শরৎ।
ভূ-আবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মে এই সময়ে উত্তর গোলার্ধে দিন ছোটো হয়ে আসে। জলবিষুব কেটে যাওয়ার পর মহালয়া। ভোর চারটেয় মিশমিশে অন্ধকার। কিন্তু কী আশ্চর্য! বাবু বাঙালি দিব্যি এদিন রাতভোরে উঠে পড়েন। তারপর বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মাদকতা-ভরা পাঠ শুনে মোহিত হয়ে যান। কেউ কেউ আবার খানিক গড়িয়ে নেন, কেউ বা ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানাতে বসেন।
কিছু বছর আগে কয়েকজন লাফালাফি করে ফেসবুক লাইভে দাবী জানাচ্ছিল – “মহালয়ার দিনটিকে আন্তর্জাতিক বেতার দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হোক।”
এসব চিন্তাভাবনা আপাতত মুলতুবি রাখতে হল। কারণ, আমার পাশে এক ও অদ্বিতীয় হরিশঙ্কর দাস, এবং তিনি তখন ফোনে কথা বলে চলেছেন উচ্চস্বরে। তার কথা শুনতে শুনতে বিবেকানন্দ ক্লাবের চত্বরে ঢোকার মুখেই যে কালো ব্ল্যাকবোর্ডটা, সেটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সেখানে চক দিয়ে লেখা – “মাস্ক ছাড়া ক্লাব প্রাঙ্গণে ঢোকা নিষেধ।”
ফোনালাপের মেজাজ শুনে বুঝতে পারছিলাম, ওপ্রান্তে তার স্ত্রী। সেই মুহূর্তে সে তার স্ত্রীকে বলছিল – “আজকে বড়ো ফাঁড়া কাটল, জানো। ভোর-ভোর উঠে পড়েছি, বাবুঘাটের প্যাসেঞ্জার ছিল। উঠে দেখি, চোখে পুরো অন্ধকার, মাথাটাও ঘুরছে বনবন করে। মনে হচ্ছে, আর বাঁচব না। তারপর অনেকবার বমি হতে শরীর ঠিক হল।”
আরও পড়ুন
‘শীতলা মন্দিরের রাস্তা ধরে ছুটছি, গুলিটা কপালে লেগে ছিটকে গেল’
ভোরের আলো ফোটার আগেই মামাকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল বাবুঘাটের উদ্দেশে। প্যাসেঞ্জারদের পিতৃতর্পণ। ঘুম থেকে উঠে মামা বাইরে এসে পায়চারি করছিল। শরীর তখন আইঢাই করছে। সামনের রাস্তায় তখন ক্রেতাকে ফোন করছে একজন জোম্যাটোর ডেলিভারি কর্মী। ভোররাতে এমন কাউকে দেখতে পাবে, এটা মামার আশাতীত ছিল। বউকে বলছিল সেকথা। আমি শুনে মজা করে বললাম – “কারও হয়তো বিরিয়ানি খেতে খেতে মহিষাসুরমর্দ্দিনী শোনার সাধ হয়েছিল।”
আরও পড়ুন
‘পুকুরে ভেসে উঠল মরা শাল মাছ, কপালে তার সিঁদুর’
ভোরে বদহজমের ধাক্কায় প্রাণবায়ু বেরোনোর উপক্রম হয়েছিল। আর বাবুঘাটে পৌঁছনোর পর তার প্রাতঃরাশের পদ ছিল গরম-গরম ভাজা কচুরি আর জিলিপি। তার গাড়ির যাত্রীরা অফার করেছিল। এমন ‘লক্ষ্মীর দান’ কি আর পায়ে ঠেলা যায়? সেখবরও গৃহমন্ত্রীর কানে পৌঁছে দিল সে। তারপরেই কান থেকে ফোনটা সরিয়ে মুখ কাছে নিয়ে এসে নিচু স্বরে আমাকে বলল – “এইবার হেবি রেগে যাবে!” তার মুখে তখন ঝিলিক দিচ্ছে আধফোকলা দাঁতের দুষ্টু হাসি।
আরও পড়ুন
‘গ্র্যান্ড হোটেলের সামনে ‘City of Joy’-এর লোক এসে বলল, অভিনয় করবে?’
ওপাশ থেকে নিশ্চয় প্রত্যাশা মতোই রাগের বহিঃপ্রকাশ। কারণ, তারপরেই মামাকে বলতে শুনলাম – “ওরা ছ’খানা করে খেল। আমি তো তাও চারখানা খেয়েছি। তার বেশি খাইনি।”
এরপর আরও কিছুক্ষণ খবর দেওয়া-নেওয়ার পালা চলল। তার ফাঁকেই মামাকে একবার বলতে শুনলাম – “মরেই যেতাম, তোমার সিঁদুরের জোরে বেঁচে আছি এখনও।”
শুনে মনে মনে হাসি। সিঁদুরের জোরই বটে!
ফোনালাপ-পর্ব শেষ হলে আমি প্রশ্ন করলাম – “গ্যাস হয়ে গিয়েছিল নাকি?”
মামা ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে বলল – “হ্যাঁ গো। বাপরে! আমার কোনোদিন বমি হয় না। কত বছর আগে শেষ বমি করেছি, আমার মনে নাই। আজকে একেবারে সে কী বমি কী বমি! বমির সঙ্গে শুধু জল বেরিয়ে আসছে।”
-কী খেয়েছিলে? গ্যাস হল কেন?
-আরে আমার ডিম খাওয়া একদম বারণ। আর কালকে ডবল ডিমের অমলেট খেয়ে নিয়েছি দুপুরে। রোজ মাছ খাই, কাল মাছ খেতে ভালো লাগছিল না। তা ভাবলাম, ডিম খাই। ব্যাস। আর এ জীবনে ডিম খাচ্ছি না।
খাওয়ার ব্যাপারে ছোটো থেকেই তার উৎসাহটা কিঞ্চিৎ বেশি। সেসব গল্প মাঝেমধ্যেই শুনেছি তার মুখে।
ছোটো থেকেই সে গাছ-বাঁদর। এই বিশেষ উক্তিটি তার নিজস্ব উদ্ভাবন। শুনতে দিব্যি লাগে। তার যখন কৈশোর, ঊষার মাঠের চারপাশে সার সার আমগাছ। বাড়ির ছোটো ছেলে সে, কিন্তু পড়াশোনায় মন নেই। তাই বাবার হাতে মার জোটা ছিল প্রায় নিত্যকার অভ্যাস। বিকেলে পাঁচটায় মাস্টারমশাই আসতেন পড়াতে। তখন তার খেলতে যাওয়ার টাইম। এমন নিষ্ঠুর ফরমান সে মানতে চাইত না। তার ফলে বাবার হাতে মারের সম্ভাবনাও বেড়ে যেত ক্রমশ।
মারের হাত থেকে সাময়িক নিষ্কৃতি পেতে আমগাছে উঠে আম খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত সে। অনেকগুলো ডাল একসঙ্গে বেরিয়েছে, এমন একটি জায়গা দেখে শুয়ে পড়ত। তখন এত পুলিশের ঝামেলা ছিল না এ তল্লাটে। কোনো-কোনোদিন সারারাত আমগাছেও কাটিয়েছে।
ডাব গাছে ওঠাও কোনও বাধা ছিল না তার কাছে। অত উঁচু গাছে উঠতে তার লাগত মোটে পাঁচ মিনিট, নামতেও ওই একই সময়। তিন-চারটে ডাব একাই ছাড়িয়ে খেয়ে নিত।
এমন ছেলেমানুষের মতো সে তার বীরত্বের গল্প বলে যায়, রাগও বুঝি তেমন হয় না। আমি মাঝেমধ্যেই বলি – “একখানা পিস ছিলে সে তো বুঝতেই পারি।”
আমার কথা শুনে সবসময়েই হাসে মামা।
আজ সে বলছিল – “তখন অভাব ছিল তো। তরকারি নেই, জল দিয়েই খেয়ে নিচ্ছি কুড়ি-বাইশখানা রুটি। তারপর আস্তে আস্তে অবস্থা ফিরেছিল। বাবার চাকরিতে মাইনে বাড়ল। আমাদের গোয়ালে গরু হল, কটা মুরগিও পোষা হয়েছিল। গরুর দুধ দোয়ানো থাকত বালতিতে, তা থেকে একটা বড়ো বাটিতে দুধ ঢেলে নিতাম। মুরগিতে ডিম দিত, দুটো ডিম নিয়ে ফাটিয়ে দুধে ফেলে গুলে নিয়ে পুরোটা খেতাম তারিয়ে তারিয়ে।”
উঠে এল শীতকালের কথাও। মাঠ-বাগান-ঘেরা বিধানপল্লীতে শীত পড়ত জাঁকিয়ে। খেজুর গাছে হাঁড়ি বেঁধে রাখত শিউলিরা। গাছ-বাঁদর হরিশঙ্কর দাসের নজরও ডাব গাছ থেকে ঘুরে গেছ খেজুর গাছের দিকে। ওখানে মন বেঁধেছিল সে। কীভাবে? সে বলল – “বললে বিশ্বাস করবে না, খেজুর গাছে উঠে এক হাঁড়ি রস একাই খেয়ে নিতাম।”
খেজুরের টাটকা রসে এক অদ্ভুত ঝাঁঝ থাকে। সে ঝাঁঝেও নেশা ধরে দিব্যি। ওই বীরেন ভদ্রের পাঠের মতোই সে নেশা। যে একবার খেয়েছে, তার পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়। কিন্তু তা বলে একাই এক হাঁড়ি রস! আমি সত্যিই অবাক হয়েছিলাম সেদিন।
মামা অবশ্য নির্বিকার। সে ফলাও করে তার গুণপনার কথা বলে যাচ্ছে – “তাও সে আমাদের খেজুর গাছ নয়। ঊষার মাঠের ওখানে তখন প্রচুর খেজুর গাছও ছিল। যারা হাঁড়ি বেঁধে রাখত, তারা আমাকে বলত, হরে, তুই রসটা খেয়ে নে, ঠিক আছে। কিন্তু হাঁড়িটা ফাটাসনি। আমি ওইজন্যে হাঁড়িটায় কিছু করতাম না। রস খেয়ে নেমে আসতাম। আমাকে সব খুব ভয় পেত। ইয়া চেহারা ছিল। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে এই ক্লাবে ব্যায়াম করতাম। তখন এখানে বাঁশের বেড়া দেওয়া থাকত।”
সুঠাম শরীর নিয়ে তার এই চিরকালীন গর্বের কথা শোনাও আমার একপ্রকার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। তবে এই গর্বই যে আজ ভোরের অবস্থার জন্য দায়ী, সেকথাও পরিষ্কার হয়ে গেল খানিক পরেই।
আমার সঙ্গে আজ যখন সে কথা বলছে, সেই সময়ে ক্লাবের পাশ দিয়ে একজন হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিল। ডবল ডিমের অমলেটের প্রসঙ্গ শুনে সে আমি কিছু বলার আগেই বলে উঠল – “ডিম খাওয়া বারণ, আর তুমি দু’খানা ডিমের অমলেট খেয়েছ!”
বক্তার ভালো নাম ফটিক। আদরের ডাক হনুমান। সেই হনুমানের দিকে তাকিয়ে মামা বলল – “তখন কি আর জানি এমন হবে? ভাবলাম, আমার শক্ত শরীর। ঠিক হজম করে ফেলব। এখন দেখছি, খাওয়াটা সত্যিই কমাতে হবে।”
মামার কথায় সম্মতি জানিয়ে সে বলল – “আমারও চিংড়ি খাওয়া বারণ। সেদিন ওই বাপিদা খাওয়াল। বিশ্বকর্মা পুজোয়। গলদা চিংড়ি খেয়ে ফেলেছিলাম চারটে। তখন কিছু হয়নি। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, চোখ চাইতে পারছি না। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলাম, চোখ-মুখ সব ফুলে গেছে। অ্যালার্জিতে। তোমার বয়স হচ্ছে হরেকাকা, এখন আর এত খেয়ো না। মটনটাও খেয়ো না। হাই প্রোটিন তো। ছোটো মাছ খাও।”
মাটন না খাওয়ার উপদেশটি ভুলতেই বুঝি মামা ফিরে গেল অতীতে। মহিষাসুরমর্দ্দিনী-প্রিয় বাঙালির মতো সে তার খাওয়ার নস্টালজিয়ায় বিভোর হয়ে যায়। ওপাড়ার পরিমল সিংহের বাড়িতে অনুষ্ঠানে এলাহি আয়োজন হত তখন। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থাকতেন মিষ্টির বালতি হাতে। হরে, স্বপন, খোকন, গোপালদের প্রতিযোগিতা চলত।
কাকা বলছেন যখন, ভাইপোই বা বাদ থাকেন কেন! তিনিও বলে চলেন, একসময়ে কাজবাড়িতে কী অবলীলায় কুড়ি পিস চিংড়ি খেয়ে নিয়েছেন, তখন তাঁর মুখ-টুখ ফুলত না।
অবশ্য খুব শিগগিরই আবার বাস্তবে ফিরে আসে তারা। ভাইপো কদিন আগে অ্যালার্জিতে কাবু হয়েছিলেন, আর তাঁর খাদ্যরসিক কাকা আজ ভোরেই গ্যাস-অম্বলের জোড়া ধাক্কায় যারপরনাই নাকাল হয়েছেন। দুজনেরই বোধহয় সেকথা মনে পড়ে যায়। তার মানসিক রেশ কাটেনি এখনও। মামাকে তাই বলতে শুনি – “যারা কম খায়, তারাই দেখি, ঠিক থাকে। আর এই আমার মতো বেশি খেলেই দেখছি সমস্যা বেশি।”
সাবুর পাঁপড় চিবোতে চিবোতে দুজনের এই ভোজন-আখ্যান আমি বেশ উপভোগ করছিলাম।
তবে শরীরের কারণেই বোধহয়, এই খাওয়ার নস্টালজিয়া বেশিক্ষণ চললে ক্রমশ অস্বস্তি বাড়ে। সঙ্গে মনখারাপ। অতএব, উপশম হিসেবে প্রসঙ্গ পরিবর্তন।
এবারের প্রসঙ্গও গ্যাস, তবে বদহজমের দোসর গ্যাস নয়, রান্নার গ্যাস। এলপিজি, ইথাইল মারক্যাপটন, এই শব্দগুলো ভরা থাকে লাল সিলিন্ডারে। সেই সিলিন্ডার বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেন খাঁকি পোশাকের কর্মী। তাঁদের চেহারা ওই যুবক হরিশঙ্কর দাসের মতোই সুঠাম।
ফটিকের বাড়িতে এখনও ডবল গ্যাস হয়নি, সে সারাদিন বাড়ি থাকে না, গ্যাস ফুরিয়ে গেলে বউমা রান্না করবে কীভাবে, এই নিয়ে হরেমামার চিন্তা। ভাইপোকে সে বলে – “আর দেরি করিসনি। এবার পয়সা দিয়ে ডবল গ্যাসটা নিয়ে নে।”
বোঝাই যায়, এ উপদেশ সে আগেও দিয়েছে।
ভাইপো বলে – “আসলে কী জানো, এখন ডবল গ্যাস নিতে গেলে তিন হাজার টাকা জমা রাখতে হচ্ছে। আড়াই ছিল, হুট করে তিন করে দিল। তিন হাজার টাকা একবারে দিতে, সত্যি বলছি কাকা, গায়ে লাগে।”
মামা তখন আমার দিকে ঘুরে বলল – “মোদী কী শুরু করল বলো তো!”
আমি হাসলাম তার কথায়। ফটিকও হাসল। মামা আবার তাকে জিজ্ঞাসা করে – “হ্যাঁ রে, সাবসিডি পাচ্ছিস?”
সে বলল – “ওখানেও কেলো। সরকার থেকে বলেছিল, বছরে বারোটা গ্যাস সিলিন্ডার হলে দুশো টাকা করে সাবসিডি। আমাদের ঘরে তো দুজন লোক, দশটা সিলিন্ডারেই কুলিয়ে যায়।”
প্রত্যুত্তরে হরেমামা আরও কিছু বলত, কিন্তু তখনই তার ভাইপোর তার মনে পড়ে যায়, আজ অমাবস্যা। নিবিড়দাদের কালীমন্দিরে পাঁঠাবলি হবে। বলি দেখার নিমন্ত্রণ তার। এখন এই রান্নার গ্যাসের জটিল অঙ্ক থেকে যত তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাওয়া যায়, তত ভালো। তাই আর দাঁড়াল না ফটিক। শুধু যাওয়ার আগে তার কাকার উদ্দেশে বলে গেল – “পুজোর আগে একটা চশমা জোগাড় করে দিও আমায়।”
হনুমান ওরফে ফটিকের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি আমি। হাঁটার গতি অস্বাভাবিক দ্রুত। সত্যিই বুঝি পালাচ্ছে সে!
অলংকরণ - অমর্ত্য খামরুই
Powered by Froala Editor