সময়ভ্রমণ – ১০
আগের পর্বে
মংপু-র সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ এবং মৈত্রেয়ী দেবীর অনুষঙ্গ। জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসও। সেই ইতিহাস ধরে রেখেছে মৈত্রেয়ীদেবীর বিস্মৃতপ্রায় গ্রন্থ ‘ন হন্যতে’। ১৯৪০ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালনের সময় মৈত্রেয়ী দেবী ভেঙেছিলেন মংপুর সাহেবি প্রথা। আমন্ত্রণ করেছিলেন সিনকোনা বাগানের শ্রমিকদের। তবে সেটা ভালোভাবে নেয়নি ইংরেজরা। ১৯৪২ সালে দাঙ্গা বাঁধলে সিনকোনার বাঙালিদের শ্রমিকদের জন্য কোনো ব্যবস্থা হয়নি। তাঁদের নিয়ে কাজ চালিয়ে যান মৈত্রেয়ী দেবী। ১৯৫১ সালে তৈরি করেন শ্রমিক কল্যাণ কেন্দ্র। পরে তিনি শিকাগোয় চলে যান। মৈত্রেয়ী দেবীর বর্ণিত সেই আদিম বনের অস্তিত্ব আজ আর নেই। জীর্ণ অবস্থা সিনকোনা বাগানেরও।
সিঙ্কোনার কথা হচ্ছিল। কথায় কথা টেনে আনে, এক গল্পে বহু গল্প মিশে যায়। সিঙ্কোনার গল্প পড়তে গিয়ে দেখা গেল সেটা একটাই গল্প নয়, স্রেফ মংপু-সুরেলের ভূগোল ইতিহাসের চৌহদ্দির মধ্যে তাকে ধরাবোঝা যাবে না। বেশ কয়েকশো বছর ধরে চারটে(তিনটে তো বটেই) মহাদেশ ও সেখানকার অসংখ্য মানুষ বন উদ্ভিদ এসব নিয়ে সিঙ্কোনার গল্প তৈরি, চমকপ্রদ দুঃসাহসিক অভিযান যেমন আছে, বিজ্ঞান আর রাজনীতিও আছে। নিছক ইতিহাস কিম্বা ঐতিহাসিক গল্পগাছাও আছে। সিঙ্কোনা যেভাবে বিশাল এক সময়কাল ধরে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক ভূখণ্ডের ইতিহাস-ভূগোলের সঙ্গে জুড়ে ছিল, আগেপরে অন্য কোনো গাছ নিয়ে এমন হয়নি। চা-গাছ নিয়েও অনেক গল্প আছে, আছে পপি গাছ(যা থেকে আফিম এবং হেরোইন পাওয়া যায়) বা কোকা গাছ (যা থেকে কোকেন তৈরি হয়--শরদিন্দুর প্রথম ব্যোমকেশ কাহিনি সত্যান্বেষী মনে পড়ে?) নিয়েও। সে সব গল্পে অ্যাডভেঞ্চার, রোমাঞ্চ এবং আর্ন্তজাতিক ড্রাগ ব্যবসার(পপি এবং কোকা-র ক্ষেত্রে) রগরগে অ্যাকশ্যান ইত্যাদি মিশে আছে। চায়ের গল্প পরে কখনো সময় নিয়ে করা যাবে। হেরোইন কোকেন নেশাভাং এসব নিয়ে প্রচুর জনপ্রিয় কাহিনি ও খবর অনেকদিন ধরে জমা হচ্ছে, হালের নেট জমানায় সহজলভ্য। সে তুলনায় সিঙ্কোনা বিস্মৃতপ্রায়।
পৃথিবীর নানান জায়গায় এখনো সিঙ্কোনার চাষ হয়। কুইনাইনও তৈরি হয়। অথচ সিঙ্কোনা নিয়ে আর গল্প তৈরি হয় না। দার্জিলিং হিমালয়ের সিঙ্কোনা বাগানের ইতিহাস অর্থনীতি সমাজনীতি নিয়ে সম্প্রতি গবেষণার কাজ করেছেন এক তরুণ আমেরিকান নৃতত্ববিদ, তাঁর নতুন বইয়ের নাম হবে কুইনাইন ক্ৰনিকল্স বা কুইনাইন বৃত্তান্ত। বইয়ের কাজ শেষ হয়নি। তবে লেখার একটা অংশ অন্য একটা বইয়ে ছাপা হয়েছে। পড়ে দেখলাম মিডলটন বলছেন, এ অঞ্চলের সিঙ্কোনা বাগানের ভবিষ্যৎ বলে বিশেষ কিছু নেই, গাছপালা লোকজন পুরোনো ঘরবাড়ি এই সমস্ত নিয়েই পুরো ব্যাপারটা ক্রমাগত ক্ষয়ে যাচ্ছে। পুরোনো বই, পুরোনো গল্পের মতো। কাগজ হলদে লাল ঝুরঝুরে হয়ে যায়, পাতাগুলো আলগা হয়ে খসে পড়ে, কালি ঝাপসা হয়ে যায়। বই বা গল্পটা একসময় থাকে না। বই অবশ্য আবার ছাপা যায়, গল্প নতুন করে বলা যায়। মিডলটনের মতো, দার্জিলিং-এর সিঙ্কোনা গল্পটা আবার নতুন বাঁক নেবে। আদৌ নেবে কিনা সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে।
সিঙ্কোনার ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে দুটো পুরোনো বইয়ের সন্ধান পেলাম। দুটোই উনিশ শতকের শেষ দিকের। পুরোনো আর একটা দলিল পাওয়া গেল, সেটায় দার্জিলিং হিমালয়ে(তখন সিকিম হিমালয় বলা হত) সিঙ্কোনা চাষের একেবারে গোড়ার কথা বলা আছে। প্রথম বইটা লিখেছিলেন সে সময়কার প্রসিদ্ধ ভৌগোলিক, অভিযাত্রী, উদ্ভিদবিৎ সর ক্লিমেন্টস মারখাম। বইয়ের নাম, পেরু এবং ভারতবর্ষে ভ্রমণ, ট্রাভেলস ইন পেরু অ্যান্ড ইন্ডিয়া। ১৮৬২তে ছাপা বইটার নামপত্রে ছোট করে লেখা আছে, দক্ষিণ আমেরিকায় সিঙ্কোনা গাছ ও বীজ সংগ্রহ করাকালীন এবং সেই গাছ ও বীজ ভারতবর্ষে পরিচিত করানোর কাজ চলাকালে। পেরু আর দক্ষিণ আমেরিকা কেন?
সিঙ্কোনার আদি বাসস্থান পেরু। শুধু পেরু নয়, ভেনেজুয়েলা থেকে ইকুয়াডর, পেরু এবং বলিভিয়া হয়ে ছড়িয়ে আছে আন্দিজ পর্বতশ্রেণীর যে সব চিরহরিৎ বর্ষাবনে ঢাকা শাখাপ্রশাখা শিরা-উপশিরা, সেই বনের দুর্গম গভীরে সিঙ্কোনা জন্মায়। মারখাম যখন আন্দিজের বনে সিঙ্কোনা খুঁজছেন, ততদিনে ইউরোপের বৈজ্ঞানিকদের জানা হয়ে গেছে সিঙ্কোনা বলতে একটাই গাছ নয়। অনেক রকমের প্রজাতির আলাদা আলাদা গাছকে পারিবারিক নামে সিঙ্কোনা বলা হতো। সিঙ্কোনা নামটা দিয়েছিলেন স্বয়ং লিনিয়স, আধুনিক উদ্ভিদবিদ্যার, বিশেষত উদ্ভিদপরিচয় বা ট্যাক্সোনমি বিদ্যার জনক। ইংরেজিতে বানান করা হত, এখনো হয়, cinchona. মারখ্যাম বলছেন, ওটা ভুল, বিকৃতি। আসল নাম chinchona. লিনিয়স এই নামের মধ্য দিয়ে এক অসামান্য অভিজাত স্পেনদেশীয় নারীর প্রতি সম্মান জানাতে চাইছিলেন, বলছেন মারখাম।
আরও পড়ুন
ন হন্যতে : মৈত্রেয়ী, মংপু ও রবীন্দ্রনাথ
সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে, পরবর্তী ইতিহাসে কাউন্টেস অব সিঙ্কোনা নামে পরিচিত এই মহিলার নিবাস ছিলো পেরুর রাজধানী লিমায়। তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় স্বামী দুজনেই আলাদা আলাদা সময়ে পেরুর লাটসাহেব বা ভাইসরয় ছিলেন। দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন তলেদো রাজ্যের সিঙ্কোনা শহরের তৃতীয় বংশানুক্রমিক অর্থাৎ হেরেডিটারি কাউন্ট। সিঙ্কোনার কাউন্ট থেকে সিঙ্কোনার কাউন্টেস। কাউন্ট ও কাউন্টেসের বংশগরিমার বিস্তারিত কুলুজি হাজির করেছেন মারখাম। সে বয়ান এ-গল্পে প্ৰক্ষিপ্ত ঠেকতে বাধ্য। মারখাম নিজে সাধারণ বংশের সন্তান, অনেক পরিশ্রম করে তাঁকে ওপরে উঠতে হয়েছিল। শেষ বয়সে তাঁর নাইটহুড প্রাপ্তি হয়, নামের আগে সর শব্দটি বসানোর অধিকার মেলে। যে সময় সিঙ্কোনা অভিযান চলছে, মারখাম ব্রিটিশ সরকারের ভারত দপ্তরে কর্মরত নিতান্তই এক কনিষ্ঠ কেরানি।
আন্দিজ পর্বতশ্রেণী সুদ্ধ দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের অধিকাংশ কি করে স্পেনের কব্জায় এসেছিল তা নিয়ে বাংলাতেই একটা বড় ভালো লেখা আছে। সূর্য কাঁদলে সোনা নামের সে উপন্যাসের লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র। ঘনাদার এক তস্য তস্য পূর্বপুরুষ কীভাবে কঙ্কিস্তাদোর(জয়ী) ফ্রান্সিসকা পিজারোর অভিযানের অংশ হয়ে আন্দিজ এলাকায় পৌঁছনো, কিভাবে প্রতারিত ও বিজিত ইংকাদের পক্ষ নিয়ে তিনি লড়াই শুরু করেন, স্পেনীয় লুটেরারা ঠিক কি কায়দায় শক্তিশালী ইঙ্কা সাম্রাজ্য দখল করে, সেসব নিয়ে লেখা এই মহাকাব্যিক উপন্যাস সম্ভবত এখনো ছাপা আছে। পিজারোর সময় থেকে, অর্থাৎ ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগ থেকে উনিশ শতকের প্রথম ভাগ অবধি, অর্থাৎ সাইমন বলিভারের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পর্যন্ত পেরু এবং আন্দিজ এলাকার পুরোটাই স্পেনের দখলে ছিলো। সাইমন বলিভারের শেষ জীবন নিয়ে মার্কেজের বিখ্যাত লেখা, জেনারেল ইন হিজ ল্যাবিরিন্থ। বলিভারের স্বপ্ন ছিল, কলম্বিয়া, পেরু, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়াডর, বলিভিয়া নিয়ে, মানে আন্দিজ অঞ্চল থেকে বহু নিচের সমুদ্রতীরবর্তী এলাকার পুরোটা নিয়ে একটাই প্রজাতান্ত্রিক দেশ গড়ে উঠবে। বলিভারের জীবদ্দশাতেই, বলিভারিয় প্রজাতন্ত্র গড়ে ওঠার আগেই ভেঙে যায়। পুরোনো ইংকা সাম্রাজ্য ও নতুন স্পেনীয় উপনিবেশের এলাকায় আলাদা আলাদা রাষ্ট্র মাথা তোলে।
আরও পড়ুন
মংপু, সুরেল ও ‘পাহাড়ী’ রবীন্দ্রনাথ
উনিশ শতকের মাঝামাঝি যখন মারখাম পেরু এবং আন্দিজ অঞ্চলে পৌঁছোচ্ছেন, রাষ্ট্রগঠনের হেয়ালির তখনো মীমাংসা হয়নি। আন্দিজের পাহাড়বনের গোলকধাঁধায় কোন দেশ কোথায় শুরু হচ্ছে আর কোথায় শেষ হচ্ছে তা বোঝা দুঃসাধ্য ছিল। অথচ, সিঙ্কোনার বন ছড়িয়ে রয়েছে সব কটা দেশের মধ্যে। বনজঙ্গলে সিঙ্কোনার খোঁজ যখন শুরু হয়েছে ততদিনে আন্দিজ এলাকার নতুন দেশগুলোর কর্তারা টের পেয়ে গেছেন, সিঙ্কোনা কত মহার্ঘ্য। পেরুর কর্তারা সে সম্পদ বিনা খাজনায় বাইরে পাঠানোর ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না।
১৮২০-তে ফ্রান্সের পারি শহরে প্রথম সিঙ্কোনার ছাল থেকে রাসায়নিক পদ্ধতিতে কুইনাইন গুঁড়ো তৈরি করা হয়। সেসময় স্পেনের উপনিবেশ সাম্রাজ্যে ভাঁটা, অন্যদিকে অন্য ইউরোপীয় শক্তিরা নতুন জমি খুঁজছে, আফ্রিকা আর এশিয়া তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে সাম্রাজ্যলোভী বানিয়াহানায়।
আরও পড়ুন
বনের মধ্যে আরো : টঙিয়া, এফ ডি হোল্ডিং আর ইয়েসলু
সাম্রাজ্য গড়া সহজ নয়, সহজ নয় ইউরোপে বসে এশিয়া আফ্রিকায় শাসন চালানো। সাপ বাঘ সিংহ গণ্ডার হাতি এসব আছে, অ-ইউরোপীয় অ-শ্বেতাঙ্গ বর্বর নেটিভ জাতিরা আছে। সবচেয়ে বেশি করে আছে অসংখ্য নতুন, অজানা অসুখ। ইউরোপীয় উপনিবেশকারীরা বহু নতুন অসুখ সমুদ্রপারের সাম্রাজ্যে নিয়ে গিয়েছিল। বহু নতুন অসুখের মোকাবিলাও তাদের করতে হয়েছে। নানা জ্বরজারির মধ্যে অন্যতম ম্যালেরিয়া বা পালাজ্বর। কি করে অসুখ ছড়ায় জানা ছিল না। কুইনাইন খেলে ব্যাধির উপশম, এইটুকু জানা ছিল। সাগরপারের সাম্রাজ্যে পাকাপাকি শিকড় গেঁড়ে বসতে হলে কুইনাইন ছাড়া যে চলবে না, বুঝতে সময় লাগেনি।
ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় সিঙ্কোনা গাছের ছাল কাজে লাগে, তা বোঝা গিয়েছিলো সতেরো শতকেই। শোনা যায়, ১৬০০ সাল নাগাদ পেরুর এক জেসুইট পাদ্রীর জ্বর সিঙ্কোনার ছাল খেয়ে সেরে গিয়েছিল। ওই অঞ্চলের বাসিন্দারা বলতেন কুইন-কুইনা, মানে ছালের ছাল। স্পেনীয়দের মধ্যে ওই ছাল ব্যবহারের চল ছিল। তাঁরা বলতেন পেরুদেশীয় ছাল। ১৬৩৮ এ সিঙ্কোনার কাউন্টেসের মারাত্মক ম্যালেরিয়া যখন ছালের ছাল( বা পেরুদেশীয় ছাল) খেয়ে সেরে গেল, তাঁর নামের সঙ্গে কুইনকুইনা, তার উৎস যে গাছ, সেই গাছের সন্ধানে পরপর অভিযান, এবং পরে পৃথিবীজোড়া বিভিন্ন উপনিবেশে সেই গাছের চাষ, ম্যালেরিয়া বা রোগপ্রতিরোধে ইউরোপীয় সাহেবদের রাজনীতি, ছাল নিয়ে বাণিজ্য, এই দীর্ঘ পরস্পর-সংযুক্ত ইতিহাস অচ্ছেদ্য বন্ধনে জুড়ে গেলো। কাউন্টেসের আসল নাম ছিল আনা। এর দু বছর পর আনা যখন স্পেনে ফিরলেন সঙ্গে করে নিয়ে এলেন কুইনকুইনা, পেরুদেশীয় ছাল। ইউরোপে এর আগে এই ওষুধ কেউ চোখে তো দেখেইনি, এর কথাও কেউ জানত না। পেরুদেশীয় ছালের নতুন নাম হয়ে গেল কাউন্টেসের (নিয়ে আসা)ছাল। ছালগুঁড়ো করে যে ওষুধ, তার নাম হয়ে গেল কাউন্টেসের পাউডার। আনার চিকিৎসক হুয়ান দ্য ভেগা সে সময় সেভিল শহরে এই ওষুধ বিক্রি করেন পাউন্ড-পিছু একশো রিয়াল দরে।
আরও পড়ুন
নীলপাহাড়ি অঞ্চলের টঙিয়ায়
ইউরোপে সিঙ্কোনার ছাল এরপর থেকে ঢুকতে থাকে জেসুইটদের মারফত। আন্দিজের বনে বনে ঘুরে জেসুইট পাদ্রীরা প্রচুর ছাল সংগ্রহ করে দেশে পাঠাতে থাকেন। কালক্রমে কুইন-কুইনার আর এক নাম হয় জেসুইট ছাল। জেসুইটদের বিষয়ে ইউরোপের বহু লোকের বিতৃষ্ণা ছিল, বিশেষ করে প্রটেস্টান্টদের। ফলে সেকালের চিকিৎসকদের মধ্যে সিঙ্কোনার কার্যকারিতা নিয়ে নানান তর্ক ছিল, বহু চিকিৎসক জেসুইট ছাল ব্যবহারের ঘোর বিরোধী ছিলেন।
ইউরোপীয় চিকিৎসকেরা সিঙ্কোনার গুণাগুণ নিয়ে ঝগড়া করছেন, ওদিকে উপনিবেশ বসানোর কাজ চলছে। ইউরোপ থেকে বনজঙ্গলে ভরা অসভ্য সব দূরদেশে সাদাচামড়া সায়েবদের নিয়মিত যাতায়াত চলছে। যাঁরা যাচ্ছেন তাঁদের অনেকেই ফিরে আসছেন না। যে সব অসুখ প্রাণঘাতী হয়ে উঠত ম্যালেরিয়া তাঁদের মধ্যে ব্যাধিশিরোমণি, যাকে ধরে তার কষ্টের অন্ত থাকে না। ম্যালেরিয়া জ্বরের একমাত্র ওষুধ হিসেবে কুইনাইনের চাহিদা বাড়তেই থাকল। শুধু যে ইংরেজরা উপনিবেশ বসাচ্ছিলেন বাড়াচ্ছিলেন এমন তো নয়, ফরাসি আর ওলন্দাজেরা ছিলেন, ছিলেন পর্তুগিজ, দিনেমার আর বেলজিয়ানরা, এমনকি জার্মনরাও। কুইনাইন দরকার হয়ে পড়ল সবারই।
আরও পড়ুন
নীলপাহাড়ির খোঁজে
কুইনাইন দরকার অথচ সিঙ্কোনা ছালের পর্যাপ্ত যোগান নেই। দক্ষিণ আমেরিকায় যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই আছে, তার ওপরে বনপাহাড়ের দুর্ভেদ্য জটলা, জ্বরজারি নেটিভ, সেখানে কে-ই বা ছাল যোগাড় করে, কে-ই বা রপ্তানি করে। তার ওপর খবর আসছিল অতি-সংগ্রহের ফলে সিঙ্কোনা গাছের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। ছাল খোঁজার জন্য, এবং ক্রান্তীয় উপনিবেশে সিঙ্কোনা চাষ শুরু করার উদ্দেশ্যে চারা আর বীজ নিয়ে আসার জন্যও, ইউরোপ থেকে লোক পাঠানোর দরকার হয়ে পড়ল। উনিশ শতকের বিভিন্ন সিঙ্কোনা অভিযান শুরু হবার আগেই অবশ্য ফ্রান্সের বৈজ্ঞানিক, ভৌগোলিক এবং উদ্ভিদবিৎদের নিয়ে তৈরি একটা দল পেরুর সিঙ্কোনাবনে পৌঁছে যায়, চারাগাছ, বীজ সংগ্রহ করে। পারির জার্দা দে প্লান্ত, অর্থাৎ বটানিক্যাল গার্ডেনে সে সব চারা আর বীজ লাগানোর কথা ছিল। অভিযাত্রী দলের নেতা কন্দামিঁ যে গাছগুলো নিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই গাছ রাখার বাক্সটা আমাজন নদীর মোহানায় ঢেউয়ের ঝাপটায় ভেসে যায়। দলের আর এক সদস্য, উদ্ভিদবিৎ জোসেফ দ্য জুসু পেরুতে থেকে যান, আন্দিজ পাহাড়ের বনে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। কোকা গাছের খোঁজ ইউরোপকে প্রথম জুসুই দেন। জুসুর পনেরো বছরের পরিশ্রমের ফসল যে উদ্ভিদসংগ্রহ, তার পুরোটাই নাকি বুয়েনস আয়ার্সে তাঁর এক ভৃত্য চুরি করে। সে ভেবেছিলো জুসুর গাছভর্তি বাক্সগুলোতে অনেক টাকা আছে। দেশ ছাড়ার চৌত্রিশ বছর পর ১৭৭১ সালে জুসু যখন দেশে ফিরছেন, শোকেদুঃখে তাঁর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। জাঁর্দা দে প্লান্তে অবশ্য এর অনেক আগেই সিঙ্কোনা পৌঁছে গেছে। লিনিয়স সিঙ্কোনা গোত্রের শ্রেণীবিন্যাস সেরে ফেলেছেন। সেটা ১৭৪২ সাল। পরে, জুসুর নামেও সিঙ্কোনার একটি উপ-প্রজাতির নামকরণ হয়। ভারতের পাহাড়ে যে ঝোপমতো গাছের চাষ এখনো দেখা যায়, সেগুলো সেই প্রজাতির, সিঙ্কোনা জোসেফিয়ানা।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগ ধরেই সিঙ্কোনার নতুন প্রজাতির খোঁজ আসতে থাকে। মারখামের সঙ্গী অভিযাত্রী ছিলেন উদ্ভিদবিৎ রবার্ট ক্রস। মারখাম দক্ষিণ আমেরিকা পৌঁছনোর আগে থেকেই ইকুয়াডরের বনে গাছ খুঁজছিলেন রিচার্ড স্প্রুস। ক্রস, স্প্রুস এবং মারখামের সঙ্গী প্রিচেট, ওয়্যার, এঁরা সবাই ছিলেন লন্ডনের কিউ গার্ডেনের সঙ্গে যুক্ত। পারির যেমন জাঁর্দা দে প্লান্ত, লন্ডনে কিউ। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নতুন গাছ এসে এই সব বাগানে জমা হচ্ছিল। নতুন অজানা গাছ প্রথম লাগানো হবে সরকারি বাগানে। উপযোগিতা ও প্রয়োজন বুঝে সেগুলো এরপর পাঠিয়ে দেওয়া হবে দূর উপনিবেশে, সেখানে স্থানীয় গাছপালা কেটে, বন নষ্ট করে, নতুন বাগান তৈরি হবে। যাঁরা প্রচুর কষ্ট করে দূর দুর্গম জঙ্গল থেকে নতুন গাছ জোগাড় করছিলেন, তাঁদের সেসময়ে বলা হত গাছ শিকারি বা প্ল্যান্ট হান্টার। সফল প্ল্যান্ট হান্টারদের অনেকেই অগাধ ধনসম্পত্তির মালিক হন, সরকারি বা রাজস্বীকৃতিও মেলে। মারখাম সে অর্থে পেশাদার গাছশিকারি ছিলেন না। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার যখন পেরু আর বলিভিয়ায় সিঙ্কোনার খোঁজে অভিযাত্রী দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন, সেই দলের নেতা হিসেবে নিজের নাম প্রস্তাব করে মারখাম লম্বা চিঠি দিয়েছিলেন। দক্ষিণ আমেরিকার সঙ্গে মারখামের পূর্ব পরিচয় ছিল, তিনি স্পেনীয় ভাষা জানতেন, এমনকি অভিজাত ইংকাদের ভাষা কুয়েচুয়াও তাঁর জানা ছিলো।
মারখাম, স্প্রুস, ক্রস এঁরা যখন ব্রিটিশ সরকারের হয়ে আন্দিজ পাহাড়ে গাছশিকারে ব্যস্ত, জাভা (এখন ইন্দোনেশিয়ার বালি অঞ্চল) থেকে ওলন্দাজরাও আন্দিজ এলাকায় লোক পাঠাচ্ছে। হাসকার্ল বলে এক ওলন্দাজ, যিনি না বুঝতেন উদ্ভিদবিদ্যা না জানতেন স্থানীয় রীতিনীতি ভাষা, কি করে কি করে বাক্সভর্তি চারা বীজ জোগাড় করে করে জাভা ফিরে গেলেন। সেখানে সেইসব চারা বীজ থেকে আরো লক্ষ লক্ষ চারা তৈরি করে লাগানো হল। প্রথম সিঙ্কোনা বাগান তৈরি হল জাভাতেই, ব্রিটিশ ভারতে নয়। অবশ্য সে বাগান পরে পরিত্যক্ত হয়। হাসকার্ল গাছ চিনতেন না, যে গাছ নিয়ে এসেছিলেন তা থেকে কুইনাইন তৈরি হয় না। এর পরে, জাঁর্দা দে প্লান্ত থেকে চারা এনে ওলন্দাজরা আবার নতুন বাগান বানায়।
এদিকে মারখাম যে হাজার পনেরো চারা সংগ্রহ করলেন, স্থানীয় শাসনকর্তাদের নজর এড়িয়ে সেগুলোকে বন্দরে পাঠানো হল। গাছ গেলো একপথে, মারখাম ঘোরাপথে বন্দরে পৌঁছলেন। সেখানে আরো দেরি। গাছ নিয়ে যাবার জন্য লিমা থেকে মারখামকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে আসতে হল। শেষমেশ, পানামা ঘুরে দীর্ঘ সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে গাছ লন্ডন পৌঁছল। সেখান থেকে ভারত অবধি আর এক সমুদ্রযাত্রার শেষে দেখা গেল, সে গাছের অধিকাংশ হয় মুমূর্ষু না হয় মৃত। ক্রসের পাঠানো গাছগুলো বেঁচে গেল, সরাসরি পেরু থেকে মাদ্রাজে পাঠানো হয়েছিল বলে।
ক্রসের আনা সিঙ্কোনা থেকে ভালো কুইনাইন তৈরি হত না। সে গাছের ছাল ছিল লাল। হলুদ ছালের ভালো সিঙ্কোনা ভারতে এসে পৌঁছোয় আরো পরে। হলুদ ছাল ছাড়া ছিলো ধূসর ছাল আর ফ্যাকাসে ছাল। সবগুলো আলাদা গাছ। উনিশ শতকের মাঝামাঝি কুইনাইনওলা গাছের যে তালিকা তৈরি হচ্ছে, তাতে চব্বিশ প্রজাতির সিঙ্কোনার নাম ছিল। সবগুলোর চাষ করা যায়নি বা চাষ লাভজনক ছিল না।
চোখ বন্ধ করে সময়টার কথা ভাবছি। চোখের সামনে পৃথিবী খেলনা গ্লোবের মতো আস্তে আস্তে ঘুরছে। ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া। পুরোনো ভারত থেকে নতুন ভারত। আন্দিজ পাহাড়ের চিরবাষ্পাচ্ছন্ন বর্ষাবনের গভীরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন গাছশিকারির দল। মেঘ নামছে উঠছে হুহু করে। সারাক্ষণ বৃষ্টি, পায়ের তলায় নরম মাটি চকখড়িতে ভর্তি, পা পড়লে বসে যায়। ছোট নদীখাতগুলো সোনার রেণু মেশানো বালিতে ভরা। বন এত ঘন, দৃষ্টি চলে না। সেখানে তিরিশ চল্লিশ পঞ্চাশ ফুট সিঙ্কোনা গাছের ঝকঝকে লাল পাতা জ্বলছে। সৌন্দর্যে চোখ ধাঁধায়।
ছবি বদলাচ্ছে। জঙ্গলের পাকদন্ডি বেয়ে নেমে আসছে খচ্চরের সারি। তাদের পিঠে চারাভর্তি বাক্স। ছবি বদলাচ্ছে। সমুদ্রতটে জাহাজ, সেখানে একে একে বাক্স উঠছে। ঝড়, ঢেউয়ের দাপট, জলদস্যু, এসবের ধাক্কা সামলে আন্দিজের সিঙ্কোনা পৌঁছে যাচ্ছে লন্ডনে, পারিতে, বাতাভিয়ায়, মাদ্রাজে, কলকাতায়। সেখান থেকে অন্য বনে। নতুন বাগান তৈরি হচ্ছে। বাগানে কাজ করার জন্য কুলি নিয়ে আসা হচ্ছে জাহাজে করে, ট্রেনে, হাঁটিয়ে। বাগান ঘিরে নতুন বসত তৈরি হচ্ছে। ছবি বদলাচ্ছে। পৃথিবী বদলাচ্ছে।
Powered by Froala Editor