সময়ভ্রমণ - ৩৬
আগের পর্বে
লয়েড বিদায়ের পর সিকিমের রাজার সঙ্গে দীর্ঘদিন কোম্পানির কোনো যোগাযোগ ছিল না। ওদিকে রাজার বয়স বেড়েছে। তিনি অথর্ব হয়ে পড়েছেন। প্রশাসনিক এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের বেশিরভাগটাই সামলাতেন তাঁর দেওয়ান। ক্যাম্পবেলের ভাষায় তিনি ছিলেন পাগলা দেওয়ান। ১৮৪৮ সালে হুকার এবং ক্যাম্পবেলের সিকিম-নেপাল-তিব্বত যাত্রার সময় তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়। কোম্পানি দেওয়ানকে অগ্রাহ্য করে রাজার সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তি করতে চায় জেনে দেওয়ান ক্রুদ্ধ হন। তিনি সাহেবদের জব্দ করতে তাঁদের সিকিমে নজরবন্দি রাখার ব্যবস্থা করেন। তবে দুজন ভুটিয়া সেপাই পালিয়ে গিয়ে কোম্পানিকে সেই খবর জানায়। যদিও যুদ্ধের প্রয়োজন পড়েনি। কূটনৈতিক চালে স্বাধীন সিকিমের প্রায় সবটাই দখল করে নেয় কোম্পানি। কিন্তু পাগলা দেওয়ানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্যাম্পবেল ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
হিলকার্ট রোড ধরে পাহাড়ে উঠছেন, কিম্বা পাঙ্খাবাড়ির রাস্তায়। অথবা, রোহিনীর নতুন পথ দিয়ে কার্শিয়াং-এর দিকে, বা মিরিক-সীমানা-সুকিয়াপোখরির পথে। যেদিকেই, যে পথেই যাওয়া যাক, পাহাড়বনের ঘন সবুজ মিশে যাচ্ছে চা-বাগানের হাল্কা সবুজে, ক্রমে বন আর থাকছে না, পাহাড় ঢেকে, ছেয়ে শুধু বাগান আর বাগান। কোথাও গভীর উপত্যকা, খাদ, কোথাও বা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়া ঢেউ-খেলানো মাঠ, অথবা পাহাড়ের চুড়ো, গিরিশিরা। চোখ-জুড়োনো, মন ভালো করা, থইথই সবুজ, তার ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে বা নেমে আসছে সরু ফিতে, পেঁজা তুলো কিম্বা চারদিক অন্ধকার করা সাদা মেঘ, হলুদ-কমলা রোদ্দুরের ফালি। এই সব পথে যাঁরা প্রথম আসেন, কিম্বা বারবার, তাঁদের খানিক থামতেই, দাঁড়িয়ে দেখতেই হয়। দেখার মতো, ছবির মতো দৃশ্য সব, দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ আসেন, দেখেন, ছবি তোলেন। দার্জিলিং থেকে চা বাগানের এই ছবিকে আলাদা করা যায় না। দার্জিলিং ছাড়াও আরো বহু পাহাড়ি জায়গায় চা বাগান আছে, ভারতবর্ষেই। পশ্চিমঘাট পাহাড় এবং নীলগিরিতেও অপূর্ব সুন্দর সব বাগান, একবার দেখলে বারবার যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু, সেসব জায়গা শুধু চা দিয়ে পরিচিত নয়। দার্জিলিং-এর সঙ্গে চা ব্যাপারটা যেভাবে ইতিহাস-ভূগোল-প্রকৃতি-মানুষ-নামানুষ এই সবটা মিলিয়েই জড়িয়ে আছে, আর কোথাও ঠিক ওইরকম নয়। এত কিছু আছে যখন, ধরে নিতেই হয়, বহু, অনেক, রকমারি গল্পও আছে। আমরা দার্জিলিং-এর গল্প শুনছি, বলছি, পড়ছি। চায়ের গল্প তো শুনতেই হয়।
যে কোন গল্পই আসলে অনেক, তার মধ্যে কিছু লেখাপড়া হয়েছে, কিছু হয়নি। যা লেখাপড়া হয়েছে, তার মধ্যেও আবার অনেকগুলো পুরোনো তামাদি হলদে হয়ে ভেঙেচুরে ঝরেপড়ে গেছে, খুঁজে পাওয়া মুশকিল। চায়ের, দার্জিলিং চায়ের গল্পটাও তা-ই, কিছু কথিত, বেশিটাই অদ্যাবধি অকথিত। খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলাম, দেশবিদেশের অনেক মানুষ খুব মন দিয়ে, সযত্নে, দার্জিলিং চায়ের গল্পগাছা খুঁজে বার করছেন, অন্যদের বলছেন। সেইসব অনেক গল্পের দু চারটে এখানে বলি।
আম-বাঙালি সাধারণত দার্জিলিং চায়ের দুরকম গল্পের সঙ্গে পরিচিত। প্রথম গল্পটা পানীয় হিসেবে চা বস্তুটির স্বাদগন্ধ, গোত্রকৌলীন্য, এসব নিয়ে। উৎকৃষ্ট সুরা বা সোমরসের মতো, চায়েরও জাতগোত্র বিচার্য, অন্তত রসিকদের কাছে তো বটেই। চা চিনতে হয় তার পাতা দিয়ে। পাতা বলতে গাছ। গাছ বলতে কোন বাগানের, কী গাছ। পাহাড়ের কোন ঢালে কোন মাটিতে সেই গাছ জন্মায়, কতটা রোদজলছায়া পায়, কত ইঞ্চি বৃষ্টি আর মেঘ তাকে ভিজিয়ে সুস্নিগ্ধ শীতল রাখে। তারপরে দেখতে হবে সেই গাছ থেকে পাতা ঠিক সময়ে তোলা হচ্ছে কিনা। গাছ যদি উপযুক্ত লালন না পায়, তোলবার মতো পাতাও সে গাছে জন্মায় না। আর শুধু তুললেই তো হলো না। দেখতে হবে তাকে ঠিকভাবে শুকোনো, জারানো, পোড়ানো হচ্ছে কিনা। তারপরেও কাজ থাকবে। কীভাবে সেই পাতাকে ভাঙা হচ্ছে, বা গুটিয়ে রাখা হচ্ছে, কোন কাগজে কোন রাংতায় মুড়ে বাইরে পাঠানো হচ্ছে। আমরা যারা চা খাই, খেয়ে আহাবাহা করি বা মুখ কুঁচকোই, তাদের কাছে আসার আগে সেই চা পৌঁছোবে বিরল ঘ্রাণশক্তির অধিকারী চা-চাখিয়েদের কাছে, চা ভিজিয়ে, শুঁকে ও চেখে তাঁরা বলে দেবেন, কোন চায়ের কী জাত। আর দশ-পঁচিশটি গল্পের মতো, চায়ের গল্পও শেষত বাজারের, ফলে চায়ের জাত মানে দাম, দাম দিয়ে জাত চিনতে হয়। ভালো বাগান, ভালো জাতের গাছ, পাতা, ভালো দাম। ভারতের খোলা বাজারে যে দার্জিলিং চা ইদানিং পাওয়া যায়, প্রতি একশো গ্রাম পিছু তা সত্তর-আশি থেকে সাত-আট হাজার টাকা অবধি দামে বিক্রি হয়। আরো বেশি দামের চা বিদেশি ধনকুবেররা খেয়ে থাকেন, এমন শোনা যায়।
দার্জিলিং-এ তো বটেই কলকাতাতেও এখন জাত-চায়ের দোকানপত্র হয়েছে, সেখানে পাতার এবং বাগানের নাম দিয়ে চা কেনা এবং খাওয়া যায়। সব চা-ই বছরে দুবার তোলা হয়, বসন্তে ও শরৎ-হেমন্তে। বসন্তে তোলা দার্জিলিং চায়ের জাত ও স্বাদ উৎকৃষ্টতর, ফলে তা বেশি দামে বিক্রি হয়। একটি বড়গোছের চা কোম্পানি দার্জিলিং অঞ্চলে একাধিক দোকান খুলেছে, সেখানে এককাপ চায়ের দাম সাড়ে সাতশো টাকা অবধি হতে পারে। বসন্তের চায়ের পোশাকি নাম ফার্স্ট ফ্লাশ, শরৎ-হেমন্তের সেকেন্ড ফ্লাশ। দার্জিলিং-এর নিসর্গ এবং চা, দুইই বিক্রি হয়, নিতান্ত গরিবগুর্বোরা তা কিনে খেতে পারেন না। গরিবদের জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা, অর্থাৎ সে চায়ের জাতগোত্রস্বাদ সব আলাদা। পরে সে কথায় আসা যাবে।
আরও পড়ুন
দার্জিলিং-এর গপ্পোগাছা – হুকার, ক্যাম্পবেল ও পাগলা দেওয়ান (দুই)
যে দার্জিলিং আমরা দেখি, যেখানে বেড়াতে যাই, যেখানকার বাগানের চা খাই, পাহাড়, বাগান, গাছ, পাতা, তোলবার ও বানানোর ধরণ, এই এতকিছু ভেবে, মেনে, বিচার করে চা খাওয়ার যে প্রথা, তা কিন্তু সেখান থেকে শুরু হয়নি। সায়েবরা দার্জিলিং-এ চা আমদানি করেছিলেন বটে, তবে চা খাওয়ার অভ্যাসটি তাঁরা শিখেছিলেন চিনদেশীয়দের কাছ থেকে। নিতান্তই চৈনিক চা সায়েবি ব্রিটেনে ঢুকেছিল সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, রাজা দ্বিতীয় চার্লসের বধূ পর্তুগিজ রাজকন্যা ক্যাথরিন ডি ব্রাগাঞ্জার সঙ্গে আসা রাজকীয় যৌতুকের অংশ হিসেবে। শুরুর দিকে রাজপরিবারের সদস্য ও অন্যান্য অভিজাতকূল ভিন্ন বড়ো একটা কেউ চা খেতেন না। দ্রুত এই অবস্থাটা বদলায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মালভর্তি জাহাজ তখন পৃথিবীর এমুড়ো ওমুড়ো দৌড়োচ্ছে। কোম্পানি চিন থেকে সস্তার চা আমদানি করতে শুরু করল। গাঙ্গেয় ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় কোম্পানিরাজ কায়েম, সেখানে শুরু হল আফিং অর্থাৎ পপি ফুলের চাষ। জাহাজবোঝাই ভারতের আফিং চিনে যেতে থাকল, বিনিময়ে চিন থেকে ব্রিটেনে ও কোম্পানিদুনিয়ার অন্যত্র আসতে থাকল চা।
আরও পড়ুন
দার্জিলিং-এর গপ্পোগাছা - হুকার, ক্যাম্পবেল ও পাগলা দেওয়ান
উনিশ শতকের গোড়ায় চিনের শাসকেরা ঠিক করলেন, অনেক হয়েছে। আফিং খেয়ে খেয়ে দেশ উচ্ছন্নে যাচ্ছে, সুতরাং সাদা-চামড়া কোম্পানিসায়েবদের আফিং তাঁদের আর দরকার নেই। এমনিতেই, ১৭২৯ সালে পিকিংনিবাসী চিনসম্রাট আফিং বিক্রি বন্ধ করার নির্দেশ জারি করেছিলেন। তাতে ফল হয়নি, দেদার আফিং চোরাচালান হচ্ছিল। লক্ষ্যণীয়, কোম্পানি যতই আফিং চাষ করুক আর চালান দিক, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের সর্বত্র আফিং বিক্রি নিষিদ্ধ করেছিলেন স্বয়ং রানি ভিকটোরিয়া। ওদিকে, চিনে আফিং বিক্রি বাড়ছিল তো বাড়ছিলই। ১৮২২ থেকে ১৮৩৭-এর মধ্যে কোম্পানির আফিংব্যবসা পাঁচগুণ বেড়ে যাবার পর, ক্যান্টনের রাজপ্রতিনিধি বন্দরের তামাম সায়েবকে পণবন্দি করে রাখলেন। প্রায় ৬০ লক্ষ ডলারের আফিং আটকে রেখে সায়েবদের বলা হল, এই আফিং আমাদের বিনিপয়সায় না দিলে তোমাদের কাউকে ছাড়ব না। সে সময়ের ৬০ লক্ষ ডলার মানে এসময়ের ৩০ কোটি পাউন্ড স্টার্লিং-এর কাছাকাছি। যত দামিই হোক, প্রাণের চাইতে আফিং মূল্যবান হতে পারে না, সায়েবরা আফিং ছেড়ে দিলেন। বিনিময়ে, সায়েবদেরও ছাড়া হল বটে, কিন্তু ক্যান্টনের যে মান্দারিন অর্থাৎ কিনা রাজপুরুষ এই কান্ডের চাঁই, তাঁর অন্য মতলব ছিল। তিনি ৫০০ কুলি পাঠালেন, তারা ৩০ লক্ষ পাউন্ড(ওজন) সায়েবি আফিং-এ নুন আর চুন ঢেলে মুক্তো নদীতে ফেলে দিল, নদী সেই নোংরা মিশ্রণ নিয়ে ফেললো সোজা দক্ষিণ সাগরে। ভয়ঙ্কর অনাসৃষ্টি এবং অনেক টাকার ব্যাপার(উভয়ার্থে), সুতরাং রানি ভিক্টোরিয়া চিনাদের শিক্ষা দেবার ও বেওসা বাঁচিয়ে রাখার জন্য ব্রিটিশ নৌবহর রওনা করিয়ে দিলেন। চিনাদের মান্ধাতার আমলের কাঠের নৌকো, আর সায়েবদের আধুনিক বাষ্পচালিত রণপোত, যুদ্ধে চিনারা গোহারা হারল। সন্ধিচুক্তির শর্তমাফিক সায়েবরা চিনের পাঁচটা উপকূলবর্তী শহরে ব্যবসা করার একচ্ছত্র অধিকার(কার্যত দখল) পেল, সেইসঙ্গে হংকং।
আরও পড়ুন
দার্জিলিং-এর গপ্পোগাছা (তিন)
কোন গল্প কোথায় নিয়ে যায়। ভারতে কোম্পানির আফিং চাষ ও আফিং যুদ্ধ ইত্যাদি নিয়ে অমিতাভ ঘোষের তিন তিনটে উপন্যাস আছে, সি অব পপিজ, রিভার অব স্মোক এবং ফ্লাড অব ফায়ার। অনেকেই পড়ে থাকবেন, আমরা সে গল্পে আপাতত ঢুকছি না। চিনের চা কিভাবে কোম্পানিভারত ও ব্রিটিশ সিকিমের দার্জিলিং-এ পৌঁছোল, তা নিয়ে অন্য একটি সুখপাঠ্য আখ্যান আছে, ফর অল দি টি ইন চায়না। বছর দশ আগে দার্জিলিং-এর অক্সফোর্ড বইয়ের দোকানে বইটি দেখতে পেয়েই কিনি, এক নিঃশ্বাসে পড়েও ফেলি। দার্জিলিং-চায়ের গল্পের সঙ্গে যে সায়েবের নাড়ির যোগাযোগ, যিনি না থাকলে দার্জিলিং চায়ের জাতগোত্রস্বাদচাষ কিছুই ঠিকভাবে ঘটে উঠত কিনা সন্দেহ, স্বনামধন্য গাছ-শিকারি সেই রবার্ট ফরচুনের কথা জানাও হত না নাহলে। আমেরিকানিবাসী লেখক সারা রোজের এই লেখা এবং আরো গোটা দুই লেখার সূত্র ধরে চৈনিক ও দার্জিলিং চায়ের আদিপর্বের গল্পে আমরা প্রবেশ করবো। অন্য যে দুটি লেখার কথা বলছি, দুটিই চৈনিক, তন্মধ্যে প্রথমটি লিউ য়ু-এর সুপ্রাচীন লেখা, ইংরেজি অনুবাদে দি ক্লাসিক অব টি। দ্বিতীয়টি লুয়াও জিয়ালিন-এর, দি চায়না টি বুক। চা নিয়ে আরো অসংখ্য ছোটবড় লেখা আছে, থাকার কথাও। বিভিন্ন এশিয় দেশে চা তো শুধু পণ্যমাত্র নয়, তা সামাজিক রীতিরেওয়াজ ও ধর্মাচরণের অবশ্যম্ভাবী অংশ। চিনা চা জাপানে গিয়েও সামাজিক-ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে, জাপানদেশের বিশেষ বৌদ্ধ দর্শন, যাকে জেন দর্শন বলা হয়, তার সঙ্গে চা ও চা পান জড়িয়ে যায়। জাপানি চা নিয়েও একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ আছে, কাকুজো ওকাকুরার লেখা বুক অব টি, বা চায়ের বই। তিব্বতীয় মালভূমি থেকে মধ্য এশিয়ার অন্তঃস্থল পর্যন্ত বিস্তৃত যে বিস্তীর্ণ যে পর্বতসঙ্কুল ও মরুময় অঞ্চলকে স্বেন হেদিন ট্রান্স হিমালায়াজ বলে অভিহিত করেছিলেন, যার মধ্যে চিন থেকে মধ্য এশিয়া হয়ে যুরোপ পৌঁছোনোর বিভিন্ন রেশম পথের ঐতিহাসিক গোলকধাঁধা অবস্থিত, সেখানকার অসংখ্য বিচিত্র জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনেও চা নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু, সামাজিক অর্থেও মূল্যবান। মধ্য এশিয়া পেরিয়ে রাশ্যা ও পূর্ব ইউরোপ, সেখানেও চায়ের বহুল প্রচলন। ফলে চা নিয়ে অসংখ্য বিচিত্র গল্পজটলা থাকবে, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
আরও পড়ুন
দার্জিলিংয়ের গপ্পোগাছা (দুই)
সে তুলনায় দার্জিলিং চায়ের গল্প অনেক ম্যাড়মেড়ে, ফিকে, একমাত্রিক। ঔপনিবেশিক সায়েবরা পৃথিবীর প্রায় সবটা আবাদ করে সেখানকার প্রকৃতি-মানুষ-ইতিহাস-ভূগোল সব বদলে দিয়েছিল, আমাদের চেনা দার্জিলিং সেই বিশ্বব্যাপী উথালপাথালের মানচিত্রে বিন্দুমাত্র, সেভাবে দেখলে ওরকম আরো বহু দার্জিলিং আছে। তবে কিনা কাছ থেকে দেখলে প্রতি বিন্দুই সিন্ধুবৎ, চেনাজানা গল্পের ঘরে অজস্র অজানা কমজানা গল্পও বসত করে। রবার্ট ফরচুনের কথা হচ্ছিল। চিনে সায়েবদের গাছ-শিকারের পরম্পরা যে ফরচুনকে দিয়ে শুরু হয়েছিল এমন নয়, ফরচুনের আগেপরে দীর্ঘ ইতিহাস আছে। চিন ও চিন-সংলগ্ন তিব্বতে বিভিন্ন গাছ-শিকারিদের অভিযান নিয়ে লেখা একটি বই সম্প্রতি হাতে এল। ১৯৪৫ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ই এইচ এম কক্স(ইউয়ান হিলহাউস মিলভেন কক্স)-এর লেখা প্ল্যান্ট হান্টিং ইন চায়না বইটায় ফরচুন ও অন্যান্য সায়েব গাছ-শিকারিদের কথা আছে। কক্স নিজে খ্যাতনামা উদ্ভিদবিৎ, এবং তাঁর পূর্বসূরি অনেকের মতোই, স্কটদেশীয়। দেখলাম, সেই কক্স একজায়গায় বলছেন, ফরচুন এত কষ্ট করে চিন থেকে চায়ের গাছ, বীজ সংগ্রহ করলেন, সেগুলো নানান ঘাটা-আঘাটা ঘুরে দার্জিলিং-এ এসে পৌঁছোল, লাগানোও হল। তবে কিনা সবটাই পণ্ডশ্রম, দার্জিলিং-এ সেসব চিনা গাছের চিহ্নমাত্র হালে বর্তমান নেই, কক্সের বক্তব্য। দার্জিলিং-এর চা-বাগানে যা টিঁকে আছে তা পুরোদস্তুর দিশি, আসামি(অহমদেশীয়) চায়ের রকমফের।
আরও পড়ুন
দার্জিলিংয়ের গপ্পোগাছা
কক্সের বয়ান পড়ে মুষড়ে পড়লাম। ফরচুনের গল্প পড়ার বহু আগে থেকেই শুনে আসছি, চায়ের জন্ম চিনে। কথাটা কি তাহলে ভুল? আসামে নেহাতই স্থানীয় জাতের বন্য চা জন্মাত, জানা ছিল। সেই চা এখন আসামে ও আমাদের তরাই ডুয়ার্সের সর্বত্র চাষ হয়। তা বলে, প্রধানত দানা দানা, গন্ধহীন সেই ছোটজাত(হে পাঠক, চায়ের ক্ষেত্রে 'জাত' শব্দটির বহুল প্রচলন আছে--জাত দিয়ে জন্ম বোঝা যায়) নেটিভ সিটিসি(সিটিসির পুরো কথাটা হল 'ক্রাশ টিয়ার কার্ল'--ভাঙো ছেঁড়ো গুটলি পাকাও) থেকে দার্জিলিং-এর নৈকষ্যকুলীন গন্ধ-ভুরভুর সোনালি চায়ের উদ্ভব? এও কি হয় নাকি? ওদিকে কথাটা বলছেন কক্সের মতো নামজাদা মানুষ, ফেলে দেওয়া যায় না। যে সব নামে দার্জিলিং চা বিক্কিরি হয়, সেগুলোও তো সব চৈনিক: অরেঞ্জ পিকো, ব্রোকেন অরেঞ্জ পিকো, উলং ইত্যাদি। তবে কি বুনো ও দিশি আসামি চা দার্জিলিং-এর সায়েবপাহাড়ের পরিমণ্ডলে এসে ঝাঁ করে 'উচ্চজাত' লাভ করল, এবং যেহেতু জাত চা মানেই চৈনিক, সেই চায়ের ওপরই চিনা নামটাম চাপিয়ে দেওয়া হল? ব্যাপারটা কী আসলে? খোঁজ লাগাতে, খুঁজে দেখতে হয়, রাষ্ট্ৰভাষায় যাকে বলে সঘন অনুসন্ধান।
Powered by Froala Editor