সময়ভ্রমণ – ৩
আগের পর্বে
তিস্তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক বিভীষিকা। আটষট্টির বন্যা। তার উন্মত্ত জলকল্লোল ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কত ঘর-বাড়ি, তিস্তা বাজার, ব্রিজ, দু’পাশের পাহাড়ের ঢাল আর প্রাণও। কিন্তু তার পিছনেও ছিল মানুষের হাত। বাঁধের পর বাঁধ দেওয়ায় বর্ষা এলেই ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে তিস্তার জলরাশি। রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে অনেক চেষ্টা করেও আটকানো যায়নি কালিঝোরার বাঁধ। এক এক ঋতুতে তিস্তার রং এক এক রকমের। তিস্তার সেই রূপ ধরা দিয়েছিল রুমারের লেখায়। অনুপ্রাণিত করেছিল রেঁনোয়ার তুলিকেও। তিস্তার নামের সঙ্গেও জুড়ে আছে এই রং। ‘রঙ-ন্যিয়ো’, এটাই তিস্তার ভুলে যাওয়া আদি ও লেপচা নাম।
তিস্তা, মানে রঙ-ন্যিয়োর কথা হচ্ছিল। তিস্তা লাইনের ছোট গাড়ির রিয়াং স্টেশনটা যেখানে ছিল, সেখান থেকে খাড়া উৎরাই নামলে যে জায়গাটায় পৌঁছনো যেত, সেখানে তিনটে নদী এসে মিশেছে, রঙ-ন্যিয়ো, রিলি বা রেললি আর রিয়াং। লেপচা ভাষায় রিলির অর্থ ফেনিল জলস্রোত। কোথায় একটা পড়ছিলাম রিয়াং আসলে রি-ইয়ায়ঙ, সময় দিয়ে সময় রাখা। তিনটে নদীর তিনরকম রং, চেহারা, ছবি। রঙ-ন্যিয়ো বড়ো, সবুজ জলের ভিতরে দৈত্যাকার পাথরেরা ডুবে আছে। রেললি তুলনায় ছোটো, অথচ খরস্রোতা। তিস্তাবাজারের দিকে, অর্থাৎ উত্তরে মুখ করে দাঁড়ালে, ডানদিক থেকে রেলি এসে পড়ে, আর দক্ষিণ থেকে আসে রিয়াং, তার নীলচে-সবুজ জল, এক বর্ষার সময় ছাড়া বাকি সময়টা তিরতিরে ক্ষীণকায়া ধারা, হেঁটে পেরিয়ে যাওয়া যায়।
পুরোনো রোপওয়েটা ভেঙে পড়ল। নদীগুলো চাপা পড়ল বাঁধের তলায়। ঘিরলিংটাও বন্ধ হয়ে গেল— বাঁধ পেরিয়ে এপার ওপার হয় এখন। কথা নেই, বার্তা নেই, শেখরও দুম করে চলে গেল। কাউকে কিচ্ছু না বলে, একদিন দুপুরবেলা সাঁতার কাটতে কাটতে সুস্থ সবল মানুষটা উধাও হয়ে গেল— ভাবলে এখনও কেমন ধন্দ লাগে।