তরাই: নিসর্গ নির্মাণ, ছবি তৈরি ও ছবি ভাঙা

সময়ভ্রমণ - ২১

আগের পর্বে

আজ দার্জিলিং মোড়ের যে নৈসর্গিক দৃশ্য চোখের আরাম দেয়, তা তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিক তৃণভূমি আর জলা-জঙ্গল ধ্বংস করেই। সায়েবি আমলে তৈরি হওয়া খেলনা-রেল এখন ঐতিহ্য। কিন্তু তারও বহু আগে যেসব মানুষের জীবন এখানে বয়ে চলত, সেই ইতিহাস মনে রাখননি কেউই। সায়েবরা চলে গেলেও নিসর্গ বদলাতেই থাকে। ৯০-এর দশক থেকে শিলিগুড়িকে ঘিরে শুরু হয় ব্যাপক নগরায়ন। এমনকি চা-বাগান বন্ধ করে ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরির পরিকল্পনাও হয়। চাঁদমণি বাগান উচ্ছেদ নিয়ে আন্দোলনও শুরু হয়। তবে শেষ পর্যন্ত চাঁদমণি মুছে গিয়েছে। হারিয়ে যেতে বসেছে দাগাপুর, মাটিগাড়া, নিশ্চিন্তপুর, শিমুলবাড়িও। শুধু পুরনো রেলস্টেশন দাঁড়িয়ে আছে ভূতের আশ্রয়ের মতন।

শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে শুকনা হয়ে পাহাড়ে ওঠা। হিলকার্ট রোডে এখন বিশেষ যানচলাচল থাকে না, দুপাশের শাল জঙ্গল নিঃঝুম, গাড়ির রাস্তার গায়ে গায়ে সরু রেলপথ পাকদন্ডি কেটে বনের ভিতর হারিয়ে যায়। শুকনা ছাড়িয়ে জমি খুব আস্তে আস্তে উপরে উঠছে। রংটং আসার খানিক আগে থেকে বোঝা যায় পাহাড় এসে গেছে, পথ উঠছে আর নিচে ছড়িয়ে পড়ছে সমতল। একটা জায়গায় পাহাড়ের কাঁধের খানিকটা দুদিক খোলা, সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় ডাইনে অর্থাৎ পশ্চিমে মেচি, পূর্বে বা বাঁয়ে তিস্তা। মধ্যিখানে মহানন্দা আর বালাসন। বেশির ভাগ দিন ধোঁয়া ধোঁয়া আবছা থাকে, নদীদের দেখায় সবুজ জমিতে সাদাটে ক্ষতের মতো। সবুজটা চা বাগান, ক্ষেত, বন। পরিষ্কার নয়, ঘোলাটে। সবুজ আর সাদা ঢেকে আরো আবছা একটা পিণ্ডমতো, ধূসর, সাদাকালো, লালনীল। শহর, শিলিগুড়ি শহর, বুঝতে পারা যায়। রংটং চুনাভাটি তিনধারে ছাড়িয়ে কারসিয়াং অবধি পৌঁছোলে, নিচের দিগন্ত ক্রমে প্রশস্ততর। ওল্ড মিলিটারি রোড থেকে তিস্তার পূব দিকের এলাকাও নজরে আসে। মাঝে মাঝে, জোরে বৃষ্টি হয়ে গেলে নিচটা পরিষ্কার হয়ে যায় একদম। সাদাটে নদীগুলোকে তখন মনে হয় রুপোলি, সবুজটা ঝকঝকে, শহরটা বাড়িঘরে ভর্তি। যত ওপরে ওঠা যায়, নিচের সমতল তত দূরে যেতে থাকে, ঠিক চেনা নয়, খুব ছড়ানো, অনেকটা বড় একটা অঞ্চল, যার ওপরে মেঘ ছায়া ফেলে, মেঘেরও ওপর দিয়ে এরোপ্লেন উড়ে যায়, হাজার হাজার মাইল পথ পেরিয়ে উড়ে আসে বুনো হাঁসেদের ঝাঁক। অবনীন্দ্রনাথের বুড়ো আঙলা যারা পড়েছে তারা জানে ওপর থেকে নিচের কি ছবি সে হাঁসেরা দেখে। 

শুধু হিলকার্ট রোড কেন? শিলিগুড়ি থেকে মিরিক যাবার পথে আগাগোড়া, কিম্বা রোহিনী হয়ে কারসিয়াং যাবার নতুন পথে বা পুরোনো পাঙ্খাবাড়ি রোডের অনেকটায় নিচের সমতলভূমি সঙ্গী থাকে। ওপর থেকে, দূর থেকে সে নিসর্গ ভালো, সুন্দর, মনোরম। পথের বিভিন্ন জায়গায় লোকে দাঁড়িয়ে দেখে, ছবি তোলে। যা দেখা যায়, তা ছবির মতোই। সমতল, একমাত্রিক ছবি, দেয়ালে টাঙানো যায়, ফোনে জমিয়ে রাখা যায়। 

একসময়, আমারও এমন মনে হত। এখনও মাঝেমধ্যে হয়। শ্রাবণের মাঝামাঝি কি ভাদ্রের গোড়ায়, ছোটবড় সমস্ত নদীতে যখন জল থাকে, চারপাশের সব গাছপালা ভেজা, গাঢ় সবুজে আচ্ছন্ন, ক্ষেতে ধান যখন লকলকে, নীলচে-সবুজ পাহাড়ের একবারে গোড়ায় আটকে থাকে কাপাস তুলোর মতো মেঘ, মন ভালো হয়ে যায়। কোনটা দূর কোনটা কাছ, কী ছবি কী নয়, সত্যি কী আর মিথ্যাই বা কী, সব গুলিয়ে যায়। ছবি আর রঙের ওপর মানুষের সহজাত টান থাকে, রঙিন ঝলমলে ছবি দেখলে অন্য অনেক কথা ভুলে যাওয়া যায়। পর্যটন বলে ইদানীং যে ব্যাপারটা চালু, তা টিঁকে থাকে ছবির ওপর। ছবি যত রঙিন, যত ঝলমলে, তত পর্যটন। অন্য কথা কে ভাবে, কেনই বা। ছবি যে আর চিরকাল এক থাকে না, পুরোনো ছাপা ছবির কাগজ শুকিয়ে ঝুরঝুরে হয়ে যায়, রঙ আলগা হতে থাকে, আচমকা ভাইরাস হানা বা প্ৰযুক্তি গন্ডগোলে আচমকা মুছে যায় ফোনে কিম্বা ডিস্কে রাখা ছবি। কিম্বা খারাপ হয়ে যায়। লোকে তখন নতুন ছবি খুঁজতে, তুলতে নতুন জায়গায় যায়। 

সায়েবরা যেসব জায়গায় পৌঁছেছে সেসব জায়গাকে ছবি করে তোলার চেষ্টা তারা কমবেশি করেছেই। বিশেষত যেসব জায়গায় গোরা সায়েবরা থাকত। পাহাড়ের পুরনো বনজঙ্গল সাফ করে ছবির মতো সব হল, রাস্তা, ঘরবাড়ি, দোকান, রেলগাড়ি, বাগান। কোন জায়গা ভালো লাগলে সায়েবরা বলতেন, আহা কী চমৎকার, ঠিক দেশের উডল্যান্ডস-এর বা পার্কের মতো। নিসর্গ তৈরি বা ল্যান্ডস্কেপিং বলে একটা ব্যাপার পৃথিবীর সর্বত্র সায়েবরা আমদানি করেছিলেন। পাহাড় ভর্তি এলোমেলো গাছপালা, সেসব পুড়িয়ে কিছু জংলি লোকজন চাষ করছে, নিচে ঘাসবন শরবনে ভর্তি জলা, বাঘভাল্লুকের আড্ডা, বিচ্ছিরি সব অসুখেরও। কিছু লোকের কাছে সে জায়গাগুলো যে ঘরবাড়ি, হয়তো ছবির মতোই ঘরবাড়ি, ঝলমলে রঙ যে জংলিদেরও ভালো লাগতে পারে, সে সব সায়েবদের কাছে অবান্তর। হয়তো কচ্চিৎ কদাচিৎ দু একজন সায়েব সহানুভূতিশীল হয়েছেন, আহা, পুরোনো লোকগুলো সব মরে গেল, বিলুপ্ত হয়ে গেল, ওদের জন্য কিছু করা হোক। লেপচা বা মেচদের যখন জমি দিয়ে নতুন জায়গায় বসানো হচ্ছে, তাদের ঘরবাড়ি বন নির্মম ভাবে উচ্ছেদ করা চলছেই। ইঞ্চি ইঞ্চি জমি চেনফিতে দিয়ে মেপে, বনের প্রতিটি গাছ সাদা দাগ কেটে গুনে, জরিপ বা সার্ভে হত। তারপর বেচা হতো। খাজনা তো বাড়তই। একইসঙ্গে ছবি তৈরি হতো, নিসর্গও। অবাধ্য জংলি জ্বরো নিসর্গ আমূল বদলে ফেলে ভালো, বাধ্য, ছবির মতো নিসর্গ তৈরি করা হতো। লাভ ও খাজনা খুঁজতে খুঁজতে পাহাড় ছেড়ে সায়েবরা নিচে নামলেন, চা বাগান করলেন, বন ইজারা নিয়ে কেটে ফেললেন, নতুন গাছ লাগালেন। চা বাগান হোক আর লাগানো বাগিচাবন, ছক কেটে করা। চৌকো চৌকো খোপে ভাগ হয়ে গেলো ঈশ্বরের মাটি। এক খোপে বাগান, এক খোপে বন, অন্য অন্য খোপে ক্ষেত, গ্রাম, শহর। বাগানের মধ্যেও আলাদা খোপ, আলাদা ডিভিশান, আলাদা আলাদা কুলিলাইন। শহরের মধ্যে সায়েবদের আর নেটিভদের থাকার আলাদা জায়গা। বনের মধ্যেও খোপ, ব্লক, কম্পার্টমেন্ট, বিট, রেঞ্জ, ডিভিশান, সার্কেল। সায়েবদের আগে যে সব শাসকেরা ছিলেন তাঁরাও বাগান করতেন, সুরম্য প্রাসাদ বানাতেন, জমি বন্দোবস্ত করতেন, প্রজা বসাতেন। দিল্লি, আগ্রা বা লখনৌয়ের প্রাক-সায়েব নিসর্গ নিয়ে সায়েব ভ্রমণকারীরা উচ্ছসিত হয়েছেন বারবার। কিন্তু সে নিসর্গ হাতে গোনা কিছু শহরকেন্দ্রে সীমিত থেকেছে বরাবর। তাঁদের শাসনদুনিয়ার সমস্তটা যেভাবে সায়েবরা ঢেলে সাজিয়েছিলেন, শুধু এ অঞ্চলে কেন, ভারতীয় ভূখণ্ডের কোথাও তার অন্য কোন নজির পাওয়া যাবে না। 

আরও পড়ুন
বদলে যাওয়া তরাই বা শিলিগুড়ি-চরিত (২)

মুশকিলটা হচ্ছে, নিসর্গশাসন ও নিসর্গনির্মাণের এই যুগ্ম সায়েবি প্রক্রিয়ার গোড়ায় ফাঁকি ছিল। টাকায় টাকা বাড়ে, পুঁজিতে পুঁজি, যেখানে যা আছে সব দখল করো আর সস্তা কিম্বা দাসশ্রম দিয়ে সেখানে লাভজনক কিছু তৈরি করো, উপনিবেশবাদের এই যে মহাতত্ত্ব, সেখানে নিসর্গ বিষয়টা নিতান্তই পিছড়ে বর্গের, বাইপ্রোডাক্ট। যতক্ষন নিসর্গ থেকে লাভ হচ্ছে, খাজনা উঠছে, ফার্স্টক্লাস। ছবি উঠুক, ছবি হোক, লোকে আহাবাহা করুক। লাভ কমতে শুরু করা মানে নিসর্গের ছবির রঙ আলগা হতে থাকা, কাগজ কুঁকড়োতে থাকা, শেষমেষ ছবি নষ্ট হয়ে যাওয়া। এক নিসর্গ যাবে, অন্য আসবে। ছাড়া নদীতে বাঁধ পড়বে, চা বাগান নষ্ট করে মল আর ফ্ল্যাটবাড়ি হবে, বন কাটা পড়বে। আলাদা করে রাখা পাহাড় বিচ্ছিরি গিজগিজে ঘরবাড়িতে ভরে যাবে। পুরোনো খোপগুলো ভেঙে একাকার হয়ে যাবে। ছবির মতো সায়েবি নিসর্গ ছবিত্ব হারিয়ে খারাপ হয়ে যাবে। 

কয়েক দশক ধরে তরাই চষে বেড়ানো আর পুরোনো বইপত্র ঘাঁটার সুবাদে, ছবি তৈরির, ভাঙার আর নষ্ট হয়ে যাওয়ার এই অমোঘপ্রায় প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করেছি বারবার। এখনো করছি। শিলিগুড়ি অধুনা 'বড় শহর', বুম টাউন, যার হাওয়ায় টাকা ওড়ে, সেখানে বদল ঘটবে এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ঘটবে, তা জানা কথা। নব্বুইয়ের শেষে, চাঁদমণি চা বাগান উচ্ছেদ-বিরোধী আন্দোলন যখন চলছে, শাসক বামেরা একটা কথা খুব বলতেন। নগরায়ণ ঘটবে না? শহর বাড়বে না? উন্নয়ন হবে কি না? ঠিকই তো। উন্নয়ন হবে না, তা কি হয়? নগরায়ণ হবে না, শহর থাকবে অথচ বাড়বে না সেটাই বা কেমন অনাছিষ্টি কথা? 

আরও পড়ুন
বদলে যাওয়া তরাই বা শিলিগুড়ি-চরিত

ছোটবেলা গিয়ে বড়বেলা আসে, শহরও ছোট থেকে বড় হয়। বড় হওয়া মানে কুৎসিত হয়ে যাওয়া? নিসর্গ চুলোয় যাক। শিলিগুড়ি শহরটা কোনকালে সায়েবি নিসর্গের আওতায় ছিলো না, ফলে এক টাউন স্টেশনটা ছাড়া হেরিটেজ বলে চেল্লামিল্লি করার মতোও কিছু নেই। প্রচলিত ধারণায় স্থানীয় বাড়িঘর মাঠঘাট বনজঙ্গল হেরিটেজের মধ্যে পড়ে না। সরকারি ধারনাতেও তাই। সায়েবরা তাদের নিজেদের দেশে মাঠবননদী এসবকে পরমসুন্দর নিসর্গ বা ল্যান্ডস্কেপ অব এক্সট্রাঅর্ডিনারি বিউটি বলে আলাদা করে রাখে, সেগুলোকে নষ্ট করতে দেয় না। এদেশ এবং অন্য উপনিবেশগুলো প্রধানত সায়েবদের লুটের জায়গা ছিল, নিসর্গশোভা উপভোগের নয়। তাও যতদিন সায়েবশাসকেরা ছিল, যেসব জায়গায় তারা থাকত, সেগুলোকে সাজিয়েগুছিয়ে রাখা হত। বুনো ঝাড়জঙ্গলে চা বাগান তৈরি হচ্ছে বা সরকারি বন, সায়েব প্ল্যান্টার কিম্বা ফরেস্ট সায়েবদের থাকার জন্য আলাদা বাংলো তৈরি হত, কাঠ, পাথর, কাঁচ দিয়ে। সেই বাংলোগুলোর স্থাপত্য একরকমের নয়, দেখতেও একরকম নয়। কিছু নিতান্তই ইংরেজি ধরণের(মক-টিউডর বা ভিক্টরীয়), কিছু স্থানীয় স্থাপত্যের ধাঁচে(মাটি থেকে খানিক উঁচুতে, মাচা গোছের), কিছু পাথরে তৈরি, কিছু বা পুরো কাঠের। তথাপি সেগুলোকে সব এখন 'রাজ' স্থাপত্য বা ওইরকম কিছু একটা বলা হয়ে থাকে। সে যাই হোক, বাংলোগুলো বড় ভালো জায়গায় হতো। ও'ম্যালীর গ্যাজেটিয়ারে বলা আছে প্ল্যান্টারদের বাংলোগুলো সব মনোরম জায়গায় থাকত, 'চার্মিংলি সিচুয়েটেড'। পাহাড়ের সব বাংলো এত সুন্দর সুন্দর জায়গায় থাকত, নিসর্গ তৈরি বা ল্যান্ডস্কেপ গার্ডেনিং-এর জন্য খুব একটা পরিশ্রম করতে হত না। 

কোন কথা থেকে কী এসে যায়। সে যাই হোক। কথাটা হচ্ছিলো শহরের নিসর্গ নিয়ে। শহর মানে শুধু গিজগিজে ছিরিছাঁদহীন ঘরবাড়ি, গুচ্ছের দোকান আর গাড়ি, এমন তো নয়। শহর কিরকম হবে তা নিয়ে সায়েবদের যেমন ভাবনা ছিল, প্রাক-সায়েব শাসকদেরও ছিল। হাম্পিতে মধ্যযুগের বিজয়নগরের ধংসাবশেষ দেখলে সেটা দিব্য বোঝা যায়। শরদিন্দুর তুঙ্গভদ্রার তীরে উপন্যাসে পুরোনো শহরের বিশদ বর্ণনা আছে। শহর চৌহদ্দির মধ্যে গ্রাম, মাঠ, বন, সব থাকতে পারে, কেউ কোথাও মাথার দিব্যি দিয়ে বলেনি শহরকে দেখতে এইরকম বা ওইরকম হতেই হবে। সায়েবদের শহরভাবনা অবশ্য উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে হিসেবি নগরপরিকল্পনা বা 'টাউন প্ল্যানিং' হয়ে উঠল। প্ল্যানিং বলতে অবশ্য সেই খোপ কাটার ব্যাপার। কোথায় বাড়ি থাকবে, কোথায় বাজার। কোথায় মাঠ থাকবে, কোথায় বাগান। নদী বা পুকুরের পাড় কিভাবে সাজানো হবে। কোথায় অভিজাতদের মহল্লা, কোথায় গরিবগুর্বোর পাড়া, বস্তি। কোথায় কারখানা বা গুদামঘর, তাদের শ্রমিক থাকবার জায়গা। এদেশের যেসব শহরে সায়েবরা থাকতো, সেখানে নগরপরিকল্পনার প্রয়োগ খানিক হয়েছিল, যেমন কলকাতায়, দার্জিলিং-এ, নতুন দিল্লিতে। সায়েবপরবর্তী শাসকেরাও পরিকল্পিত শহর করেছেন, যেমন চন্ডীগড়। 

আরও পড়ুন
তরাই-মোরাং-এ সায়েবসময়

আখাম্বা শিলিগুড়ি বা রোগাভোগা জংলি তরাই-এর সঙ্গে এইসব এলাকার তুলনা চলে না, তবু কী আশ্চর্য, শিলিগুড়ি নিয়ে প্রথম নগর পরিকল্পনা তৈরি হয় সুদূর ষাটের দশকে। ১৯৬৬ সালে শিলিগুড়ি প্ল্যানিং অরগানাইজেশন নামে এক সরকারি সংস্থা বৃহত্তর শিলিগুড়ি উন্নয়নের মহাদলিল বা 'মাষ্টার প্ল্যান' তৈরি করে। সে দলিলে বলা ছিলো এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ (যথা কৃষিজমি, চা-বাগান, অরণ্য) শহর বৃদ্ধির কারণে বিপন্ন এবং নতুন পরিকল্পনা এমনভাবে করতে হবে যাতে এই সম্পদকে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না করা হয়। আরো বলা হয়, শহরের ভূমিব্যবহার এমন ভাবে করা হবে, যাতে শহরের মধ্যে একটি বিশেষ কৃষি অঞ্চল থাকে, ৩০০ একরের উপর ফাঁকা মাঠ থাকে মাঠ হিসাবেই, এবং চা-বাগান চা-বাগানই থাকে। পরে, দলিল রচয়িতা সংস্থাটি শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি নামের এক নতুন সংস্থার সঙ্গে মিশে যায়। পুরোনো দলিলের ভিত্তিতে ১৯৮৬ সালে তৈরি হয় আউট্লাইন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান। নতুন দলিলেও বলা ছিলো চা-বাগান এলাকায় শহর করার প্রশ্নই ওঠে না। অবশ্য মাঠ বা কৃষি অঞ্চলের কথা রাখা হয়নি। নব্বুইয়ের শুরু থেকেই জমির দাম বাড়তে থাকে, পুরোনো পাড়া মহল্লা ভেঙে ফ্ল্যাটবাড়ি তোলার প্রোমোটারি প্রক্রিয়া চালু হয়ে যায়, খামোখা জমি ফেলে রাখাটা মূর্খতার নামান্তর। ফলে, যা হবার হয়, এখনো হচ্ছে। নিয়ন্ত্রিত নিসর্গ মায়ামাত্র, পুঁজির পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে ছবি তৈরি হয়, বা তৈরির চেষ্টা হয়, এই পর্যন্ত। সে ছবি টেঁকে না। 

শিলিগুড়ির নগরপরিকল্পনার আদি দলিলের বিরল একটা অনুরূপ আমাদের বাড়িতে দীর্ঘকাল যাবৎ ছিল। নতুন, পরিকল্পিত শহরের ছবি ফোটানো হয়েছিল মোটা কাগজে টাইপ করে, মোম দেওয়া কাগজে তৈরি, ভাঁজ করা, বহু মানচিত্রে। সায়েব-বিরোধী লড়াই ও সমাজতন্ত্রী রাজনীতি করতে করতে আমার বাবা উত্তর কলকাতা থেকে শেষ-চল্লিশে প্রথমে দার্জিলিং এসে পঞ্চাশের মাঝামাঝি  শিলিগুড়িতে ডেরা বেঁধেছিলেন। শিলিগুড়ির উন্নতি নিয়ে তাঁকে ভাবতে  দেখেছি। নগরপরিকল্পক দলিল রচয়িতা তাঁর বন্ধুস্থানীয় ছিলেন, শহর কিভাবে বাড়তে পারে তা তাঁদের নিয়মিত চর্চার বিষয় ছিল। কালক্রমে দলিলটি বাতিল কাগজ হয়, নগরনিসর্গ সম্পর্কে সব ভবিষ্যত পরিকল্পনাও। বাবা কালের নিয়মে ভিনদেশে যাত্রা করেন। চাঁদমণি আন্দোলন শুরু হবার সময় পুরোনো দলিলটিকে জনসমক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছিল। কলকাতা হাইকোর্টে যে মামলা হয়, সেখানেও আদি পরিকল্পনাটি থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি ছিল। সম্ভবত সেই সময়, সে দলিল আমাদের বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যায়। 

আরও পড়ুন
তরাই-মোরাং : নিসর্গ, মানুষ, যুদ্ধবিগ্রহ

পুরোনো বা নতুন আরো যে সব ছবি মনে বাসা বেঁধে ছিল, সেগুলোর সবকটায় দাগ লাগছে, ভাঁজ পড়ছে। শিলিগুড়ি বড় শহর, বড় ব্যাপার। ছোট ছোট, টুকরো টুকরো, অনেক ভালো, সুন্দর ছবি, শহরের আশেপাশের বনে, মাঠে, চা-বাগানে ছড়িয়ে ছিলো বহুকাল। ইতিহাস-ভূগোল নয়, তরাই বলতে সেসবই বুঝে এসেছি আশৈশব। এখন বুঝি, সে বোঝাটা ঠিক ছিল না। তা হোক। বেঠিক বোঝার গল্পগুলোও বলা দরকার।

Powered by Froala Editor

Latest News See More