সময়ভ্রমণ – ১৯
আগের পর্বে
সায়েবরা চলে যাওয়ার পরেও নিসর্গ বদলাতেই থাকল। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া যায় শিলিগুড়ি শহরকে দেখে। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত শিলিগুড়ির অস্তিত্ব ছিল কিনা সন্দেহ। দার্জিলিং-এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্যই প্রথম রেলপথ পাতা হল। ১৮৮১ সালে থেকে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং রেল চলতে শুরু করল। স্টেশন তৈরি হলেও জনবসতি ছিল কিনা সন্দেহ। সেন্সাস রিপোর্ট বলছে ১৯৩১ থেকে ১৯৪১-এর মধ্যে শিলিগুড়ির জনসংখ্যা বেড়েছে ৭৩ শতাংশ, আর ১৯৬১ সালের মধ্যে বেড়েছে ৬৭৩ শতাংশ। এখন ৭ লক্ষ মানুষের বাস শিলিগুড়িতে। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বদলে যেতে থাকল নিসর্গ। প্রথমে নদী হারিয়ে গেল, তারপর মাঠ। এখন বাড়ির জঙ্গলে শিলিগুড়িকে তরাই না দমদম বোঝা যায় না।
শিলিগুড়ি শহরের চৌহদ্দি ছাড়ালে দার্জিলিং মোড়, সেখান থেকে একটা রাস্তা, হিলকার্ট রোড, গেল শুকনা হয়ে পাহাড়ে, আর একটা অর্থাৎ ৩১ নং রাজমার্গ, পশ্চিমে বাগডোগরা, নক্সালবাড়ি, বিহার, কলকাতা, পূবে তিস্তা পেরিয়ে আসাম। বেশ অনেক বছর আগের কথা, হুট বললেই বেরিয়ে পড়া যেত না, বেরোলেও বেশি দূরে যাওয়া যেত না। শহর থেকে দূরে নয় অথচ খোলামেলা, গাছগাছালিতে ভরা, এমন জায়গা বলতে দার্জিলিং মোড়, হাঁটতে হাঁটতে কি বাসে করে চলে চলে যেতাম প্রায়ই। ঠিক মোড়ের মুখে একটা তিনমুখ হলুদ-কালো মাইলপোস্ট, তার উত্তরমুখো ডানায় লেখা দার্জিলিং ৮০ কিমি, পশ্চিমেরটায় বারহি। বড় রাস্তার মোড়ে একটা সিমেন্টের মাইলপোস্ট, কিন্তু ওই অবধি পৌঁছে গেলেই খুব ভালো লাগত। বাঁয়ে ঢেউ-খেলানো ডাঙা জমিতে স্তরে স্তরে শিরিষ গাছ-ঘেরা চা-বাগান, সামনে, পাহাড়ের দিকে, দাগাপুর, মোহরগাঁ-গুলমা মানে আরো বাগান, তার পিছনে জঙ্গল, তারো পিছনে পাহাড়। চোখ কোথাও আটকাত না। বিকেল শেষ হয়ে এসে আকাশে রঙ ধরছে, চা-বাগানের ছায়াগাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ডুবন্ত টকটকে লাল সূর্য, সেই লাল এসে পড়ছে উত্তরের পাহাড়শ্রেনীর ওপর। সামনের শুকনা, দূরের কার্সিয়াং, সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, শেষ রোদ পড়ছে ছোট ছোট বাড়িতে, তাদের টিনের চালে, পাহাড়শুরুর গভীর শালবনে। নয়নশোভন দৃষ্টিনন্দন নিসর্গ, দেখলে মন ভালো হয়।
হায়, আর দশটি ঐহিক বিষয়ের মতোই নিসর্গ বস্তুত মায়া। যা দেখা যায় তা আদৌ আছে কি নেই, বোঝা যায় না। যা দেখা যায় তা না দেখা না থাকা অসংখ্য জিনিসকে ঢাকা দিয়ে, চাপা দিয়ে লুকিয়ে রাখে, কিম্বা নিশ্চিহ্ন করে দেয়। দার্জিলিং মোড় থেকে যে চা-বাগান বনজঙ্গল দেখে আমরা মুগ্ধ হতাম, তা যে আদি প্রাকৃতিক ঘাসবন জলাজঙ্গল নষ্ট করে তৈরি, সে কথা কে কাকে বলে। যে চা-বাগান দেখে, মসৃণ সবুজে আর অস্তগামী সূর্যের বর্ণচ্ছটায় চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে, সেখানে যে মেচ ধিমালদের জুমিয়াজীবন স্বচ্ছ ধারায় বয়ে চলত না, তা কে বলতে পারে? শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যায় ছোট খেলনা রেলগাড়ি, তা ইতিহাসের বস্তু, স্বীকৃত হেরিটেজ, সে রেলগাড়ি বসার শ’শ বছর আগে থেকে যে মানুষেরা এই অঞ্চলে থাকতেন, না-মানুষ যেসব বুনোরা থাকত, তা হেরিটেজ নয় কেন? তার কথা মনে করা হবে না কেন?
সায়েবসময় অন্য সময়কে গিলে ফেলে, ভুলিয়ে দেয়। সায়েবদের আগের সব ইতিহাসভূগোল উনিশ শতকের শেষেই ‘নেই’, এখন সাদাসায়েবদের সময়টাও যাচ্ছে। সায়েবসময় পুঁজির সময়, শহর বাড়ছে, উন্নত হচ্ছে, ধূলোমুঠি সোনা, কাঠাজমির দাম লাখ পেরিয়ে কোটির কাছাকাছি, সে নিরিখে চা-বাগান সেকেলে, ছ্যাছ্যা। ফলে শিলিগুড়ির কাছাকাছি যে বাগানগুলো জায়গা আটকে রেখেছে সেগুলো হটাও, শহর বসাও, সিদ্ধান্ত হলো।
নব্বুইয়ের মাঝামাঝির কথা বলছি। সেসময়ের আর দশটি বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তের মতো এটিও বাম-সম্ভূত, রীতিমতো হেডকোয়ার্টার থেকে অনুমোদন করানো। চা-বাগানের জমিতে অন্য কিছু করায় আইনি বারণ, বড় কায়দায় ব্যাপারটায় নামা হল। শহরের সবচাইতে কাছে, দার্জিলিং মোড় থেকে বাগডোগরার দিকে এগুতেই দুপাশের টিলামতো উঁচু জমিতে চাঁদমণি বাগান। দিশি বাগান। তরাই-ডুয়ার্সের আরো অনেক দিশি বাগানের মতো সে বাগানেরও মালিক ছিলেন জলপাইগুড়ির রায়-পরিবার, এস পি রায়। দীর্ঘদিন অবধি বড়ো রাস্তার ওপর, বাগানে ঢোকার ঠিক মুখে যে বিবর্ণ বোর্ডটা লাগানো থাকত, তাতে লেখা ছিল ১৯২১-এ জন্ম। দিশি হলেও, নিসর্গ উচ্ছেদের যে সর্বব্যপী প্রক্রিয়ার কথা বলছিলাম, এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি, ধরা যেতে পারে। অর্থাৎ দার্জিলিং পাহাড়ের তলায় তরাই-এর ঘাসে ঢাকা প্রান্তর ও উঁচু জমির শালবন হাসিল করে বাগান বসানো হয়, এবং সে সময়ের যা দস্তুর, আড়কাঠিরা ভুলিয়েভালিয়ে বাগানশ্রমিক ধরে আনে ছোটনাগপুর থেকে। এস পি রায় গোষ্ঠীর অন্য আর দশটা বাগানের মতো চাঁদমণি দীর্ঘদিন দিব্যি চলছিল।
আরও পড়ুন
বদলে যাওয়া তরাই বা শিলিগুড়ি-চরিত
১৯৯১-২ নাগাদ এই পুরোনো বাগানটাকে নিকেশ করার নীল নক্সা তৈরি হয়। তার আগে অবশ্য বাগান একবার হাতবদল হয়ে এসেছে শিলিগুড়ির বিনয় দত্ত মশাই(তিনি এস পি রায়দের খাস কর্মচারী ছিলেন)-এর হাতে।
বাগানের মূল শ্রমিক ইউনিয়ন বামেদের। তারা স্ট্রাইক-টাইক ডেকে বাগান লক-আউট করিয়ে দিল। বন্ধ বাগান পড়ে আছে, শ্রমিকদের ঘোর দুরবস্থা, রুগ্ন তকমা লেগে গেল। সম্ভবত বাগান-মালিককে ম্যানেজ করা গেল না, সিপিএম-ঘনিষ্ঠ আর এক চা-কর মানে প্ল্যান্টার এসে বাগানটা কিনে নিলেন। কিনলেন কিন্তু চালালেন না। কেনার দু বছর পরেই তিনি সরকারকে চিঠি দিয়ে জানালেন, বাগান চলছে না, চলবেও না, সরকার বাগানের জমিটা বরং নিয়ে নিক। জমি নিয়ে সেটা আবার ফিরিয়ে দিক একটা নতুন কোম্পানিকে, বর্তমান বাগান-মালিকই যার মালিক। বাগান-কোম্পানির নাম ছিলো লক্ষ্মী টি কোম্পানি, নতুন কোম্পানির নাম হল লক্ষ্মী টাউনশিপ। সরকারে-মালিকে চুক্তি সই হল, যথাসময়ে চা-গাছ উপড়ে-টুপড়ে সেখানে শহর হল, মানে বড় বড় সব ফ্ল্যাটবাড়ি, রঙচঙে মলবাজার। নতুন কোম্পানির অংশীদার স্বয়ং সরকার বাহাদুরও, ফলত উদ্যোগটি সর্বার্থেই বড় লক্ষ্মীমন্ত ছিল, সন্দেহ নেই। শেষে দেখা গেলো, বাগানের জমি, সে জমিতে শ্রমিকদের বাড়িঘর, পুরোনো কারখানা, সব চলে গেছে বড় বড় আবাসন আর মল বানানোয় খ্যাতনামা এক শিল্পগোষ্ঠীর কাছে, কোথায় বাগান-মালিক কোথায় সরকার। শিল্পপতিটি লাল ছেড়ে নীল হলেন, যেখানে যা চলবার সব গুছিয়ে চলতে থাকল।
আরও পড়ুন
তরাই-মোরাং-এ সায়েবসময়
এই বাগান, এই মল। কিছুই আগের মতো থাকে না। দার্জিলিং মোড় থেকে ডাইনে বাঁয়ে যেদিকে যাওয়া যাক, ছোট বড় বাড়ির জটলা। আবাসন, দোকান, হোটেল, ইস্কুল কলেজ, ক্লাব। চাঁদমণি এলাকাটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আলো-ঝলমলে নতুন এশীয় মহাসড়ক দৌড়োচ্ছে, তার পাশে উত্তরায়ন নামের নতুন উপনগরী, সেখানে বিশাল মল। সামনের রাস্তায় এত ভিড় হয় যে গাড়ি যেতে পারে না।
শিলিগুড়ির পাড়া মাঠ নদী বন সব চুরমার হয়ে যাচ্ছিলো যখন, শহরবাসীরা উন্নয়নের অমোঘ অনিবার্য যজ্ঞ চোখ বুঁজে দেখছিলেন, ঠিক। তবে চাঁদমণি বাগানের ক্ষেত্রে প্রতিবাদের একটা চেষ্টা হয়েছিল। একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, ছোট ছোট বাম দল, কিছু ট্রেড-ইউনিয়ান, কিছু ব্যক্তি-নাগরিক একজায়গায় জড়ো হয়ে একটা যৌথ আপত্তি তুলেছিলেন। রাস্তায় রাস্তায় অনেক মিটিং মিছিল অবস্থান হয়েছিল, কলকাতা হাইকোর্টে মামলাও করা হয়েছিল। বাগানে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ, শ্রমিকদের আন্দোলনে যথাসাধ্য সাহায্য করা, সঙ্গে থাকা, এসবও হয়েছিল।
আরও পড়ুন
তরাই-মোরাং : নিসর্গ, মানুষ, যুদ্ধবিগ্রহ
মামলাটা জেতা যায় না, সরকার গুন্ডা পুলিশ লাগিয়ে বাগান উপড়োতে গেলে শ্রমিকরা বাধা দেয়, গুলি চলে, শ্রমিক-পরিবারের দুজন গুলিতে মারা যান। এর কিছু পরেই শ্রমিকদের সঙ্গে সরকারের একটা বোঝাপড়া হয়ে যায়, শহুরে প্রতিবাদ আরো দিনকয় হাত পা ছুঁড়ে স্তিমিত হয়ে আসে, মরে যায়। গাছ-টাছ উপড়ে বাগানের জমিটি ফাঁকা করে দেওয়া হয়, কালক্রমে তা ভরাটও হয়ে যায়।
চাঁদমণির পর উচ্ছেদ তালিকায় পরপর শহর-লাগোয়া বাগান ছিল—দাগাপুর, মাটিগাড়া, নিশ্চিন্তপুর, শিমূলবাড়ি ইত্যাদি। আন্দোলনের অভিঘাতে সেগুলো কিছুদিনের জন্য হলেও টিঁকে গেল, ধরে নেওয়া যায়। যায় কি? দার্জিলিং মোড় থেকে শুকনার দিকে গেলে প্রথম বাগান দাগাপুর। তার জমি নিয়মিত দখল হচ্ছে, কিম্বা বিক্রি হচ্ছে। ধরেই নেওয়া যায়, মালিকের সম্মতিতে। দাগাপুরের পর মোহরগাঙ-গুলমা। সে বাগান এখনো চলছে বটে, কিন্তু কতদিন? শহর এগিয়ে এসে চম্পাসারি পেরিয়ে মহানন্দা অভয়ারণ্য অবধি পৌঁছে গেছে প্রায়। মহানন্দার পাড় ঘেঁষে বিরাট মাঠ, মাঠের পিছন থেকে গুলমা বাগানের এলাকা শুরু হচ্ছে। বছর কয়েক আগে সেই মাঠ নিয়ে গন্ডগোল। মালিক বলছেন মাঠ বাগানের। বাগানের আদিবাসী শ্রমিকরা বলছেন মাঠ তাঁদের, তারা খাস জমিতে দখল নিয়েছেন। জমির পুরোনো কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেল তা দেখানো আছে ঝাড় বা জঙ্গল হিসেবে। হান্টারের বিবরণের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ওই এলাকাটা চম্পাসারি ঝাড়ের অংশ ছিলো। পুলিশপেয়াদা এল, মামলাও হল সম্ভবত, এখনো অবধি মাঠটা ওইরকম আছে, শুনতে পাই। বছর কুড়ি আগেও চম্পাসারি পেরিয়ে মহানন্দার পাড়ে মিলন মোড় অবধি যেতে গেলে ওরকম অনেক মাঠ দেখা যেত। ফাঁকা, ঘন সবুজ মাঠ, তার বুক চিরে তিরতিরে স্বচ্ছ জলধারা বয়ে গেছে মাঠ শেষ হচ্ছে যেখানে, শুরু হচ্ছে বন আর পাহাড়। তিস্তা থেকে মহানন্দার দিকে যেতে ঠিক হুকার যেমন দেখেছিলেন। শহর এবং জমিবাড়ি অর্থাৎ রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের অমোঘ থাবা সেখানে পৌঁছে গেছে কবে, মাঠগুলোর একটাও বেঁচে নেই, নদীভর্তি আবর্জনা। মিলন মোড় থেকে হাঁটলে মহানন্দা আর গুলমা নদীর সঙ্গমবিন্দুতে পৌঁছনো যায়। নদীর এপারে ওপারে ছড়ানো এই অঞ্চলটায় তরাই-মোরাং এর আদি বাসিন্দা মেচরা এখনো অবধি বসবাস করেন। কতদিন? একদিক থেকে শহর ঢুকছে, অন্যদিক থেকে জমি ভাঙছে মহানন্দা। কিছুই আগের মতো থাকে না, কেন থাকে না?
আরও পড়ুন
তরাই-মোরাং : ভূগোল-ইতিহাসের সন্ধানে
কেন-র উত্তর পাওয়া মুশকিল নয়। বিশ শতকের গোড়ায় ও-ম্যালী বলছেন চা বাগান খুব লাভজনক ব্যবসা তার কারণ জমি পাওয়া যায় জলের দরে, শ্রমও খুব সস্তা, কম মজুরিতে কুলিরা কাজ করে। চা বাগান, সিঙ্কোনা বাগান, টঙিয়া বস্তি, এসব বসানো হয়েছিলো সস্তা শ্রম বা দাসশ্রমের ওপর নির্ভর করে। সায়েবশাসকেরা, সায়েবমালিকেরা, তাদের দেখাদেখি দিশি ধনীরা এক্ষেত্রে অনেকাংশেই সায়েবপূর্ব সামন্তশাসকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। বড় বড় ভূমিখণ্ড অর্থাৎ এস্টেট নিয়ে যে ব্যবসা তা চালাতে গেলে অবিরল সস্তা শ্রমের দরকার। বিশ শতকের মধ্যবিন্দু থেকে চা-বাগানগুলোতে শ্রমিক সংগঠন গড়ে উঠতে থাকলো, মজুরি ও সুবিধাবৃদ্ধির দাবি উঠল। ১৯৫১-য় ঐতিহাসিক প্ল্যান্টেশান লেবার অ্যাক্ট বা বাগিচা শ্রমিক আইন চালু হল। ফলে বেগারশ্রম, দাসশ্রম, দিনের পর দিন মজুরি না বাড়িয়ে শ্রমিকদের খাটিয়ে নেওয়া, এসবের ক্ষেত্রে অসুবিধা হয়ে পড়ল। এছাড়া, চা-বাগান হোক বা সিঙ্কোনাবাগান কি চাষ-করা জঙ্গল, তাদের যত্ন না করলে উৎপাদন ক্রমশ কমতে থাকে। যত্ন করতে গেলে খরচ করতে হয়। সে খরচা করে কে?
চা-বাগানের আর দক্ষিণ ভারতের কফি বাগানের জন্য সরকারি আইন, নিয়মকানুন আছে। বাগানের কিছু কাজে (যেমন নতুন চারাগাছ লাগানো হল, তার চারপাশে বেড়া দেবার জন্য) চা বোর্ডের মাধ্যমে সরকারি সাহায্য পাওয়া যায়। বাকি টাকা আসবে ব্যাঙ্ক থেকে। অনেক, অনেক দিন আগে জলপাইগুড়ি শহরের এক পুরোনো ছাপাখানার মালিক চা-বাগানের নতুন অর্থনীতি প্রাঞ্জল করে বুঝিয়েছিলেন। আমার দুই বাল্যবন্ধু সেসময় বাগানে বাগানে কয়লা চালান দিত। ফ্যাক্টরির বয়লার চলত কয়লায়, শ্রমিকদের ঘরগেরস্থালির জ্বালানি বাবদও কয়লা দিতে হত। কয়লার টাকা মাসের পর মাস, সময়সময় বছরের পর বছর বকেয়া পড়ে থাকত। সেই টাকা আদায়ে বন্ধুরা জলপাইগুড়ির আপিসে দরবার করত। অনেক দিশি বাগানের হেড আপিস তখন জলপাইগুড়িতে, শহরের ধনীরা প্রায়শই হয় চা-কর নয় কাষ্ঠ-ব্যবসায়ী ছিলেন। কী করে কী করে ছাপাখানায় পৌছেছিলাম, মনে নেই। সম্ভবত ছাপাখানা মালিক ভদ্রলোকের পরিবারের চা-বাগান ছিল, চা ব্যাপারটা তিনি ভালো বুঝতেন। আশির দশকের মাঝামাঝি, বাগান রুগ্ন হয়, লক আউট হয়, একদম বন্ধ হয়ে যায়, এসব ইতিমধ্যেই চেনা গল্প হয়ে গেছে। যা জানতাম না তাও জানা হয়ে গেল। ভদ্রলোক বললেন, কিছু হবে না বুঝলেন। কেউ কিছু করতে পারবে না। সাহেবরা চলে গেলো, বাঙালি বাগানগুলোরও মালিক বদল হল। নতুন মালিক সব মারওয়াড়ি, তারা চা বোঝে না, বুঝতেও চায় না। বাগানের যত্ন নেয় না, কন্ট্রাকটারদের পাওনা দেয় না, ওয়ার্কারদের টাকা মেরে দেয়। ব্যাংক থেকে রাশিরাশি টাকা ধার নেয়, টি বোর্ড থেকেও টাকা পায়, সেসব টাকা কোথায় যায় কে জানে? কত প্রোডাকশান হচ্ছে তাও বুঝবেন না, মালিক আর ম্যানেজার সাঁট করে চা বাইরে পাঠিয়ে দেয়, খাতায় তোলে না। বাগানের ধারদেনা বাড়তে থাকে, এদিকে আয় নেই। বাগান বন্ধ হবে না তো চলবে? ইউনিয়নের কথাও না বলাই ভালো, মালিকদের সঙ্গে তাদের বোঝাপড়া থাকে, লুটপাটে দুপক্ষই লাভবান হয়।
আশির দশকে চা-বাগানের জমিতে শহর হবে, এমন কষ্টকল্পনা সবচাইতে বড় ফাটকাবাজরাও করত না। শিলিগুড়িও তখন কার্যত নিঃঝুম মফস্বল। জলপাইগুড়ির ছাপাখানা মালিকের ধারণায় বাগান নিয়ে ভবিষ্যতের প্রোমোটারি ব্যবসার পদ্ধতিপ্রকরণ থাকার কথা নয়। চা-বাগান থাকবে অথচ কারখানা থাকবে না, দু দশ বিঘে জমিতে ছোট বাগান জন্মাবে চাষের জায়গা নষ্ট করে, এসবও তখন ভবিষ্যতের অন্ধকারে। অথচ ভালো করে ভাবলে বোঝা যায়, এখন যা যা হচ্ছে, তার বীজ উনিশ শতকের সায়েবসময়েই পোঁতা। নয়নশোভন নিসর্গের প্রয়োজনে নয়, তরাই-মোরাং-দুয়ার-পাহাড়ের ইতিহাস-ভূগোল ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল বিনি পয়সার কিম্বা সস্তা শ্রমের ওপর ভিত্তি করে লাভ তৈরির প্রয়োজনে। লাভ, আরো লাভ, আরো আরো লাভ, সায়েবসময়ের নির্যাস এই। সেখানে কার গায়ের রঙ কি, কে সায়েব কে বাঙালি কে মারওয়াড়ি তাতে কিছুই যায় আসে না। তরাই-এর প্রথম চা-বাগান নিউ চাম্পটা তৈরি হয় জেমস হোয়াইট নামে এক সায়েবের হাতে, ১৮৬২ সালে। নব্বুইয়ের শুরুতেও সে বাগানে গেছি, এলাহি ব্যাপার, ম্যানেজারের বাংলো দেখলে তাক লেগে যায়। বছর কয়েক আগে শুনলাম, সে বাগানেরও অসুখ, শ্রমিক ছাঁটাই আর লক-আউট জাতীয় জিনিস শুরু হয়েছে। বাগানের পিছনে চাম্পটা-খোকলঙের বাঘ-ডাকা জঙ্গল, সেখানে সেগুন ঝাড় ছাড়া এখন অন্য গাছ নেই। চাম্পটা খোকলঙ নামের যে দুটো টঙিয়া বস্তি, তার জমি দেদার বিক্রি হচ্ছে এরকম শোনা যাচ্ছিল। বহুদিন পর নিউ চাম্পটা বাগানের মধ্য দিয়ে পুরোনো মেচ বস্তি মানসারা জোতের দিকে যাচ্ছি, অবাক হয়ে দেখলাম বাগানের ঠিক মধ্যিখানটায় বিশাল, প্রাসাদোপম টি রিসর্ট হয়েছে। দেখবার মতো ব্যাপার, গোটা এলাকায় অত বড় হোটেল দ্বিতীয়টি নেই। চা বাগানের জমিতে এত বড় হোটেল হয়ে গেল, কেউ টুঁ শব্দ করল না? এক রাজনৈতিক বন্ধুকে ফোন করে জানা গেল বাগানের শ্রমিক ইউনিয়নগুলো নাকি আপত্তি করেনি।
শিলিগুড়িতে এখন শীতকালেও রোদে গা পুড়ে যায়। হেমন্ত উধাও, কুয়াশা বা হিম পড়ে না বললেই হয়। বর্ষারও তেজ কমে গ্যাছে। আমিও নাচার না হলে বাড়ির বাইরে যাই না বড় একটা। কোথায় যাব? কখনো সখনো বেরোলে দেখতে পাই উদ্ভট একটা উড়াল পুলের কোণ ঘেঁষে হলদে-ধূসর পুরোনো স্টেশানটা পড়ে আছে, লোকজনের যাতায়াত নেই, বেশিটাই মালগাড়ি-টাড়ি যায়। বহুদিন সে স্টেশানে যাই না, প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করি না। দিন যায়, বয়স বাড়ে পাজি নখের মতো, ভাবছি আর কিছু না হোক ভূত খুঁজতে সে মোকামে গেলে কেমন হয় একবার? ভাবছিই।
Powered by Froala Editor