে জমবে স্ফটিকদানার ছড়া। তৃতীয় ও শেষ ধাপে উল্লসিত হর্ষিত জলে দেখা দেবে বড় বড় ঢেউ। ঠিক এই সময়েই চা ভেজাতে হবে, আগেও না, পরেও না।
চা পাত্রে পাত্রে দেবার সময় নজর রাখতে হবে যাতে চায়ের ফেনা বা সর সব পাত্রে সমান ভাবে পড়ে। পুরু ফেনা হলে বলা হবে 'বো'। হাল্কা হলে, 'মো'। আরো হাল্কা ফেনা, চোখে দেখা যায়ই না প্রায়, তা হচ্ছে 'হুয়া'(ফুল)।
হুয়াকে দেখতে কেমন? যেন পুকুরের জলে মৃদু আলোড়ন, সেখানে ভেসে যাচ্ছে জুজুবে ফুল। অথবা, ঘুরে ঘুরে জল যাচ্ছে, তাতে স্থির হয়ে আছে দাম। কিম্বা, নির্মল আকাশ বেয়ে উঠছে কুঁকড়ে থাকা মেঘপুঞ্জ।
চা প্রথম খেয়েছিলেন সেনঙ(বেন চাও)। চা-কে জনপ্রিয় করেছিলেন ঝাও গংদান, লু রাজ্যের শ্রদ্ধেয় অভিজাত। লিউ য়ু বলছেন, ক্রমে চায়ের অভ্যাস সমাজে ছড়াতে থাকলো। তাঁর সময়ে, অৰ্থাৎ তাং বংশের রাজত্বকালে, রাজ্যের দুই রাজধানী ও একাধিক প্রদেশে চা-এর চল প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে, চা, নিত্য ও অবশ্য ব্যবহার্য বস্তু।
প্রতিদিনের ব্যবহারের, প্রয়োজনীয় জিনিস, চা। লিউ য়ু-র লেখা পড়ে বোঝা যায়, সেই আটপৌরে চায়ের ইতিহাসে কিভাবে মিশে আছে চিন দেশের দীর্ঘদিনের ইতিহাস, আঞ্চলিক ভূগোল, প্রকৃতি, মানবসমাজ। চা ঢুকে পড়ছে লোককথায়, রূপকাহিনিতে, কবিতায়, ধর্মে। পুরোনো ও নতুন সময়ের জড়িয়েপেঁচিয়ে থাকা শিরাউপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছে সবজেটে লাল, ঘন গোলাপি, সোনালি-হলুদ চা, তার শরীরে প্রাচিন পর্বতমালা থেকে বেরিয়ে আসা ঝর্ণাজলের উৎসার। রঙের পর রঙের পর রঙ ভাঙছে লিউ য়ু-র লেখায়, সেই সঙ্গে ছবি। চিনা নিসর্গ ছবি যাঁরাই অল্পবিস্তর দেখেছেন, জানেন সে সব জলরঙে আঁকা, কাঠ-খোদাই, কাপড়ে রং ফেলে কিম্বা সূক্ষ্ম সূচিকর্মে ফুটিয়ে তোলা ছবির ঐন্দ্রজালিক সম্মোহন। সাদাকালো কিম্বা হাল্কা রঙের সেই ছবিতে মেঘ-কুয়াশায় ডুবে থাকা উঁচু উঁচু পাহাড়, আকাশ বিদীর্ণ করে উঠে যাওয়া সরু লম্বা বাঁশঝাড় আর গাছ। যে বইয়ের কথা হচ্ছে, সেখানে এইরকম ছবির কিছু ছাপা ছবি আছে, তার মধ্যে একটিতে দেখানো আছে পাহাড়শ্রেণির মধ্যে, উঁচু উঁচু গাছে ছাওয়া সংকীর্ণ উপত্যকা, সেখানে একটি কুটির। চা-পানের সরঞ্জাম সাজিয়ে বসে আছেন লিউ য়ু স্বয়ং।
রঙে, ছবিতে, কবিতায়, লোককথা রূপকাহিনী ইতিহাসে, এবং বনপাহাড়ের প্রাচীন প্রকৃতিতে একাধারে লালিত ও বিধৃত চিনা চা, তার শারীরিকতা নিছক মরমানুষের নয়, অমরদেরও ভোগ্য, এমন কি তাঁদেরও, মৃত্যুর ওপারে যাঁরা চলে গেছেন। পুরোনো পুঁথিপত্র থেকে একাধিক কাহিনীর সন্ধান দিচ্ছেন লিউ য়ু, যেখানে দেখা যাচ্ছে চায়ের টানে পৃথিবীতে ফিরে আসছেন বিদেহী আত্মা, অথবা হঠাৎই আকাশপথে উড়ে যাচ্ছে চা-বিক্রেতা বুড়ি।
চায়ের জন্মপুরাকথা বা অরিজিন মিথ বলেছেন সারা রোজ। দুটি গল্পের মধ্যে প্রথমটির সঙ্গে সম্রাট সেনঙের নাম জড়িয়ে। কথিত আছে, একটি ক্যামেলিয়া(চা-র বৈজ্ঞানিক নাম ক্যামেলিয়া) গাছের পর্ণছায়ে বিশ্রাম করছিলেন সেনঙ, হেনকালে তাঁর হাতে ধরা ফুটন্ত জল ভরা পাত্রে এসে পড়ল চকচকে একটা পাতা। জলের দানাগুলো পাতা থেকে আলাদা হয়ে গেলে দেখা গেল জলের মাথায় ভাসন্ত পাতা ঘিরে ফিকে সবুজ তরল তৈরি হচ্ছে। গাছ বিষয়ে যা যা জানার সেনঙ জানতেন, এই পাতা আর তরল বিষাক্ত নয়, মুহূর্তে বুঝলেন। পাতাসুদ্ধ জলে চুমুক দিয়ে দেখলেন, আহা! সুগন্ধি, ঈষৎ তিতকুটে, প্রাণদায়ী, বলবর্ধক।
রোজ বলছেন, চিনে এটাই দস্তুর; পুরোনো দিনের শ্রদ্ধাভাজন এক নেতার সঙ্গে এই যে চায়ের নাম জুড়ে দেওয়া হল, এটা চালু কনফুসিয় কায়দা। চিনা বৌদ্ধদের মধ্যে দ্বিতীয় এক কাহিনি প্রচলিত, যাঁর সঙ্গে স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ জড়িত। প্ৰব্রজ্যায় বেরিয়েছেন তরুণ সিদ্ধার্থ, ঘুরতে ঘুরতে এক পর্বতে পৌঁছোলেন। ক্লান্ত মানুষটি গাছের তলায় বসেছেন ধ্যান করবেন বলে, মোক্ষলাভের নানা উপায় নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লেন। জেগে উঠে নিজের উপর চূড়ান্ত ক্রুদ্ধ হলেন, নিজের শরীর প্রতারণা করছে, চোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে আসছে, এমতাবস্থায় কী করে করবেন তিনি নির্বাণ-সন্ধান? ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে নিজের ভ্রুপল্লব টেনে ছিঁড়ে ফেললেন সিদ্ধার্থ। সত্য ও আলোকলাভের পথে যাত্রায় কোন বাধা তিনি স্বীকার করবেন না। ছিন্ন ভ্রুপল্লব ছুঁড়ে দিলেন হাওয়ায়, যেখানে যেখানে তা গিয়ে পড়ল, সুগন্ধি পুষ্পল গাছ জন্মাল--চা। শ্রেষ্ঠ জাতের চা পাতার উল্টোপিঠে যে সূক্ষ্ম রুপালি লোম থাকে, তাকে এখনো দেখতে লাগে অবিকল ভ্রুপত্রের মতো।
রবার্ট ফরচুন চিন থেকে 'শিকার' করে এই চা নিয়ে এলেন ভারতবর্ষে, দার্জিলিং-এ। চা অর্থে সেই আবহমান, যা জন্ম নিচ্ছে অলৌকিকে, জন্মাবধি যাঁকে ঘিরে রেখেছে ইন্দ্রজাল, মায়া, রহস্য। কোম্পানির মুনাফালোলুপ বেনিয়াসায়েবদের হাতে পড়ে চায়ের জন্মান্তর গোত্রান্তর ঘটলো, দেবকূলোদ্ভব অথচ সর্বজনভোগ্য চা আধুনিক সময়ের লুটেরাদের হাতে পড়ে জমিজমা, লাভলোকসান, উৎপাদন আর সস্তা শ্রমের কেঠো কেজো হিসেবের মধ্যে ঢুকে গেল।
অবশ্য এমন নয় যে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি যখন ফরচুন চিনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সেটি স্বর্গরাজ্যবিশেষ ছিল, কিম্বা সেখানকার বাগানগুলো মায়াকানন। ক্ষয়িষ্ণু সামন্তশাসন, অপদার্থ নৃপতি, অপরিমিত শোষণ আর দারিদ্র, সব অর্থেই অহিফেনলিপ্ত সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পচন আর অবক্ষয়, এই হচ্ছে আঠেরো-উনিশ শতকের চিন, বিশ শতকের গোড়ায় গিয়ে যা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। ফরচুন-কাহিনিতে ও সমসাময়িক বহু বিবরণে এই পচন ও অবক্ষয়ের বর্ণনা মেলে। তবে, চা, অর্থাৎ আসল চৈনিক 'জাতের' চা, তা তখনো জন্মাত, তৈরি হত, শহুরে শাসনকেন্দ্র বা সমতল বাজারগ্রামের হইহটল্লা থেকে বহু দূরে, উঁচু উঁচু পাহাড়ের কুণ্ডলির ভিতর। সে পাহাড়ে মেঘকুয়াশার চিরস্থায়ী আবরণ, বহু গাছের চিরসবুজ ভিড়। অর্ধেক মাথা কামিয়ে চিনা মান্দারিন, অর্থাৎ অভিজাত পুরুষ সেজে ফরচুন দূর পাহাড় অঞ্চলে গিয়ে পৌঁছলেন, সেখানে শ্রেষ্ঠতম চায়ের নিবাস। সে গল্প পরেরবার।
Powered by Froala Editor