দার্জিলিং-এর বহু গল্প

সময়ভ্রমণ -৩০
আগের পর্বে

দার্জিলিং পত্তনের দায়িত্ব নিয়ে ক্যাম্পবেল রীতিমতো সামন্ততান্ত্রিক কায়দায় বিনাপারিশ্রমিকে কুলিদের দিয়ে কাজ করাতে থাকেন। কোম্পানিরও এতে কোনো আপত্তি ছিল না। তাঁরা জানতেন, এটা অনেক বেশি সহজ। অবজারভেটরি পাহাড় লাগোয়া অঞ্চলে গড়ে ওঠে সাহেবদের এলাকা। আর তার নিচে কুলি-কামিনদের বসতি। আজ সেই পুরনো দারজিলিং-এর কিছি ইস্কুলবাড়ি অবশিষ্ট আছে। কোম্পানির কাছে কিছু জমি চেয়ে আবেদন করেছিলেন লয়েড। কিন্তু কোম্পানি সেই আবেদন খারিজ করে। দার্জিলিং-এ লয়েডের নামে যে বোটানিক্যাল গার্ডেন আছে, তিনি অবশ্য অন্য লয়েড। মূল স্থপতির নাম নেই কোথাও।

দার্জিলিংয়ের নানান গল্পগাছা বাঙালি সমাজে বহুদিন ধরে চলছে। শহরপত্তনের পর, রাস্তাঘাট যখন খানিক তৈরি হয়েছে, কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি, শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং রেলপথ বসে গেছে, কলকাতা এবং বাংলার অন্যত্র থেকে ধনাঢ্য ও ভূস্বামী বাঙালিরা যাতায়াত শুরু করেছেন, সেই থেকে বাংলায় দার্জিলিংবৃত্তান্ত লেখা শুরু হয়েছে, এখনো, দার্জিলিংপত্তনের দেড়শো বছর পরেও সে সিলসিলা জারি আছে। বহু সায়েবদের বৃত্তান্ত যেমন, বাঙালির দার্জিলিংদর্শনও বস্তুত ভ্রমণকথা, নিসর্গবর্ণনায় মুখর, ছবি দেখার উত্তেজনা এবং বহুবিধ ব্যক্তিগত অনুষঙ্গে ভরপুর। বাঙালি, অথবা বাঙালিকল্প বিশিষ্টরা শরীর সারাতে এবং ছুটি কাটাতে দার্জিলিং এসেছেন, থেকেছেন, অনেকে জমিবাড়িও কিনেছেন। সে সব বাড়ির কোনো-কোনোটা বদলে যাওয়া দার্জিলিংয়েও থেকে গেছে, লেবং কার্ট রোডে নিবেদিতার স্মৃতিধন্য রায় ভিলা, ম্যালের একটু নিচে স্টেপ য়্যাসাইড, যেখানে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন মারা যান, অথবা লালকুঠি যাবার পথে বাঁদিকে জগদীশচন্দ্র বসুর বাড়ি।  সমতলের অর্থবান রাজা-জমিদারেরা দার্জিলিংয়ের উন্নয়নকল্পে টাকাপয়সা ঢেলেছেন, যথা কুচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ, বর্ধমান রাজারা। পুরোনো, প্রাক-ঔপনিবেশিক দার্জিলিং ভেঙে যখন সুরম্য সায়েবি দার্জিলিং ছড়িয়ে পড়ছে গিরিশিরায় আর পাহাড়ি ঢালে, বাঙালিরা সেই নির্মাণের শরিক, অংশীদার। সায়েবি দার্জিলিংয়ের নিসর্গের মায়া যখন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে রাজনীতি ও বাজারের যুগপৎ যৌথ আক্রমণে, সে কাহিনীতেও বাঙালির সরব উপস্থিতি, প্রধানত ভ্রমণার্থী হিসেবে, হোটেল মালিক বা ভ্রমণ ব্যবসায়ী হিসেবেও। দার্জিলিংয়ে আলাদা গোর্খা রাজ্য চেয়ে আন্দোলন শুরু হলে বাঙালি বিপন্ন বোধ করে, গঙ্গার এপারে ওপারে শহরের মানুষের মনে হতে থাকে, দার্জিলিং বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ, আহা রে, ওরা সব নিয়ে নিল। 

এই 'ওরা'ই বা কে, 'আমরা'ই বা কারা, এ নিয়ে বরাবর ধন্দ থেকে গেল। সায়েবপূর্ব দার্জিলিংয়ের কাহিনি যতটুকু জানা যায় তা বিশদ করে বলার পিছনে ওই 'ওরা-আমরা'র সমীকরণটির উৎস খোঁজার তাড়না যে খানিক কাজ করেনি, তা নয়। কার পাহাড়, কাদের বন, কার নদী, কাদের মাটি? কে বাইরের, কে-ই বা ভূমিপুত্র? কোন ভূমিখণ্ডের ওপর কার দখল? কোন প্রশ্নেরই সহজ উত্তর নেই। ব্রিটিশরা যখন এ অঞ্চলে ঢুকছে, কলকাতা অর্থাৎ সভ্যতা থেকে বহুদূরের এই জংলা পাহাড়ে ঘাঁটি গাঁড়বার বিশেষ ইচ্ছে তাদের ছিল না, বোঝাই যায়। লয়েড যদি না অত্যুৎসাহী হয়ে সিকিমরাজের সঙ্গে খুবই গোলমেলে একটা দেওয়া-নেওয়ার(নেওয়া বেশি, দেওয়া কম, নামমাত্র, কোম্পানির কাজের যা ধরণ) সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তেন, মস-লাইকেনে ছাওয়া দার্জিলিংয়ের আদিম বৃষ্টিভেজা পাহাড়ি বন আবাদ হত কিনা সন্দেহ। যাই হোক, সায়েবরা যখন ঢুকেই পড়ল, শহর বাড়তে থাকল, যে সহজ ওরা-আমরাটা সায়েবরা আর দশটা উপনিবেশে চালু করে দিয়েছিলেন, এখানেও তাই হল। শুধু ব্রিটিশ নয়, সাগরপাড়ের যাবতীয় সাদাচামড়া একদিকে, তাঁদের বলা হতে থাকল ইউরোপিয়ান। অন্যদিকে পাহাড়-সমতলের জুমিয়াসমাজ, লেপচা, লিম্বু, মেচ, ধীমল, তাঁদের বলা হতে থাকল নেটিভ। নেপাল থেকে বন কাটবার ও ব্রিটিশ সরকারের খাজনাদায়ী প্রজা হবার জন্য যাদের নিয়ে আসা হল, তাঁরাও তাই। যুরোপীয়ান সায়েবরা পাহাড়ে থাকবেন, ছুটি কাটাবেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করবেন। তাঁদের হয়ে কায়িক শ্রম দেবেন নেটিভরা। নেটিভ এবং যুরোপীয়দের মধ্যে সেতুবন্ধরূপে ঢুকে পড়লেন বিশেষত ধনী বাঙালিরা, যাঁরা সায়েব না হয়েও সায়েবদের মতো, পাহাড়ে বেড়াতে আসেন, সায়েববাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকেন কি পাহাড়ে ভূসম্পত্তির মালিক হন। সায়েবরা সমতল বাংলার আমবাঙালিদের মোটেই নেটিভ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেন না। অবশ্য সমতলের সাধারণ বাঙালিরা পাহাড়ে বেড়াতে আসতেনও না। যাঁরা আসতেন, তাঁদের কাছেও নেটিভরা নেটিভই। পাহাড়িদের নিয়ে বাঙালিরা কিছু ভাবছেন, লিখছেন, করছেন, চোখে পড়ে না। বিভিন্ন ভ্রমণবৃত্তান্ত ও স্মৃতিকথায় যেটুকু বলা হয়েছে, তা বিরল নিসর্গদর্শনের অংশ হিসেবে, পাহাড়ি শ্রমিকেরা সেখানে নিতান্তই 'ওরা', বড়জোর নৃতাত্ত্বিক আগ্রহের বস্তু, এক্সটিক। প্রচুর উদাহরণ হাজির করা যায়, দু একটি বলি। 

১২৯৫ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ইংরেজি ১৮৮৭ সনে ভারতী পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে স্বর্ণকুমারী দেবীর 'দার্জিলিং পত্র'। সম্ভবত এই লেখাই বাংলায় প্রথম দার্জিলিং ভ্রমণবৃত্তান্ত। স্বর্ণকুমারী ও তাঁর সঙ্গীরা(যাঁদের অন্যতম ছিলেন তরুণ রবীন্দ্রনাথ) দার্জিলিং গিয়েছিলেন ১৮৮৬তে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য তার আগেও একবার দার্জিলিং গিয়েছিলেন। ১৮৮২তে। তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ হিমালয় প্রেমিক ছিলেন, বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর পরিব্রাজন ছিলো, ফলে তিনি দার্জিলিংয়ে আসবেন, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। স্বর্ণকুমারীদের দলে ছিলেন মূলত পরিবারের মহিলারা, পুরুষ বলতে রবীন্দ্রনাথ।  শিলিগুড়ি-দার্জিলিং রেলপথ তৈরি হচ্ছে ১৮৭৯ থেকে ১৮৮১র মধ্যে। ১৮৮০র মার্চে  তিনধারিয়া অবধি ট্রেন চলাচল শুরু হয়ে গিয়েছে, বড়লাট লর্ড লিটন ট্রেনে করেই ওই পর্যন্ত যান। কোনো বড়লাটের সেই প্রথম দার্জিলিং সফর। ১৮৮১-র জুলাইতে দার্জিলিং অবধি গাড়ি চলাচল শুরু হয়ে যায়। শিক্ষিত, ধনাঢ্য বাঙালিরা সায়েবদের চেয়ে খুব পিছিয়ে ছিলেন না। 

স্বর্ণকুমারীর এই ভ্রমণকথা নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয়দের সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা বাদ দিলে সায়েবি দার্জিলিংয়ের নিসর্গের, এমনকি দার্জিলিং হিমালয়ের সায়েবপূর্ব অরণ্যের বিশদ চিত্রময় বর্ণনা আছে লেখায়, আছে তরুণ রবীন্দ্রনাথের ভাবনাচিন্তার ইঙ্গিত। দার্জিলিংপত্তন নিয়ে স্বর্ণকুমারী যে বয়ান দিচ্ছেন সেটাও বিশেষ আগ্রহের।  

আরও পড়ুন
দার্জিলিংপত্তনের পর

স্বর্ণকুমারীরা উঠেছিলেন ক্যাসলটন হাউসে, দার্জিলিংয়ের লেফটেন্যান্ট গভর্নরের পূর্বনিবাস এই বাড়ি দেবেন্দ্রনাথ ভাড়া নিয়ে রেখেছিলেন। অবজার্ভেটরি পাহাড় ছাড়িয়ে বার্চ হিলের রাস্তায় সে বাড়ি এখনো বেঁচে আছে। যতদূর জানি সেখানে এখন দার্জিলিং সরকারি কলেজের মেয়েদের হস্টেল। 

কাসলটন হাউস থেকে মল রোড এবং বার্চ হিলের পার্ক, দুটোই কাছাকাছি, ফলে ইচ্ছা হলেই চলে যাওয়া যেত। দূরে যেতে হলে ডান্ডিতে বা ঘোড়ায় যেতে হত। এইসব সময় এবং ট্রেনযাত্রায় পাহাড়িদের সঙ্গে বাঙালিদের দেখাসাক্ষাৎ হত। দার্জিলিং(আসলে ওটা ঘুম) স্টেশনে ট্রেন সবে থেমেছে, রবীন্দ্রনাথ নেমে দেখছেন গন্তব্যে যাবার কী ব্যবস্থা হয়, সেই সময়… 'এদিকে কুলিরা জিনিস লইতে উপস্থিত, ভুটিয়া কুলির চেহারা সেই প্রথম... চোখের কাছে--কী রকম ষন্ডা চেহারা, গাল দিয়া যেন রক্ত পড়িতেছে, মুখের হাড়গুলা সব বাহির হইয়া রহিয়াছে, এক একজন স্ত্রীলোক...ঠিক ডাইনির মতো, দেখিলে ভয় হয়।' অন্যত্র, 'লেপচারা... ভুটিয়াদের অপেক্ষা...সুশ্রী--ইহাদের নাসিকাও অপেক্ষাকৃত উন্নত।...ভুটিয়ারা অপেক্ষাকৃত সভ্য জাত।' 

আরও পড়ুন
দার্জিলিংপত্তন: লয়েডের চিঠি ও লয়েডবিদায়

সেসময়কার যে কোনো বাঙালিরচিত ভ্রমণবৃত্তান্ত পড়লেই বোঝা যায়, পাহাড়িদের প্রতি বাঙালিদের বিশেষ শ্রদ্ধাভক্তি ছিল না। 'দার্জিলিং পত্রে'র আর এক জায়গায় ভুটিয়া বস্তির এক লামা সম্পর্কে স্বর্ণকুমারী বলছেন, 'বাস্তবিকই...ভক্তি হইবার কিছু নাই, সাধারণ ভুটিয়ার মতো চেহারা, পোশাক পরিচ্ছদও সেইরূপ ময়লা, বিদ্যাবুদ্ধিও তথৈবচ'। 

শুধু পাহাড়ি মানুষ নয়। বন্য পাহাড়ি নিসর্গও পছন্দের বস্তু নয়। সেঞ্চল বনের বর্ণনা: 'সমগ্র দার্জিলিং...আগে এইরূপ বন ছিল। ইংরাজ নরককেও স্বর্গ করিয়া তোলে, কী কারখানা!' সেই স্বর্গের বর্ণনাও আছে: 'মলরোড আমাদের বাড়ির দক্ষিণে।...গাছপালার জঙ্গল আদপে নেই, কলকাতার রাস্তার মতো রাস্তার ধারে ধারে এক একটি গাছ...ফুলে ফুলে ভরা, গভর্নমেন্ট হাউসের কাছে একটি চাঁপার গাছে দুই একটি ফুল ধরে আছে, তাহার গন্ধেই তার আশপাশ ভরপুর। এক একটি গাছে সুন্দর পরগাছার ফুল।... কতরকম সুদৃশ্য ঘাস, কত ফার্ন...বন গোলাপের গাছে ছোট ছোট গোলাপফুল।...রাস্তার কিছু নীচে ইংরেজদের সুসজ্জিত দোকান...দার্জিলিং শহরের আর জলা পাহাড়ের মুক্ত দৃশ্য। পাহাড়ের সবুজ গায়ের উপর দার্জিলিংয়ের সাদা বাড়িগুলি স্তরে স্তরে উঠেছে--দেখতে বড়োই সুন্দর।' 

আরও পড়ুন
দার্জিলিংয়ের ছবি, ছবির দার্জিলিং - দার্জিলিংপত্তন নিয়ে আরও

যে বন্যতা বোধের অগম্য, ভয় পাইয়ে দেওয়া, তাকে সভ্য ভ্রমণকারীরা পছন্দ করেন না, তা তাঁরা সায়েব হোন বা বাঙালি। বন্য নিসর্গের প্রীতিপ্রদ পুষ্পশোভিত স্বর্গোদ্যানে রূপান্তরের, অর্থাৎ ছবি হয়ে ওঠার পিছনে যে দীর্ঘ ধ্বংসলীলা কাজ করেছে তা নিয়ে কেউ বড় একটা ভাবেননি। বেড়ানো ও ছবি দেখার, এমনকি ছবি তৈরির প্রক্রিয়া একমাত্রিক থেকেছে বরাবর। আগে যাঁরা বেড়াতে আসতেন তাঁদের অনেকেই নিসর্গছবি বা ল্যান্ডস্কেপ আঁকতেন। ক্যামেরায় ছবি তোলার চল হবার পর থেকে লোকে ছবি তুলত, তোলাত। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে। দার্জিলিং এবং ওইজাতীয় পাহাড়ি শহরগুলোয় যে নির্গলমুক্ত ট্যুরিস্টভিড় আছড়ে পড়ে, সেখান থেকে অহোরাত্র ফেনাবিজবিজে ছবি উঠছে ও উড়ছে। সেই সব ছবির অনেকগুলোতে 'স্থানীয়' পোশাক ও রং থাকে। লেবং কার্ট রোড ধরে নর্থ পয়েন্ট ছাড়িয়ে একটু গেলেই বাঁয়ে সবুজ চা বাগানের ছবির মতো ঢাল। ভালো রোদ্দুরের দিনে তার পিছনে কাঞ্চনজঙ্ঘা। রাস্তার পাশে সার সার ঝুপড়ি দোকান হয়েছে, সেখানে গাড়ির ভিড়। মহিলাপুরুষ বালিকাবালক বাগানের পাকদণ্ডি দিয়ে নিচে নামছেন, রঙচঙে 'পাহাড়ি' পোশাক পরে ছবির পর ছবি তুলছেন। সেই 'পাহাড়ি পোশাক' পাহাড়িরা কদাচ পরেন না, কিন্তু তাতে কি বা এসে যায়। সবুজের মধ্যে লালনীলকমলাবেগুনি রং ঝলমল করে, ভালো ছবি হয়। ছবি ভিন্ন 'দেখা' হয় না, বেড়ানোও। 

আর একটি ভ্রমণবৃত্তান্ত। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছবি তুলতেন, আঁকতেন। তাঁর লেখাতেও ছবি থাকতো। দার্জিলিং নিয়ে একাধিক লেখার সন্ধান পাওয়া যায়। ১৮৯১ সালে সখা পত্রিকায় প্রকাশিত 'দার্জিলিং প্রবাসীর পত্র' শীর্ষক ছোট্ট লেখায় দার্জিলিংয়ের 'মুটে'দের কথা বলা আছে:'...দেখিবার জিনিস দার্জিলিঙের মুটে।...তাহারা জিনিস ধরিয়া টানাটানি করে, কিচির মিচির করিয়া কথা কয় আর ফিক ফিক করিয়া হাসে।' আরো পরের দিককার অন্য একটি লেখায় আছে: 

আরও পড়ুন
দার্জিলিংপত্তন : লয়েডের বিদায় ও ক্যাম্পবেলের অভ্যুদয়

'...অনেকেই এখন দার্জিলিং গিয়া থাকেন। এক সময় এই স্থানের কথা লোকে জানিতও না। এমনকি ওইরূপ স্থান যে স্বাস্থ্যকর হইতে পারে, এ দেশের লোকের সেরূপ ধারণাই ছিল না। এরূপ হইবার দুইটি কারণ। পাহাড়ে অসভ্য লোকেরা থাকে, তাহাদের জ্বালায় নীচে থাকিয়াই অস্থির; সুতরাং উপরে উঠিয়া দেখিবার সাহস কাহারও হইতো না।' 

উপেন্দ্রকিশোরের বিশেষ সায়েবপ্রীতি ছিল বলে জানা যায় না, ফলে তিনি নিতান্তই ইয়ার্কি দিচ্ছিলেন কিনা জানা নেই। উনিশ শতকের শেষাশেষি এবং বিশ শতকের গোড়ায় দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি বাসিন্দাদের সম্পর্কে তিনি যা যা বলছেন তাতে কৌতুকমিশ্রিত প্রশ্রয় ছিলো, তীব্র অশ্রদ্ধা নয়। তথাপি উপেন্দ্রকিশোরের পাহাড়ি দেখা সাধারণ নিসর্গদর্শনের অংশ, ওরা-আমরার বিভাজনরেখা সেখানে স্পষ্ট। আরো কিছুকাল পরে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাহাড়ে উঠছেন, কার্শিয়াং-এ থাকছেন বেশ কিছু দিন। অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ দুজনেরই এদিককার পাহাড় নিয়ে আঁকা অনবদ্য সব নিসর্গছবি আছে। 'হাওয়াবদল' বলে দার্জিলিং পাহাড় নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ যে স্বভাবসিদ্ধ ছবি লিখেছিলেন, সেখানে পাহাড়ি মানুষ রঙিন, ছবিতে ঠাসা পাহাড়ি নিসর্গের অংশ: 

'গোলাপি ঘাগরা নীল ওড়না, নীল ঘাঘরি তার উপরে জাফরানি ঘোমটা--এমনি রঙের প্রজাপতির মতো পাহাড়ি মেয়ে চা বাগানের সবুজ ঝোপের উপর উড়ে বসেছে। নীল আকাশের আলো নীচের পাহাড়ে বেগুনি রঙের গাঢ় প্রলেপ মাখিয়ে দিয়েছে, উপরের পাহাড়ে কচি পাতার রঙে ছোপানো রোদের ঘোমটা, সমস্ত চা-ক্ষেতগুলো দেখাচ্ছে যেন গেরুয়ার উপরে চাকা চাকা সবুজের ছোপ-ধরানো গুলবাহার এক একখানি শাড়ি, অতি যত্নে মানুষ পাহাড়ের গায়ে জড়িয়ে দিয়েছে।' 

রঙের পর রং এসে পড়ছে, সবুজ, গোলাপি, নীল, জাফরানি, গেরুয়া। অবনীন্দ্রনাথ ছবি লিখছেন, যা তাঁর পক্ষেই সম্ভব। কার্শিয়াং-এর যে বাড়িটায় তিনি থাকতেন তার বারান্দা থেকে পাহাড়ি চা-বাগানের এই ছবি দেখা যেত, ধরে নেওয়া যায়। যে রঙ যে ছবি থাকতো না, অন্য ছবি থেকে সেই রংছবি নিয়ে আসতেন অবনীন্দ্রনাথ, দার্জিলিং পাহাড়ের সায়েবশাসিত,  বানানো, ঔপনিবেশিক নিসর্গে মিশে যেত বহু দূরের রাজপুতানার রঙ, মোঘল আর কাংড়া ছোটছবির পরিমিত দ্যুতি। কিন্তু রঙের নিচে সায়েবশাসনের যে হিংস্রতা ঢাকা পড়ে ছিল, গুলবাহার শাড়ির নিচে পাহাড়ি বনকাটাইয়ের যে নৃশংস অভিযানের ইতিহাস সুপ্ত ছিল, বাঙালি লেখক, শিল্পীদের চোখে তা ধরা পড়েনি। বাঙালির ছবি, দেখা, রঙ, সহানুভূতি, মানবিকতা, এর প্রায় সবটাই সায়েবি দার্জিলিংয়ের সুন্দর, ছবির মতো নিসর্গের প্রবল আপাতপ্রত্যক্ষতায় ভেসে গেছে। 

সমতলের বাঙালিরা সায়েবদের মতো করে পাহাড়কে দেখতে শিখেছেন। শুধু বাঙালিরা নন, সায়েবরা পাহাড়ে যাঁদের নিয়ে বসিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকের দেখাও ওইভাবে তৈরি হয়েছে। যে নিসর্গে বাঙালি দেখেছেন রং, অন্য কেউ দেখেছেন নাফা। যে নিসর্গ উপনিবেশের, শাসকের, সায়েবরা তা ছেড়ে দেশে ফিরে গেছেন কালক্রমে, ছবি ভেঙেচুরে নষ্ট হয়ে গেছে। অবনীন্দ্রনাথ যে বাড়িতে থাকতেন, তার চারপাশ ঘিরে বেরং ধূসর নির্মাণ মাথা তুলেছে। ডাউহিল যাবার পথে যেখানে বাড়িটা ধুঁকছে, তার সামনের পিছনের পাহাড়ে ছড়িয়ে গেছে ঘিঞ্জি শহর। চা-বাগান ছেড়ে ব্যাপারীর পুঁজি দৌড়েছে অন্য কোথাও, প্রজাপতিদের ডানা ছিঁড়ে মেরে ফেলেছে কেউ। হায়, এখনো অন্য দেখা তৈরি হয় না, পুরোনো ওরা-আমরার ভাবনা বদলে নতুন কিছু আসেনি। এলেও তা নষ্ট হয়ে গেছে। ধীরেসুস্থে সেসব কথায় আসা যাবে।

Powered by Froala Editor