সময়ভ্রমণ – ১৬
আগের পর্বে
১৮৫০ সালে ব্রিটিশদের অধিকারে আসে তরাই অঞ্চল। প্রজাপালনের জন্য শুরু হয় অরণ্য নিধন। ১৮৬৯ সালে পশুহত্যার পুরস্কার বাবদ ৩১৮ টাকা খরচ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। শিকারে সাহেবদের থেকে কম যেতেন না বাঙালি বড়লোকবাবুরাও। ক্রমাগত শিকারে কমতে কমতে একসময় বাঘই থাকল না উত্তরে। সেইসঙ্গে শুরু হয় কাঠের ব্যবসা। ফিকে হয়ে আসে অরণ্য। স্বাধীনতার পর মহানদী ও মহানন্দার ধারে অভয়ারণ্য গড়ে উঠলেও সমস্যার সমাধান হয় না। অপরিকল্পিতভাবে ধরে আনা হয় হরিণদের। তাদের অনেকেই এই উৎপাতে মারা যায়। শুকনা বাজারের কাছেই আছে একটি পুরনো বাংলো বাড়ি। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, জ্যোতি বসু সহ অনেক মুখ্যমন্ত্রী থেকেছেন সেখানে। আজও মন্ত্রী-আমলাদের যাতায়াত লেগেই থাকে। বনবস্তিগুলোকে ইদানীং ডাকা হয় 'বনছায়া' নামে।
হিমালয় পাহাড় থেকে নামলেই যে বনে ঢাকা সমতল জমির দেখা পাওয়া যায়, তরাই বলতে সেটাই বোঝানো হয়। তরাই-এর আগে, মানে পাহাড় আর তরাইয়ের মাঝখানে আসবে ভাবর, বড় বড় পাথরের, উঁচুনিচু জমির আর বড় ঘাসের বনের রাজত্ব। নেপাল হিমালয় ধরে পশ্চিমে এগুতে থাকলে, পুরোনো ইউনাইটেড প্রভিন্স বা উত্তরপ্রদেশে, বিশেষত হালের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের কুমায়ুন এলাকায়, ভাবর অঞ্চলের দেখা পাওয়া যায়। জিম করবেটের লেখা জাঙ্গল লোর বইটায় ভাবরের বন, বন্য প্রাণী, প্রকৃতি, এসবের বর্ণনা আছে। ওই বন এখন জিম করবেট জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত বাঘবন নামে খ্যাত, ফি বছর নভেম্বর থেকে মে অবধি লোকে সেখানে বাঘ সাফারি করতে যায়। ওই জাতীয় উদ্যানে অবশ্য শুধু ভাবর নয়, তারপরের তরাইয়ের বনও ঢুকে আছে।
দার্জিলিং অঞ্চলে তরাই শব্দটার মানে খানিক আলাদা। পুবে তিস্তা থেকে পশ্চিমে মহানন্দা, আরো পশ্চিমে মেচি নদী, ওদিকে রংপুরের খানিক, বিহারের কিষাণগঞ্জ, এই অঞ্চলটাকে সায়েবরা তরাই বলত। আসল তরাই এদিকে তিস্তা ওদিকে মেচি ছাড়িয়ে হাজার দুয়েক মাইল লম্বা, হিমালয় ঘুরে ঘুরে এঁকে বেঁকে যতদূর যাচ্ছে, নিচের তরাইও যাচ্ছে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সায়েবরা প্রথম যখন গঙ্গার এপারে আসে, সেটা আঠেরো শতকের শেষ, সুবাবাংলায় ওয়ারেন হেস্টিংস-এর রাজত্ব। হিমালয়ের কোথায় শুরু কোথায় শেষ, কে জানে? দার্জিলিং পাহাড়ের নিচের তরাইকে বলা হত মোরাং। দূর্গম, কার্যত অজানা পাহাড়দেশের এমুড়ো ওমুড়ো চর পাঠিয়ে, নিজেরা ঘোরাঘুরি করে, দরকারমতো অভিযান চালিয়ে হিমালয়ের পুরোটার মানচিত্র তৈরি করতে করতে সায়েবদের প্রায় আরো একশো বছর লেগে যাবে, কি তারও বেশি।
মানচিত্র ছাড়া ভূগোল হয় না, ভূগোল না থাকলে শাসনও হয় না। সব শাসকই অল্পবিস্তর এটা বোঝে, তবে সায়েবদের বোঝার একটা অন্য ধরণ ছিল। সায়েবরা এ অঞ্চলে আসার আগে যে সায়েব-পূর্ব শাসকেরা ছিলেন, তাদের শাসনবৃত্তের মধ্যে নদী, পাহাড়, বনজঙ্গল, মানুষ--এর সবটাই ছিল। জমি ইঞ্চি ইঞ্চি জরিপ করে অথবা না করেও, সেখানে প্রজা বসিয়ে খাজনা আদায় করা, কিম্বা গ্রাম পিছু কর নেওয়ার বন্দোবস্ত, এসব মুঘল ও মুঘল-পরবর্তী শাসকেরা করে ফেলেছিলেন। সে ব্যবস্থা যথেষ্ট পাকা ছিল, জটিলও বটে।
আরও পড়ুন
তরাইয়ের অরণ্যে
সায়েবরা ব্যবস্থাটা পুরোটা বদলে ফেলেছিল, এমনও নয়। তা সত্ত্বেও, সায়েবদের ভূগোলবোধ এবং মানচিত্রশাসনের সঙ্গে সায়েবপূর্ব সময়ের শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি ও স্বভাবগত ভিন্নতা ছিল। সায়েবদের ভূগোল তৈরি হচ্ছে যুগপৎ পুঁজির তাড়নায় ও তথাকথিত পাশ্চাত্য যুক্তিক্রম অনুযায়ী। সায়েবরা একটা দেশ, এলাকা, অঞ্চল দখল করছে, ভূগোলও বদলাচ্ছে। ছক কেটে। পরিকল্পনামাফিক বদল। ভূগোল মানে তো শুধু এই নদী থেকে ওই নদী, এই পাহাড় থেকে ওই পাহাড় নয়। দুই নদী এবং দুই পাহাড়ের মধ্যে যা আছে সব। পাহাড়ে বন থাকলে কী বন? কী গাছ আছে সেই বনে? কী প্রাণী? পাহাড়ে মাটি, পাথর থাকলে কী মাটি, কী পাথর? নদী থাকলে সে নদী কোথা থেকে এসে কোথায় যাচ্ছে? এলাকায় গ্রাম, শহর, বাজারহাট আছে? থাকলে কীরকম? কারা থাকে সেখানে? কী করে? কী খায়?
এহেন বহু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে, বিপদসঙ্কুল অজানা অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে হত। প্রচুর কষ্ট সহ্য করে, প্রানের ঝুঁকি নিয়ে, সায়েব ভূগোলবিৎ, উদ্ভিদতত্ব ও প্রাণীতত্ত্ববিৎ, খনি-বিশারদ ও নৃবিজ্ঞানী, এঁরা যে বৈজ্ঞানিক তথ্য যোগাড় করতেন, তা জড়ো করে আসল ভূগোল, মানচিত্রের পিছনের মানচিত্র তৈরি হত। একদিনে হত না, সময় লাগত, কিন্তু হত।
আরও পড়ুন
বনপথ ধরে--মাহালদি নদী, শুকনা-সেভকের জঙ্গল
ভূগোল তৈরি ও মানচিত্র বানানোর এই গূঢ় সুদূরপ্রসারী প্রক্রিয়া চলতে চলতেই দুই নদী আর দুই পাহাড়ের মাঝের যে অঞ্চল, সেটা বদলে যেত। সায়েবদের নিচের ঘাম-কুটকুটে বিচ্ছিরি গরমে কষ্ট, ওপর পাহাড়ে শহর হোক। বাকি পাহাড়ে প্রয়োজনমতো অন্য কিছু করা হোক। দরকারি কিছু, যা থেকে শিল্প, ব্যবসা, উন্নয়ন হয়। সেসব করতে গিয়ে পাহাড় ভেঙে ফেলতে হলে ভাঙা হোক। পাহাড়ে বন আছে? বনটা ভালো না খারাপ, কাজের না অকাজের? কাজের হলে কাঠ বার করে নাও, তারপর কাঠের, কাজের গাছ লাগাও। অকাজের হলে কুপিয়ে উপড়ে ফেলে দাও, সেখানে অন্য কিছু হোক, ধরা যাক চা বাগান বা সিঙ্কোনাবাগান। নচেৎ, পাহাড়ে লোক নেই, লোক বসাও। হয় খাজনা আদায় হবে, নয় সস্তার এমনকি বিনিমজুরির শ্রম পাওয়া যাবে। লোক তো বসাতে হবে, সে লোক আসবে কোথা থেকে? দুই নদী আর দুই পাহাড়ের এদিক ওদিক যে সব 'অন্য' অঞ্চল আছে সেখান থেকে। অসুবিধা হলে 'অন্য' ভূগোলকে নিজের ভূগোলের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলো। তাতেও কাজ না হলে, গোটা পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক তোমার করতলগত, সেখান থেকে লোক আমদানি করো। লোক বসানো কি আমদানি করার আগে দেখে নাও, লোকগুলো ঠিকঠাক না গোলমেলে, অনুগত থাকবে না সায়েবদের সঙ্গে ঝামেলা করবে।
হচ্ছিলো ধান মানে তরাইয়ের কথা। সেখানে বিস্তারিত শিব-যথা ভূগোলগীত কেন? কারণ, ভূগোলের কথা না বুঝলে মানে ভূগোলবদলের ব্যাপারটা না বুঝলে তরাই জায়গাটাকেও ধরাবোঝা যাবে না। আম-বাঙালির সমূহচৈতন্যে সায়েবি ভূগোল শিকড় গেঁড়ে আছে, সে ছকের বাইরে যাওয়া অসম্ভব না হলেও কঠিন। ফলে, তরাই বলে যে জায়গাটায় পঞ্চাশ পেরিয়ে ষাট ষাট বছর দেখতে দেখতে কেটে গেল, সায়েবদের আগে সেখানে কী ছিল কী নেই আদৌ কিছু ছিলো কিনা ঠাওর করাটা মুশকিল হয়ে পড়ে। অন্য বহু জায়গার নানারকম ইতিহাস আছে, উনিশ শতকের শুরু থেকে সৃষ্টিরও শুরু, এমন না ধরলেও চলে। আমাদের এই অঞ্চলের সে সৌভাগ্য নেই, সায়েবদের কথা পড়া বা বলা ভিন্ন উপায়ও নেই।
আরও পড়ুন
পথের কথা: ওল্ড মিলিটারি রোড
সায়েবি বয়ানে দার্জিলিং পাহাড়ের ইতিহাস শুরু হচ্ছে মোটামুটি ১৮২৮ সালে জেনারেল(সেসময়ে ক্যাপ্টেন)লয়েড আর মালদার তৎকালীন বাণিজ্য আধিকারিক(কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট)গ্র্যান্টের সিকিম যাত্রা দিয়ে। ১৮১৪-য় ইংরেজদের সঙ্গে নেপালের গোর্খাদের যুদ্ধ শুরু হয়। আগে থেকেই অবশ্য নেপাল আর কোম্পানিরাজ্যের সীমান্ত বরাবর ছোটখাটো ঝগড়ামারামারি চলছিলই। বছরটাক যুদ্ধ চলার পর ১৮১৫-র ২রা ডিসেম্বরে দেরাদুনের কাছে সুগৌলি বা সুগাওলি বলে একটা জায়গায় দুপক্ষের সন্ধি হয়।
সন্ধিপত্রের বয়ানে দেখা যাচ্ছে নেপাল সীমান্ত লাগোয়া তরাই অঞ্চলের পুরোটাই কোম্পানি নিয়ে নিচ্ছে, পূর্ব কুমায়ুনের কালি নদী থেকে পশ্চিমের তিস্তা পর্যন্ত। বছরখানেক পর তরাইয়ের একটা অংশ(কোশি নদী থেকে রাপ্তি নদী অবধি)নেপালকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন
সিঙ্কোনার আরো গল্প
সুগৌলি চুক্তির তিন নম্বর ধারায় বলা ছিল, এক, মিচি(মেচি) নদী থেকে তিস্তা নদীর মধ্যেকার সমস্ত নিচু জমি কোম্পানিকে ছেড়ে দেওয়া হবে। দুই, মেচির পূর্বদিকের যাবতীয় পাহাড়, বিশেষত নাগরি দুর্গের জমি ও ইমারত, তৎসহ মোরাং থেকে পাহাড়ে যাবার জন্য যে নাগারকোট গিরিপথ, নাগরি দুর্গ এবং নাগারকোটের মধ্যবর্তী অঞ্চল, কোম্পানিকে ছেড়ে দেওয়া হবে। ওই এলাকা থেকে গোর্খা সৈন্যদের সরিয়ে নিতে হবে চল্লিশ দিনের মধ্যে। সন্ধিপত্রের চতুর্থ ধারায় বলা ছিল, সিকিম রাজার অধিকারে থাকা জমিতে নেপাল রাজা কোনোরকম উৎপাত করবেন না, সিকিম রাজার ওপর হামলাও করবেন না। জমি বা সীমানা সংক্রান্ত বিবাদের নিষ্পত্তি করবেন ব্রিটিশ সরকার।
১৮১৫-১৬। এটা ২০২০। দুশো বছর আগের তরাইয়ের সঙ্গে আজকের তরাইকে মেলাতে যাওয়াটা সমীচিন হবে না। সায়েবদের দখলে দার্জিলিং তরাই বা মোরাং আসছে ১৮৫০ থেকে। ১৮৭০ নাগাদই তিস্তা-মহানন্দার মধ্যবর্তী এলাকার ওপর সরকারি বনবিভাগের আধিপত্য কায়েম হয়েছে, মেচ জুমিয়াদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তিস্তা থেকে মেচির মাঝখানে যা ঘাসবন আছে, পুড়িয়ে পরিষ্কার করে সেখানে নতুন প্রজা বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নতুন চা বাগান বসছে, সেখানে কাজ করবার জন্য কুলি আসছে ছোটনাগপুর, সিংভূম আর সাঁওতাল পরগণা থেকে, মেচির ওপারের গোর্খা রাজত্ব থেকে তো বটেই। আর্চিবল্ড ক্যাম্পবেল(ড: ক্যাম্পবেল নামে সমধিক পরিচিত), দার্জিলিং শহর পত্তনের পিছনে যাঁর অবদান সর্বাধিক, সরকারি কাজ থেকে অবসর নিচ্ছেন ১৮৬১-তে। অবসরের আগে বলছেন, ১৮৩৯-এ যখন দায়িত্ব নিই, পঞ্চাশটা লোকও এখানে থাকতো না। এখন ৬০০০০ লোকের বাস।
আরও পড়ুন
আরো সিঙ্কোনা-কাহিনি
এত মানুষ আসছেন বাইরে থেকে, ভূগোল ইতিহাস তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে, কিচ্ছু আগের মতো থাকছে না, তরাই-মোরাং একরকম থাকবে কী করে? জায়গা বদলাচ্ছে, সেই সঙ্গে জায়গার নাম। নাগরি নামের একটা জায়গা মেচির পূর্বদিকে, বালাসন নদীর পাড়ে এখনও আছে বটে। কিন্তু নাগারকোট গিরিপথ, নাগরি দুর্গ? ১৮১০-সালে ফ্রান্সিস বুকানন-হ্যামিল্টন লিখছেন, নাগরি বা নাগরিকোঠি সুপরিচিত জায়গা, পাহাড়িরা তো বটেই, নিচের লোকজনও জায়গাটার কথা জানত। খাজনা দিতে সেইখানে যেতে হত। বড় বাড়ি, রাজকর্মচারী, সৈন্যসামন্তের বাস। কোথায় সেসব? কবে দুর্গটা ভেঙে পড়ল, খাজনা নেওয়া বন্ধ হয়ে গেল?
এতবছর ধরে বনপাহাড়ে ঘোরাঘুরি চলছে, বুকানন-হ্যামিল্টনের লেখাপত্র সেভাবে খতিয়ে পড়া হয়নি, নাগরি নামটার মাহাত্ম্যও জানা ছিল না। জায়গাটার কথাই জানলাম এই বছর দুই--একদিন বালাসন নদীর উপত্যকা ছাড়িয়ে মিরিকের পথে পাহাড়ে উঠছি, কিছুদূর গিয়ে গয়াবাড়ি বাগান শুরু হবার আগে, ডানহাতি পথ বংকুলুঙ গ্রামে ঢুকছে(এখন সে রাস্তা ভাঙা, সম্ভবত নতুন করে তৈরি হচ্ছে), সেখান থেকে আধ-কাঁচা পথ নামছে বালাসন নদীতে। নদীর ওপারে পেল্লায় কংক্রিটের সেতু, পেরুলে ওপারে আম্বুটিয়া চা বাগান হয়ে খরসঙ যাবার রাস্তা। নদীতে নামার আগেই অন্য একটা গাছে ঢাকা পথ পাহাড়ের কাঁধ বেয়ে ওপরের দিকে যাচ্ছে, চোখে পড়েছিল। কোথায় যাচ্ছে রাস্তাটা? বংকুলুঙ ফিরে জিজ্ঞাসাবাদ করায় জানা গেল সে রাস্তা যাচ্ছে নাগরি চা বাগানে। নাগরি হয়ে শুকিয়াপোখরি। শুকিয়া হয়ে নয়, মিরিকের পর থারবু বাগানের মধ্য দিয়ে অনেক নিচে রংবং খোলা পার করে ওদিকের পাহাড় বেয়ে উঠে নাগরি বাগানে পৌঁছনো গেল। নাগরি থেকে খুব নড়বড়ে একটা পথ ধরে বালাসন পৌঁছোতে সন্ধ্যা। নাগরির পর ধজিয়া চা বাগান। ঘোর অন্ধকারে গুচ্ছ তারার মতো অনেক ওপরে কারসিয়াং শহরের আলো। বাকি গাছপালা লোকজন আলাদা করে বোঝা যায় না। এই পথটা, যেটা দিয়ে এলাম, সেটাই কি আদি নাগারকোট গিরিপথ? একদিকে রংবং, অন্যদিকে বালাসন নদী উপত্যকা জুড়ে যে নাগরি চা বাগান আর জনপদ সেখানেই কি নাগরি দুর্গটা ছিল? পাহাড় উপত্যকা জুড়ে গোধূলির আবছায়া, পশ্চিম আকাশে নীল-বেগুনি-লালের ছোপ। পথের পাশে চা বাগানের বড় কারখানা। বাজারের দোকানে বিক্রিবাটা চলছে। গ্যাস সিলিন্ডার কাঁধে হেঁটে যাচ্ছেন বৃদ্ধ শ্রমিক। সাদা-কালো, হলুদ-বাদামি লোমওলা পাহাড়ি কুকুরেরা ছুটছে বা ঘুমুচ্ছে। পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট একতলা বাড়ি, ঘন নীল, হলুদ, সবুজ। বাড়ির বারান্দায়, রাস্তার ধারে ফুলের বন্যা, গোলাপ, গাঁদা, জিরেনিয়াম, ডালিয়া। এই সব ছবি সরিয়ে কোনো জাদুমন্ত্রে দুশো বছর আগে ফিরে গেলে কি নাগরিকোঠি খুঁজে পাওয়া যাবে?
আরও পড়ুন
সিঙ্কোনা-কাহিনি
নাগরিকোঠি নামটা জানা হল যাঁর লেখা পড়ে, সেই ফ্রান্সিস বুকানন-হ্যামিল্টন বড় যে সে লোক ছিলেন না। স্কটল্যান্ডের পার্থশায়ার অঞ্চলের বাসিন্দা বুকানন-হ্যামিল্টন এডিনবরা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাস করেন ১৭৮৩ সালে। লিনিয়সের কায়দায় উদ্ভিদতালিকা তৈরি ও উদ্ভিদের শ্রেণীবিন্যাস করতে জানতেন হাতে গোনা যে কয়েকজন, তার মধ্যে অন্যতম জন হোপ, বুকানন-হ্যামিল্টন তাঁরও ছাত্র ছিলেন। চিকিৎসাবিদ্যা ও উদ্ভিদতত্ত্বে শিক্ষিত হয়ে তিনি ভারতবর্ষে এলেন, ১৭৯৪ থেকে ১৮১৪ পর্যন্ত কাজ করলেন বেঙ্গল মেডিক্যাল সার্ভিসে। সরকারি কাজ করতেন যে সব সায়েব বা সিভিল সার্ভেন্টরা, তাঁদের প্রত্যেককেই সেকালে বিভিন্ন কাজ করতে হত। বুকানন-হ্যামিল্টন ১৮০৭ থেকে ১৮১৪ অবধি বাংলার নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে সেখানকার ইতিহাস, ভূগোল, মানুষজন, সমাজ, প্রকৃতি, উদ্ভিদ, প্রাণী ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেন। বাংলায় তখন লার্ড ওয়েলেসলির রাজত্ব, বুকানন-হ্যামিল্টন তাঁর খাস চিকিৎসকও ছিলেন। ১৮০৪-এ, আলিপুর চিড়িয়াখানার সূচনা বুকানন-হ্যামিল্টনের হাতে।
সরকারি কাজে বুকানন-হ্যামিল্টন নেপালে কাটান ১৮০৯-১০ এর ১৪ মাস। সেসময় কোম্পানির সঙ্গে নেপালশাসক গোর্খাদের গন্ডগোল চলছে, নেপালের ভিতর সায়েবদের থাকাটা সুবিধার ব্যাপার ছিল না। বুকানন-হ্যামিল্টন গিয়েছিলেন ডাক্তার হিসেবে। যে ১৪ মাস নেপালে ছিলেন, তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন রামজয় ভট্টাচার্য নামে এক বাঙালি ব্রাহ্মণ। পুজোআচ্ছার ও শুদ্ধ আচারবিচার সম্পর্কিত উপদেশ নেবার প্রয়োজনে বাঙালি ব্রাহ্মণদের তখন প্রায়ই উত্তর-পূর্বের সদ্য-হিন্দু আদিবাসী রাজত্বে যেতে হত, নেপালেও বাঙালি ব্রাহ্মণদের কদর ছিল। কাঠমান্ডুতে কয়েক পুরুষ ধরে বাস করতেন ব্রাহ্মণ পরিবারের লোকজন, উমাপ্ৰসাদ মুখোপাধ্যায়ের শেরপাদের দেশে বইতে এঁদের কথা আছে, আছে সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা-কাহিনি হত্যাপুরীতেও। বুকানন-হ্যামিল্টনের লেখা পড়ে বোঝা যায় রামজয় ভট্টাচার্যের আনুগত্য ছিল কোম্পানির প্রতি। তিনি এবং তাঁর মতো আরো কিছু এদেশীয় মানুষ(যথা জনৈক লামা, কিরাত বংশের প্রধান আগম সিংহ, বাহাদুরগঞ্জের মুন্সেফ জনৈক ব্রাহ্মণ, কায়স্থ কলমচি নারায়ণ দাস, গোর্খা রাজার জনৈক দাস)বুকানন-হ্যামিল্টনকে নেপাল এবং তার আশপাশের পাহাড়ি রাজত্ব সম্পর্কে যে তথ্য সরবরাহ করেন, মূলত তার ভিত্তিতে বুকানন-হ্যামিল্টন কোম্পানিকে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠান। সে রিপোর্ট বই হয়ে বেরোয় ১৮১৯-এ, য়্যান য়্যাকাউন্ট অব দি কিংডম অব নেপাল, য়্যান্ড অব ডি টেরিটরিজ অ্যানেক্সড টু দিস ডমিনিয়ন বাই দি হাউজ অব গোর্খাস। অর্থাৎ নেপাল রাজত্বের বৃত্তান্ত, এবং গোর্খাবংশ দ্বারা অধিকৃত অঞ্চলেরও বৃত্তান্ত। ১৮০৯-১০-এ সংগৃহিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বুকানন-হ্যামিল্টন লাপচা-রাজত্ব, অর্থাৎ সিকিমের সংক্ষিপ্ত ভূগোল-ইতিহাস লেখেন। যেহেতু দার্জিলিং পাহাড়ের নিচের তরাই(মোরাং) আঠেরো শতকের শেষ পর্যন্ত লেপচা-রাজত্বের অংশ ছিল, এই লেখাটা সে অর্থে তরাই-মোরাংয়ের প্রথম সায়েব-লিখিত ইতিহাস। নানারকম মানুষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে যা লেখা হল তার যথার্থতা নিয়ে লেখকের নিজেরও সন্দেহ ছিল। যাঁরা বুকানন-হ্যামিল্টনকে তথ্য দিচ্ছেন তাঁদেরও আবার খবর নিতে হয়েছে নানা বিচিত্র সূত্র থেকে, ফলে কোনটা ঠিক কোনটা নয়, তা চুলচেরা বিচার করা সম্ভব ছিল না।
আরও পড়ুন
ন হন্যতে : মৈত্রেয়ী, মংপু ও রবীন্দ্রনাথ
প্রাক সায়েব ভূগোল ইতিহাস সায়েবি আমলে বদলাল। বদলাল, কিন্ত থেকেও গেল আবার। সায়েবরা চলে যাবার পর থেকে আজ পর্যন্ত, তা প্রায় পঁচাত্তর ধরে, দার্জিলিং পাহাড় আর তার নিচের তরাই-মোরাং আসলে কার, তা নিয়ে নানানরকম ঝগড়াকাজিয়া চলছে। বিবাদ চলেছে নেপালের ভিতরেও। পুরোনো জাতি, গোষ্ঠী, কৌম মিশে যাচ্ছে নতুন জাতিপরিচয়ে, মরে যাওয়া, না থাকা ইতিহাস আর কাল্পনিক ভূগোল ঘিরে তৈরি হচ্ছে নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। দার্জিলিং পাহাড়ে নেপাল থেকে আসা লোকের সংখ্যা বেশি, তাঁরা পাহাড় এবং তরাই-মোরাং সহ তিস্তার ওপারের দুয়ার এলাকার ওপরও গোর্খা অধিকার দাবি করছেন, যেহেতু একসময় ওই এলাকা গোর্খা রাজত্বের অংশ ছিল। পাহাড়ে লেপচা-ভুটিয়াদের বড় অংশই নিজেদের ভাষা ও ইতিহাস ভুলে গেছেন, বিশেষ আপত্তি করছেন না। তরাই-দুয়ারের আদি অধিবাসী যে জুমিয়ারা, তাঁরা এতই সংখ্যালঘু, আপত্তির জায়গায় নেই। ছোটনাগপুর উড়িষ্যা মধ্য ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা আদিবাসীরা সংখ্যায় অনেক, তাঁরা আপত্তি করছেন। হিমালয়ের নিচের বাংলার আদি বাসিন্দা কোচ-রাজবংশীরা বলছেন, তরাই-মোরাং দুয়ার, সবটাই প্রাচীন কামতাপুর রাজত্বের অংশ। কোচবিহার রাজত্বের সীমা তিস্তা পর্যন্ত প্রসারিত ছিল, ফলে সেটা নিয়েও আলাদা করে দাবি আছে। মেচি নদীর ওপারে যে আদি কিরাত রাজত্ব, সেখানে গোর্খা আধিপত্যের বিরুদ্ধে লিম্বুয়ান অঞ্চলের দাবি উঠছে। গোর্খারা, লিম্বুরা, কামতাপুর ও কুচবিহারপন্থীরা সবাই প্রাক-সায়েবি ইতিহাস-ভূগোল থেকে উদাহরণ তুলে আনছেন। সেই ইতিহাস কোথায়? এক কোচবিহার রাজত্বের কিছু তথ্য আর নেপালের কিরাত রাজত্বের কিছু তথ্য বাদ দিলে, ইতিহাসের উপাদানই বা কোথায়? লেপচাদের ইতিহাস লেখার কিছু চেষ্টা হয়েছে। তরাই-মোরাং এলাকায় নয়, মেচদের বিখ্যাত রাজত্ব ছিল কামরূপ বা আসাম এলাকায়, যা কচারি বা কাছাড়ি রাজত্ব নামে খ্যাত। জাতিগত আত্মপরিচয়ের যে দাবি, সেখানে পুরোনো ইতিহাস কোথায় শেষ হচ্ছে, কোথায়ই বা শুরু হচ্ছে প্রামাণ্য ইতিহাস, গুলিয়ে যায় অবিরল। সময়ভ্রমণ চলতে থাকুক, আমরা ইতিহাস-ভূগোল খুঁড়ে দেখি।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মংপু, সুরেল ও ‘পাহাড়ী’ রবীন্দ্রনাথ