সময়ভ্রমণ – ১৯
আগের পর্বে
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় সায়েবশাসন কায়েম হয় তরাই-মোরাং এলাকায়। তখনও জারি আছে কোম্পানিরাজ। তাঁদের হয়ে স্থানীয় জুমিয়া আদিবাসী ও অন্যান্যদের থেকে খাজনা আদায় করত চৌধুরী ও লামারা। সময় সময় সাহেবদের কুলির জোগানও দিত। জুমিয়ারা ছিল শান্তিপ্রিয়; কোনরকম বৈষম্যের স্থান নেই তাদের মধ্যে। এদিকে কোম্পানির জোরে চৌধুরী-লামারা পাহাড়ের ওইসব জায়গায় নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখত। তবে পরবর্তীকালে সিপাহী বিদ্রোহ এবং বিভিন্ন আদিবাসী, কৃষক বিদ্রোহের ফলে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কিছুটা বদল আসে। এদিকে একটা সময় সিকিম রাজাকে দমন করল ব্রিটিশরা; আর সিকিম ও ভুটানকে নিজেদের করদ রাজ্যে পরিণত করল। এইভাবে সাহেবশাসন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল পাহাড়ে…
ইতিহাস, ভূগোল সব বদলায়। সায়েবসময় ব্যাপারটা তো সত্যিই তো আর শুধু সায়েবদের হাত-ধরা ছিল না, সায়েবরা চলে যাবার পরেও সেটা থেকে যায়, যেখানে ছিটেফোঁটা অন্য সময় যা অবশিষ্ট থাকে হাঁ করে গিলতেই থাকে। তরাই-এর অঘোষিত রাজধানী শিলিগুড়িকে দেখলেই সেটা বোঝা যায়। রুমাল ঝাঁ করে বিড়াল হয়ে যায় কিনা তা লিউইস ক্যারল আর সুকুমার রায় জানতেন। এক নিসর্গ বদলে অন্য কিছু যে হয়ে যায়, তা স্বচক্ষে দেখা, শিলিগুড়িতে ছ-দশক বসবাসের সুবাদে। শিলিগুড়ি নামের জায়গাটা আনন্দখনি নয়, পুরোনো তো নয়ই, তাকে নিয়ে অনেক কথাগল্প বলার অবকাশ নেই। যে জায়গাটায় থাকি, তার চারপাশ আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে উঁচুউঁচু বাক্সবাড়ি উঠছে, যেমন হয়। বাড়ির জঙ্গলে দৃষ্টি চলে না, খুব উঁচু কোথাও না উঠলে যেখানে আছি সেটা হিমালয়ের তরাই না ছাপরা বা দমদম বোঝার উপায় নেই। যেভাবে মারি বা কালব্যাধি ছড়ায়, ‘বনমারা’ বা আসামলতার সবুজ হিলহিলে লতা দ্রুত ঢেকে নেয় আসল জঙ্গল, পুবে পশ্চিমে উত্তরে দক্ষিণে শহর ছড়াচ্ছে তো ছড়াচ্ছেই, ফলে ভিড় ঠেলে অনেকটা পথ না গেলে পাহাড়বনের দেখা পাওয়া যায় না। অন্য কত শহরের কত জমে থাকা ঘুম থাকে, সরু সরু শিরায় মরে যাওয়া গান থাকে, সেখানে গায়েগায়ে লাগা উঁচু উঁচু বাড়ির মাঝখান দিয়ে খালের মতো গলিনদী বয়ে যায়। সে সব শহর অনেককাল ধরে জন্মায়, আস্তে আস্তে কষ্ট পেয়ে মরে। সে তুলনায় এই শহর বড় হালফিলের, ম্যাড়মেড়ে, নীরক্ত, এর কোনো স্মৃতিবিষণ্ণ আত্মা নেই, একে নিয়ে কি গল্প যে বলি। তা হোক। নেই নেই করে এ-শহরেই ষাট বছর কেটে গেলো যখন, সম্ভবত বাকি অল্প কদিনও কাটবে, দু চারটি কথা বলা যায়।
উনিশ শতকের প্রায় শেষদিক অবধি শিলিগুড়ি বলে কিছু ছিলো কিনা সন্দেহ। হুকারের হিমালয়ান জর্নলে শিলগোড়ি বলে একটা জায়গার কথা বলা আছে, তিতলিয়া থেকে পাহাড়ে ওঠার পথ সেখান দিয়ে গেছে। লেখকের বর্ণনা এইরকমঃ “তরাই-এর কিনারায় শিলিগুড়ি দাঁড়িয়ে। ...হঠাৎ আসা একটা উৎরাই বেয়ে মহানদীতে নামা। উপত্যকাটা সংকীর্ণ, নুড়িপাথরে ভরা নদীর তলদেশ। এই ঋতুতেও নদী খরস্রোতা, পাড়ে ঘন ঝোপজঙ্গল, জল এত স্বচ্ছ আর ঝকঝকে যে মনে হয় স্কটল্যান্ডের ট্রাউট-মাছে ভরা কোনো ধারা। নদী পার হয়ে পথ খয়ের আর শিশু গাছের ঘন ঝাঁটিজঙ্গলের(ব্রাশউড) মধ্য দিয়ে ঘুরে ঘুরে গিয়েছে। এই ঋতুতে কয়েকটাই মাত্র বসন্তের ফুল, অর্কিডের পাতা দেখা গেলো, সেসঙ্গে ফার্ন আর গরম ভেজা এলাকার আগাছা। অনেক ছোট ছোট ধারা পেরিয়ে গেলাম, কিছু একেবারে শুকনো, সবগুলোই একেবেঁকে যাচ্ছে, তাদের পাড়ে ঘন বন, কনভলভুলাস আর বেগোনিয়ার লতা।” দ্বিতীয় বার হুকার শিলিগুড়ির দিকে আসেন তিস্তার পাড় ধরে, বৈকুন্ঠপুর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। তিস্তা এবং মহানন্দার পৌঁছোনোর পথের নিসর্গশোভায় হুকার উচ্ছসিত - “...যত যাওয়া যায় আশেপাশের এলাকা তত সুন্দর হয়ে ওঠে, উচ্চাবচ, মাঝে মাঝে ঝলমলে সবুজ প্রান্তর, ঘাসের ঢাল আর বনে-ঢাকা ছোট ছোট নদী, শালজঙ্গল থেকে বেরিয়ে তারা এই চিত্রময় নিসর্গের ভিতর দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গ্যাছে। সুরম্য হর্ম্য নির্মাণের জন্য এ অপেক্ষা সুন্দরতর স্থান আর কি হতে পারে…।”
সায়েবদের মর্জির ব্যাপার। ১৮৪৮-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি, দার্জিলিং থেকে তিতলিয়া যাবার পথে হুকার শিলিগুড়ি বাংলোয় এক বেলা কাটান। পাঙ্খাবাড়ি থেকে শিলিগুড়ি যাবার পথের বর্ণনা - “...সকালটা না ঝলমলে না তাজা; মাটি ফাটা ধুলাক্ত; চারপাশটা ঘোলাটে হলদেটে... সূর্য উঠল। সমতল ছেয়ে আছে ধোঁয়ার ঘন মেঘে, ক্ষীণ বাতাসে মন্থর উড়ে আসছে পোড়া ঘাসের বড় বড় টুকরো। পাক খাচ্ছে বিশ্রী নোংরা শকুনের পাল, চনমনে পাহাড়িদের জায়গা নিচ্ছে ঝিমোনো বাঙালিরা ( ১৮৪৮-এ ওই পথে ‘বাঙালি’ কোথায় পেলেন হুকার?), শেয়াল-শেয়াল নেড়ি কুকুরেরা থিকথিক করছে প্রত্যেক গ্রামে…।” তিতলিয়া থেকে নেপাল সীমান্তের মেচি, অন্যদিকে জলপাইগুড়ি পর্যন্ত এলাকায় শুধু মাঠ আর মাঠ, ঝোপঝাড় তেমন নেই, বড় গাছ নেই-ই। বিস্তীর্ণ এই এলাকা একশো বছর আগেও আবৃত ছিল ঘাসজঙ্গলে, তরাইয়ের যা দস্তুর। আগুন লাগিয়ে পোড়ানো হয়েছে ঘাস, হুকার জানাচ্ছেন। তাঁর মতে আপদ গেছে, ঘাসবনে বাজে গন্ধ ডেরা বেঁধে থাকে, সে সঙ্গে তৃণভোজী মাংসাশী দু রকমেরই বুনো জন্তু, উভয়েই মানুষের পক্ষে সমান বিপজ্জনক। ‘সভ্যতা প্রসারের রাস্তায় সবচাইতে বড় বাধা ঘাসবন’, বলছেন হুকার।
শিলিগুড়ি জায়গাটা আদতেই বড় আলটপকা—উঁচু নীল পাহাড়ের নীচে ঘাসবন, বালি পাথরে ভরা স্বচ্ছতোয়া ছোট বড় নদী, ডাঙা জমিতে বন—এসবের মধ্যে একদিন হঠাৎ শহরপত্তন। কারণ দার্জিলিং। কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত রেলপথ টানা হলো, উনিশ শতকের শেষাশেষি শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত ছোট লাইনও বসে গেল। শিলিগুড়িতে যে স্টেশানটা জন্মাল তার আদিনাম কি দেওয়া হয়েছিলো বলা মুশকিল(এখন তাকে শিলিগুড়ি টাউন নামে ডাকা হয়), সেখানে কলকাতার গাড়ি থেকে নেমে দার্জিলিং-য়ের গাড়ি চড়তে হত। সায়েবরা চলে গেছে সেই কবে, স্টেশানটা থেকে গেছে।
আরও পড়ুন
তরাই-মোরাং-এ সায়েবসময়
১৮৭৮–এর শেষদিকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত রেল পৌঁছোয়। ১৮৮১ নাগাদ শিলিগুড়ি-দার্জিলিং রেল যাতায়াত চালু হয়। স্টেশান ছিলো যখন, ধরে নিতে হবে স্টেশানকে কেন্দ্র করে লোকবসতিও ছিল। অথবা ছিল না। ১৮৭৬-এ হান্টার সায়েবের বাংলার সংখ্যাতাত্বিক বর্ণনা-র দার্জিলিং খণ্ড প্রকাশিত হচ্ছে, সেখানে শিলিগুড়ির নামগন্ধ নেই, যদিও দার্জিলিং জেলার তরাই মহকুমার উল্লেখ আছে। ১৯০৯-এ ও’ম্যালির জেলা গ্যাজেটিয়ার বেরুচ্ছে, সেখানে শিলিগুড়িকে বলা হচ্ছে তরাই-য়ের জলাভূমিভর্তি ম্যালেরিয়াকীর্ণ গণ্ডগ্রাম, তাতে ১৯০১-এর লোকগণনায় মোটে ৭৮৪ জন লোকের বাস। লোক থাক না থাক, সরকারি ঘরবাড়ি ছিলো। স্টেশান-এর আশেপাশেই ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের দপ্তর, সব-জেল, ডাকঘর, একাধিক বাংলো, থানা, হাসপাতাল।
কোথা থেকে কী হয়ে গেল, শিলিগুড়ি হুহু করে বাড়তে থাকল। জলা ভরাট হলো, মশারা পালিয়ে গেল বোধহয়, অথবা ম্যালেরিয়াভয় তুচ্ছ করেই পাল পাল লোক শিলিগুড়িতে আসতে থাকল, বিশেষত বাঙালিরা। ড্যাশের ১৯৪৭-এর গ্যাজেটিয়ার অনুযায়ী ১৯৪১-এ শিলিগুড়ির জনসংখ্যা ১০, ৪৮৭, আগের দশকের (১৯৩১) থেকে ৭৩ শতাংশ বেশি। সরকারি সেন্সাস তথ্য অনুযায়ী ১৯৩১ থেকে ১৯৬১-র মধ্যে জনসংখ্যা বাড়ে ৬৭৩ শতাংশেরও বেশি। ২০১১-তে বৃহত্তর শিলিগুড়ির জনসংখ্যা ৭ লক্ষাধিক। এতো লোকজন এলে, থাকলে, যা হয় তাই, গ্রাম আর গ্রাম থাকে না, ঝাঁ করে শহর হয়ে যায়। মানে ভিতরে বাইরে দুভাবেই। বাইরে থেকে জায়গাটাকে দেখতে যেমন ছিলো, তেমন থাকে না।
আরও পড়ুন
তরাই-মোরাং : নিসর্গ, মানুষ, যুদ্ধবিগ্রহ
থাকা না থাকার কথা বলি। যবে থেকে দেখছি শিলিগুড়ির একটা আধা-শহর গোছের চেহারা ছিল—সেটা ঠিক কলকাতার শহরতলির আর দশটি আম-মফস্সলের মতো ধূসর ও ঘিঞ্জি নয়। বরং পুরোনো শিলিগুড়ি গ্রামটা তার মাঠ, নদী, গাছপালা ঝোপঝাড়, উঁচুনিচু জমি এসব নিয়েই নতুন শহরটার মধ্যে অনেকদিন টিঁকে ছিল। বাড়িঘর ছিল, ভিড় ছিল না। আমরা যে পাড়াটায় থাকতাম সেখানকার প্রতি বাড়ির সামনে পিছনে ফাঁকা জমি, বাগান। দু পা এগুলেই ছোট বড় মাঠ। বাড়ির লাগোয়া ফাঁকা জমিতে, সেই সব অনর্গল মাঠে সরু মোটা নানান জাতের ঘাস জন্মাত। আর অফুরন্ত বুনো ঝোপঝাড়—বড় ছোটো কচুগাছ, আকন্দ, ভাট, কলকে, ধুতরো, শেয়ালকাঁটা, আরো কত কি। সারা বছর ধরে সেই সব গাছে সাদা, হলুদ, বেগুনি, নীল আর লাল ফুল ফুটত, তার কোনো-কোনোটায় কি মিষ্টি মধু!
বাড়িগুলোও বড় নিরীহ ঠান্ডা গোছের ছিল—বেশির ভাগ কাঁচা আধা-কাঁচা, মানে তাতে সিমেন্ট লোহা এসবের ব্যবহার থাকত নামমাত্র। শালকাঠের খাঁচার মধ্যে চেরা বাঁশের ঠাসবুনোট বেড়া বসিয়ে দেয়াল তৈরি হত, তার ওপরে সিমেন্টের প্রলেপ। ছাত হতো ঢেউ-খেলানো টিনের, ছাতের নিচে সিলিং-এ হয় কাঠ নয় দরমার বেড়া। কোথাও কোথাও দেয়ালও টিন দিয়ে বানানো হত। এরকম। আর ছিলো আগাগোড়া কাঠ দিয়ে তৈরি সব বাড়ি, কোনোটা একতলা কোনোটা দোতলা, প্রায় ক্ষেত্রেই মাটি থেকে শাল কিম্বা সিমেন্টের খুঁটি তুলে তার ওপরে কাঠের তক্তা ফেলে ফেলে বানানো। কাঠের গায়ে রঙ করা থাকতো—কখনো সবুজ কখনো ইস্পাতধূসর কখনো নীল। আমাদের পাড়ায়, আশেপাশের অঞ্চলে পুরো সিমেন্টে তৈরি পাকা বাড়ি ছিলই না বলা চলে, থাকলে তা রীতিমতো দ্রষ্টব্য হয়ে দাঁড়াত।
আরও পড়ুন
তরাই-মোরাং : ভূগোল-ইতিহাসের সন্ধানে
সে সময়ে শিলিগুড়ির বহু পরিবারেরই নিজেদের বাড়ি থাকত না। পাড়ার বেশির ভাগ বাড়িরই মালিক ছিলেন বীরেন রায় সরকার মশাইরা। তাঁরা এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দা, প্রচুর জমিজমা ধনসম্পত্তি ছিল। শোনা যায় শহরের বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের বাড়িজমি ছিল—এমন কি শিলিগুড়ি নর্থের নতুন রেল স্টেশানটা পর্যন্ত তাঁদেরই জমির ওপর। সে জমির জন্য যে রাশি রাশি টাকা পাওয়া দিয়েছিল সেটা নাকি বীরেনবাবু মাটির তলায় পুঁতে রেখেছিলেন, পরে সে টাকা পচে যায়। এরকম নানান গল্প ছিল। বড় পরিবার, সম্ভবত ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ বাঁধে, বীরেনবাবুরও বয়স বাড়ে, ভাড়া-টাড়া ঠিকমতো আদায় হত না। আমাদের বাড়ির সামনে রাস্তার ওপরেই একজোড়া কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল—তার একটার তলায় দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ বীরেনবাবু খুব দুঃখ করছিলেন একদিন, এখনো মনে পড়ে। সম্পত্তি সব বেহাত হয়ে যাচ্ছে, লোকে ভাড়া দেয়ও না ঠিকমতো, এইসব।
এখন বুঝতে পারি, বীরেনবাবুরা ছিলেন ধনী, বড় জোতদার। শিলিগুড়ি শহরটা হিমালয়-সংলগ্ন যে তরাইভূমির ওপর, সেখানে প্রাক্-ঔপনিবেশিক ও ঔপনিবেশিক সময়ে বড় বড় জমিখণ্ড ছিল, যেগুলোকে বলা হত জোত। হান্টার সায়েবের বাংলার সংখ্যাতাত্বিক ইতিবৃত্তের (১৮৭৬-এ প্রকাশিত) দশম খন্ডে দার্জিলিং জেলার বিবরণে দ্যাখা যাচ্ছে, ১৮৭৩-এর সেটলমেন্টে তরাইতে ৮০৬টি জোতে ১, ২৪, ২৩৬ একর জমি দশ বছরের হিসেবে ইজারা দেওয়া আছে। ২৮,৬৬৩ একর দেওয়া আছে তিরিশ বছরের ইজারায়। তরাই-ডুয়ার্স-দার্জিলিং পাহাড়ে মৌরসি পাট্টা কি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চল ছিল না, ইজারার মেয়াদ শেষে হয় নতুন সেটলমেন্ট, না হয় খাজনা বৃদ্ধি। জোতের ইজারাদারদের বলা হত জোতদার। ১৯০৭-এ এল এস এস ও’ম্যালির দার্জিলিং জেলার গ্যাজেটিয়ার বেরুচ্ছে, সেখানকার হিসেব অনুযায়ী, ৮৩৪টা জোতের মধ্যে ২৭২টাই দেনার দায়ে স্থানীয় কৃষিজীবীদের হাত থেকে বহিরাগত সুদখোর মহাজনদের হস্তগত। সুদের হার সে সময় ছিল বার্ষিক ৭৫ শতাংশ। ও’ম্যালি বলছেন ৫ বছরের মধ্যে ১৩৯টা জোত নিরক্ষর স্থানীয়দের কাছ থেকে এই করে মহাজনেরা হাতিয়ে নিয়েছিলো। তাঁর হিসেবে জোতের গড় আয়তন ছিল ১৫০ একর, বা পঞ্চাশ বিঘা। কিছু জোত ১০০০ একরের ওপর, বা তিন-চারশো বিঘারও ছিল। জোতদারদের প্রায় সবাই ছিলেন রাজবংশী সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁদের জমি চাষ করতেন বনে থাকা মেচ বা মেচিয়ারা, ধিমালরা, পরে চা-বাগানে কুলি হিসেবে নিয়ে আসা উঁরাও, মুন্ডা, সাঁওতালেরা। জমিতে জন খাটতেন যাঁরা তাঁদের মজুরি নগদে হত না, ফসল বা তদনুরূপ কিছুতে হতো। মেচি নদীর ওপারে নেপাল, সেখান থেকেও স্থানান্তরিত নেপালি জনগোষ্ঠীভুক্ত মানুষেরা আসছিলেন। জোতদারদের জমি চাষ করা মানুষদের বলা হত আধিয়ার। আধিয়ার আর জোতদারদের মধ্যের স্তরে যথাক্রমে মধ্যসত্বভোগী ও উপসত্বভোগী চুকানিদার ও দর-চুকানিদারেরা থাকতেন। অবস্থাপন্ন শহরবাসী জোত কিনে টাকা খাটাতে শুরু করেছিলেন। ১৯২৫ সেটলমেন্টে (এ জে ড্যাশের দার্জিলিং জেলার গ্যাজেটিয়ার, ১৯৪৭) দেখা যাচ্ছে, যার জোত সে চাষ করে না, মধ্যসত্বভোগী ও উপস্বত্বভোগীদের সংখ্যা বেশি।
আরও পড়ুন
তরাইয়ের অরণ্যে
জোত বৃত্তান্ত থাক। আমাদের পাড়াটা যে ডাঙা জমির ওপর, সেটা খানিকদূর গিয়েই গোঁৎ খেয়ে নিচে নেমে যেত, সেখানে অল্প কিছু বাড়িঘর, তারপর জলপাইগুড়ি জেলা শুরু হয়ে যেত। সেখানে মাঠ আর ধানক্ষেত। এক বন্ধুর বাবা গল্প করেছিলেন, বিকেলে সে মাঠে হরিণ চরত। চরতেই পারে। শহর থেকে বন বেশি দূর ছিল না, আমাদের দেশবন্ধুপাড়া থেকে সুভাষপল্লি হয়ে রবীন্দ্রনগর ছাড়ালেই ধূধূ মাঠ। মাঠ ছাড়ালেই জঙ্গল, সেখানে উঁচু উঁচু শালগাছের সঙ্গে মিশে আছে অগুন্তি কুল আর চালতার গাছ। পেড়ে খেলেই হয়।
সন্ধ্যা নামলেই আশপাশের ঝোপঝাড় থেকে শেয়ালদের কোরাস শুরু হতো—হুক্কা-হুয়া-আ-আ-আ-কা হুউক্কা-হুয়া। প্রায় ঘরেই ইলেকট্রিকের আলো ছিলো না, টিমটিমে কুপি আর হারিকেনের আলো তাক করে ঝাঁপিয়ে পড়ত গিজজিজে পোকার ঝাঁক, গ্রীষ্ম বর্ষায় বসন্তে। বর্ষা শুরু হলে যেতে চাইত না, ভিতরের উঠোন থেকে বাইরের মাঠ, নালা, সব ভরে উঠত জলে। সে জলে চুনো মাছ ভেসে আসত, পুঁটি, খলসে, দারকিনা। আর অজস্র ব্যাঙাচি। ঘরে ঢুকে আসতো সোনালি-হলুদ ব্যাঙ, কেঁচো, শামুক।
বর্ষা বিদায় হলে ঝকঝকে নীল আকাশের, সাদা-কমলা সুগন্ধ শিউলির শরৎ। হাওয়া বদলাত, ভোরের দিকে শিরশিরানি। শরৎ পেরুলেই হেমন্ত, মাঠে ঘাস হলুদ হয়ে আসা, তাদের ডগায়, গাছের রং-বদলানো পাতায় টলটলে শিশির। তারপরেই শীত, দীর্ঘ দীর্ঘ শীত, দুপুরে ছায়া গড়াতে শুরু করলেই ঠান্ডায় হাতের আঙুল কুঁকড়ে যাওয়া, সন্ধ্যা থেকে ভোর অবধি পুরু ভারী কুয়াশা, মাঠে, নদীতে, টিমটিমে হলুদ আলো জ্বলা রাস্তায়। শীত ফুরোলে পলাশ-শিমূলের, হুহু হাওয়ার, পাতা ঝরার, চামড়ায় টানের বসন্ত। চারপাশে সবকিছু ঠিকঠাক, যেমন হওয়া উচিত, যেমন থাকে, থেকেছে এতকাল, মাটির জায়গায় মাটি, জলের জায়গায় জল, হাওয়ার জায়গায় হাওয়া। অমোঘ ঋতুচক্র।
সময় বদলায়, নিসর্গও। প্রথমেই নদীগুলো গেলো। চম্পাসারি আর শালুগাড়ার মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে মহানন্দা নদী শিলিগুড়িতে ঢোকে। আশির গোড়ার দিকেও চম্পাসারি ছেড়ে নদীর দিকে গেলে দেখা যেতো, সাদা বালিপাথরের ওপর দিয়ে বইছে স্বচ্ছ নীল জল, তার দুপাশে খালি ঘাসজমি, উজান বরাবর সামনে তাকালে স্তরে স্তরে বিছিয়ে আছে হিমালয়। দশ বছরের মধ্যে সেই নয়নাভিরাম শেষ, নদীর দুধারে চম্পাসারি থেকে প্রধাননগর অবধি লোক বসানো হয়ে গেছে, ঘরবাড়ি পাড় উপছে প্রায় নদীর ভিতরেই। মহানন্দার পর ফুলেশ্বরী, তার সরু উঁচু খাত। রবীন্দ্রনগর-ডাবগ্রাম হয়ে ভক্তিনগর অবধি সে নদীর দুপাশে লোকবসতি, নদী নর্দমার নামান্তর। শহর ছাড়িয়ে সুকনার দিকে কিয়দ্দূর গেলেই পঞ্চানই নদীর কাকচক্ষু জল, দুপাশে মাঠ, চা বাগান, পিছনে জঙ্গল, পাহাড়। দার্জিলিং মোড় থেকে যত যাওয়া যায়, বড় বড় বাড়ি পঞ্চানইকে ঠেসে চেপে ধরেছে, দুপাশের মাঠ ক্রমে ভরাট। নদীর খাতে, পাড়ে, গিজগিজে ঘরবাড়ি, আর নদীর বুকে সেই বাড়িঘর বানানোর জন্য বালিপাথর তোলা।
নদী গেল, মাঠও । শুধু নদীপারের ঘেসো জমি নয়, পাড়ার ভিতরে ভিতরে, শহরের চারপাশে যত মাঠ ছিলো, সব দখল হয়ে বিক্রি হয়ে গেল—মাঠ ঘিরে লম্বা উঁচু পাঁচিল, বড় বড় লোহার গেট। প্রভাবশালি বাম নেতা, দীর্ঘদিনের মন্ত্রী, খুব যত্ন করে নগর-পরিকল্পনা বুঝিয়েছিলেন। কী করা যাবে, উপায়টা কি? শহর তো বাড়বেই। শালুগাড়া অবধি সব জমি মারোয়াড়িরা কিনে রেখে দিয়েছে, ওখানে হাত দেওয়া যাবে না। কথাটা হল, শহর বাড়বে কীভাবে? আড়ে না বহরে? হরাইজন্টালি না ভার্টিক্যালি? সিঙ্গাপুর গিয়ে স্বচক্ষে বৈজ্ঞানিক নগরায়ণ দেখে এসেছেন, সেটাও বললেন।
শহর বাড়তে থাকল। মানে যে শহরটা ছিল, শহরের মধ্যে যে না-শহর গ্রাম, গ্রামেরও আগের মাঠঘাটবনজঙ্গল টিঁকে ছিল বহুদিন, মরে গেল অনাথ বিড়ালছানার মতো। ছোটো ছোটো বাড়িদের গোড়া থেকে উপড়ে ফেলে বিক্কিরির জমি করে ফেলা হল। তারপর সে জমিতে প্রোমোটার, ঠিকাদার, মরচে পড়া লালচে লোহার রড আর ট্রাক ট্রাক বালিবজরি। পাড়ায় পাড়ায় প্রোমোটার দালাল ঠিকাদারের ঝাঁক শুঁকে বেড়াতে থাকল, কোথায় কোন কোণাঘুপচিতে ভাঙবার মতো বাড়ি আছে। মাঠ-বাগান ঘেরা বাঁশ-কাঠ দিয়ে তৈরি বাড়ির জায়গায় খাঁচাগোছের বাক্সবাড়ি উঠতে থাকল একের পর এক। সে সব বাড়িতে থাকতে এলো যারা, জায়গাটার সঙ্গে, শহরটার সঙ্গে তাদের কোন যোগাযোগ আত্মীয়তা ছিল না কোনদিন। পুরোনো লোকেরা চাপা পড়ে গেল ভিড়ে। পুরনো বাড়িগুলোতে অনেক ভাইবোন মাবাবা ঠাকুমাদাদু মিলিয়ে থাকত যে বড় বড় পরিবারেরা, তারা টুকরো টুকরো হলো, পুরনো বাড়িতে জায়গা হয় না, ভেঙে ফেলে বড় বড় নতুন পাকা বাড়ি করতে হল।
এ গেল পাড়া, লোকের থাকার জায়গার কথা। টাউন স্টেশান থেকে উত্তরমুখী এগুলে হিলকার্ট রোড বিধান রোড সেভক রোড এসব বাজার অঞ্চল বদলে গেল লহমায়—পুরোনো দোকানগুলোকে চেনা যায় না, খুঁজে পাওয়া যায় না। বড় বড় বাজার, মল, দিনরাত সেখানে ঝকঝকে আলো জ্বলে, কাঁচের মধ্য দিয়ে দেখা যায় রকমারি দ্রব্যসম্ভার, জামাকাপড়, খানাপিনা, প্রসাধনী, গাড়ি।
রাস্তাগুলোও নানান ছোটবড় গাড়িতে আর গাড়ির ধোঁয়ায় ভরে গেল। আশি-নব্বুই কি তার পরেও, হিলকার্ট রোড কি ওইরকম বড় রাস্তারা রাত আটটার পর থেকে নিঃঝুম হয়ে আসত, পাড়ার ভিতরের সরু নিরিবিলি পথ দিয়ে হেঁটে বেড়ানো যেত অনায়াসে। লোকে এ পাড়া ও পাড়া যেতে হলে হাঁটত, নাহয় সাইকেলে কি রিকসোয় চড়ত। এখন রাত দুটো পর্যন্ত পাড়ার ভিতরেও গাঁক গাঁক করছে মোটরবাইক, গাড়ি। দুদন্ড পায়চারিরও উপায় নেই।
শহর বাড়ছিল, উন্নত হচ্ছিল। একদিকে রবীন্দ্রনগর ছাড়িয়ে ডাবগ্রাম-আমবাড়ি, অন্যদিকে শালুগাড়া পেরিয়ে তিস্তার দুই পাড়ে ছড়িয়ে ছিলো যে বৈকুণ্ঠপুরের শালবন, মাত্র বছর কুড়ি লাগলো তা সাফা হতে। বাম শাসকদলের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে বনে গিয়ে গাছ কাটা হয়ে দাঁড়াল গণ-শিল্প, ব্যবসা, উদ্যোগ। স্রেফ বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গল নিকেশ করে শালখুঁটি চালান দিয়ে শহরের প্রসিদ্ধ ধনীদের অন্যতম হয়ে দাঁড়াল এক প্রসিদ্ধ মাস্তান—শোনা যায় জঙ্গলের ভিতর সে রীতিমতো কারখানা বসিয়ে দিয়েছিল, কাঠ চেরাই হত সকালে-সন্ধেয় তিন শিফটে। সে কবে গুলি খেয়ে মরেছে, শহর তার স্মৃতি ধরে রেখেছে তার নামের রাস্তায়, হোটেলে। শুধু শাসক বামেরা কাষ্ঠ-উদ্যোগী ছিল, এমন নয়। জেল থেকে বেরিয়ে আসা কি ঘরে ফেরত আসা বিপ্লবী নকশালদের মধ্যেও অনেকে নেমে পড়লেন—এঁরা যদি বৈকুণ্ঠপুরের ইজারা নিয়ে থাকেন, তাঁদের এলাকা হলো শিলিগুড়ির পশ্চিমে
বাগডোগরা-পানিঘাটা-নক্সালবাড়ি-টুকুরিয়া। গাছ পড়তে থাকলো। কাঠ-চালানের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন এমনকি প্রবাদপ্রতিম নক্সাল নেতা জঙ্গল সাঁওতাল মশাইও।
শুধু বামমার্গীরা কেন? জঙ্গল সাবাড় যথা পুণ্যকর্মে কে ছিল না? কংগ্রেসীরা, গোর্খাওয়ালারা(আশির মাঝামাঝি থেকে পাহাড়ের, তরাই-ডুয়ার্সের নেপালিভাষী এলাকার জঙ্গলে গোর্খা পার্টির একচ্ছত্র আধিপত্য), যে যেখানে ছিলো সবাই বনমুখী হল। ফলে শিলিগুড়ির চাদ্দিকের গোটা এলাকায় পুরোনো গাছ বলতে কিছু থাকল না বিশেষ, এখন যা দেখা যায়, সেগুলো কাটা গাছের গুঁড়ি থেকে বেরুনো সরু ফেকড়ির বন, অর্থাৎ কপিস।
নদী, মাঠ, জঙ্গল গেল, হাতে থাকল চা-বাগান। থাকলো কি? সে গল্প আলাদা করে বলা দরকার।
Powered by Froala Editor