পাহাড়ে ওঠা, থাকা : লয়েড, দার্জেলিং ও ফ্রেড পিনের দার্জিলিং লেটার্স

সময়ভ্রমণ – ২৩

আগের পর্বে

সাহেবরা চলে গেলেও তরাইয়ের নিসর্গ বদলাতে থাকে। পুরনো ছবির মধ্যে ঢুকে পড়ে নতুন ছবি। একসময় মাটিগাড়ার রাস্তায় শালের বন চোখে পড়ত। চা বাগানের জমিতেও শালবন থাকত। সেখান থেকেই জ্বালানি আসত। কালক্রমে সেইসব হারিয়ে যেতে থাকে। হিমূল দুগ্ধ-শিল্প এবং কাঞ্চন ফল-প্রক্রিয়াকরণ শিল্প নিয়ে বিরোধিতা জানিয়েছিল নকশাল আন্দোলনের কর্মীরা। কিন্তু এই দুই শিল্প তরাইয়ের অর্থনীতিকে দ্রুত বদলে দিতে থাকে। তবে সময়ের নিয়মে তার মধ্যেও ঢুকে পড়ে নানা দুর্নীতি। একসময় এই দুই সংস্থাই হারিয়ে যায়। কোনো কিছুই যেন আর আগের মতো থাকে না। আজও বদলাচ্ছে তরাইয়ের চেহারা। তবে তার মধ্যেও কিছু পুরনো ছবি চোখে পড়ে। তারপর...


দার্জিলিং চকবাজার থেকে লেবঙ কার্ট রোড ধরে একটু এগুলেই ডাইনে সায়েবি দার্জিলিং-এর ইতিহাসের অর্ধেকটা ঘাসে-ঢাকা, আগাছায় ছাওয়া পাহাড়ি মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে। নিচের রাস্তা থেকে ওপরের বার্চ হিল অবধি খাড়া ঢাল, সেখানে পুরোনো সায়েবি গোরস্থান। বার্চ হিলের, অর্থাৎ চিড়িয়াখানা যাবার পথের দিক থেকে নামলে একটা ভাঙাচোরা সিঁড়ি পাওয়া যায়। সেখান দিয়ে এলে দুদিকেই ভাঙা আধভাঙা দেড়শো-দুশো বছরের বৃষ্টি-হাওয়া-কুয়াশায় ভিজে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে, কালচে ধূসর হয়ে যাওয়া অসংখ্য ছোটো-বড়ো সমাধিফলক। একদম নিচের দিকে, কার্ট রোডের গায়ে কিছু আস্ত সমাধি আছে। সে অঞ্চলে দু চারটি ফুলগাছ, কিছু যত্নআত্তির ছাপ নজরে পড়ে। বাকি গোরস্থান নেহাৎই পোড়ো, পরিত্যক্ত গোছের। গোরস্থান, মরা সায়েব-মেম ও ইতিহাস এসব মিলিয়ে দিব্যি হেরিটেজ পর্যটন হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে হয়নি। ফলে দার্জিলিং বেড়াতে আসা পিলপিলে ট্যুরিস্ট জনতার কাছে পুরোনো কবরখানাটি ব্রাত্য, স্থানীয় নেশাখোর ও প্রেমাভিলাষী কতিপয় বালিকাবালক ভিন্ন সেখানে বড়ো একটা কেউ যায় না। বছর বারো আগে জায়গাটাকে আচমকা আবিষ্কার করে বড় আনন্দ হয়েছিল। গোরস্থান সচরাচর আনন্দের নয়। তবে রাশি রাশি সমাধিফলক, পুরোনো ভাঙা ঘরবাড়ি, আর সবুজ ঘাস, এসব মিলিয়ে থেমে যাওয়া, থেমে থাকা, শান্ত সময়ের, শান্তির একটা অনুভুতি যে কোনো পুরোনো সমাধিক্ষেত্রে গেলেই পাওয়া যায়। দার্জিলিং-এর সমাধিক্ষেত্রে গেলে এর সঙ্গে যোগ হয় হিমালয়ের নিসর্গের তীব্র, অপরূপ বিভা। অনেক নিচে কার্ট রোড দিয়ে ছোটো হয়ে আসা গাড়ি ছুটছে, খেলনা লোকজন হাঁটছে। উল্টো দিকে স্তরে স্তরে নেমে যাচ্ছে হ্যাপি ভ্যালি চা বাগানের সবুজ উপত্যকা। দক্ষিণে, দক্ষিণ-পশ্চিমে দার্জিলিং শহরের ঠাসবুনোট ঘিঞ্জি বিস্তার। দূর থেকে সেটাকেও ছবির মতো লাগে। সেই ছবি বেয়ে কখনো ঘন, কখনো হাল্কা মেঘ নেমে আসে অনবরত। রৌদ্রোজ্জ্বল পরিষ্কার দিনে উত্তর ঘেঁষে দেখা দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘা। ঝাপসা, হলুদ-বাদামি হয়ে আসা সায়েবি ছবিতে যেমন দেখা যায়, ঠিক তেমন। কতবার, কতদিন যে ওই ছবির মধ্যে ঢুকেছি, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে শুনেছি হাওয়ার শব্দ, পাখির ডাক, দূরের ট্রেনের ভোঁ, বৃষ্টির টিপটিপ ঝরঝর। মাঠের ঘাস লম্বা হয়ে সমাধিফলক ঢেকে ফেলছে, হেলে পড়া পাথরের মাথায় এসে বসেছে হলুদ লাল ঠোঁট পাহাড়ি কাক। ঘাসের মধ্যে ছোটো ছোট লালচে-গোলাপি লিলি। সকালের লাল আলো গভীর গভীরতর হয়ে উজ্জ্বল হলদেটে বিকেল, হ্যাপি ভ্যালিতে গড়িয়ে আসা ছায়া, খাদের নিচ থেকে ওঠা তাল পাকানো কুয়াশা, উত্তর দিগন্তের তুষারে গোধূলির বর্ণচ্ছটা। দিন কেটে সপ্তাহ, মাস, বছর, যুগ, শতাব্দী। কতবার ভেবেছি যদি এই ক্রমে পিছনেও ফেরা যেত। সপ্তাহ, মাস, বছর, যুগ, শতাব্দী কুঁচকে ছোটো হয়ে বিলুপ্ত, কমে আসত সমাধিফলকের সংখ্যা, কমতে কমতে একটাও থাকত না, পাহাড় ঢেকে ফিরে আসত আদিম, দুর্ভেদ্য জঙ্গল, বনের ফাঁকে লেপচা জুমিয়াদের কুঁড়ে, গোর্খা সৈন্যদের আবাস। অথবা, গোর্খারা দার্জিলিং ছেড়ে চলে গেছে, জঙ্গলে ঢাকা গিরিশিরার প্রান্তে এসে দাঁড়াচ্ছেন লয়েড আর গ্র্যান্ট। সিকিম রাজার কাছ থেকে দার্জিলিং টুকরোর(ট্র্যাক্ট) লম্বাটে চাপা জমি কোম্পানির কাছে চলে এসেছে, সেখানে নতুন স্বাস্থ্যাবাস বা স্যানাটোরিয়াম হবে, হবে হোটেলও, সেখানে কলকাতার সায়েবসুবোরা গ্রীষ্মকালীন ডেরা বাঁধবেন। নিচে তরাই-এর সমতলে তিতলিয়ার সেনাশিবির, বাংলো। সেখান থেকে পাহাড়ে ওঠার রাস্তা তৈরি করতে হবে। পাকদন্ডি নয়, ভালো, বড় রাস্তা, যাতে ঘোড়া যেতে পারে, মালবাহী গরু-মোষের গাড়িও। লয়েড, সেসময়ে কোম্পানির সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল, জি ডব্লিউ এ লয়েড ছিলেন কোম্পানির তরফে সিকিমরাজার সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর দায়িত্বে, দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি জঙ্গল হাসিল করে নতুন বসতি গড়ার ভারও তাঁর ওপর এসে পড়ল। তিতলিয়া থেকে পাঙ্খাবাড়ি হয়ে পাহাড়ে ওঠার নতুন রাস্তা তৈরিরও। দার্জিলিং-এর পুরোনো গোরস্থানে ঢোকার মুখেই হাঙ্গেরিয় পণ্ডিত, তিব্বত বিশেষজ্ঞ সোমা দে করোসের সমাধি। সে সমাধির চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, নিয়মিত যত্ন নেওয়া হয়ে থাকে। করোসের কথা পরে বলা যাবে। একটু ওপরেই উঁচু রেলিং দিয়ে ঘেরা আর একটা লম্বাটে তেকোনা সমাধিসৌধ। ভিতরের লেখাটা অস্পষ্ট হয়ে আসছে, তবু পড়া যায়। সেখানে লেখা, দার্জিলিংয়ের আবিষ্কর্তা জেনারেল লয়েড এখানে শায়িত। 

লয়েড মারা যান ১৮৬১ নাগাদ। সায়েবি দার্জিলিং পত্তনের কাজ শুরু হচ্ছে ১৮৩৭-৮ নাগাদ। ১৮৩৯-এ কলকাতার সায়েবদের আসা-যাওয়া শুরু হচ্ছে। কলকাতার বিখ্যাত উইলসন হোটেলের মালিক ডেভিড উইলসন দার্জিলিং-এ হোটেল খোলার উদ্যোগ নিয়েছেন। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বুকিং নেওয়া শুরু হয়ে গেছে। অথচ কলকাতা থেকে পাহাড় অবধি সুদীর্ঘ পথ, যাতায়াতের ব্যবস্থাই নেই বলা চলে। বিশেষত পাহাড়ে। ফলে রাস্তাটা, অর্থাৎ রাস্তা বানানোটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াল। ফ্রেড পিনের দার্জিলিং লেটার্স বইটার কথা আগে এসেছে। লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে বসে, দার্জিলিং বসানোর আদিপর্বে লয়েড, কোম্পানি ও ক্যাম্পবেলের চিঠিপত্র ও  অন্যান্য সমসাময়িক দলিল দস্তাবেজ মন দিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে, হাতে লেখা সেই সব দলিলের ও অনুলিপির পাঠোদ্ধার করে ফ্রেড পিন সায়েবি দার্জিলিং-এর আধুনিক ইতিহাস চর্চার শুরু করেন বলা যায়। পিন ভারতীয় ছিলেন না। গত শতাব্দীর শেষদিকে অক্সফোর্ড মিশনের কাজে ভারতে এসে তিনি দক্ষিণ কলকাতার উপকণ্ঠে বেহালায় একটি ইস্কুল তৈরি করেন, প্রায় দশ বছর ওখানে কাটান। ভারতের অন্যত্রও তিনি শিক্ষকতার কাজ করেছেন। সেই সময়েই দার্জিলিং-এ তাঁর যাতায়াত শুরু হয়, দার্জিলিং-এর ইতিহাস নিয়ে আগ্রহও বাড়ে। সেই আগ্রহের ফসল সায়েবি দার্জিলিং-এর ইতিহাস নিয়ে তিন তিনটি বই। এক, ‘দি রোড টু ডেস্টিনি-দার্জিলিং লেটার্স ১৮৩৯’, যার কথা এখন বলছি। তার পরে দার্জিলিং এর প্রথম চা-কর বা প্ল্যান্টার পরিবারকে নিয়ে ‘ওয়েরনিকে-স্টোলকে স্টোরি’। তিন, এক ইতালীয় প্ল্যান্টার ও পক্ষীবিশারদ লুই ম্যান্ডেলিকে নিয়ে ‘এল. ম্যান্ডেলি--টি প্ল্যান্টার য়্যান্ড অর্নিথলজিস্ট’। তিনটে বইয়ের একটাও ছাপা নেই। দার্জিলিং লেটার্স-এর সন্ধান পাই বছর ছয়েক আগে, আধুনিক এক গবেষণাকাজের পাদটীকায়। অনেক যোগাড়যন্ত্র করে সে বই তারপর হাতে এসেছে। ইদানিংকালের দার্জিলিং গবেষকদের প্রায় সবাই পিনের কাজ ব্যবহার করছেন, নজরে পড়েছে। করার কথাই। নিজে প্রশিক্ষিত ইতিহাসবিদ না হয়েও যে অপরিসীম যত্নে ও অধ্যবসায়ে পিন দার্জিলিং হিমালয়ের ঔপনিবেশিক ইতিহাসের ভুলে যাওয়া মরে যাওয়া এক অধ্যায়ের পাতা উল্টেছেন, তার তুলনা বিরল। পিনের কাজের ফলে যা জানা ছিল না, তা জানা হয়েছে, ইতিহাসের যে সব চরিত্রেরা নিতান্তই গ্যাজেটিয়ারের পাতায় কিম্বা সমাধিফলকের গায়ে আটকা ছিলেন এতকাল, তাঁরা প্রায় জ্যান্ত হয়ে উঠেছেন। যেমন লয়েড। দার্জিলিং-এর সঙ্গে লয়েড এবং ক্যাম্পবেলের নামদুটো জড়িয়ে আছে বহুদিন, জানা ছিল। পিনের বইটা পড়বার আগে নামের পিছনের যে মানুষেরা, তাঁদের সম্পর্কে কিছুই সেরকম জানা ছিল না, জানবার আগ্রহও তৈরি হয়নি।

অথচ, মানুষদের সম্পর্কে জানাটাও দরকার। পিনের কাজের সঙ্গে হালফিলের গবেষকদের কাজের সবচাইতে বড় পার্থক্য, পরের কাজগুলোয় উপনিবেশ স্থাপনের 'বড়ো' ইতিহাসটাকে বোঝবার চেষ্টা চলছে বেশি, সে ইতিহাসের মানুষি উপাদানগুলো সে তুলনায় গুরুত্ব পায়নি। সায়েবশাসক মানে সায়েবশাসক, কোম্পানির নীতি মানে কোম্পানির নীতি। যে সায়েবরা দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের বনজঙ্গল হাসিল করে যুগপৎ সাম্রাজ্য ও ব্যবসা বাড়াচ্ছিলেন, তাঁদের সবাই তো একরকম ছিলেন না। ১৮৫৭-র লড়াইয়ের পর না হয় সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের শাসন শুরু হল, স্থানীয় প্রশাসকদের ওপর সরকারি আইনকানুন বিধিনিষেধ চেপে বসলো বেশি। কোম্পানির আমলে সে সবের বালাই কম ছিল, ফলে স্থানীয় সায়েবশাসকরা প্রায়শই রাজাগজার মতো ব্যবহার করতেন। সেই ব্যাপারটা পরের দিককার সায়েবশাসকদের ক্ষেত্রেও কখনো কখনো খাটে, সবাই একইমাত্রায় অত্যাচারি বা বদ, অথবা সহৃদয় ও সহানুভূতিশীল ছিলেন না। ফলে ঔপনিবেশিক শাসনের বড়ো ইতিহাসের মধ্যেও অজস্র ছোটো ছোটো স্থানীয় ইতিহাস মিশে থাকত। সেগুলোও জানাবোঝা দরকার। ছক থাকলে ছকভাঙাটাও থাকে। পিন দুক্ষেত্রেই যত্নবান ছিলেন, সেকারণে দার্জিলিং লেটার্স বইটা এত মূল্যবান।

আরও পড়ুন
টুকরো টুকরো তরাই: নিসর্গের খোঁজ

১৮৩৫-এ তৎকালীন সিকিম রাজা সুগ-ফুদ-নামগিয়াল( চো-ফো-নামগে)(উচ্চারণটা এরকম না-ই হতে পারে, এখানে রিসলের সিকিম গ্যাজেটিয়ারে ব্যবহৃত নাম অনুসরণ করা হল) কোম্পানির হাতে দার্জিলিং ভূমিখণ্ড (ট্র্যাক্ট) নিতান্তই দানস্বরূপ তুলে দিচ্ছেন। এই দানের পিছনে প্রাক-ঔপনিবেশিক স্বাধীন সিকিমের ইতিহাসের একটা টুকরো আছে। কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে লয়েড প্রথমাবধি সেই ইতিহাসে ঢুকে আছেন। পিনের বইটায় বিষয়টা প্রাঞ্জল হয়। তবে পিন লিখছেন শুধুই ১৮৩৯ সালের কথা। ইতিহাস শুরু হচ্ছে আরো আগে। ১৮১৭-র সুগাওলি সন্ধির কথা বলা হয়েছে। সিকিমের যে অংশটা গোর্খারা দখল করে নেয়, তার খুব সামান্য একটা অংশই ফেরত আসে। দার্জিলিং লাগোয়া পূর্ব নেপালের যে এলাকা প্রাচীন কিরাতভূমি বলে খ্যাত এবং যেখানে লিম্বুরা ও লেপচারা একদা সিকিম রাজার অধীনে বসবাস করতেন, গোর্খাদখলের পরও সেখানে লেপচাদের বাস ওঠেনি। এখন সেই এলাকা ইলাম নামে পরিচিত, নকসালবাড়ি হয়ে মেচি নদী পেরিয়ে যাওয়া যায়, অথবা মিরিক-সীমানা রাস্তা ধরে পশুপতি বাজার হয়ে। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, এখনো কিছু লেপচা সেখানে থেকে গেছেন। এখনকার সামরিক রাষ্ট্ৰসীমা আর সরকারি ইতিহাস-ভূগোলের সঙ্গে পুরনো ইতিহাস-ভূগোল মেলানোটা এমনিতেই কঠিন। তদুপরি, যে সব মানুষ আর সমাজ মূলে রাষ্ট্ৰহীন ছিলেন, তাঁদের সবার ভাবনায় আধুনিক সময় এখনো সর্বত্র একইভাবে চুঁইয়ে ঢোকেনি, পুরোনো-নতুন আর প্রাচীন-আধুনিক দিব্যি সহাবস্থান করে। সে সব কথায় ফেরত আসা যাবে। 

মোদ্দা, সিকিম রাজার প্রত্যাশা ছিল, তাঁদের রাজত্বের দখল হয়ে যাওয়া টুকরোগুলো ফেরত পাবার ব্যাপারে কোম্পানি সাহায্য করবে। সুগাওলি চুক্তি মারফত সে প্রত্যাশা মেটেনি। ওদিকে, রাজত্বের মধ্যেই গন্ডগোল লেগে ছিল। ১৮১৯-এ সিকিম রাজার সঙ্গে তাঁর কাকা ও রাজ্যের প্রধান মন্ত্রী ভো-লোদের ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। ব্রিটিশদের আসার আগে পর্যন্ত, তার পরেও, সিকিম রাজবংশের ওপর আগাগোড়া তিব্বতের প্রভাব বজায় ছিল, দরবারের ঝগড়াঝাটি মেটানোর জন্য তিব্বতের শরণাপন্ন হতে হত। সিকিমের রাজারা তিব্বতের অভিজাতকূল সম্ভূত, অন্যদিকে তাঁদের মন্ত্রীরা লেপচা, ফলে সেখানেও সংঘাতের একটা ক্ষেত্র থেকেই যেতো। এবারে রাজা-মন্ত্রী ঝগড়া মেটানো তো গেলই না, উল্টে রাজানুগত দেওয়ান দুন্য নামগে(পাগলা দেওয়ান নামে সমধিক পরিচিত) তাঁর ছেলেকে দিয়ে ভো-লোদকে নৃশংসভাবে খুন করালেন। ভো-লোদের তুতো ভাই, য়ুক-লহাটগ্ৰুপ বা তক্রা-থুপ, ৮০০ জন লেপচাকে (ও'ম্যালি বলছেন ১০০০-১২০০) নিয়ে সিকিম ছেড়ে পূর্ব নেপালের অন্টুতে পালিয়ে গেলেন। এটা ১৮২৬-এর কথা। এর পরপরই সিকিম-নেপাল বরাবর নানান ঝামেলা শুরু হয়ে গেল। 

আরও পড়ুন
তরাই: নিসর্গ নির্মাণ, ছবি তৈরি ও ছবি ভাঙা

সেসময়ে নেপালের সায়েব রেসিডেন্ট ড: ক্যাম্পবেল। ১৮২৮-এ কোম্পানি ক্যাপ্টেন লয়েডকে সীমান্ত বিবাদ সম্পর্কে খোঁজখবর নেবার বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে সিকিম পাঠায়। প্রথম যাত্রায় তাঁর সঙ্গী হন মালদার কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট জে ডব্লিউ গ্র্যান্ট। তাঁরা সিকিমের ভিতরে রিংচিংপং অবধি চলে যান, সেই সময়েই দার্জিলিং তাঁদের নজরে আসে। কোম্পানিকে লেখা বিভিন্ন চিঠিতে লয়েড বারবার বলেছেন সেসময় ওখানে লোকবসতি ছিল না, সবটা জঙ্গল। কথাটা সর্বৈব সত্য নয়। হ্যামিলটন-বুকানন বলছেন উনিশ শতকের গোড়ায় দার্জিলিং-এ গোর্খা সেনাদের বড় ডেরা বা গ্যারিসন মোতায়েন থাকত। তার আগে লেপচারাও দার্জিলিং-এ থাকতেন। 

সল মুল্লার্ড, রুন বেননিকে ও ক্যাথরিন ওয়ার্নারের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, দার্জিলিং অঞ্চলে সিকিম-নেপালের লড়াইটা আসলে ছিলো গোর্খা ও লেপচাদের মধ্যে। লেপচা বলতে এখানে জুমিয়া অরণ্যবাসী কৌম নয়, সিকিম রাজপরিবারের সঙ্গে সংযুক্ত ক্ষমতাবান ভূস্বামীদের গোষ্ঠী, যাঁরা কার্যত রাজার নামে শাসন চালাতেন। ভো-লোদ যে গোষ্ঠী/গোত্রের প্রধান ছিলেন, তাকে বলা হত বারফুঙ। গোর্খাদখলের পরেও বারফুঙদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কমেনি, তাঁরা সিকিম ও গোর্খা রাজাকে কর দিচ্ছেন। ভো-লোদ খুন হবার পর বারফুঙরা যে বিদ্রোহ করেন, তা কোটাপা বিদ্রোহ নামে খ্যাত। লয়েড যে জনহীন দার্জিলিং দেখছেন ১৮২৮-এ, তা আসলে কোটাপা(বারফুঙদের কোটাপা অংশ) বিদ্রোহের ফল। 

আরও পড়ুন
বদলে যাওয়া তরাই বা শিলিগুড়ি-চরিত (২)

সল মুল্লার্ডের গবেষণায় প্রথমবারের মতো একাধিক সিকিমি সূত্র ব্যবহার করা হয়েছে, ফলে সায়েবরা যে ইতিহাস টুকরো করে বলেছেন কিম্বা আদৌ বলেননি, তা জানা যাচ্ছে। মুল্লার্ডের কাজের উল্লেখ করে ক্যাথরিন ওয়ার্নার বলছেন লেপচাদের সিকিম ছেড়ে পূর্ব নেপালে পালিয়ে যাবার পিছনে লয়েডের বুদ্ধিপরামর্শ ও ইন্ধন ছিল। লয়েড সেসময়, অর্থাৎ ১৮২৬ নাগাদ তিতলিয়া শিবিরে থাকতেন, কোম্পানি রাজত্বের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। ওই অঞ্চলে কোম্পানির বড়ো অফিসার ছিলেন তিনি, যেখানে যা ঘটেছে সেখানে তাঁকে মাথা গলাতে হতো। অথবা তিনি নিজেই মাথা গলাতেন, নেটিভদের আভ্যন্তরীণ ঝামেলা মানে তাঁরই ঝামেলা, সম্ভবত এই বিবেচনায়। বারফুঙদের সঙ্গে লয়েডের যোগাযোগ যে ছিল সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। ১৮২৯-এ লয়েড কোম্পানিকে দোর্জেলিং সম্পর্কে জানাচ্ছেন, "আগে এখানে বড়ো গ্রাম বা শহর(এদেশের পক্ষে বিরল ঘটনা) ছিল। কিছু দোকান-টোকানও। এক প্রধান লেপচা কাজি এখানে থাকতেন, তাঁর বাড়ির ভগ্নাবশেষ এবং একটা গুম্ফা বা মন্দিরেরও, এখনো টিঁকে আছে। সবগুলোই পাথরে তৈরি, শক্তপোক্ত। এছাড়া বিভিন্ন কাজি ও লামার পাথরে তৈরি সমাধি বা চৈত্য। পাহাড় থেকে একটা ঝর্ণা নামছে, কিছু দূরে, দীর্ঘকাল অযত্নে পড়ে থাকার ফলে ঘাসবনে ঢেকে গিয়েছে পুরোনো বসতি এলাকা।" 

পিন বলছেন, বোঝাই যাচ্ছে পাহাড়টা অবজার্ভেটরি হিল, বাকিটা তার আশেপাশের এলাকা। লয়েডের বর্ণনার সুত্র ধরে ও'ম্যালিও বলছেন, "জেনারেল লয়েড বলেছিলেন, 'পাহাড়ের এই অঞ্চল আমাদের হাতে চলে এলে, যে কাজি আর তার লোকজন চলে গেছে, তারা সব আবার ফিরে আসবে।' লেপচা নয়, নেপাল থেকে আসতেই থাকা অন্য অসংখ্য মানুষের ভিড়ে দার্জিলিং জমজমাট হয়ে উঠল মাত্র কুড়ি বছরে। 

আরও পড়ুন
বদলে যাওয়া তরাই বা শিলিগুড়ি-চরিত

ও'ম্যালির গ্যাজেটিয়ার ছাপা হচ্ছে ১৯০৭ সালে। কোম্পানিকর্তাদের কাছে তিরস্কৃত ও দার্জিলিংয়ের দায়িত্ব থেকে অপসারিত লয়েড সরকারি কাজ থেকে অবসর নিয়ে দার্জিলিং-এই থেকে যাচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন ১৮৬৭তে। দার্জিলিং আবিষ্কারের জন্য কোম্পানি লয়েডকে কোনদিনই সেভাবে সাধুবাদ জানায়নি। দার্জিলিং বিষয়ে কোম্পানির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন গ্র্যান্ট, লয়েড তাঁর সঙ্গে ছিলেন, এইমাত্র। ১৮৩৯-এই পাহাড়ের নতুন সায়েবরাজা এসে হাজির হচ্ছেন, ড: ক্যাম্পবেল। লয়েডকে সরিয়ে তাঁকে নতুন রাস্তা বানানোর এবং বসতি তৈরির দায়িত্ব দেয় কোম্পানি। সেসব গল্প পরেরবার।

Powered by Froala Editor