সময়ভ্রমণ - ২৫
আগের পর্বে
দেশের অন্যান্য পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি স্থাপনের অনেক আগেই সেখানে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। দার্জিলিং-এর বিষয়টা আলাদা। নেপাল, ভুটান এবং সিকিমের রাজত্বের মধ্যে গোলমাল যত ছিল, জায়গাটা তত লাভজনক ছিল না। যাবতীয় কাজের দায়িত্ব সামলাতে হয়েছিল কোম্পানির কর্মচারী লয়েডকে। তিনি রাজনীতিক থেকে শুরু করে স্থপতি, বাস্তুবিদ এমনকি ভূতাত্ত্বিকের কাজও করেছেন। অথচ কোম্পানি পরে যে জটিলতার মুখে পড়েছিল তার জন্য লয়েডকেই দায়ী করেছিলেন কলকাতার কর্তারা। যদিও লয়েড একটু দেরিতে হলেও কোম্পানিকে সবটাই জানিয়েছিলেন। তারপর...
কৌন্সিল সিকিম রাজার অনুরোধ মানতে রাজি না হওয়ায় লয়েড মুশকিলে পড়লেন। ফেব্রুয়ারিতে তিস্তাপারের দরবারে রাজ সন্দর্শনে গিয়ে তিনি কি বলেছিলেন (বা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন) তা জানবার উপায় নেই। কৌন্সিলের পিছনে তিনি লেগে রইলেন, রাজার অনুরোধ যে যুক্তিসঙ্গত তা কলকাতার কর্তাদের বোঝাবার চেষ্টা করলেন:
“যে জমিটা আমি রাজার কাছে দাবি করেছি...মাসে ৫০০ টাকা অথবা বছরে ৬০০০ টাকা হিসেবে ধরলে তার দাম দাঁড়ায় নিদেনপক্ষে ১২০০০০ টাকা। জমির খাজনা থেকে সরকারের টাকা উঠে আসবে। আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, ব্যক্তি হিসেবে যদি আমি জমিটা কিনতাম, কিম্বা যদি আমার কাছে টাকা থাকতো, খুশিমনে এক লক্ষ টাকা আমি খরচা করে ফেলতাম।...তবে রাজার কাছে টাকার বিশেষ দাম নেই। পরিবর্তে দামি উপহার কিছু দেওয়া গেলে, যথা মুক্তোর ছড়া, প্রবালের নেকলেস কিম্বা দামি পশমের কাপড়, রাজা খুশি হবেন। আমার মত হচ্ছে রাজা যদি রঙ্গীত থেকে সেঞ্চল অবধি দিতে রাজি হন, সেইসঙ্গে ওই এলাকায় পৌঁছোনোর জন্য রাস্তা বানানোর মতো জমি, আর রাস্তার দুধারে দুশো গজ মতো জায়গা, আর বিনিময়ে সরকার যদি ১০১টা সুদৃশ্য মুক্তা, তিনটে বড়গোছের প্রবাল নেকলেস, বিভিন্ন রকমের কাপড় ও আরো কিছু ছোটখাটো জিনিস রাজাকে ভেট দেয়...সরকারের সন্তুষ্ট হওয়া উচিত। গভর্নর জেনরেল যদি কতটা জমি চাওয়া হচ্ছে তা বুঝিয়ে রাজাকে একটা চিঠি দেন এবং ঠিক কি কি ভেট যাচ্ছে সে বিষয়ে রাজা যদি জ্ঞাত থাকেন... মনে হয় না রাজার আপত্তি হবে।”
১৫ই জুন কৌন্সিল লয়েডকে কড়াগোছের নির্দেশ পাঠায়:
“….আপনার পত্র থেকে ভারতের মাননীয় গভর্নর জেনরেলের ধারণা হয়েছে, সিকিমের রাজা দার্জিলিং ছাড়তে রাজি নন। সুতরাং, এ বিষয়ে কোনরকম কথাবার্তা চালানো থেকে আপনাকে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে।”
আরও পড়ুন
লয়েড, সিকিমপতি রাজা ও কোম্পানির দার্জিলিংলাভ – ১
পিন বলছেন, দার্জিলিং গল্পের ওপর ওখানেই দাঁড়ি পড়ে যাওয়া উচিত ছিল। তা তো হলই না, উল্টে ১৮৩৫-এর নভেম্বরের গোড়ায় লয়েডের কাছ থেকে সরকারের রাজনৈতিক বিভাগের সচিবের কাছে চমকে দেওয়া এই চিঠি পৌঁছল:
মহাশয়
সবিনয় নিবেদন এই যে গত আগস্ট মাসে সিকিম রাজার তরফে আমি যেভাবে বলেছিলাম ঠিক সেভাবেই তৈরি করা দার্জিলিং-এর দানপত্র এসে পৌঁছেছে। সত্যি বলতে কি, আমি যে কাগজটা পাঠিয়েছিলাম, তার ওপরেই আমার অনুরোধমতো লাল সিল দিয়ে পাঠানো হয়েছে। এখন সেটা আমার কাছে...
আরও পড়ুন
পাহাড়ে ওঠা, থাকা : লয়েড, দার্জেলিং ও ফ্রেড পিনের দার্জিলিং লেটার্স
কী ঘটল আসলে? লয়েড যে কোম্পানির ইচ্ছা রাজাকে জানাননি, বোঝাই যায়। কিন্তু রাজা দার্জিলিং ছাড়তে রাজি হলেন কেন, বিশেষত যখন কোম্পানির তাঁর দুটো প্রধান অনুরোধই অস্বীকার করেছে? পিন বলছেন, হয়তো দু মাস কথাবার্তা বন্ধ থাকার ফলে রাজার ধৈর্যচ্যুতি ঘটছিল, তিনি সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করতে চাইছিলেন। প্রাচ্য প্রথা অনুযায়ী উপহারের উত্তরে প্রতি-উপহার আসে, ফলে রাজা হয়তো ভেবেছিলেন দানপত্র পৌঁছে গেলে ব্রিটিশ সরকার পাল্টা উপহার পাঠাতে বাধ্য হবে। নাকি রাজা কোম্পানির বিরাগভাজন হতে ভয় পাচ্ছিলেন? নেপাল-সিকিম সীমান্ত নিয়ে যে গন্ডগোল চলছিলোই, তার অনুকূল সমাধান চাইছিলেন রাজা, এও হতে পারে। যথেষ্ট তথ্যের অভাবে পিন পরিষ্কার করে বলেন নি, কিন্তু লয়েড রাজার কাছে অন্যরকম কিছু ইঙ্গিত(অনটু এলাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে, অথবা ডাবগং ইত্যাদি নিয়ে) পাঠিয়ে থাকতেই পারেন।
১৮৪৬-এ কলকাতার সুপ্রিম কৌন্সিলে নতুন লোকজন, এরি মধ্যে দুজন লাটসাহেব এসেছেন গেছেন। দার্জিলিং-এ তখন ক্যাম্পবেলরাজ। তাঁর সঙ্গে সিকিম রাজার খটামটি লেগেই থাকছে, সরকারের আন্ডার-সেক্রেটারি মেলভিল কারণ খুঁজতে গিয়ে লয়েডকে দায়ী করলেন। এক, সরকারের কথা না শুনে লয়েড সিকিম রাজার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। দুই, লয়েডের পক্ষে একটাই করণীয় কাজ ছিল, সেটা হচ্ছে রাজার দানপত্র 'তৎক্ষণাৎ ফেরত দেওয়া'। সরকারের পক্ষে দার্জিলিং-এর বিনিময়ে রাজার অনুরোধমতো কিছু দেওয়া যাচ্ছে না, ফলে এছাড়া আর কিছু করারও থাকেও না। দার্জিলিং যেতো বটে কিন্তু সরকারের মানসম্মান বাঁচত।
আরও পড়ুন
টুকরো টুকরো তরাই: নিসর্গের খোঁজ
আগের কৌন্সিল বা পরের কৌন্সিল, কোনটাতেই লয়েডের বন্ধুরা ছিলেন না বোঝাই যায়। দানপত্র যে ফেরত দেওয়া যেত না, কোম্পানির কর্তারা জানতেন। লয়েড যে রাজাকে কোম্পানির অবস্থানের কথা জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন, বোঝা যায়। ১৮৩৬-এর ৫ই জানুয়ারি, রাজার কাছ থেকে লয়েড চিঠি পাচ্ছেন, সেখানে দার্জিলিং প্রসঙ্গে বলা আছে:
“আপনি দার্জিলিং নিয়ে অনেকবার লিখেছেন। কিন্তু গত বৎসর আমার লাল সিল দেওয়া দার্জিলিং-এর দানপত্র আমার ভকিলরা আপনার কাছে পৌঁছে দিয়েছে এবং আমার সরকারের পক্ষে এর কোন অন্যথা করা সম্ভব নয়। আপনি যদি অন্য কিছু ভেবে থাকেন, আমার কিছু করবার নেই।”
আরও পড়ুন
তরাই: নিসর্গ নির্মাণ, ছবি তৈরি ও ছবি ভাঙা
লয়েড এই চিঠি হিন্দি ও ইংরেজিতে অনুবাদ করে কোম্পানিকে পাঠিয়ে দেন। সঙ্গের চিঠিতে লয়েড জানাচ্ছেন, রাজা স্বেচ্ছায় ও বিনাশর্তে দার্জিলিং দান করেছেন। লয়েড আরো জানান, রাজার ভকিলদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তিনি নিঃসংশয় যে রাজা কোম্পানির সঙ্গে বন্ধুত্বের খাতিরে এই উপহার দিচ্ছেন, এবং এটা ফেরত নেওয়া রাজার কাছে অতীব অসম্মানের হবে। লয়েড জানান যে সরকারের পক্ষে উপহার গ্রহণ করে ও রাজাকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটা চিঠি দেওয়া উচিত, 'বিশেষত যখন রাজার রাজত্বের মোট আয়তনের সাপেক্ষে এই উপহার ছোটখাটো কিছু নয়'। লয়েড বললেন, সোমা দে করোস কলকাতাতেই আছেন, তিনি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি আরো পরিষ্কার করে বুঝিয়ে লিখতে পারবেন। লয়েড আরো চাইছিলেন, ডাবগং কেন দেওয়া যাচ্ছে না আর রাম্মু পরধানকে কেন সিকিমের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না, তা রাজাকে লিখিতভাবে বুঝিয়ে বলা হোক।
এই চিঠির উত্তরে কোম্পানির তরফে লয়েডকে যে চিঠি দেওয়া হয় তার সংক্ষিপ্ত কাঠ-কাঠ বয়ানে না ছিলো সন্তোষপ্রকাশ বা কৃতজ্ঞতা, না লয়েডের কাজ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র প্রশংসার ইঙ্গিত। লয়েডকে কোম্পানির তরফে ভারত সরকারের সচিব ডব্লিউ এচ ম্যাকনাটেন জানান:
“বোঝাই যাচ্ছে যে রাজা নি:শর্ত হস্তান্তর করেছেন। এই ব্যাপারটাকে এখন সরকারের পক্ষে সুবিধাজনক জায়গায় নিয়ে যেতে হবে...সিকিম রাজাকে দেবার জন্য পত্র পাঠানো হল।”
সিকিম রাজাকে দেবার জন্য যে চিঠি তাতে কোম্পানির তরফে কী কী ভেট পাঠানো হচ্ছে তার তালিকা ছিল: ১) একটা দোনলা বন্দুক ২) একটা রাইফল ৩) লাল পশমি কাপড় ২০ গজ ৪) উৎকৃষ্ট শাল ২টো ৫) নিকৃষ্ট শাল ২টো।
লয়েড যা বলেছিলেন, এই ভেট তার ধারকাছ দিয়েও যায় না। রাজাও নিশ্চয় সেরকমটাই ভেবেছিলেন। ফলে রাজা অপেক্ষা করতে থাকলেন কবে দার্জিলিং-এর উপযুক্ত বদলি উপহার আসে। পিন বলছেন, কোম্পানির কর্তারা বুঝতেই পারেননি যে রাজার এরকম প্রত্যাশা থাকতে পারে--দার্জিলিং তো দেওয়া হয়েছে নি:শর্তে! বিষয়টা বিশ্বাস্য নয়। কোম্পানির বাংলা জয় ১৭৫৭-য়। তার পর থেকে অসংখ্য রাজত্ব কোম্পানি দখল করেছে, ঝুরি ঝুরি মিথ্যে কোম্পানির কর্তারা নির্বিকার মুখে বলে গেছেন। অতবড় একটা এলাকা হাতবদল হয়ে গেলো, লয়েড নিজে অতবার উপযুক্ত উপহারের কথা বলে চিঠি দিলেন, আর কৌন্সিল সদস্যরা বা লাটসায়েবরা কিচ্ছু বুঝলেন না এটা বিশ্বাস করাই যায় না। পরের দিকে, অর্থাৎ ক্যাম্পবেল জমানায় অবশ্য রাজাকে বছরে প্রথমে তিন হাজার ও পরে ছ হাজার টাকা করে দেবার চল হয়।
৩৬এ দার্জিলিং কোম্পানির হাতে আসে। কলকাতা ও ভারতের অন্যত্র যেসব সায়েবসুবো ছিলেন তাঁদের মধ্যে সাজো সাজো রব পড়ে যায়। দার্জিলিং-এর জমি দ্রুত বিক্রি হতে থাকে, এমন কি কৌন্সিল সদস্যরাও জমি নিতে থাকেন। ৩৮-এ বেইলির দোর্জে-লিং পুস্তিকা প্রকাশের পর কলকাতায় সাহেব ও ধনী বাঙালিদের নিয়ে রীতিমতো একটা দার্জিলিং য়্যাসোসিয়েসন তৈরি হয়ে যায়, তাঁরা দার্জিলিং-এর উন্নতি তদারক করতে থাকেন। এই য়্যাসোসিয়েসনের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর। অন্তত দুটো খবরের কাগজে দার্জিলিং সম্পর্কিত খবরাখবর ছাপা হতে থাকে। প্রথমটা ইংলিশম্যান ও দ্বিতীয়টা বেঙ্গল হুরাকারু, যার অন্যতম মালিক ছিলেন দ্বারকানাথ। উইলসনের কথা বলা হয়েছে। ডেভিড উইলসনের কলকাতার হোটেল, যাকে এখন আমরা গ্রেট ইস্টার্ন বলে জানি, সে যুগে বিখ্যাত। রবীন্দ্রনাথের লেখায় উইলসনের হোটেলের উল্লেখ পাওয়া যায়। 'বিনি পয়সার ভোজ' কৌতুকনাটকের সেই গান মনে পড়ে? 'যদি জোটে রোজ/এমনি বিনি পয়সার ভোজ!/ডিশের পরে ডিশ/ শুধু মটন কারি ফিশ/...পরের তহবিল/ চোকায় উইলসনের বিল---' ইত্যাদি। উইলসন সফল এবং উদ্যোগী ব্যবসায়ী ছিলেন, তিনি দার্জিলিং-এ হোটেল খুলবার তোড়জোড় শুরু করে দিলেন। সেটা ১৮৩৮, দার্জিলিং-এ যাবার রাস্তাঘাট তখনো ভবিষ্যতের গর্ভে, তরাই-মোরাং এবং পাহাড়ের বেশিরভাগটা সিকিম দেশের অংশ। উইলসনের কলকাতার হোটেলও তখনো শুরু হয়নি। অকল্যান্ড হোটেল য়্যান্ড হল অব নেশনস নামে সে হোটেল তৈরি হচ্ছে ১৮৪১-এ। তার আগে উইলসন কেকবিস্কুট বানাতেন আর বিলেত থেকে নানান সুখাদ্য ও পানীয় রপ্তানি করতেন। ১৮৩৯-এর ১১ই জানুয়ারির ইংলিশম্যান কাগজে প্রকাশিত দার্জিলিং হোটেলের বিজ্ঞাপন উদ্ধৃত করেছেন পিন:
“দার্জিলিং পারিবারিক(ফ্যামিলি) হোটেল--হোটেলের কাজ দ্রুতগতিতে শেষের দিকে এগুচ্ছে, থাকার জায়গার বেশির ভাগ ইতিমধ্যেই সংরক্ষিত, এই অবস্থায় কলকাতা এবং ভারতের ভদ্রজনের কাছে, আসন্ন গরমকালে এই নতুন স্বাস্থ্যাবাসের সুবিধা নিতে যাঁরা ইচ্ছুক, আমরা ঘোষণা করতে চাই যে আমরা এই হোটেলের পরিচালনভার গ্রহণ করেছি, আশা করি যে হোটেল আগামি এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই খুলে দেওয়া যাবে।হোটেলে বাকি খালি জায়গা (সংরক্ষণের) জন্য...আগ্রহীদের কাছ থেকে আবেদনপত্র আশা করছি।
যুরোপের হালফ্যাশনের জলস্থানগুলির(ওয়াটারিং প্লেসেস--উষ্ণ জলের কুন্ড বা ঝর্ণা যেখানে থাকত, এখনকার স্পা) ধরণে এই হোটেল চলবে। খাওয়া(টেবল ডি'হোটে) এবং থাকা জনপ্রতি মাসে মাত্র ১৫০ টাকা খরচা। ...আমাদের পৃষ্ঠপোষকদের...যাবতীয় সুখসুবিধার দিকে নজর দেওয়া হবে, শুধু হোটেলেই নয়, তিতলিয়া থেকে যাবার পথের সবকটি জায়গায়, প্রত্যেক বাংলোয় ভৃত্যবর্গ ভ্রমণকারীদের খিদমৎ খাটার জন্য মোতায়েন থাকবে।...তাং ডিসেম্বর ১৭, ১৮৩৮, ডি উইলসন অ্যান্ড কোং।”
বিজ্ঞাপনটা পরপর কয়েকদিন বেরিয়েছিল। তারপরে, দার্জিলিং নিয়ে কাগজে কোনো খবর বেরুলেই আবার বিজ্ঞাপনটাও ফেরত আসতো। এদিকে কোম্পানিসরকারের পক্ষ থেকেও বেঙ্গল হুরাকারু কাগজে ৩রা জানুয়ারি জানিয়ে দেওয়া হলো, দার্জিলিংস্থিত হেপ্পার ও মার্টিন সংস্থার কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক চিঠি এসেছে। 'পথের(স্টেজিং)বাংলোগুলোর কাজ প্রায় শেষ, হোটেলও থাকবার মতো করে তৈরি হয়ে যাবে ১৩ই মার্চ নাগাদ। জেনরেল অগ্ল্যান্ডার এবং অধীনস্থ অফিসারেরা 'উজ্জ্বল জায়গা'টি পরিদর্শন করে এসেছেন, তাঁরা জলহাওয়া নিয়ে উচ্ছসিত'। পিন বলছেন ওইসব আশাব্যঞ্জক চিঠি দিয়েও আসল অবস্থাটা ঢাকা যাচ্ছিল না। হোটেল ও রাস্তার বাংলো বানানোর দায়িত্ব যে ঠিকাদার সংস্থার ওপর, সেই হেপ্পার ও মার্টিনের কর্তারা কলকাতায় দৌড়ে এসে বাড়ি বানানোর মালপত্র সরঞ্জাম, খাবারদাবার আর মিস্ত্রি-কারিগর জোগাড়ে ব্যস্ত ছিলেন। বেঙ্গল হুরাকারুতে ৮ই জানুয়ারি বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হল, তাঁরা অনেক পরিমাণে চুন এবং বছরখানেকের চুক্তিতে ছুতোর মিস্ত্রি এবং চেরাইকার(কাঠ পাথর কাটতে পারেন এমন লোক) খুঁজছেন।
ওদিকে লয়েড ও তাঁর সহযোগী ইঞ্জিনিয়ার গিলমোর পাহাড়ে উঠবার রাস্তা আর দার্জিলিং-এর বাজার বানাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। রাস্তা নেই, থাকবার উপযুক্ত ঘরবাড়ি নেই, খাবার সংস্থান নেই। অথচ কোম্পানির আদেশমতো লয়েডকে ইতিমধ্যেই মাস আষ্টেক (১৮৩৬-এর নভেম্বর থেকে ১৮৩৮-এর জুন)দার্জিলিংয়ে থেকে প্রমাণ করতে হয়েছে যে সায়েবদের থাকার পক্ষে দার্জিলিং দিব্য জায়গা। তাতে কলকাতার সায়েবমেমদের উত্তেজনা বেড়েছে, লয়েডের কাজের বিন্দুমাত্র সুবিধা হয়নি। বদলি উপহার না পাবার বা অন্য যে কারণেই হোক, সিকিমের রাজা তাঁর প্রজাদের বলে দিয়েছিলেন, সায়েবদের সাহায্য করা চলবে না। ওদিকে, রাস্তা বানানো হোক আর বাজার বা হোটেল তৈরি, কুলি লাগবেই। লেপচারা এমনিতেই কুলির কাজ করতে চায় না, রংপুর-জলপাইগুড়ির সমতল থেকে লোক আনা সম্ভব নয়, কেউ এলেও তাঁরা বেঘোরে মারা যায় কিম্বা পালিয়ে যায়। বাকি থাকে মোরাং এবং নিচ-পাহাড়ের মেচরা, বীর সিং চৌধুরীর লোকজন। তারা সব সিকিম রাজার প্রজা, তাদের হাবভাব দেখে লয়েড বুঝে গেলেন এদের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে না। ফলে ৩৭ পেরিয়ে ৩৮ এলো, ৩৯ শুরু হল। কৌন্সিল কর্তাসমেত কলকাতার তামাম সায়েবরা গরমের ভয়ে কাতর, দার্জিলিং-এর ঠান্ডায় কমাস কাটাবেন সব ঠিক, অথচ কাজ শেষ হয় না, না রাস্তা, না বাজার না হোটেল। হয় না যে তার মূল কারণ, কুলি নেই। ওদিকে ইঞ্জিনিয়ার গিলমোর আসাইস্তক অসুস্থ, কোন কাজেরই তদারক করে উঠতে পারেন না। রাজার কাছে সাহায্য চেয়ে লয়েড দরবার করছেন, রাজা নিয়মিত পাশ কাটাচ্ছেন। কলকাতায় নিজের অসুবিধার কথা জানিয়ে লয়েড চিঠির পর চিঠি দিচ্ছেন, কোম্পানিকর্তারা গ্রাহ্য করছেন না। যা অসুবিধা হবে তা দূর করার দায়িত্ব লয়েডের। হোটেল খোলার সরকারি তারিখ বলে দেওয়া হয়েছে, তার আগে রাস্তার কাজ, পথের বাংলোর কাজ, বাজারের কাজ শেষ করতে হবেই। হবে তো বটে, কিন্তু কী করে?
Powered by Froala Editor