দার্জিলিং-এর গপ্পোগাছা – হুকার, ক্যাম্পবেল ও পাগলা দেওয়ান (দুই)

সময়ভ্রমণ - ৩৫
আগের পর্বে

জালাপাহাড় রোডের বাড়িতে থাকতেন ক্যাম্পবেল। এখন সেটা পুলিশ সুপারের আস্তানা। পাহাড়চূড়ার একটি বাড়িতে থাকতেন উদ্ভিদবিদ হুকার। তিনি এসেছিলেন দার্জিলিং-এর প্রকৃতি ও নিসর্গ নিয়ে গবেষণা করতে। তবে তাঁর বিখ্যাত বইটির ছত্রে ছত্রে খুঁজে পাওয়া যায় সাদা চামড়ার মানুষের জয়গান এবং ঔপনিবেশিক দম্ভ। তবে দার্জিলিং-এর প্রকৃতি বিষয়ে জানতেও এই বই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রধান কারণ তাঁর সুললিত ভাষা। এখন আর সেইসব সময়ের ইতিহাস সেভাবে সংরক্ষণ করা হয় না। সাহেব সময় একরকম হারিয়েই গিয়েছে।

বলে রাখা ভালো, ক্যাম্পবেলের সঙ্গে তখনো অবধি(সেটা ১৮৪৮ সাল--ক্যাম্পবেল দার্জিলিং-এ আসছেন ১৮৩৯-র জুলাইতে) সিকিম রাজার মোলাকাত হয়নি। অর্থাৎ, লয়েড দার্জিলিং ছাড়ার পর থেকে সিকিমের সঙ্গে কোম্পানি সরকারের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে আসে। হুকার ক্যাম্পবেল যে সিকিম হয়ে নেপাল যাবেন ও নেপাল থেকে তিব্বত হয়ে আবার সিকিমে ঢুকবেন, এই ব্যবস্থাতেও সিকিম দরবার প্রথমে সম্মতি দেয়নি। পরে, হুকার যখন নেপালে পৌঁছে গেছেন, খবর আসে, তাঁদের আর্জি মঞ্জুর হয়েছে, তাঁরা সিকিম হয়ে ফিরতে পারবেন, রাজা তাঁদের সঙ্গে দেখাও করবেন। সেইমতো রাজার সঙ্গে হুকার ও ক্যাম্পবেলের সাক্ষাৎ ঘটে। হুকারের কথামতো, সেসময় সিকিম রাজার অনেক বয়স হয়েছে, তিনি ধর্মকর্ম নিয়ে থাকতেন। তাঁর হয়ে রাজকাজ চালাত তাঁর দেওয়ান। দেওয়ান অর্থে ভো-লোদ বা পাগলা দেওয়ান, যার কথা আগেই বলা হয়েছে। হুকার বলছেন, তিব্বতের সঙ্গে সিকিমের যেটুকু ব্যবসাবাণিজ্য চলত, তার সবটাই দেওয়ানের দখলে ছিল। ফলে লাভের গুড় দেওয়ানপিঁপড়ের কাছে যেত, রাজার কপালে লবডঙ্কা। কোম্পানি সরকারের তরফে ক্যাম্পবেল চাইছিলেন দেওয়ানকে বাদ দিয়ে এই ব্যবসাটায় ঢুকতে। স্বভাবতই, দেওয়ান তাতে রাজি ছিল না। অন্য ব্যবসা ছাড়াও, তার মূল আগ্রহ ছিল ছোট তিব্বতী ঘোড়ায়(পনি)। পাহাড়ে যাতায়াতের জন্য এই জাতীয় ঘোড়ার চাইতে উপযুক্ততর বাহন সেকালে ছিল না। দেওয়ান কোম্পানিকে গোটা পঞ্চাশেক পনি ইতিমধ্যেই বিক্রি করে ফেলেছিলো। এমতাবস্থায় দুই সায়েব সিকিমে ঢুকে ঘুরে বেড়াবে, এদিক ওদিক যাবে, রাজার কান ভাঙাবে, এটা হতে দেওয়া যায় না। ভো-লোদ দেওয়ান আবার ইংরেজি হিন্দুস্তানি কিছুই বুঝত না, ফলে রাজার সঙ্গে সায়েবরা কী কথাবার্তা বলছে, তা বোঝার উপায়ও ছিল না। রাজা ও দেওয়ানের সঙ্গে হুকার ও ক্যাম্পবেলের কথা হয় জনৈক চেবু লামার মাধ্যমে। চেবু ভাঙা ভাঙা হিন্দুস্তানি বলতে পারত, এবং, সিকিমের যাবতীয় লামাদের মতোই, দেওয়ানকে যারপরনাই অপছন্দ করত। যা ঘটছে, তাতে দেওয়ান শঙ্কিত হয়ে পড়ে, এবং সায়েবদের খানিক শিক্ষা দেওয়া মনস্থ করে। 

সিকিম নেপাল হয়ে তিব্বতে ঢুকে হুকার ও ক্যাম্পবেল আবার সিকিমে ঢুকছেন, খবর এল, রাজা ক্যাম্পবেলের সঙ্গে দেখা করতে চান। হুকার ও ক্যাম্পবেল সেইমতো তৎকালীন রাজধানী তুমলুঙ-এ বসে আছেন, রাজা আর সময় দেন না। দেওয়ান আসছে যাচ্ছে এবং খবর পাঠাচ্ছে, ক্যাম্পবেলকে কিছুদিন থেকে যেতে হবে, গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক কথাবার্তা লেনদেন হবে। হুকার ও ক্যাম্পবেল ঠিক করলেন, তাঁরা আবার তিব্বতের দিকে, চোলা-লা গিরিপথে যাবেন, পারলে, ওপারে চুম্বি উপত্যকায়। চোলা-লা পৌঁছে বোঝা গেল, চুম্বি যাওয়া সম্ভব নয়, সীমান্তে তিব্বতী শুধু নয়, চিনা সিপাইও মোতায়েন। হুকার ও ক্যাম্পবেল ঠিক করলেন নিচে নেমে যাবেন। ফেরার রাস্তায় প্রথমে ক্যাম্পবেলকে ও পরে হুকারকে তিব্বতী সৈন্যরা ও সিকিম রাজার ভুটিয়া সিপাইরা আটক করল। ক্যাম্পবেলকে গলাধাক্কা দিয়ে হাত পা বেঁধে নিয়ে যাওয়া হল, হুকারের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করা হল। সঙ্গে যে কুলি সর্দার ইত্যাদিরা ছিল তাদেরও আটক করা হল। প্রায় সাড়ে বারো হাজার ফুটে, বরফের মধ্যে, হুকার ও ক্যাম্পবেলকে রাত্রিবাস করতে বাধ্য করা হল। হুকারের সঙ্গে ক্যাম্পবেলের দেখা হচ্ছিল না, ক্যাম্পবেল জীবিত না মৃত বোঝার উপায় ছিল না। ইতিমধ্যে হুকারকে বলা হয়েছে, সিকিমের যা গন্ডগোল সবটাই ক্যাম্পবেলের সঙ্গে, হুকার ইচ্ছা করলে চলে যেতে পারেন। হুকার একা যেতে রাজি হন না। অবশেষে ক্যাম্পবেলের সঙ্গে তাঁকে দেখা করতে দেওয়া হয়, এবং তাঁদের তুমলুঙ-এ নামিয়ে আনা হয়। দেওয়ান প্রায়ই দেখা করতে আসছিল। যদিও দার্জিলিং-এ বা কলকাতায় কোম্পানি সরকার ক্যাম্পবেল ও হুকারকে কয়েদ করার বিষয়ে কিছুই জানত না, দেওয়ান ভয় পাচ্ছিল জানতে পারলে কী ঘটবে। হুকার (ও পরে ক্যাম্পবেল) দেওয়ান ও তার অনুচরদের বলতে থাকেন, তাঁদের যদি বিনাশর্তে সম্মানের সঙ্গে দার্জিলিং-এ ফিরে যেতে দেওয়া না হয়, দেওয়ান ও রাজার কপালে ঘোরতর দুঃখ আছে, কোম্পানি সরকার কী শাস্তির বিধান দেবে আগে থেকে বলা যাবে না।

নানান অজুহাতে হুকার ও ক্যাম্পবেলকে সিকিমের মধ্যেই আটকে রাখা হয় প্রায় মাস দেড়েক। এমনকি ফেরার পথেও দফায় দফায় বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের পটি আটকানো হয়। চেবু লামা ও অন্যান্য লামারা সায়েবদের পক্ষ নেয়, দেওয়ানকে বিশেষ কেউ পছন্দ করত না। ইতিমধ্যে, হুকারদের সঙ্গে যে ভুটিয়া কুলিসর্দাররা এসেছিল, তাদের মধ্যে একজন কোনোক্রমে পালিয়ে দার্জিলিং পৌঁছোয়, তার পায়ে ভারী লোহার শিকল বাঁধা ছিল। সরকারের কাছে খবর পৌঁছোয়, কোম্পানির সেনারা সিকিম অভিযানের প্রস্তুতি নিতে থাকে। সে খবর পেয়ে বা আরো সাত সতেরো ভেবে দেওয়ান হুকার ও ক্যাম্পবেলকে ছেড়ে দেয়, রঙ্গীত পার হয়ে তাঁরা বিনা বাধায় দার্জিলিং ফিরে আসেন। 

কোম্পানির তরফে 'শাস্তিমূলক' বিশেষ কিছু করা হয়নি। অনেক দিন ধরেই 'খবর' আসছিলো, তিব্বত থেকে পঞ্চাশ হাজারি ফৌজ সিকিম রাজার সমর্থনে দার্জিলিং আক্রমণ করতে আসছে, ভুটিয়ারা তো আছেই। অন্যদিকে, এই সুযোগে নেপালও আক্রমণ করতে পারে। সেই সব খবরে প্রভাবিত হয়েই হোক, বা পথঘাটহীন সিকিমে সামরিক অভিযান চালানো কঠিন সে বিবেচনাতেই হোক, কোম্পানি সিকিমে যুদ্ধবিগ্রহ কিছু করল না। দেওয়ান তুমলুঙ ছেড়ে দার্জিলিং-এর উল্টোদিকে নামচিতে আশ্রয় নিল। কোম্পানির সৈন্যসামন্ত রঙ্গীতের পারে কিছুদিন বসে থেকে ফিরে এল।

আরও পড়ুন
দার্জিলিং-এর গপ্পোগাছা - হুকার, ক্যাম্পবেল ও পাগলা দেওয়ান

সিকিম রাজা লয়েডকে দানবাবদ যতটা জমি দিয়েছিলেন, তার ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছনে আরো জমি কোম্পানি নিয়ে নিল। এর চাইতে কড়া কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি বলে হুকার বিরক্তি প্রকাশ করছেন বারবার। ভাবটা এরকম, সিকিম রাজা অথর্ব, দরিদ্র, শক্তিহীন, চালচুলো নেই, তাকে এত রেয়াত করার কীই বা আছে! তিব্বতী আর ভুটিয়া সেনার ব্যাপারটা বাড়িয়ে বলা হচ্ছে, হুকারের মত। তাছাড়া, নেপালের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো, তারা খামোখা আক্রমণ করতে যাবেই বা কেন? খাস কোম্পানির দেশের সায়েব হুকার, সিকিম রাজত্বে তাঁকে অসম্মানিত হতে হয়েছে, তিনি ক্রুদ্ধ হবেন, তা প্রত্যাশিত। কিন্তু যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে হুকার যা বলছিলেন, তাতে যুক্তি ছিল। হিল স্টেশনের ঠান্ডা ও গোরাসৈন্যপরিবৃত নিশ্ছিদ্র নিরাপদ 'বাফারে' বসে বসে সায়েবশাসকেরা দূর পাহাড় নিয়ে চিরকাল অকারণ আতঙ্কে ভুগেছেন। এর অন্যতম প্রধান কারণ, হিমালয় ও হিমালয় পার করে যে তিব্বতী মালভূমি ও মধ্য এশিয়ার প্রাচীন অজানা অঞ্চল, সে বিষয়ে সম্যক কেন, আংশিক তথ্যও ব্রিটিশদের কাছে ছিল না। তিব্বত ও সংলগ্ন এলাকায় কোম্পানি-পরবর্তী ব্রিটিশ শাসনকালে অসংখ্য গুপ্তচর পাঠানো হয়েছে, পরের দিকে সায়েব পর্বতারোহী, অভিযাত্রী ও রাজপুরুষেরা(যথা ইয়ং-হজব্যান্ড) বারবার অভিযান চালিয়েছেন। তবু উঁচু পাহাড়ের ভূগোল বশে আসেনি, পুরো এলাকার প্রামাণ্য মানচিত্রও তৈরি হয়নি। ফলে, যে ব্রিটিশরাজ অর্ধেক পৃথিবী অনায়াসে দখল করেছে, হিমালয় সীমান্তে তারা অতিরিক্ত সাবধানী, এমনকি নড়বড়ে। কে বলতে পারে, তুষারাচ্ছাদিত পর্বতমালা এবং সুউচ্চ মালভূমি এলাকায় ঠিক কোন বিপদ ঘাপটি মেরে বসে আছে? তিব্বত, চিন, জারের এবং পরের দিকে বলশেভিক রাশিয়া, এদের কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। সুতরাং হিল স্টেশনগুলোকে মজবুত করো, সীমান্তবর্তী ছোট রাজ্যগুলোকে চাপে রাখো। তার বাইরে বেশি হঠকারী কাজকর্ম করো না। সৈন্যসামন্ত সমেত লাসা অবধি চলে গেলেও সরে এসো। দূর থেকে, 'বাফার' থেকে দেখো, কী ঘটছে। হিমালয় সীমান্তে ব্রিটিশদের কাজকর্ম নিয়ে বহু লেখা আছে। স্বেন হেডিনের বিখ্যাত 'ট্রান্স হিমালয়াজ' তো আছেই, তা ছাড়া ইয়ং-হজব্যান্ডের একাধিক লেখা। পরের দিকে, ব্রিটিশরাজসময়ের অক্লান্ত কুলুজিকার চার্লস য়্যালেনের বহু সুখপাঠ্য লেখা আছে। এই প্রসঙ্গে আরো বহু লেখার কথা উল্লেখ করা যায়, আমাদের গল্পে সেসব অধিকন্তু ঠেকবে। 

আরও পড়ুন
দার্জিলিং-এর গপ্পোগাছা (তিন)

হুকার রেগে গিয়ে কড়া কথা বলেছেন, কিন্তু কোম্পানি সরকার সিকিম প্রসঙ্গে কিছু করেনি, এমন আদৌ নয়। ও'ম্যালির গ্যাজেটিয়ারে বলা আছে, সেসময়ের লাটসাহেব লার্ড ডালহৌসি নাকি বলেছিলেন, ক্যাম্পবেলের বা হুকারের মাথার একটা  চুলেরও যদি ক্ষতি হয়, সিকিম রাজার মাথা কেটে তার উত্তর দেওয়া হবে। ক্যাম্পবেলের চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিল সিকিমের সিপাইরা, সে প্রসঙ্গেই এই উক্তি বোধহয়। দার্জিলিং দান বাবদ রাজাকে যে বার্ষিক ৬০০০ টাকা দেওয়া হতো, তা বন্ধ করা হয়। হুকার ক্যাম্পবেলের দুর্গতির জন্য দায়ী যে দেওয়ান, তাকে দরবার থেকে তাড়ানো হয়। হুকার বলছেন, তাকে গলায় দড়ি দিয়ে তিব্বতে নিয়ে যাওয়া হয়।

আরও পড়ুন
দার্জিলিংয়ের গপ্পোগাছা (দুই)

দেওয়ান অবশ্য এত সহজে হারার বান্দা ছিল না। ও'ম্যালি বলছেন, তার মদতে সিকিমের সিপাইরা 'আমাদের এলাকায়'(সিকিমের এক তৃতীয়াংশ তখন 'আমাদের' অর্থাৎ কোম্পানির এলাকা) ঢুকে লুঠপাট চালায়, প্রজাদের তুলে নিয়ে সিকিমে আটকে রাখে। প্রজাদের বিষয়টি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। আগে বলা হয়েছে, ব্রিটিশরা এতদাঞ্চলে আসার আগেও খাজনা দেবার মতো প্রজা সিকিমে বিশেষ ছিল না। উদ্যোগী লয়েডের কূট প্যাঁচে দার্জিলিং-এর অনেকটা এলাকা কোম্পানির হাতে আগেই চলে এসেছিল, কোম্পানি ১৮৫০-এ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বাকিটার দখল নিল। এর ভিতরে তরাই-মোরাং-এর মেচ-ধিমাল জুমিয়া এলাকাটাও ছিল, যেখান থেকে স্থানীয় চৌধুরীরা নিয়মিত খাজনা তুলত। সেই খাজনাও যখন সরাসরি ব্রিটিশদের কাছে চলে গেল, সিকিম দরিদ্রতর হয়ে পড়ল। যে সব সিকিমবাসী পাকেচক্রে কোম্পানির এলাকার বাসিন্দা হয়ে পড়লেন, তাঁদের যেভাবে হোক ফিরিয়ে আনার দরকার ছিল। প্রজা ও খাজনা না থাকলে রাজত্বই বা কী, রাজ্যই বা কোথায়? এভাবে দেখলে, পাগলা দেওয়ানের 'পাগলামি'র কারণ বেশ বোঝা যায়। 

আরও পড়ুন
দার্জিলিংয়ের গপ্পোগাছা

সিকিমি হানা চলতে থাকল, ক্যাম্পবেল জেরবার হয়ে গেলেন। সিকিমরাজার বয়স আশি পেরিয়েছে, তিনি সিকিম ছেড়ে তিব্বতের চুম্বিতে বসে আছেন, কিছু নিয়েই মাথা ঘামান না। ফলে প্রজা ফেরানো বিষয়ে ক্যাম্পবেলকে বাধ্য হয়ে দেওয়ানের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করতে হল। লাভ হল না। অবশেষে, ১৬০ জন 'নেটিভ' ও গুটিকত গোরা সৈন্য নিয়ে ক্যাম্পবেল দেওয়ানকে শিক্ষা দিতে চেয়ে রাম্মাম নদী পেরিয়ে সিকিমে ঢুকে পড়লেন, রিংচিংপং অবধি চলে গেলেন। হায়, দেওয়ানের লোকজন তাঁকে তাড়িয়ে দার্জিলিং অবধি নিয়ে গেলো, মানে ক্যাম্পবেল পালিয়ে বাঁচলেন। এর পর, স্যর য়্যাশলি ইডেনের নেতৃত্বে জনৈক কর্নেল গওলার হাজার আড়াই লোক ও বিস্তর কামানবন্দুক নিয়ে ১৮৬১ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি দার্জিলিং থেকে রওনা দিলেন, তুমলুঙ পৌঁছোলেন মার্চ মাসের গোড়ায়। দেওয়ান পালিয়ে গেলো, তুমলুঙ দুর্গ গুঁড়িয়ে দেওয়া হল, রাজা তাঁর ছেলেকে সিংহাসনে বসিয়ে বাধ্যতামূলক বানপ্রস্থে গেলেন। ব্রিটিশ সরকারের হয়ে নতুন সিকিম রাজার সঙ্গে নতুন সন্ধিচুক্তি সই করলেন ইডেন সাহেব। চুক্তি নামে, আসলে তা বশ্যতাস্বীকারের দলিল। তিব্বতের সঙ্গে সায়েবদের সরাসরি বাণিজ্য চলবে, ঠিক হল। তিব্বত সীমান্ত অবধি রাস্তা করা হবে, যার অর্ধেক খরচ সিকিমের। সায়েবদের এলাকা থেকে ব্যাপারী ও পর্যটকরা বিনা বাধায় সিকিমে ঢুকতে পারবেন। ব্রিটিশ সরকারের প্রজাদের কাছ থেকে যা লুঠ করা হয়েছিল, সব ক্ষতিপূরণসহ ফিরিয়ে দিতে হবে। ক্যাম্পবেলের পালিয়ে আসার সময় যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তাও পুরিয়ে দিতে হবে।

এসবের মানে দাঁড়াল, স্বাধীন সিকিম বলতে আর কিছু থাকলই না। এদিকে দার্জিলিং-এ ততদিনে চা-চাষ শুরু হয়েছে পুরোদমে, সিঙ্কোনার চাষ শুরু হব-হব করছে। নেপাল ও সমতল থেকে লোকজন নিয়ে এসে ক্যাম্পবেল দার্জিলিং জমজমাট করে ফেলেছেন, বনটন প্রায় সাফ, নতুন চওড়া রাস্তা তৈরি হচ্ছে। তার আগে অবশ্য ভুটানের সঙ্গে সায়েবদের যুদ্ধ হচ্ছে, সায়েবসাম্রাজ্য প্রসারিত হচ্ছে তিস্তার ওপারেও। কিন্তু সে ভিন্ন গল্প।

Powered by Froala Editor