সিঙ্কোনার আরো গল্প

সময়ভ্রমণ – ১২

আগের পর্বে

ব্রিটিশ ও অন্যান্য ঔপনিবেশিক শাসকরা পাল্টে দিয়েছিলেন পৃথিবীর খোলনলচে। শুধু ইতিহাস, ভূগোল নয়, পাল্টেছিল প্রকৃতিও। এশিয়া, আফ্রিকায় বনজঙ্গল নির্দ্বিধায় কেটে শুরু হল কফি, তুলো, চিনি, কোকার চাষ। গজিয়ে উঠল শহর, সেনাছাউনি, বাজারহাট। সাধারণ মানুষদের দেখা হতে লাগল খাজনার চোখে। ভারতে সেইভাবেই শুরু হল সিঙ্কোনার চাষ ১৮৬১ সালে। নীলগিরিতে। কলকাতা ঘুরে দার্জিলিংয়ে সিঙ্কোনা পৌঁছায় ১৮৬২ সালে। সিঞ্চল পাহাড়ে, আজকের টাইগার হিলে চাষের উপযুক্ত পরিবেশ থাকলেও প্রধান প্রতিবন্ধকতা ছিল দুর্গমতা, যোগাযোগ এবং শিলাবৃষ্টি। বন কেটে তৈরি হওয়া রাস্তা জুড়ল মংপু, রিশপকে। আরেকটি রাস্তা জুড়ল কালিমপঙের সিঙ্কোনা বাগানকে।

দার্জিলিং পাহাড়ের এদিকে ওদিকে কোথাও পুরো পাহাড় জুড়ে কোথাও বা কোণা ঘুপচিতে ছড়িয়ে আছে সিঙ্কোনাবাগান। ১৮৬৪-তে রাংবি বা রংগু উপত্যকায় শুরু হয়ে সিঙ্কোনার চাষ বিস্তৃত হয় মংপু ও রিশপে। মংপুর কথা বলেছি। রিশপ বলতে ঠিক কোন জায়গাটাকে বোঝানো হয়েছিল বোঝা মুশকিল। কিং সাহেবের সিঙ্কোনাচাষের ম্যানুয়ালে রিশপের উচ্চতা বলা আছে ২১০০ ফুট। রাম্বিবাজার থেকে তিন মাইল অবধি যাওয়ার যে মোটরপথ, সে রাস্তায় মংপু সুরেল ছাড়িয়ে আরো ওপরে উঠলে রিশপ গ্রাম পাওয়া যায়, তা অন্তত হাজার পাঁচেক ফুট উঁচু। গ্রামের আগেই সিঙ্কোনা এলাকা শেষ হয়ে গিয়ে টঙিয়া এলাকার শুরু। রিশপ গ্রামটা পাহাড়ের ঢালে, ছড়ানো, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে গেলে অনেকটা চড়াই ভাঙতে হয়। একসময় সেখানে সিঙ্কোনা গাছ ছিল কিনা, বোঝার উপায় নেই। যাঁরা এখন রিশপের বাসিন্দা তাঁদের স্মৃতিতে সিঙ্কোনা নেই। এ থেকে অবশ্য প্রমাণিত হয় না রিশপে সিঙ্কোনার চাষ হত না। গ্রাম ছাড়ালেই রাস্তার ধারে আবার সিঙ্কোনা। তাছাড়া সেকালে বন আর সিঙ্কোনাবাগানে ভেদাভেদ ছিল না। থমাস অ্যান্ডারসন যে শুধু সিঙ্কোনা চাষের দায়িত্ব নিয়ে দার্জিলিং অঞ্চলে এসেছিলেন, এমন নয়। দার্জিলিং পাহাড়ের প্রথম বনপাল বা কনজারভেটর অফ ফরেস্টসও অ্যান্ডারসন। ফলে কোন জমি সিঙ্কোনা আর কোনটা বন তা নিয়ে খুব পরিষ্কার হিসেব ছিল না। লিভারের গুরুতর অসুখ নিয়ে য়্যান্ডারসন দার্জিলিং ছেড়ে তাঁর স্বদেশ স্কটল্যান্ড অভিমুখে যাত্রা করছেন সম্ভবত ১৮৬৮ নাগাদ। তার আগেই, মাত্র তিন-চার বছরের মধ্যে সিঙ্কোনাচাষের জন্য প্রাথমিকভাবে প্রস্তাবিত ৫০০০ একর জমি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭০০০ একরে। সবটাই ফরেস্ট রিজার্ভ বা সরকারি বন হিসেবে দেখানো ছিল। ১৮৬৫তে প্রথম আলাদা বনদপ্তর তৈরি হয়। ১৮৭৮-এ প্রথম ভারতীয় বন আইন। দার্জিলিং পাহাড়ের পথহীন দুর্গম বন, সেখানে মানুষ বলতে হাতে গোনা কিছু লেপচা ভুটিয়া জুমচাষি পরিবার, তার প্রায় সবটাই ব্রিটিশ সরকারের খাস জিম্মায় চলে গেল। জুম বন্ধ করা হল, জুমচাষিদের উচ্ছেদ। দখলহীন বনে সায়েব সরকারের একচ্ছত্র আধিপত্য, কোনো বন সিঙ্কোনাচাষের জন্য দেওয়া হল, কোনো বন গেল চা বাগানে, কোনো বন আবার বন হিসেবেই থেকে গেল। পুরোনো জুমচাষীদের একাংশ এবং প্রতিবেশী নেপাল, ভূটান, সিকিম থেকে নিয়ে আসা লকজন কুলি হিসেবে বনের কাজে, চায়ের কাজে, সিঙ্কোনার কাজে লাগলেন। নতুন গ্রামের পত্তন হতে থাকল। লেপচা ভুটিয়াদের দেওয়া জায়গার নামের ওপর চেপে বসতে থাকল নতুন নাম। এসবের বিশদ কেন তিলমাত্র বিবরণও নেই, ফলে সেকালের নাম থেকে একালের জায়গা খুঁজে বার করা খুব কঠিন, আন্দাজ ভিন্ন গতি নেই। 

কিং এর বই, ও'ম্যালির গ্যাজেটিয়ার এবং বনবিভাগের বার্ষিক রিপোর্ট ইত্যাদি থেকে জানা যাচ্ছে রাংবির পরপরই মংপু এবং রিশপে সিঙ্কোনাচাষ শুরু হয়। ১৮৭০-এর একটা পুরনো হাতে আঁকা নকশা দেওয়া আছে টাউনসেন্ড মিডলটনের লেখায়। আবছা হয়ে আসা সেই নকশায় দেখা যাচ্ছে রংগু নদীর একটা উপনদীর দুধারে সাদা-কালো ছাপ দিয়ে বিভিন্ন রকম সিঙ্কোনা গাছের চাষ এলাকা দেখানো আছে। রংগু ছাড়া, রিয়াং নদীর ধারে এক চিলতে কালো ছাপ। 

মংপু বাজার থেকে ঘুরে ঘুরে সরু পথ নেমে গেছে রিয়াং নদীর উপত্যকায়। ছোট নদী, অথচ উপত্যকাটি প্রশস্ত, নয়নাভিরাম। বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে বড় বড় পাথর, বন্য উদ্ভিদ, কিছু সিঙ্কোনা। রিয়াং নদীর জল আশ্চর্যরকমের স্বচ্ছ, নীলচে-সবুজ, নিচ অবধি দেখা যায়। সে ধারার ওপরে সে আমলের ঝোলা পুল। হেঁটে পার হতে হয়। প্রথম যখন যাই, পুলের কাছে কিছু পনি বা টাট্টুঘোড়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমোচ্ছিল। ওপারে কর্দমাক্ত কাঁচা রাস্তা উঠে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, কায়ক্লেশে সে পথে গাড়ি যায়। রিয়াং নদীর ওপারের এলাকাটাকে বলা হয় সিটঙ। ও'ম্যালির গ্যাজেটিয়ার থেকে জানা যাচ্ছে লেপচা ভাষায় সিটঙ নামের অর্থ বাঘপাহাড়, একদা অনেক বাঘ থাকত বলে। আমি যবে থেকে দেখছি সিটঙ-এ বন বলতে নেই, বাঘ তো দুরস্থান। রিয়াং নদী পেরিয়ে চড়াই ভেঙে পথ উঠছে তো উঠছেই। এ অঞ্চলে লেপচাদের বর্ধিষ্ণু বসতি। প্রথম চড়াই শেষ করে পাহাড়ের কাঁধের ওপর উঠে গেলে সামনে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। ওইখানে মিশনারি-পরিচালিত একটা অতিথিনিবাসে ছিলাম একবার, তার ওপরের ঘরগুলো থেকে দেখা যেত চারদিক থেকে গোল হয়ে ঘিরে আছে উঁচু পাহাড়, অনেকটা রোমক য়্যাম্পিথিয়েটারের মতো, চোখ কোথাও আটকায় না। উজ্জ্বল পরিষ্কার রোদে আর ঘন  মেঘের দিনে এ দৃশ্য দেখতে বড় ভালো লাগে। দূরের পাহাড়ের ঘরবাড়ি গাছপালা স্পষ্ট বোঝা যায়, আকাশ টকটকে নিকোনো নীল, অথবা নীল-কালো মেঘে অন্ধকার, পাহাড় আর আকাশ তফাৎ করা যায় না। 

রিয়াং এর ওপর এখন শক্তপোক্ত পাকা ব্রিজ, ওপারের পথ পিচঢালা। ওই এলাকায় ইদানিং অনেকগুলো হোমস্টে ইত্যাদি হয়েছে, গেলেই চোখে পড়ে ট্রাক ভর্তি বালিপাথর, রাস্তার ধারে, ক্ষেতের মধ্যে জমা করে রাখা ইঁট রড। ক্ষেত বলতে ধাপচাষ, পাহাড় কেটে জমি সমান করে ধান, ভুট্টা এসব পোঁতা। জলে চাষ হয় যে ক্ষেতে তাদের বলা হয় পানিক্ষেতি। পাহাড়ের অনেক উঁচুতে, যেখানে জলের সুবিধা নেই, মূলত আলুর চাষ হয়, সেগুলো শুখাক্ষেতি। নিচের দিকের যে শুখাক্ষেতি, সেখানে ভুট্টা হয়। লেপচারা কেন, দার্জিলিং অঞ্চলে কেউই এখন আর জুম করেন না। লেপচারা ধাপচাষ শিখেছিলেন নেপালিদের কাছে। লাঙল দিয়ে চাষের চলও ছিল না, সেটাও নেপালিদের কাছ থেকে শেখা। নেপালি অর্থে নেপাল থেকে নিয়ে আসা বা আসা মানুষজন, কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী নয়।  

আরও পড়ুন
আরো সিঙ্কোনা-কাহিনি

সিঙ্কোনা বাগান, পানিক্ষেত শুখাক্ষেত আর কমলালেবুর বাগান। সিটঙ এলাকা জুড়ে অনেক কমলালেবুর বাগান। নভেম্বর-ডিসেম্বরে সব গাছগুলো হলুদ ফলে ভরে থাকে, দেখতে ভালো, খেতে আরো ভালো। রিয়াং থেকে সোজা উঠে যাচ্ছে যে পথ তা গিয়ে মিশেছে তিস্তাপাড়ের বিরিক টঙিয়া গ্রামের পাশ দিয়ে উঠে আসা নতুন একটা পথে। সে পথটাও সিটঙে যায়। সিটঙ যাবার পুরোনো পথ কালিঝোরা লাটপাঞ্চার হয়ে। লাটপাঞ্চার আসার একটু আগে সিটঙের কুইনাইন গুদাম, কারখানা। অনেকদিন অবধি বড় বড় পাথরে বোঝাই একটা গোলমেলে ওকাল বাটো(চড়াই পথ) সিটঙ থেকে সেলফু হয়ে এদিক ওদিক যেত, এখন সে পথে পিচ পড়েছে।

আরও পড়ুন
সিঙ্কোনা-কাহিনি

বিরিক থেকে শাল সেগুন বাগানের মধ্যে দিয়ে পথ  টানা উঠেছে সিটঙ-২ অবধি। সেখানে একটা ছোট মাঠের ওপর একটুখানি সরু পথ, একটু গেলেই পুরোনো একটা বাংলো। কাঠ আর অল্প সিমেন্ট দিয়ে তৈরি একতলা বাড়ি।  সাদা রং করা ছিল, উঠে গেছে। কাঠের দেয়ালে কাঁচের জানলা বসানো, তাতে ফাট ধরেছে। নিচ থেকে নামহীন গাছের লতা বা ডাল এসে পড়েছে দেয়ালের গায়ে, কাঁচের ওপর। 

আরও পড়ুন
ন হন্যতে : মৈত্রেয়ী, মংপু ও রবীন্দ্রনাথ

এই পথ ধরে এগিয়ে গেলে সিটঙ লাটপাঞ্চার সেলফু বাগোড়ার পথ পাওয়া যায়। বাঁদিকে নেমে গেলে সিটঙের কুইনাইন গুদাম, ডানদিকে উঠে গেলে সেলফু মানা মাহালদি, পোখরেটার, বাগোড়া। দুই পথ যেখানে মিশেছে সেখানে ইদানীং হইহই ট্যুরিস্ট ভিড়। সিঙ্কোনা ঝোপের মধ্য দিয়ে এবড়োথেবড়ো একটা পথ টিলামতো একটা জায়গায় পৌঁছোয়। সেখান থেকেও আশপাশের পাহাড়ের খোলামেলা ছবি পাওয়া যায়। জায়গাটার নাম আহালদাঁড়া। নেপালিতে দাঁড়া মানে চুড়ো, পাহাড়ের মাথা। আহালদাঁড়ার ঠিক নিচে প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া মানা চা বাগানের কিছু গাছ। দাঁড়ার একদম ধারে গেলে দেখা যায় ঢাল খাড়া নেমে যাচ্ছে নিচে। শেষ যেবার যাই, দেখলাম বড় রাস্তা থেকে সিঙ্কোনা বাগানে ঢোকার মুখটায় গেট বসেছে, সেখানে স্থানীয় কিছু যুবক আহালদাঁড়া দর্শনের খাজনা নিচ্ছে। দাঁড়ার মাথায়, পৌঁছোনোর পথ জুড়ে অসংখ্য ট্যুরিস্টচিহ্ন, লাল সাদা প্লাস্টিকের বোতল, বিস্কুটের, চিপসের রঙিন মোড়ক, সাদা থার্মোকলের থালাবাটি। ট্যুরিস্ট থাকার জন্য অনেক সবুজ ঘরবাড়ি আর লালনীল তাঁবু বসেছে। সেখানে থাকলে, না থাকলেও, বেড়াতে এলেও পাহাড়ের মাথায় চড়ে দৃশ্য দেখতে দেখতে এটা ওটা খেতে হয়।  নিসর্গশোভার সঙ্গে খাওয়াদাওয়ার নিগূঢ় যোগাযোগ আছে, সন্দেহ কি? খাওয়াশেষে প্লাস্টিক থার্মোকল ইত্যাদি পড়ে থাকবে পাহাড়ের মাথায়, ঢালে, যতদিন না দমকা হাওয়া বা বৃষ্টি উড়িয়ে ধুয়ে নিচের ঝোরায় নিয়ে না ফেলে। সিটঙ-২ থেকে লাটপাঞ্চার, রিয়াং থেকে সেলফু, সেলফু থেকে বাগোড়া, এলাকা জুড়ে রিসর্ট বানানোর ধুম পড়েছে। সিঙ্কোনা বাগান, চা বাগান, শুখাক্ষেতি, পানিক্ষেতি, কিছু বাদ নেই। খানিকটা জায়গা পেলেই ভর্তি করে উদ্ভটদর্শন বাড়িঘর উঠছে। 

আরও পড়ুন
মংপু, সুরেল ও ‘পাহাড়ী’ রবীন্দ্রনাথ

সিটঙের তুলনায় লাটপাঞ্চারের সিঙ্কোনাচাষ নতুন, প্রথম বাগান তৈরি হয় চল্লিশের দশকে। ততদিনে কোনটা বন কোনটা নয় এসবের বিশদ মানচিত্র,  হিসেব তৈরি হয়ে গেছে। লাটপাঞ্চারের সিঙ্কোনাবাগানের সমস্তটাই বনের মধ্যে। বন বলতে সেগুন কিম্বা ধুপির চাষ নয়, রীতিমতো, সত্যিকারের বন। লাট বাজার থেকে ছ কিলোমিটার উজিয়ে গেলে লাটপাঞ্চারের বিট আপিস। এ পথের শেষ দু কিলোমিটার সিঙ্কোনাবাগানের মধ্য দিয়ে। অনেকদিন যাইনি, বাগান আছে কি না কে জানে। বিট আপিসের পাশে পুরোনো লাটকুঠির ধ্বংসাবশেষ। ওই এলাকায় লাটসাহেবদের পা পড়ার কথা নয়। পুরোনো ফরেস্ট বাংলো কিম্বা সিঙ্কোনা সায়েবদের বাংলো ছিল হয়তো। প্রথম গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনে সেটাকে পোড়ানো হয়, এমন শুনেছি। 

আরও পড়ুন
বনের মধ্যে আরো : টঙিয়া, এফ ডি হোল্ডিং আর ইয়েসলু

লাটবাংলো থেকে পাকদণ্ডি অরণ্যপথ শিরার মতো ছড়িয়ে পড়ছে নানা দিকে। গভীর আদিম বনের মধ্যে সেই সব পথের সবকটায় যাওয়া হয়নি। হবে যে, সে সম্ভাবনাও নেই। তবে জানি, একটা পথ নেমে যাচ্ছে বহু নিচে মহানদীর উপত্যকায়, যেখানে মহানদী অর্থাৎ মহানন্দায় এসে মিশছে আরো দুই আরণ্যক নদী, চিপলেখোলা আর শিবখোলা। নরবুঙ আর সেপয়ধুরা চা বাগানের মধ্য দিয়ে গাড়ির পথ আছে চিপলে পৌঁছোনোর। মহানদী বলতে আসলে মাহালদি। রঙ ভাষায় মাহালদি শব্দের অর্থ, যে নদী বেঁকে বেঁকে যায়। বেঁকে যাওয়া মাহালদি-মহানদী-মহানন্দা আর ওই এলাকার বনপাহাড় নিয়ে আলাদা করে বলতে হবে কোনোসময়, সিঙ্কোনার গল্পে এরা ঢুকবে না। 

আরও পড়ুন
নীলপাহাড়ি অঞ্চলের টঙিয়ায়

লাটবাংলো থেকে তিস্তাপাড়ের বড় রাস্তায় নেমে তিস্তাবাজারের আগে চিত্রেতে নদী পেরিয়ে, কালিম্পং শহর পার করে, আলগাড়া লাভা পেডং যাবার পথ। সে পথ থেকে অন্য একটা পথ বেরিয়ে সিকিম-বাংলার সীমান্তে রংপো শহরে পৌঁছোয়। এই পথের মাঝামাঝি থেকে কালিম্পং-এর মূল সিঙ্কোনা এলাকা শুরু হচ্ছে। দার্জিলিং পাহাড়ের সুন্দরতম পথগুলোর একটা  আলগাড়া-রংপো পথ। পথের অনেকটাই যাচ্ছে খোলামেলা এক গিরিশিরার কাঁধের ওপর দিয়ে। আলগাড়া থেকে গেলে ডানদিকের পাহাড়ি ঢালে সিঙ্কোনাবাগান, বাদিকের ঢালেও। ঢাল কখনো ধাপে ধাপে কখনো সোজা নেমে যাচ্ছে রঙ-ন্যিয়ো অৰ্থাৎ তিস্তায়। ঘনসবুজ ঘাসজমির মধ্যে সিঙ্কোনার লালচে-সবুজ, ওপারের পাহাড়ের স্তরে স্তরে উঠে যাওয়া ধূসর কালচে নীল, কোথাও তার শীর্ষে কাঞ্চনজঙ্ঘার চিরতুষার। বহু বহু নিচে দুই পাহাড়ের মধ্যের গিরিখাতে বিছিয়ে আছে তিস্তা। আকাশ পাহাড় গিরিখাত বেয়ে মেঘ উঠছে আর নামছে। 

আরও পড়ুন
নীলপাহাড়ির খোঁজে

আলগাড়া-রংপো রাস্তায় মানসাং। কালিমপঙের প্রধান সিঙ্কোনাডেরা। মানসাং বাজারে পৌঁছোতে হলে রাস্তা থেকে কিছুটা নামতে হয়। এদিকে কোথাও কোথাও সিঙ্কোনা গাছ এতটাই বড়ো, ঘন বনের মতো লাগে। এরকম একটা সিঙ্কোনাবনের মধ্য দিয়ে একটু গেলে টিলার ওপরে পুরোনো মানসাং বাংলো। বাংলোর সামনে বেশ কিছু পুরনো পাইন গাছ, তাদের মোটা শিকড় মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। টিলার ধারে গেলে অবারিত নিচের তিস্তা আর দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা, থেকে থেকেই মেঘ এসে মুখে লাগছে, ভিজে যাচ্ছে মানসাং বাংলোর দেয়াল চিমনি কাঁচের শার্সি। আর একটা পুরনো বাংলো আছে সাংগসারে। সিকিম যাবার বড়ো রাস্তায় রংপো আসার আগে তারখোলা বনগ্রাম। তারখোলার একটু আগে সেগুনবাগানের মধ্য দিয়ে একটা খাড়াই রাস্তা সাংগসার হয়ে আলগাড়া-রংপো রাস্তায় পড়ছে। ঠিক মানসাংয়ের মতো নয়, পাহাড়ের খাঁজের মধ্যে, তবে সাংগসার জায়গাটাও নির্জন, সুন্দর। বাড়িটাও খুব যত্নে রাখা, দেখেই বোঝা যায়। মানসাং, সিটঙ, সাংগসার, পুড়ে যাওয়া মংপু, সুরেল বাংলো, লাটকুঠি। যে সব সায়েবরা থাকতে আসতেন বিজন জঙ্গলের গভীরে, কি ভাবতেন তাঁরা কাজ শেষ হয়ে গেলে? কী করতেন? সারাদিন ধরে সাম্রাজ্যসেবা করা যায় না, কুলি তাড়িয়েও দিন কাটে না। নেটিভ কর্মচারীদের সঙ্গে সামাজিক মেলামেশা বারণ। গাড়ির পথ নেই যে গাড়ি করে দূরের ক্লাবে গিয়ে অন্য সায়েবদের মুখ দেখবেন। অন্ধকার পাহাড়বনের কোণায় একরত্তি বাংলোয় বসে থাকতে থাকতে পাগল পাগল লাগত না? ডায়েরি বা জার্নাল লিখে যাননি সিঙ্কোনা সায়েবরা?

মানসাং পৌঁছোনোর একটু আগে, সিঙ্কোনা ঝোপ আর এলোমেলো অন্য গাছের মধ্য দিয়ে অন্য একটা পথ গেছে ইছে টঙিয়া গ্রামে। এই গ্রামে বহুবার গেছি। গাড়ি গ্রাম পর্যন্ত যেত না, হাঁটতে হত। পাহাড়ের মাথার দিকে সরু একফালি জায়গায় গোটা তিরিশ বাড়ি গায়ে গায়ে লেগে আছে। গ্রামের বাসিন্দারা অধিকাংশই গরিব, না আছে জমিজমা, না আছে স্থায়ী কাজ। অথচ গ্রামটা বড় সুন্দর জায়গায়। সামনেটা খোলা, সেখান দিয়ে নিচের তিস্তা, দূরের পাহাড়, এমনকি পরিষ্কার দিনে কাঞ্চনজঙ্ঘা। এই গ্রামটায় সবাই মিলে একটা চেষ্টা চালানো হয়েছিল গ্রামের পাশের কোনো জমিতে বাইরের অতিথিদের থাকবার জন্য ব্যবস্থা করার। হল না। জমিতে গ্রামের মানুষের দখল নেই, বনবিভাগের আমলারা ভয় দেখালেন, লোকে ভয় পেয়ে গেল। মণি বলে একটি ছেলের বাড়িতে যাতায়াত ছিল। হঠাৎ শুনি, সবাই মিলে নয়, সে নিজের বাড়িতেই হোমস্টে খুলে ফেলেছে। লোকে আসছে। মণির দেখাদেখি বাকি সবাই। বাইরের লোক ঘর বানানোর জন্য টাকা দিতে শুরু করল। গ্রামের ভিতর জলের ব্যবস্থা নেই, হেঁটে বেড়াবার জায়গা নেই, অথচ ঘরে ঘরে হোমস্টে। নানান লোকে বেড়াতে আসে, ইছেগাঁও, ইচ্ছেগাঁও এইসব নাম শুনি। হিট ডেস্টিনেশন। অনেক সেল্ফি। অনেক প্লাস্টিক। অনেক মজা।

কালিম্পং পাহাড়ের অন্য প্রান্তে আর একটা সিঙ্কোনাবাগান আছে। রংগো বলে সে জায়গাটায় পৌঁছোতে হয় জলঢাকা নদীর ধার দিয়ে, ডুয়ার্সের চালসা থেকে ঝালঙ বাজার যাবার রাস্তায়। গৈরিবাস নামের ছোট্টো জনপদ থেকে চড়াই পথ রংগো সিঙ্কোনাবাগান পর্যন্ত যায়। এই এলাকাটায় ট্যুরিস্ট পার্টিরা সেভাবে এখনো ঢোকেনি। বাকিটা একরকম। অযত্নে মরে যাওয়া, নুয়ে পড়া, বুড়ো হয়ে যাওয়া, পোকা লাগা সিঙ্কোনার গাছ। পুরোনো ঘরবাড়ি। প্রচুর কর্মহীন লোকজন। গোর্খাল্যান্ড দাদাদের সদর্প চিৎকার। 

নব্বুইয়ের দশক থেকে বেশ বার কয়েক চেষ্টা হয়েছিল দার্জিলিং কালিম্পং-এর সিঙ্কোনাবাগানগুলোকে বেচে দেবার। সেখানে হোটেল হবে, আবাসন হবে, নতুন চাষ হবে, অন্য কিছু হবে। বড় কোম্পানিগু্রলো মধ্যে হিন্দুস্থান লিভার চা বাগান করার জন্য জমি নিতে চাইছিল। সিঙ্কোনার শ্রমিক কর্মচারীরা চা বাগানের পাশে থাকেন, সেখানকার বাসিন্দাদের অবস্থা, বাগানগুলোর অবস্থা, এসবের খবর তাঁরা রাখেন। তাঁরা রাজি হলেন না, বাগানের জমি বিক্রি হল না। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সিঙ্কোনা দপ্তর বিভিন্ন বাগানে এখন কমলালেবু আর অন্যান্য ফলের গাছ লাগাচ্ছে, কোথাও রাবার আর রেশম চাষ হচ্ছে। সিঙ্কোনা তৈরি হয় না বললেই চলে। খুব সম্প্রতি, কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় কুইনাইন কাজে লাগতে পারে ভেবে মংপুর কারখানা পুরোনো আপিস সব ঝাড়পোছ করা হয়েছে এমন খবর পাওয়া গেল। 

সিঙ্কোনার দীর্ঘ গল্প শেষ হয়েও শেষ হতে চায় না। প্রায় লক্ষ একর জমির ওপর, অন্তত লাখ তিনেক লোকের বসতি নিয়ে, অনেক দিনের জমা ইতিহাসের ভার নিয়ে, থাকা এবং না থাকার মধ্যের অনির্দিষ্ট শূন্যে দার্জিলিং পাহাড়ের সিঙ্কোনাবাগানগুলো ঝুলছে। কুইনাইনের বাজার যে নেই তা নয়। কিন্তু দীর্ঘদিনের অবহেলা ও অযত্নের ফলে গাছ খারাপ হয়ে গেছে, মাটিও। ভারতের কুইনাইনের চেয়ে সস্তায় ভালো জাতের সিঙ্কোনা ডেরিভেটিভ(সিঙ্কোনা থেকে যা তৈরি হয়)আসছে কঙ্গো ও অন্যান্য জায়গা থেকে, যাচ্ছে ওষুধ কোম্পানিতে, কসমেটিক কোম্পানিতে। দার্জিলিং এর সিঙ্কোনা সে বাজারে এঁটে উঠতে পারবে সে ভরসা নেই। চেষ্টাও হয়নি সম্ভবত। 

একদম শেষ করার আগে একটা গল্প বলা দরকার। মংপুর সরকারি সিঙ্কোনাবাগানের জিম্মা এখন যাঁর কাছে, স্যামুয়েল রাই, তিনি স্থানীয় মানুষ। দায়িত্ব নেবার পর থেকে তিনি খুঁজতে থাকলেন কার হাত ধরে এদিকের পাহাড়ে সিঙ্কোনাচাষ শুরু হয়েছিল? খুঁজছেন, খুঁজছেন, কিন্তু সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না, দপ্তরে পুরোনো নথিপত্র কিচ্ছু নেই। একে জিজ্ঞেস করেন, ওঁকে জিজ্ঞেস করেন, কেউ কিছু হদিশ দিতে পারে না। শেষে নেটে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করে থমাস অ্যান্ডারসনের নাম পেলেন। সিঙ্কোনার শুরু যাঁর হাতে, তাঁকে সবাই ভুলে যাবে, এটা হতে দেওয়া যায় না। ডঃ অ্যান্ডারসনের স্মৃতিরক্ষায় কিছু করা যাক, স্যামুয়েল ভাবলেন। একটা মূর্তি বানালে কেমন হয়? মূর্তি বানানো যায়। কিন্তু ছবি কোথায়? কেমন দেখতে ছিল অ্যান্ডারসনকে? নেটে একটা ছবি পাওয়া যাচ্ছে বটে, কিন্তু সেটা কি ঠিক লোকের ছবি? 

স্কটল্যান্ড থেকে এক মহিলা স্যামুয়েলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন, তাঁর দাদু ছিলেন মংপুর বাগানের ম্যানেজার। সেই দাদুর অবৈধ সন্তানসন্ততিরা মংপু এলাকায় ছড়িয়েছিটিয়ে আছে, এই খবর পেয়ে মহিলা তাঁদের খোঁজ নেবার চেষ্টা করছিলেন। স্যামুয়েল তাঁর শরণাপন্ন হলেন। য়্যান্ডারসনের এক প্রপৌত্রের সন্ধান পাওয়া গেল খোদ ইংল্যান্ডেই। নিশ্চিত হওয়া গেল যে নেটে পাওয়া ছবিটাই আসল অ্যান্ডারসনের ছবি। স্যামুয়েলের উদ্যোগে আবক্ষ মূর্তি তৈরি করে মংপুর সদর দপ্তরের সামনে বসানো হয়েছে ২০১৮ সালের এপ্রিলে। একবার গিয়ে ডঃ অ্যান্ডারসনকে দেখে আসব, ভাবছি।

Powered by Froala Editor