দার্জিলিংপত্তন : লয়েডের বিদায় ও ক্যাম্পবেলের অভ্যুদয়

সময়ভ্রমণ - ২৬
আগের পর্বে

সিকিম রাজের সঙ্গে কোম্পানির মধ্যস্থতায় ব্যর্থ হলেন লয়েড। কোম্পানির কর্তারা তাঁর উপর রুষ্টই হলেন। অবশ্য ১৮৩৫ সালে সিকিম রাজা তাঁর প্রতিশ্রুতি মতো দার্জিলিং-এর দানপত্র পাঠালেন। বিনিময়ে কোম্পানি যে ভেট পাঠালো তা অতি সামান্য। ফলে ক্যাম্পবেলের সঙে সিকিমের সম্পর্ক খারাপ হতেই থাকে। যদিও সবকিছুর জন্য আবারও দায়ী করা হয় লয়েডকেই। এদিকে পিনের দোর্জে-লিং পুস্তিকা প্রকাশের পর ভারতীয়দের মধ্যেও দার্জিলিং নিয়ে উৎসাহ বাড়তে থাকে। ধনী বাঙালিদের নিয়ে গড়ে ওঠে দার্জিলিং অ্যাসোসিয়েশন। প্রিন্স দ্বারকানাথ ছিলেন তার অন্যতম সভ্য।

পিন যে সব সমসাময়িক দলিলপত্র জড়ো করেছেন তা থেকে বোঝা যায় লয়েড আর যাই হোন খুব কৌশলী মানুষ ছিলেন না। কৌন্সিলকর্তাদের সম্মতি না নিয়েই একতরফাই তিনি কোম্পানির অধীন দার্জিলিং এলাকায় থেকে যাওয়া লেপচাদের ওপর এক ফতোয়া জারি করলেন, যার মর্মার্থ, ওই লেপচারা আর সিকিম রাজার প্রজা নন, ফলে এখন থেকে রাজার পরিবর্তে কোম্পানিসরকার অর্থাৎ লয়েডকে খাজনা দিতে হবে। কোম্পানিকে লেখা ১৮৩৯-এর ১৬ই জানুয়ারির চিঠিতে লয়েড বলেন ব্রিটিশদের তরফে কর্তৃত্ব দেখানো দরকার। সিকিমের রাজা এখনো কোম্পানির এলাকায় থাকা লেপচাদের প্রভাবিত করে যাচ্ছেন। তাদের বুঝিয়ে দেওয়া দরকার আসল মালিক কে। এর উত্তরে কৌন্সিল জানায় সিকিমের রাজা ব্রিটিশ সরকারের বন্ধু এবং দার্জিলিং এলাকা থেকে খাজনা পাবার প্রত্যাশা সরকার করে না। সরকারের ধারণা ছিল স্বাস্থ্যাবাস বানানোর জন্য এক খণ্ড জমি নেওয়া হচ্ছে, সেখানে হঠাৎ করে খাজনাদায়ী গ্রামের কথা আসে কি করে? লয়েড সেসময় নকসালবাড়িতে বসে আছেন, নেপাল-সিকিম সীমান্ত বিবাদ, বিশেষ করে অনটু এলাকা নিয়ে তাঁকে মাথা ঘামাতে হচ্ছে। জবাবী চিঠিতে লয়েড দার্জিলিং এলাকার প্রাক-ঔপনিবেশিক সমাজ ও জনগোষ্ঠী সম্পর্কে নানান মন্তব্য করেন। জুমিয়াসমাজের সহজাত যাযাবরবৃত্তি ও জুমচাষের পদ্ধতি বুঝিয়ে তিনি বলেন যে ওই অঞ্চলে স্থায়ী গ্রাম বলতে কিছু নেই, চাষ ও গ্রাম জায়গা বদলাতে থাকে। মাথাপিছু বা 'দা'পিছু খাজনা ধরার দিশি পদ্ধতির কথাও লয়েড বলেন। তাঁর প্রধান বক্তব্য ছিলো, এখন লোক নেই, কিন্তু পরে লোক বাইরে থেকে আসতেই পারে, স্থানীয় মেচ এবং লেপচাদেরও সংখ্যাবৃদ্ধি হতে পারে। কোম্পানিসরকার খাজনায় উৎসাহী নয়, এই কথার জবাবে লয়েড বলেন, এলাকার জনসংখ্যা বাড়লে খাজনা ব্যাপারটা ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। অত:পর লয়েড আবার বলেন, 'কাজি' ও তার লোকজন আমাদের দিকে চলে আসতেই পারে। কাজির লোকজন  বলতে অনটু অঞ্চলে ডেরা বাঁধা উদ্বাস্তু লেপচারা, যাদের মধ্যে কেউ কেউ ১৮৩৪-৩৫ নাগাদ মোরাংয়ে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন। তখনো মেচি নদীর পূবদিকের মোরাং সিকিম রাজার জায়গা। রাজা লয়েডের শরণাপন্ন হন, লয়েড লেপচাদের আবার অনটু ফেরত পাঠান। 

দার্জিলিং পত্তনের ইতিহাস এবং লয়েডের ভাগ্যের সঙ্গে অনটু সীমান্ত ঝামেলার বিষয়টা প্রথমাবধি জড়িয়ে থেকেছে। কোম্পানিকর্তারা তিতিবিরক্ত হয়ে লয়েডকে বললেন, তিনি যেন অবশ্যই সিকিম রাজাকে নেপালের সঙ্গে একটা শেষ আলোচনায় রাজি করান, এই বিবাদের দ্রুত মীমাংসা দরকার। সেটা ১৮৩৮-এর অক্টোবর। লয়েড সেইমতো রাজাকে জানালেন। কিন্তু রাজা কিছুতেই আসতে রাজি হলেন না। তাঁর বক্তব্য ছিলো এ বিষয়ে তাঁর বা তাঁর ভকিলদের নতুন কিছু বলার নেই, তাঁর হয়ে লয়েড যেন আলোচনায় অংশ নেন, এবং যা করণীয় করেন। ১৮৩৯-এর জানুয়ারির শেষেও রাজা যখন রাজি হচ্ছেন না, কলকাতার কোম্পানিকর্তারা ও নেপাল দরবার প্রবল খাপ্পা হলেন। নেপালের ব্রিটিশ রেসিডেন্ট তখন স্বয়ং ব্রায়ান হজসন, তাঁকে চিঠি লিখে লয়েড রাজার পক্ষ নিলেন। আলোচনায় বসা মানে নিচে অন্তত শ তিনেক লোক পাঠানো। তাদের জন্য মাংস, মদ, গাড়ি ইত্যাদির জোগাড় করতে একগাদা খরচা। তারপর নিচে ম্যালেরিয়ার ভয়। লয়েড বললেন, এত খরচা রাজা করতে চাইছেন না, বিশেষত যখন সীমান্ত নিয়ে বিশদ কথাবার্তা আগেই বার দুয়েক হয়ে গেছে। শেষমেশ রাজার হয়ে লয়েড, ওদিকে নেপাল থেকে ক্যাম্পবেল এলেন নেপালরাজার প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে। নকসালবাড়ির কাছে মেচি পেরিয়ে তাঁরা নেপালে ঢুকলেন ৪ঠা ফেব্রুয়ারি। অনটু পাহাড় ঘুরে দেখে নকসালবাড়ি ফেরত এলেন ১৪ই। ১৫ই সিকিম রাজার কাছ থেকে আবার চিঠি এলো, তিনি আসতে পারছেন না। বিভিন্ন সাক্ষীদের সঙ্গে কথাবার্তার পর লয়েড আর ক্যাম্পবেল আলাদা আলাদা রিপোর্ট পাঠালেন। সরকার নেপালের পক্ষে রায় দিল, অর্থাৎ পূর্ব নেপালের পুরোনো লেপচা এলাকার ওপর সিকিমের দাবি মানা হল না। পিন বলছেন, কৌন্সিলের তরফে বিবাদ মীমাংসার জন্য যাবতীয় কৃতিত্ব দেওয়া হল ক্যাম্পবেলকে। লয়েডের আহত বোধ করবার সঙ্গত কারণ ছিল। তাঁর হয়ে বলবার লোক নেই বলে তিনি নিজেই কৌন্সিলকে চিঠি লিখে জানালেন, অনটু নিয়ে এত পরিশ্রম করার পরেও সমস্ত কৃতিত্ব ক্যাম্পবেলকে দেওয়া হচ্ছে, এটা ঠিক হচ্ছে না। সে চিঠিতে ফল হল না। ক্যাম্পবেল দার্জিলিং-এর গল্পে ঢুকে পড়েছিলেন। দার্জিলিং-এর সর্বময় কর্তা হিসেবে লয়েডের সময় ফুরিয়ে আসছিল। 

লয়েডের খুঁটির জোর ছিল না, বোঝাই যায়। তা ছাড়া কৌন্সিল কর্তাদের কাছে ক্যাম্পবেল বেশি পছন্দের লোক, ওদিকে কলকাতার দুর্দান্ত গ্রীষ্ম চোখ রাঙাচ্ছে, দার্জিলিং-য়ের ঠান্ডায় উঠে যাওয়া প্রয়োজন। কেন দার্জিলিং নিয়ে কাজ এগুচ্ছে না তা নিয়ে বিপুল হইচই শুরু হল, কোম্পানিসরকার নিজে না হোক, দার্জিলিং অ্যাসোসিয়েসন বিষয়টা তাদের কমিটির অন্যতম সদস্য, মেজর ই গারস্টিনকে তদন্ত করে দেখতে বলল। গারস্টিন সে সময় নিচের রাজ্যগুলির(লোয়ার প্রভিন্সেস) প্রধান ইঞ্জিনিয়ার, তদুপরি দার্জিলিং-এ একাধিক সম্পত্তির মালিক। গারস্টিন-এর রিপোর্ট দার্জিলিং য়্যাসোসিয়েসনের সম্পাদক এবং প্রধান রাজপুরুষ মি লো-এর হাত ঘুরে এবং কৌন্সিলঘর হয়ে দার্জিলিং-এ লয়েডের কাছে পৌঁছে গেল। হুরাকারুতে সে রিপোর্ট চিঠি হয়ে বেরুলো ১৬ই মার্চ। তার ঠিক  আগেই ২৫শে ফেব্রুয়ারি থেকে কিস্তিতে কিস্তিতে 'জনৈক ভ্রামণিকের চিঠি' নামে আর একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। দুটো চিঠিরই মূল বক্তব্য ছিল, দার্জিলিংয়ের কাজ আদৌ এগুচ্ছে না। কুলিদের থাকার জায়গা নেই, উপযুক্ত জামাকাপড় নেই, তারা ঠান্ডায়, পিপসা পোকার কামড়ে অথবা অন্য কারণে অসুস্থ হয়ে কিম্বা স্রেফ না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে, না হয় পালাচ্ছে। 'ভ্রামণিকের চিঠি'তে বিশদ বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বলা হল কীভাবে তিতলিয়া-দার্জিলিং পথের এখানে ওখানে পচা অর্ধপচা মৃতদেহ গড়াগড়ি খাচ্ছে। মোট এগারোটা লাশ দেখা গিয়েছিল। পথের একটা বাংলোও ঠিক করে তৈরি হয়নি। মাহালদিরাম আর কারসিয়াংগুড়ির বাংলো বলতে চেরা বাঁশের কুঁড়ে, দেয়াল ছাদ কিছুই ঠিক নেই,  মাহালদিরামে মেঝে বলতে থকথকে কাদা। পাঙ্খাবাড়ি থেকে জলাপাহাড় অবধি পুরো পথটাই চার হাতে পায়ে পাহাড় চড়ার মত করে যেতে হয়। 

এসব খবরে কলকাতার কৌন্সিলকর্তা ও অন্য সায়েবরা আশ্বস্ত হননি। রাস্তা না হওয়া, রাস্তায় থাকবার বন্দোবস্ত নিয়ে অসুবিধা, তদুপরি দার্জিলিং পৌঁছে বাজার ইত্যাদি উপযুক্ত ব্যবস্থাদি না থাকা। মার্চ এপ্রিল নাগাদ লোকে পাহাড়ে উঠতে শুরু করবে, অথচ ফেব্রুয়ারি অবধি দার্জিলিং এর বাজার বসেনি। গারস্টিনের রিপোর্টে বাজার কেন বসেনি সে বিষয়ে কিছু কথা ছিল। কৌন্সিলের সঙ্গে লয়েডের পরবর্তী কথোপকথনে দেখা যাচ্ছে, বাজারের ব্যাপারে লয়েড আগাগোড়া নির্ভর করছিলেন কিষেনগঞ্জের জনৈক মি পেরির ওপর। রাস্তা ও বাজার তৈরির খরচা বাবদ লয়েড কোম্পানিসরকারের কাছ থেকে পেয়েছিলেন বারো হাজার টাকা। তার মধ্যে আট হাজার টাকার কিছু বেশি গিয়েছিলো পেরির কাছে। লয়েডের কাছে রসিদপত্র ছিল না। গারস্টিনের রিপোর্টে দেখা গেল, বাজার বসানো দূরস্থান, যে এলাকায় বাজার বসবার কথা, সেখানকার জঙ্গল অবধি সাফ হয়নি। কৌন্সিলকর্তাদের বিস্তারিত হিসেব দিয়ে লয়েড জানালেন, তাঁর মোট খরচা হয়েছে ১৪৬৯৮ টাকা। তিনি পেয়েছেন বারো, অর্থাৎ বাকিটা সরকারের কাছে তাঁর পাওনা। এই হিসেব ১৬ই মার্চের। ৩রা এপ্রিল আর একটা চিঠি লিখে লয়েড পেরি বৃত্তান্ত খোলসা করছেন:

আরও পড়ুন
সময়ভ্রমণ ২৫: লয়েড, সিকিমপতি রাজা ও কোম্পানির দার্জিলিংলাভ (দুই)

“গত বছরের জুলাই মাসে আমি পূর্ণিয়া জেলার প্রান্তবর্তী সূর্যাপুর জমিদারির মি পেরির সঙ্গে যোগাযোগ করি। দার্জিলিং গিয়ে বসবাস আর দোকান খুলবার মতো লোক জুটিয়ে দেবেন এই কড়ারে...আমি পেরিকে অগ্রিম টাকা দিই।...১২ই সেপ্টেম্বর আমি জানতে পারি যে সূর্যাপুর জমিদারির মালিক রাজা দিদার হোসেন ও হুসেন রাজা পূর্ণিয়ার কালেক্টরের কাছে পেরির নামে অভিযোগ করেছেন যে পেরি তাঁদের না জানিয়ে দার্জিলিং বাজারের জন্য প্রচুর মাল তুলছেন।...এসব আমার আগে জানা ছিল না।….আমি ভেবেছিলাম দার্জিলিং-এর কারবারটা চালাবেন পেরির শ্যালক মি জে বার্নস।...কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। পেরি মাল রাখার জন্য গোলা বানাচ্ছিলেন, মাল নিয়ে যাবার জন্য গরুর গাড়ি তৈরি হচ্ছিল, নদীপথে শস্য নিয়ে যাবার ব্যবস্থাও….অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর জুড়ে পাঙ্খাবাড়ি অবধি মাল পৌঁছনোর সব কাজ হয়ে সারা হয়ে গিয়েছিল(আমি ২০০ কুলি ভাড়া করে দিয়েছিলাম)।...তারপরে চালানি মালের অভাব দেখা দিল, আমি পেরিকে লিখলাম আরো কুলি ভাড়া করে মালের যোগান ঠিক রাখতে। আমাকে অবাক করে পেরি উত্তর দিল যে বাজার বসানোর জন্য ওর সঙ্গে কোন চুক্তি হয়নি, কুলিও জোগাড় হচ্ছে না, ফলে ওই ব্যবসায় ওর আর আগ্রহ নেই….আমি ভাবতেই পারিনি যে পেরির মতো একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক, সরকারি চাকুরে এমন কাজ করবে….”

বলা বাহুল্য, কৌন্সিল কর্তারা এই সাফাইয়ে সন্তুষ্ট হননি। আট হাজার টাকা সে-যুগে অনেক, আজকের হিসেবে প্রায় একশো কোটি, বেশিও হতে পারে। এত টাকা কেউ বিনা লেখাপড়ায়  কাউকে দিয়ে দিতে পারে? কৌন্সিল সভাপতির তরফে লয়েডকে কড়া বার্তা পাঠানো হল :

আরও পড়ুন
লয়েড, সিকিমপতি রাজা ও কোম্পানির দার্জিলিংলাভ – ১

“মহামান্য কৌন্সিল(লাটসাহেব)আপনার ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারছেন না।...জনৈক পেরির হাতে বিশাল অঙ্কের তহবিল তুলে দিয়ে সরকারের প্রতি আপনার দায়িত্ব ফুরিয়ে যায় না।...মহামান্য কৌন্সিল আমার মাধ্যমে তাঁর চূড়ান্ত বিস্ময় প্রকট করতে চেয়েছেন যে আপনি ওই ব্যক্তিকে ক্রমাগত অগ্রিম দিয়ে গেছেন, বাড়তে বাড়তে তা ৮০৭৭ টাকায় পৌঁছেছে, অথচ আপনার পক্ষে সন্তোষজনক ব্যবস্থাদি আদৌ হচ্ছে তা নিশ্চিত করার উপায় হয়নি…”

লয়েড হয়তো বুঝতে পারছিলেন না তাঁর সময় ফুরোচ্ছে। কৌন্সিলকর্তারা এবং স্বয়ং লাটসাহেব তাঁর কাজে ঘোরতর অসন্তুষ্ট, তা জানার পরেও তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে বহুবিধ যুক্তি দিয়ে কলকাতায় চিঠি দিলেন। তাঁর বক্তব্য, পেরির ওপর ভরসা করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। লিখিত চুক্তি করতে চাইলে পেরি বিগড়ে যেতেন, ফলে কাজ যতদূর এগিয়েছে তাও হত না। রাস্তার কাজও এগিয়ে যেত, কিন্তু লয়েড তাঁর ইচ্ছামতো কাজ করতে পারেননি। দার্জিলিংকাণ্ড নিয়ে লয়েড মূলত দায়ী করেন কলকাতার লোকজনকে। 

আরও পড়ুন
পাহাড়ে ওঠা, থাকা : লয়েড, দার্জেলিং ও ফ্রেড পিনের দার্জিলিং লেটার্স

“...যাঁরা দার্জিলিং এ বাজারের অভাব নিয়ে অভিযোগ করছেন, এই অবস্থার জন্য তাঁরা নিজেরাই দায়ী।...একটা ঠিকঠাক রাস্তা যতদিন না তৈরি হচ্ছে, কী করে কী হয় সেটা ভাবা উচিত ছিল…পাহাড় কেটে যে পথ বানাতে সিমলা আর ল্যান্ডওরে লেগেছে কুড়ি বছর, তাঁরা ভাবলেন দার্জিলিংয়ে সেই কাজ এক বছরের মধ্যে হয়ে যাবে, এমন একটা এলাকায় যেখানে মজুর নিয়ে আসতে হয় নিচ থেকে, কেননা পাহাড়ে লোক নেই…”

রাস্তা বানানোর বা বাজার তৈরির জন্য মজুর জোগাড় নিয়ে এই চিঠিরই অন্যত্র লয়েড বলছেন:

আরও পড়ুন
টুকরো টুকরো তরাই: নিসর্গের খোঁজ

“কুলি জোগাড়ের কাজের জিম্মা ছিল সর্দার আর দফাদারদের। এক একজন দফাদার পুরো এক মাসের জন্য ২৫জন লোক আনবে কথা ছিল, কিন্তু দেখা গেল লোকেরা ১৫ দিনের বেশি থাকতে চায় না। তারপর তারা বাড়ি ফিরে যেত। নিজেদের খাবার ওরা সঙ্গে নিয়ে আসত। যারা এক মাসের বেশি কাজ করতে চায় না তাদের জামাকাপড় কেনার আর্থিক দায় সরকারের ওপর চাপানোটা ঠিক বলে মনে হয়নি। নিচে সমতলে মজুরি দিনপ্রতি এক আনা, রাস্তার কাজে যারা ছিলো তারা পাচ্ছিল আড়াই আনা করে। এমতাবস্থায় নিজেদের জামাকাপড়ের ব্যবস্থা তারা নিজেরাই করবে এটা ধরে নেওয়া হয়েছিলো।”

সায়েবপূর্ব সিকিম-মোরাং এবং সিকিম-নেপাল-ভূটানের পাহাড়ে রাজকার্যে প্রজাদের বাধ্যতামূলক বেগার দিতে হত। কুলি নিয়ে প্রচুর ঝামেলাঝঞ্ঝাটের পর সায়েবরা বেগার এবং আধা-বেগার প্রথার প্রচলন করেন। জঙ্গলের টঙিয়া গ্রাম, ডুয়ার্স বা আসামের চা বাগান, উত্তর থেকে দক্ষিণ বাংলার কৃষি অঞ্চলে নীল চাষ, এসবের শ্রম আসতো পুরোনো সামন্তিয় কায়দায়। কুলি জোগাড় করা মানে কুলিদের কাজ করতে বাধ্য করা, সায়েবরা এই সারসত্য দ্রুত বুঝে যান। লয়েড বারবার বলছেন কুলি জোগাড় করার জন্য সরকারি ব্যবস্থা নেওয়া হোক, নাহলে তাঁকে উপযুক্ত প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়া হোক। কিন্তু লয়েডের দার্জিলিংশাসন যে সময়ে তখনো এ অঞ্চলের সায়েবি ভূগোল তৈরি হয়নি, ঔপনিবেশিক রাজনীতির অবয়ব স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। লয়েড অপসারিত হবেন, ক্যাম্পবেল এসে বাকি কাজ করবেন। যথা, এলাকার মাতব্বর এবং সামন্তপ্রভুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে কুলি সমস্যা তিনি মিটিয়ে ফেলবেন। সেসব আখ্যানে ক্রমশ যাওয়া যাবে।

Powered by Froala Editor