‘শীতলা মন্দিরের রাস্তা ধরে ছুটছি, গুলিটা কপালে লেগে ছিটকে গেল’

মামাকে একদিন আমার অফিসঘরে নিয়ে এসেছিলাম। তার আগে একদিন আসার ইচ্ছে সে নিজে থেকেই প্রকাশ করেছিল। ঘরটি বেশ নিরিবিলিতে, আড্ডা-আলোচনার জন্য একেবারে আদর্শ স্থান। 

আড্ডা দেওয়ার মাঝে ফরতাবাদে থাকি শুনে সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল – “তুমি তপেশ ধরের বাড়ি চেনো?”

আমাদের বর্তমান বাসস্থান যেখানে, সে তল্লাটের পুরনো বাড়িগুলোর মধ্যে ধরদের বাড়ি অন্যতম। তপেশ এবং তেজেশ, দুই ভাইয়ের পাশাপাশি দোতলা বাড়ি, একই কম্পাউন্ডের মধ্যে। দুই বাড়ির সামনেই একচিলতে বাগান। দুই বাগানের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে সরু প্যাসেজ। দরজার বাইরে সাদা মার্বেলের ওপরে বাঁকানো টাইপে খোদাই করে লেখা – “ডাঃ ধরের বাড়ি।” খোদিত অংশের কালো রং অনেকটাই মুছে এসেছে এখন।

হরেমামাকে সেকথা বলতে সে বলল – “ডাক্তার আবার কে?”

সত্যি কথা বলতে, ডাক্তার ঠিক কে, সেকথা আমিও জানি না। বাড়ি আর নেমপ্লেটের বয়স অনুমান করে বললাম – “ওঁর বাবা হয়তো ডাক্তার ছিলেন। জানি না ঠিক।”

হরেমামা তখন বলল – “হ্যাঁ, তপেশ ধর তো কংগ্রেস করত। শচীন মুখার্জিও। ওদের আলাদা গ্রুপ, দুই গ্রুপে ঝামেলা ছিল।”

তপেশ ধরকে শেষ কবে রাস্তায় দেখেছি, মনে নেই। এখন বয়স আশির আশেপাশেই হবে। স্কুলে পড়াকালীন যখন তাঁকে দেখতাম, বেশিরভাগ দিনই দেখতাম সকালে। বাজারের ব্যাগ হাতে ধীরপায়ে চলেছেন। কখনও-কখনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতেন। দু’একবার আমার দিকে চেয়ে হেসেছেন। গলার স্বর ও সার্বিক স্বভাবে একটা সহজাত ভদ্রতা তাঁর অলংকার ছিল। 

আমার স্কুলবেলা কেটে আসছে, সেই সময়ে ‘পরিবর্তন’ এল। প্রথমে ২০০৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচন, তারপর ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচন। ওই ২০০৯-এই পৌরসভার ভোট। আমাদের ওয়ার্ড নম্বর ২৮, আর তার পাশের ২৯ নম্বর ওয়ার্ডেই কাউন্সিলর নির্বাচনে প্রার্থী হলেন তপেশ ধর। ততদিনে তিনি তৃণমূল কংগ্রেস। ফরতাবাদ মোড়ে ফ্লেক্স টাঙানো হল, সেখানে তাঁর ছবি। সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে দু’হাত জড়ো করে নমস্কার করছেন জনতার উদ্দেশে। শেষপর্যন্ত জিতেছিলেন।

’১১ সালে বিধানসভা নির্বাচন হয়ে গেছে। সাড়ে তিন দশকের বামফ্রন্ট সরকার অস্তমিত, ‘লাল সন্ত্রাসে’র ফাটকা খেলে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। রাজ্যের রাজনৈতিক দৃশ্যপট ক্রমশ বাঁক নিচ্ছে। ফুটেজ-সর্বস্বতা ঢুকে পড়ছে সেখানে। 

একটা সময়ে ভোট এলেই ব্যঙ্গছড়া রচনার রীতি ছিল, সেই বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরস সরে যাচ্ছে, বদলে আসছে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচা করে বানানো প্রচারমূলক তথ্যচিত্র, নামীদামী শিল্পীদের দিয়ে গাওয়ানো গান। বিনোদনমূলক ছবির দৃশ্য থেকে রঞ্জিত মল্লিকের বেল্ট দিয়ে দুষ্কৃতি চাবকানো, সৌমিত্র ব্যানার্জির একচেটিয়া তোলাবাজি বা ধর্ষকের রোল, কিংবা মিঠুন চক্রবর্তীর দুর্নীতি-পরায়ণ মন্ত্রী-সাংসদ পেটানো ক্রমশ ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। অঞ্জন চৌধুরী গত হচ্ছেন, স্বপন সাহাও একটা সময়ের পর ছবি বানানো ছেড়ে দিচ্ছেন। পরিবর্তে উঠে আসছে দক্ষিণি ছবির হুবহু টুকলি মেরে তৈরি নায়ক-নায়িকার রোমান্স-সর্বস্ব দুর্বল চিত্রনাট্য, যেখানে কোথাও রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির কথা নেই। এসব নায়ক-নায়িকারাও সরাসরি শাসক দলের ঝাণ্ডা ধরছেন পালা করে। একইসঙ্গে টেলিভিশন চ্যানেলের সংস্কৃতিও পাল্টাচ্ছে। উচ্চমানের নন-ফিকশন শো ক্রমশ কমে আসছে, কোথাও কোথাও সরাসরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চ্যানেল, আর সেখানে পরপর তৈরি হচ্ছে মেগা ধারাবাহিক। আলো-ঝলমলে সেট, জমকালো পোশাকের অসুস্থ প্রদর্শনী, আর ততোধিক জঘন্য গল্প, যার মাধ্যমে খুব সহজে ছড়িয়ে দেওয়া যায় পশ্চাৎমুখিতা, কুসংস্কারের চোরা বিষ। 

আর সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে পুরনো জমানার রাজনৈতিক সৌজন্য। 

তপেশ ধর যেমন। ছয় ও সাতের দশকের কংগ্রেস কর্মী। পাড়ার সমসাময়িক ও অনুজ সিপিআইএম সদস্যদের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল, নিয়মিত আড্ডা মারতেন, একথা শোনা গেছে। চাকরিও করতেন একটা, চৌকিদারি কর বিভাগে। পুরনো লোকজনের অনেকেই তাঁকে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিয়মিত অফিস যেতে দেখত। 

রাজ্য বিধানসভায় পালাবদলের পরপরই আমি কলেজে ঢুকেছি, কলেজে কলেজে স্টুডেন্ট’স ইউনিয়নে নির্বাচন তখনও হয়েছে। কিন্তু আশেপাশের চেহারা যে প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে, সেটা চোখে পড়ছে। বাজারের রাস্তায় তপেশ ধরকে দেখছি তিনি আরও মন্থর হয়ে পড়েছেন, তারপর এক সময়ে আর তাঁকে নিয়মিত চোখে পড়ছে না।

সেদিন অফিসঘরে বসে হরেমামার মুখে তাঁর নাম শুনে হঠাৎ আমার সেইসব দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। 

অনেকটা আমাদেরই মতো পালাবদল দেখেছে হরেমামারাও। সাতাত্তরে অভূতপূর্ব নির্বাচনী ফলাফলে ভর করে বামফ্রন্ট যখন ক্ষমতায় আসছে, হরিশঙ্কর দাসের বয়স তখন চোদ্দ। এই পালাবদলের জমি অবশ্য তৈরি হয়েছিল বিগত কয়েক দশক ধরেই। সেই জমিপ্রস্তুতের অন্যতম ভিত্তি ছিল এই বিধানপল্লীর মতো উদ্বাস্তু কলোনিগুলোতে কমিউনিস্ট পার্টির মাটি-কামড়ানো লড়াই। 

কৈশোর পার হওয়ার পর মামারাও সেই লড়াইয়ে সঙ্গী হয়েছিল। পাড়ার কারও বিপদ-আপদ হলেই তাদের ডাকছে মানুষ। বর্ষার সময় বিধানপল্লীর নিচু রাস্তা একহাঁটু জলে ডুবে যেত। একই ঘটনা ঘটত গঙ্গার জোয়ারের সময়েও। কাঁচা ভিত ছাপিয়ে গঙ্গার জল উঠে আসত মানুষজনের ঘরের মেঝেতে। রাত দুটোর সময়ে হয়তো ডাক পড়ত – “হরে, তাড়াতাড়ি আয় ছেলেদের নিয়ে। আমার মালপত্র সরাতে হবে।” আবার কেউ হয়তো বলত – “আমার অন্য কিছু সরাতে হবে না। বইখাতাগুলো সরা। পরীক্ষা সামনে।” 

ডাক পড়ত অন্য সময়েও। 

“একবার একজন মারা গেল, তার বাড়িতে বেশি লোক নেই। আমাকেই বলল, খাট কিনে নিয়ে আয়। গড়িয়া মোড়ে পনেরো টাকায় খাট পাওয়া যেত। সেই খাট কিনে আনলাম। তারপর ফুল-টুল দিয়ে, ধূপ জ্বালিয়ে খাট সাজানো হল। তখন তো আর এসব স্বর্গরথ-টথ ছিল না। আমরাই কাঁধে করে খাট বয়ে নিয়ে যেতাম। খাট বওয়া কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়, আমরা সব তাগড়াই ছিলাম, তাই আমাদেরকেই সকলে ডাকত। সেবার হয়েছে কী, ওদের বাড়ির লোক বেরোনোর আগেই আমরা চারজন খাটিয়া কাঁধে করে ‘বলো হরি, হরিবোল’ করতে করতে ছুটেছি। আর ওরা পিছন থেকে চেঁচাচ্ছে – “তোদের নিতে হবে না, দাঁড় করা।””

এমন সব মজার ঘটনা বলতে বলতেই সে আবার ফিরে আসে শচীন মুখার্জির প্রসঙ্গে। শচীন মুখার্জি আর তপেশ ধরের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা এখনও গড়িয়া অঞ্চলের আদিবাসিন্দাদের মুখে-মুখে ঘোরে। ইনিও একসময়ের দাপুটে কংগ্রেস নেতা, পরে তৃণমূল কংগ্রেস। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একদম শুরুতেই এক রবিবারের সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছিলেন, পথে খুন হয়ে গেলেন। খুনিরা এসেছিল বাইকে চেপে। একদম পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি। প্রথম ছোঁড়া গুলিটা লক্ষ্যভ্রুষ্ট হয়েছিল, পরেরটা সরাসরি বুকে। ঘটনাটা ঘটেছিল হিন্দুস্তান মোড়ে। ফরতাবাদ থেকে হিন্দুস্তান মাত্র কয়েক মিটারের দূরত্বে।

তার কয়েক মাস পরেই বিধানসভা নির্বাচন, রেকর্ড সপ্তমবার জিতে সরকার গড়বে বামফ্রন্ট। খুনের দায়টা সিপিআইএমের উপরেই চাপিয়েছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো।

হরেমামা বলল – “শচীন মুখার্জি কিন্তু রাজনীতির কারণে মরেনি। প্রোমোটিং করত, সেই নিয়ে ঝামেলার কারণে মরল। লোক অবশ্য মোটেই ভালো ছিল না। তপেশদা অনেক ভদ্রলোক ছিল।” তারপর কিছুক্ষণ থেমে যোগ করে – “আমার যখন কপালের এই বাঁদিকে গুলি লেগেছিল, শচীন মুখার্জি এসেছিল আমাদের বাড়িতে। তখন আমাদের বেড়ার ঘর, টালির চাল। আমি শুয়ে আছি দাওয়ায়, ব্যান্ডেজ বাঁধা।” 

আড্ডার গতিপথ হঠাৎ এমন বাঁক নিল যে আমি চমকে উঠলাম। হ্যাঁ, মামা একসময়ে মস্তানি করেছে, বান্টি সিনেমা হলে ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো-র জন্য বিস্তর মারামারি-কাটাকাটিতে জড়িয়েছে অন্যান্য পাড়ার মস্তানদের সঙ্গে, তার ট্যাক্সির গায়ে ধাক্কা মারার পর ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকৃত হয়েছিল বলে একটি বাসচালকের সঙ্গে তুমুল হাতাহাতি হয়েছিল বাঁশদ্রোণীতে, সেই বাসের কাচ মামা ফাটিয়ে দিয়েছিল ইঁট মেরে। তারপরে ক্রমশ সময়ের দাবী তার মধ্যেও স্থিতাবস্থা এনে দিয়েছে, দোদুদার ভাষায় ‘ঘাউড়া’ হরিশঙ্কর দাস শান্ত হয়ে এসেছে। তাও রাজনৈতিক সংঘর্ষের গন্ধ-জড়ানো গুলি চালনার ঘটনায় তার আক্রান্ত হওয়ার কথা শুনে আঁতকে না উঠে পারলাম না। 

মামার গলার স্বরে কোনও উত্তেজনা নেই। তার কাছে গুলি খাওয়া আর পদ্মপুকুরে মাছ ধরা যেন একই ব্যাপার। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম – “কে গুলি করেছিল?”

হরেমামা উত্তর দেয় – “কংগ্রেসের গুণ্ডারা।”

এ অঞ্চলে কংগ্রেসি গুণ্ডাদের দাপটের কথা পুরনো বাসিন্দাদের মুখে মুখে ফেরে। ছয়ের দশকের শেষ দিকে যখন সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্ম নিচ্ছে বামপন্থীদের একাংশের, ধীরে ধীরে সশস্ত্র বিপ্লবের রাস্তায় হাঁটতে চাইছেন তাঁরা, সেসব দুষ্কৃতীদের আনাগোনাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। সাতের দশক এল। নকশাল আন্দোলন। বাম-মনষ্ক যুবসমাজের ওপর নেমে এল নির্বিচার নিপীড়ন। কী সিআরপিএফ, কী গুণ্ডাবাহিনি, সকলেই পালা করে মেতে উঠছে অত্যাচারে। পূর্ব বিধানপল্লীর দিকে বিপদ বেশি, তাই আপাত-শান্ত পশ্চিম বিধানপল্লীতে গিয়ে আশ্রয় নিত পাড়ার যুবকেরা, কখনও বা বিপদের আভাস পেলেই ঊষার লম্বা পাঁচিল টপকে গা-ঢাকা দেওয়া। 

তারপর রাজ্যে পালাবদল হল। দুষ্কৃতীকুলের দাপট শান্ত হয়ে এল, কিন্তু পুরোপুরি ফুরিয়ে গেল না। 

হরেমামা তখন কুড়ির কোঠায়, তখনও এখানে কোনও বাড়িতে পাঁচিল ছিল না। সকলে থাকে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে, এ বাড়ি থেকে ও বাড়িতে যখন খুশি দিব্যি চলে যাওয়া যায়। হরেমামাদের বাড়ির একটু পিছনে রাস্তা। সে রাস্তা সোজা চলে যাচ্ছে সাহেবকুঠির মোড়ের দিকে। ওদিকেই মূলত দাপটটা ছিল এসব ভাড়াটিয়া গুণ্ডাদের। আশেপাশের উদ্বাস্তু কলোনিগুলোতে মাঝেমধ্যেই এসে হম্বিতম্বি করে যাওয়া ছিল তাদের অভ্যেস। কিন্তু বিধানপল্লী বা নবপল্লীতে এসে তেমন কিছু করার সাহস পায় না। 

কিন্তু একদিন– 

“ওদিকের তিনটে ছেলে ওই সন্ধে সাড়ে ছ’টা-সাতটা হবে, আমাদের বাড়ির পিছনের রাস্তাটা দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাড়ির ঠিক পিছনেই শিবাদাদের বাড়ি, শিবাদার বোন নিলুদি বাড়ির সামনের উঠোনে বসেছিল। ছেলে তিনটে সিগারেট খেয়ে সিগারেটটা ওর গায়ে ছুঁড়ে ফেলেছে। ও সঙ্গে সঙ্গে এসে আমাদের বলেছে। আমাদের পাড়া তখন হেবি স্ট্রং ছিল। সব ইয়াং ছেলে আমাদের, অন্য পাড়ার মস্তান এ পাড়ায় এসে মস্তানি করে গেলে আমরা সেই মস্তানকে তার নিজের পাড়ায় গিয়ে মেরে আসতাম। কাউকে পরোয়া করতাম না আমরা। আসলে, ওপার থেকে চলে এসেছিলাম তো, সেজন্যে জোট বাঁধতে হয়েছিল আমাদের।”

আমি জিজ্ঞাসা করলাম – “তারপর কী হল?”

-আমরা কয়েকজন মিলে ওই তিনটে ছেলেকে ধরে হেবি পিটিয়েছি। ওদের মধ্যে থেকে দুটো ছেলে পালিয়ে গেছে, গিয়ে নিজেদের পাড়ায় খবর দিয়েছে। ওখান থেকে তখন ওদের পুরো দলটা বন্দুক, ভোজালি নিয়ে এসে আমাদের তাড়া করেছে। এদিকে আমাদের তো খালি হাত। কী করি? এই যে সামনেই শীতলা মন্দিরের সামনে রাস্তাটা যেখানে বাঁকছে, ওখানে একটা বাড়ি ছিল, এখন ফ্ল্যাট হয়ে গেছে, সেই বাড়িতে ঢুকে পড়েছি। কিন্তু ওরা আমাকে বার করে দিল। তখন রাস্তা দিয়ে ছুটতে লাগলাম। ওদিক থেকে একটা গুণ্ডা গুলি করল। গুলিটা কপালের একপাশে লেগে ছিটকে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কপালের বাঁদিক থেকে ফোয়ারার মতো রক্ত। আমি একহাত দিয়ে কপাল চেপে দৌড়োচ্ছি। আরেকটু এগিয়ে রাস্তাটা যেখানে জলট্যাঙ্কের কাছে বাঁকছে, ওখানে বাচ্চুদাদের বাড়ি ছিল, ওদের বাড়িতে লুকিয়ে পড়েছিলাম। আমার পিছনে আমার এক বন্ধু ছিল, তার পেটে গুলি লেগেছিল। অনেকদিন হসপটালে ছিল। তিন-চারবার খবর এসেছিল যে ও আর বাঁচবে না, যাইহোক, শেষপর্যন্ত বেঁচে উঠেছিল।”

-আর ওই গুণ্ডাগুলো?

-গুলি চলেছে দেখে আমাদের সকলে হইহই করে উঠেছে। ওরা এদিকে আমাদের ধরতেও পারেনি, আর বুঝেছে, এখানে থাকলে ওদেরও জান থাকবে না। অন্যদিক দিয়ে ভেগেছিল। আমাদের এতজনের সঙ্গে গুলি-বন্দুক নিয়ে লড়েও কিছু করতে পারবে না।

-শচীন মুখার্জি তাহলে এর মধ্যে কোথা থেকে এল?

-শচীন মুখার্জি তো এল পরদিন। এসে বলল, এটা কারা করেছে, আমি সব জানি। তোমাকে কিছু বলতে হবে না। এই বলে নিজেই নামগুলো একটা কাগজে লিখে নিয়ে চলে গেল। 

-কিন্তু গুণ্ডাগুলোও কংগ্রেসের তো?

-হ্যাঁ, শচীন মুখার্জি তো কংগ্রেসের বড়ো লিডার। আসলে এই ছেলেগুলো তার আগে ওর সঙ্গেই ছিল। পরে অন্য দলে গিয়ে ভেড়ে। সেজন্যে এদের উপর শচীন মুখার্জির একটা রাগ ছিলই।

আমি শুনে হাসলাম। তবে তখনও যে ঘটনা কিছু বাকি, সেকথা আন্দাজ করতে পারিনি।

“প্রায় দশ-পনেরো বছর কেটে গেছে। আমরা তখন এসব ভুলেও গেছি। হঠাৎ একদিন কয়েকটা ছেলে এসে আমার বাবাকে বলছে, কাকু, আমরা সরকারি চাকরি করি, আপনি আমাদের নামে ডায়েরি করেছিলেন, সেটা যদি তুলে নেন। নাহলে আমাদের চাকরি চলে যাবে। বাবা তো শুনে অবাক। বলছে, আমি তো কখনও কারও নামে ডায়েরি করিনি। তারা বলছে, না, আপনি করেছিলেন। এখন যদি সেটা তুলে নেন, আমাদের চাকরিটা টিকে যায়। তখন আমাদের মনে পড়ল সেই ঘটনাটা। বাবা তো জানতই না, বাবার নাম ব্যবহার করে শচীন মুখার্জিই ওদের নামে ডায়েরি করে রেখেছে। তা বাবা রাজি হয়ে গিয়েছিল, কেস তুলে নেয়। আমিও বলেছিলাম, না, এদের কাউকে আমি চিনি না।” 

কথাগুলো বলতে বলতেই হাসতে শুরু করল সে। তারপর হঠাৎ কী যেন মনে পড়তে আমায় জিজ্ঞাসা করল – “কটা বাজল গো?”

ঘড়ি দেখালাম তাকে। সাতটা চল্লিশ। সময় দেখে প্রায় লাফিয়ে উঠল মামা। বলল – “ওরে ব্বাবা, সাড়ে সাতটা পার হয়ে গেছে। নাঃ, আজ আর বসব না। আমার ‘মিঠাই’ শুরু হয়ে যাবে।”


অলংকরণ - অমর্ত্য খামরুই

Powered by Froala Editor