সময়ভ্রমণ – ১৩
আগের পর্বে
রাংবি বা রংগুর পরে সিঙ্কোনার চাষ শুরু হয়েছিল মংপু ও রিশপে। কিং সাহেবের মতে এই রিশপের উচ্চতা ২১০০ ফুট। অ্যান্ডারসন সাহেব স্কটল্যান্ড ফেরার আগেই সিঙ্কোনার বাগানের আয়তন ৫ থেকে বেড়ে হয়েছিল ৩৭ হাজার একর। মাত্র তিন-চার বছরেই। রিয়াং নদীর উপত্যকাতেও দেখা মেলে সিঙ্কোনার। নদীর ওপারে সিটঙ। সেখানে কুইনাইনের গুদাম, কারখানা। সিটঙের থেকে লাটপাঞ্চারের সিঙ্কোনার চাষ শুরু অনেক পরে। চল্লিশের দশকে। তবে কালিম্পংয়ের মূল সিঙ্কোনার ডেরা মানসাং। কালিম্পংয়ের অন্যদিকে আরও একটা সিঙ্কোনা বাগান রংগোয়। যত্নের অভাবে, পোকা ধরে পরে আছে সেখানকার সিঙ্কোনা গাছেরা। নব্বইয়ের দশকে বেশ কয়েকবার দার্জিলিং-কালিম্পংয়ের এই সব বাগান বিক্রি করে দেওয়ার কথাও উঠেছিল।
পাহাড়ের কাঁধে, মাথায়, নদীর পাড় দিয়ে, কখনো পাহাড় কেটে বা দুই পাহাড়ের মধ্যের খাঁজে ছোট বড় রাস্তা চলে গেছে নানা দিকে। কিছু রাস্তা পুরনো। পুরনো মানে সত্যিকারের পুরনো, সায়েবরা এ অঞ্চলে ঢোকার আগেও সে সব পথে স্থানীয়দের যাতায়াত ছিল। সমতল থেকে সিকিম ঢোকার পথ, নেপাল আর দার্জিলিং এলাকা হয়ে তিস্তা অবধি যাওয়ার পথ। জোসেফ ডালটন হুকারের হিমালয়ান জর্নলে সে সব পথের বর্ণনা আছে। কুচবিহার আর বক্সাদুয়ার হয়ে ভুটান, সেখান থেকে তিব্বত গিয়েছিলেন জর্জ বোগল, হেস্টিংস সাহেবের দূত হয়ে। ওই পথে গিয়েছিলেন স্যামুয়েল টার্নার আর চার্লস ল্যাম্বের বন্ধু ম্যানিংও। কিছু পরে উদ্ভিদতত্ত্ববিৎ গ্রিফিথ। কোম্পানি শাসনের গোড়ার দিকের কথা, তখনো দার্জিলিং স্বাধীন সিকিম দেশের অংশ, কালিম্পং ভুটানের। দার্জিলিং-এর নিচের সমতল এলাকা, যেটা এখন দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমা, আর লাগোয়া বাংলাদেশের রংপুর, তার অনেকটাই দখলে ছিল নেপাল থেকে আসা গোর্খা সেনাদের। পাহাড় কেন, সমতলেও পথ বলতে সে অর্থে কিছু ছিল না। কলকাতা থেকে রংপুর হয়ে পাহাড়ে উঠতে ছ-সাত দিন থেকে পনেরো-কুড়ি দিন(১৮৩৮-৯ এর এক হিসেব অনুযায়ী কলকাতা থেকে দার্জিলিং অবধি ডাক পৌঁছতে ছ-দিন লাগত) লেগে যেত। পাহাড়ে ব্রিটিশদের ওঠা, বসবাস এবং রাস্তা বানানোর নানারকম কাহিনি নিয়ে ফ্রেড পিনের লেখা ও সংকলিত দার্জিলিং লেটার্স নামের একটা বই আছে। বইটা এখন ছাপা নেই। সে বই এবং দার্জিলিং-এর গোড়াপত্তনের কথা পরে কখনো বলা যাবে।
পাহাড়ের পুরোনো পথঘাট কেমন ছিল তা বলতে গিয়ে সায়েবরা রোমহর্ষক সব বর্ণনা দিয়েছেন। পথের রেখা নেই বেশির ভাগ জায়গায়, বন কেটে পথ করে নিতে হয়। কোথাও চার হাতে পায়ে পাথর শিকড় লতাপাতা ধরে পাহাড় চড়তে হয়, কোথাও পাথরে ঠেকানো নড়বড়ে বাঁশের মই, বৃষ্টির জলে ভিজে ভিজে পিছল। অসংখ্য নদীর আর ঝোরার ওপর হয় বেত দিয়ে তৈরি ঝোলা পুল নয় দড়ির সাঁকো, নাহলে আড়াআড়ি গাছের ডাল ফেলে রাখা। পথের বিপদের সঙ্গে বনের বিপদ, বিষাক্ত পোকামাকড়, সাপবিছে, বাঘভাল্লুক। ওই সব পথে সায়েবরা যখন তাঁদের তাঁবু আর সাজসরঞ্জাম সব নিয়ে সভৃত্য স-অনুচর যাত্রা করতেন সে এক হই হই ব্যাপার হত। পুরোনো পথগুলো কেবলই এক পাহাড় থেকে নেমে অন্য পাহাড়ে উঠত। দার্জিলিং আর সিকিম অঞ্চলে প্রথম প্রথম যাচ্ছেন যে সায়েবরা, বারবার বলছেন, নদীর পাড় দিয়ে সহজ পথ বার করা যায়, সেটা না করে এত কঠিন ঘোরাপথ কেন?
সুতরাং সায়েবরা রাস্তা বানানোয় মনোযোগী হলেন। ভালো পাকদণ্ডি, যা দিয়ে ছোটো ঘোড়া যেতে পারে। ইংরেজিতে বলা হত, ব্রাইডল পাথ। পাহাড় কেটে সমান করে কিম্বা পাথর ফেলে ফেলে এই জাতীয় পথ তৈরি হত। ঘোড়া যাওয়ার উপযুক্ত ব্রাইডল পাথ ছাড়া ছিল কার্ট রোড। উনিশ শতকের শেষপাদে পৌঁছে পাহাড়ে রেল ঢুকছে, মোটরগাড়ি আরো পরে। প্রায় একশো বছর ধরে সমতল থেকে পাহাড়ে যাতায়াত হত কার্ট রোড ধরে। কার্ট বলতে মূলত গরু আর মহিষ টানা গাড়ি, অবশ্য ও'ম্যালির গ্যাজেটিয়ারে বলা আছে ১৮৭৯ নাগাদ ট্রেন চলাচল শুরু হবার আগে অবধি টাংগা করে দার্জিলিং পৌঁছোতে হত। ঘোড়া যে পথে যেতে পারে গরু মহিষ পারে না, ফলে চওড়া, আস্তে আস্তে উঠছে এমন পথ বানাতে হত।
দার্জিলিং পাহাড়ে যাবার একমাত্র পথ ছিল পাঙ্খাবাড়ি রোড। পাঙ্খাবাড়ির পুরোনো না-রাস্তায় কি প্রবল পরিশ্রমে এবং অর্থব্যয়ে কার্ট রোড বানানো হল, ফ্রেড পিনের বইটা মূলত তা নিয়ে। পাঙ্খাবাড়ি রোড গিয়ে মিশতো ওল্ড মিলিটারি রোডে। সে সময় পাঙ্খাবাড়ি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত পুরো রাস্তাটাকেই বলা হত ওল্ড মিলিটারি রোড। রাস্তাটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর তদারকিতে বানানো হয়েছিল, দায়িত্বে ছিলেন লার্ড নেপিয়ার। এখন যে পথে কারসিয়াং থেকে দার্জিলিং যাওয়া হয়, সেই হিল কার্ট রোড তৈরি হবার আগে অবধি পাহাড়ের মাথায় মাথায় যাওয়া ওল্ড মিলিটারি রোডই ছিলো আদি পথ। কারসিয়াং এর ঠিক ওপরে ডাউহিল। সেখান থেকে চিমনি বাগোড়া হয়ে ওল্ড মিলিটারি বা ওল্ড কার্ট রোড চলে যাচ্ছে জোড়বাংলো হয়ে জলাপাহাড়ের চুড়োয়, জলাপাহাড় থেকে নেমে দার্জিলিং। পথটা এখনো আছে, তার অনেকটাতেই যাতায়াত করা যায়। পুরনো গাছগাছালি আর নিবিড় বানানো বনে ছাওয়া। পুরনো ঘরবাড়ি, নতুন পুরনো লোকজন নিয়ে গড়ে ওঠা জনবসতি। অনুপম নিসর্গ নিয়ে ওল্ড কার্ট রোড নির্জনে এককোণে পড়ে আছে, সে পথে লোকজনের যাতায়াত খুব কম। অন্তত কিছু দিন আগে পর্যন্ত তা-ই ছিল। তবে রিসর্টওয়ালারা খবর পেয়ে গেছে, দু দশটা হোমস্টে গজিয়েছে, আর কতদিন সে নির্জনতা থাকবে বলা মুশকিল। বিধির বিধানের অন্য নাম উন্নয়ন। কে আটকাতে পারে?
বছর পঁচিশ আগে প্রথম যখন ওল্ড কার্ট ধরে জোড়বাংলো থেকে ডাউহিল হয়ে কার্শিয়াং-এ নামি, ওই রাস্তার কথা বিশেষ কারুর জানা ছিল না। থাকার কথাও না। হিলকার্ট রোড ধরে দার্জিলিং-এর দিকে যেতে ডানদিকের পাহাড়ের মাথায় বনজঙ্গল কুয়াশায় ঢাকা ওল্ড কার্ট রোড চোখে পড়ে না। সাধারণের যাতায়াতের গাড়ি অর্থাৎ বাস, ট্যাক্সি ইত্যাদি ওপথে যায় না। বাকি থাকে ইতিহাস। তাতে কার কৌতূহল? অন্যদের কথা থাক। বাংলার অন্যতম ঘুরুয়ে, প্রসিদ্ধ ভ্রমণ পত্রিকার সম্পাদকও জানতেন না। সেসময়, বেড়ানোটেড়ানো এসব নিয়ে দিগদর্শন নামের একটা টেলিভিশন ধারাবাহিক বানানো হচ্ছিল, সেই মোচ্ছবে তিনিও ছিলেন। ওল্ড কার্ট রোড নিয়ে আলাদা একটা পর্ব বানানো হয়েছিল। সম্পাদক মশাই তাতে উৎসাহিত হয়ে তাঁর পত্রিকায় ওই রাস্তা নিয়ে একটা ভ্রমণগল্প ছাপিয়ে ফেললেন।
বহু চেষ্টা চরিত্তির করে পাঙ্খাবাড়ি থেকে কারসিয়াং হয়ে দার্জিলিং যাবার প্রথম পথ তৈরি শেষ হয় ১৮৪২ নাগাদ। ঘন বনের মধ্য দিয়ে আর খাড়া পাহাড়ের উপর সে পথ যেতো পাক্কা চল্লিশ মাইল। 'যেদিকে তাকাই, বন এত ঘন যে চোখ চলে না', লিখছেন প্রথমদিককার এক যাত্রী। 'এক আধটা জায়গায় লেপচারা পরিষ্কার করেছে, কোথাও ধস নেমেছে, কোথাও বা পাহাড়চুড়ো আগুনে পুড়ে বৃক্ষশূন্য, কিন্তু সেসব আর কটা? ফাঁকা জায়গায় গিয়ে না পৌঁছোনো অবধি বোঝাই যায় না ওই বনের মধ্যে ফাঁকা জায়গা থাকতে পারে।
আরও পড়ুন
সিঙ্কোনার আরো গল্প
সে বন কোথায়? কারসিয়াং ছাড়িয়ে ডাউহিলের চড়াই পথ। দু ধারে গিজগিজ করছে বাড়ি, এক আধটা গাছ এদিক ওদিক। বাড়ি বলতে চারচৌকো গায়ে গায়ে লাগা বাক্স, মাঝে মাঝে সেই ভিড়ের মধ্যে গুঁজে থাকা পুরোনো সায়েবী বাড়ি, বাঙালিদেরও। তাদের কোনোটার নাম ভিলা, কোনোটার কটেজ, কোনোটার ওইরকম কিছু। বাঙালি নামও আছে, আবছা হয়ে গেলেও পড়া যায়। পথ এখনো সরু, দুটো গাড়ি একসঙ্গে যেতে পারে না। ডাউহিলের চুড়োয় পৌঁছোনোর আগে ধুপিবন শুরু হয়ে যায়। তার মধ্যে মধ্যে বনবিভাগের আপিস, কোয়ার্টার, বাংলো। এছাড়া আছে স্কুল। ডাউহিল আর ভিকটোরিয়া, ডাউহিল মেয়েদের, ভিকটোরিয়া ছেলেদের। এক সময়ের বিখ্যাত সায়েবী স্কুল। দুটো স্কুলই এখন সরকারি জিম্মায়, ততো নামডাকও নেই। তবে পুরনো বাড়িগুলো থেকে গেছে। পাথরে তৈরি বিশাল ভিক্টরিয় অট্টালিকা, প্রশস্ত প্রাঙ্গণ, গাছপালা। পুরনো গির্জা, তার দেওয়াল শুকনো শ্যাওলায় বাদামি। স্কুল এলাকা ছাড়িয়ে ওপরের দিকে গেলে কিছুটা সমতল এলাকা। ডাউহিলের পুরোনো বনবাংলোর বয়স একশো বছরের বেশি। কাঠের বাড়িটার সামনের ধুপি বনের মধ্যেই কিছু পুরোনো বনের গাছ আছে। গুরাস, বড়ো ফার্ন, ওক। বর্ষায় বড় গাছের লাইকেন-ছাওয়া গুঁড়িতে লাল অর্কিডের গুচ্ছ, বহুবার চোখে পড়েছে। ডাউহিল পাহাড়ের ওই অঞ্চলে কাঠের পুরোনো বাড়িঘর, গাছপালা এবং অথৈ নির্জনতা, সব মিলিয়ে আধা-পুরোনো একটা মেজাজ এখনো আছে। বনবিভাগের কর্মীদের জন্য একটা ইস্কুল আছে বটে, তবে সেখানে লোকজন বড়ো একটা থাকে না। একটা মিউজিয়াম আছে, সেটাও বিশেষ কেউ দেখতে যায় না। কেন যে যায় না? মিউজিয়ামের দোতলা কাঠের বাড়িটায় দার্জিলিং পাহাড়ের গাছপালা, প্রাণী ও ভূপ্রকৃতির অজস্র স্মারক রাখা আছে। আস্ত স্টাফ করা বাঘ, হিমালয়ের কালো ভাল্লুক, এমন কি বুনো মহিষের শিঙ। বুনো মহিষ উত্তরবঙ্গের বনে এখন আর নেই। বাঘ আছে কিনা তা নিয়ে বিশেষ সন্দেহ আছে। মিউজিয়ামের দোতলার বারান্দা জুড়ে নানান গাছের কাঠ দিয়ে প্যানেল করা। গোটা বাড়িতে মম করছে না থাকা, নষ্ট, লুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রকৃতির পুরনো সোঁদা গন্ধ। গেলেই টের পাওয়া যায়। মিউজিয়ামে এবং ডাউহিল বাংলোর ভিতরে দার্জিলিং উপনিবেশের বহু দুর্মূল্য হলদে হয়ে যাওয়া পুরোনো ছবি। রাস্তাঘাটের, বনের, নদীর, কাঠ কাটার।
ডাউহিলে হেঁটে বেড়িয়েছি কতবার। অসংখ্য রাস্তা বনের মধ্যে ঢুকছে বেরোচ্ছে, যে-কোনো একটা ধরলেই হয়। আশপাশে দু একটা বনগ্রাম আছে বটে, বনবিভাগের আপিসও আছে, তবু লোকজনের দেখা পাওয়া যায় কচিৎ কখনো। কেউ থাকে না বলেই বোধহয় ডাউহিলের স্কন্ধকাটা ভূত নিয়ে উদ্ভট গপ্পটা বাজারচালু। বনের নির্জন পথে নাকি স্কন্ধকাটা ঘুরে বেড়ায়, বিকট আওয়াজও করে, সুযোগ পেলে ধাক্কা মেরে অবিশ্বাসীদের খাদে ফেলে দেয়। কতবার গেলাম, ডাউহিল বাংলোয় রাত কাটালাম, বনপথে হেঁটে বেড়ালাম, হায়, ভূত ধরা দিল না।
ডাউহিল থেকে উত্তরমুখো গেলে আসবে চিমনি। সম্ভবত, ওল্ড মিলিটারি রোডের সবচাইতে উঁচু জায়গা। ডাউহিল ছাড়ার ঠিক আগেই বাঁ হাতের ঢালে ওক গাছের ছোটো একটা বন। বনটা ছোটো, গাছগুলো বড়ো। ধুপিবাগানের লম্বাটে একঘেয়েমির পর ওকের এলোমেলো, মসে ঢাকা ডালপালা দেখতে বড় ভালো লাগে। বিশেষত যখন মেঘ আসে, বা মেঘ ভাঙা রোদে সদ্য ভেজা সবুজ ঝিকিয়ে ওঠে। চিমনি ছাড়িয়ে বাগোড়া যাবার পথেও পুরোনো পাহাড়ি বনের চিহ্নস্বরূপ ছোট বড় ওক গাছ টিঁকে আছে। সে সব ভাঙা বনে এখনো বড় কালো ভাল্লুক, চিতা আর ঘন বাদামি চামড়ার ডাকিয়ে হরিণের বাস। আর বন্দেল বা বনশুয়োর।
আরও পড়ুন
আরো সিঙ্কোনা-কাহিনি
চিমনি নামটা এসেছে চিমনি থেকেই। প্রথম যখন দেখি, মেঘে ঢাকা একটা মাঠের ওপর লালচে ইঁটের চিমনিটা মাথা বার করে ছিল। পরে দেখলাম, পুরো চিমনিটাই আছে। বাড়ি নেই, দেয়াল নেই, মেঝে নেই, ফায়ারপ্লেস নেই, মাঠের ওপর স্রেফ একটা চিমনি। কোনকালে একটা বাংলো বানানো হয়েছিল, ওল্ড মিলিটারি রোড দিয়ে যখন যাতায়াত চলত তখন। নিচের কার্ট রোড হলো, ওপরের পথের প্রয়োজন ফুরোল। বাংলোটাও নিশ্চয় ভাঙা পড়ল। চিমনিটা থেকে গেলো পুরোনো দেবদেউলের মতো, সায়েবদের শেষ চিহ্ন হিসেবে। চিমনি ঘিরে বাগান করা হয়েছে এখন, চারদিকে বেড়া, রীতিমতো পয়সা দিয়ে দেখতে হয়।
চিমনি বড়ো গ্রাম। প্রথমে ওপর-চিমনি, বড় বড় বাড়ি, সামনে সুন্দর ফুলবাগান। চিমনির বাড়িগুলোর কোনো কোনোটায় রডোডেনড্রন আর য়্যাজেলিয়া, দুটোই আছে। এপ্রিল নাগাদ গেলে শেষ দু একটা লাল রডোডেনড্রন আর অ্যাজেলিয়ার সাদা, লাল, গোলাপি-সাদা, অনেকগুলো রং একসঙ্গে দেখা যায়। মে-জুন মাসে চিমনি গ্রামের ক্ষেত আলো করে হাল্কা বেগুনি মুলোফুল ফোটে। এই চিমনি হচ্ছে লোয়ার বা নিচ-চিমনি, টঙিয়া গ্রাম, বাসিন্দারা গরিব। নিচ-চিমনিতে এসে পাহাড় ছড়িয়ে পড়ছে ঢেউ খেলানো মাঠে। সে মাঠের কোনোটায় ক্ষেত, কোনোটায় বাড়ি, কোনোটায় ধুপিবন। গ্রাম শেষ হলে বাঁ দিকের ঢাল গিয়ে নামছে হাজার ফুট নিচের কার্ট রোডে। সে পথ, নিচের রেললাইন, সব স্পষ্ট দেখা যায়। যদি পরিষ্কার দিন হয়, কুয়াশা না থাকে।
কুয়াশা থাকেই। যে গিরিশিরার মাথায় ওল্ড মিলিটারি রোড, তা গিয়ে শেষ হচ্ছে টাইগার হিলের চুড়োয়। চিমনির পর থেকে পুরোটাই বন, হয় বানানো নাহয় আসল। চিমনি থেকে বাগোড়া অবধি পুরোনো রাস্তায় বহুদিন পর্যন্ত হাত পড়েনি, পাশের বনেও নয়। বনের পাশের লতাগুল্মঘাস পথের ওপর চলে আসত। ওক আর ধুপির বন থেকে ঘন কুয়াশার মধ্যে আচমকাই বেরিয়ে আসত কালো মুরগির মত দেখতে লাল ঝুঁটি কালিজ, পরিবার ছানাপোনা নিয়ে। এখন নতুন ঝকঝকে পথ হয়েছে, তারা আসে কিনা জানা নেই। এলাকায় পর্যটকদের যাতায়াত বেড়েছে, আস্ত রাস্তা এবং ভাঙা চিমনির আকর্ষণে লোকজন ছুটে আসছে।
আরও পড়ুন
সিঙ্কোনা-কাহিনি
চিমনির পর বাগোড়া। বাগোড়াটাও বনগ্রাম। ওল্ড মিলিটারি রোড ওখান থেকে চলে যাচ্ছে ঘুমের দিকে। তিন মাইল রাম্বি বনগ্রাম হয়ে আর একটা পথ এসে মিশছে ওল্ড মিলিটারি রোডে। সে পথ যাচ্ছে চটকপুর টঙিয়ায়, এই মুহূর্তের অন্যতম ট্যুরিস্টকেন্দ্র, যায় না এমন লোক নেই। আর একটা সরু, অব্যবহৃত পথ নামছে সোনাদায়। রংগিরুন সেঞ্চলের আসল বন, সোনাদা-বাগোড়ার আসল বন, প্রায় নেই। পুরনো প্ল্যান্টেশন ঘন হয়ে প্রাকৃতিক বনের চেহারা নিয়েছে। শেখর, আমার যে বন্ধু এখন নেই, যে বনে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াত, একবার চটকপুর থেকে সোনাদা নামতে গিয়ে বনের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। ভিতরের দিকে এত ঘন গাছপালা, হাঁটা যায় না। দিকভ্রম হয়ে যায়। একটা খাড়াই, পাথুরে ঝর্ণা ধরে কোনক্রমে নামতে হয়েছিল। আমাদের পাহাড়ে এখনো পথ হারানো যায়? প্রথমটা খুব অবাক লাগলেও পরে মনে হল, আশ্চর্য হবার তো কিছু নেই। যে বনে কালিজ থাকে, ভালুক থাকে, মার্টেন থাকে, বিরল চিতা-বিড়াল থাকে, সে বনে মানুষ তো পথ হারাতেই পারে।
বাগোড়া থেকে দীর্ঘকায় ধুপিগাছের ছায়া-অন্ধকারের মধ্য দিয়ে উৎরাই পথ কার্ট রোদে নামছে। উল্টো ঢাল দিয়ে আর একটা পথ পোখরেবং আর কইলাগুদাম বনগ্রাম হয়ে চলে যাচ্ছে লাটপাঞ্চার, সিটঙ, সেলফু, অন্যদিকে চিপলেখোলা, শিবখোলা হয়ে রংটং। একটা পথ যাচ্ছে বহু নিচে মামরিং খোলার সাঁকো পেরিয়ে হাঁটা পথে লাবদা পেরিয়ে সুরেল, মংপু। অনেক পথ, অনেক বন, অনেক জনপদ, অনেক না থাকা, অনেক থাকা, অনেক গল্প। সব গল্প একবারে বলা যাবে না।
Powered by Froala Editor