বিবেকানন্দ ব্যায়ামাগারের ফুটবল দলের খুব নাম ছিল একসময়ে। হরেমামা সেই দলে ফুটবল খেলত। ঊষার মাঠে যখন তাদের অনুশীলন হত, অন্য কারও প্রবেশাধিকার থাকত না। এমনকি, ঊষার কোয়ার্টারের ফুটবল দলেরও নয়। সবাই ওদের ভয় পেত। হরেমামা এসব কথা যখন বলে, মুখে লেগে থাকে একটা মুচকি হাসি। এখনকার ভেঙে আসা শরীর, কথা বলার সময় সর্বদা হাসিমুখ, এসব দেখে অতীতের দুর্ধর্ষ লোকটিকে বোঝার উপায় নেই। এতকিছুর মধ্যে যেটুকু থেকে গেছে, তা হল ওই হাসির আড়ালে একটা চাপা রুক্ষতা।
ছোটোবেলায় সে যে ভয়ানক দস্যি ছিল, সেকথা আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
মাঝেমাঝেই অতীত দিনের কথা বলতে গিয়ে বলে ফেলে – “কত কিছু করেছি গো জীবনে! এখন শুধু এখানে বসি আর ড্রাইভারি করি। আর কিছু করি না। যেদিন গাড়ি চালানো থাকে না, সেদিন সারাদিন এখানেই বসে থাকি।”
সেদিন সে গিয়েছিল হিন্দমোটরে, এক বৃদ্ধাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। আমার সঙ্গে যখন তার দেখা হল, তখন সে স্নানের তোড়জোড় করছে। খালি গা, শুধু একটা গামছা পরা। তখনই সবে ফিরেছে। ধূপকাঠি জ্বালাতে রাস্তায় এসেছিল। শুক্লাদির জ্বলন্ত স্টোভটা তার দরকার।
আরও পড়ুন
তিনটে জোয়ান ছেলেকে এক আঙুলের টোকায় ফেলে দিয়েছিল মেয়েটা
হিন্দমোটরে গিয়ে এক তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। যাঁকে নিয়ে গিয়েছিল, সেই বয়স্কা মহিলা না দেখেশুনেই তার নামে ভাড়াটের কাছে নিন্দা করেছে, সেকথা হরেমামার কানে গেছে। বলল – “এদের সব মনে পাপ, বুঝলে তো।”
আরও পড়ুন
‘ঊষার স্কুলের বারান্দায় ডাব খাচ্ছি, রাত তখন দেড়টা’
ক্লাবের টেলিভিশনে তখন তর্ক-বিতর্ক চলছে। মহাচুরির পক্ষে-বিপক্ষে সওয়াল-জবাব। রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, বিশ্লেষক, সকলকে নিয়ে একেবারে ঝাঁ-চকচকে হট্টমেলা। হরেমামাকে বলি – “এসব কী দেখছ!” সে বলে – “আর কী দেখব! ভাবলাম ইন্ডিয়ার খেলাটা দেখি। চ্যানেলই আসছে না।” তারপর স্যুট-প্যান্ট পরা ধোপদুরস্ত সঞ্চালকের দিকে উদ্দেশ করে সে বলে – “এ তো আমার বাড়ির ওখানে থাকে। সেবার অ্যাক্সিডেন্ট হল। তারপরেই দেখি এখানে গিয়ে বসছে।”
আরও পড়ুন
‘পঞ্চপাণ্ডবের রথের চাকার দাগ দেখছি, তেড়ে এল ভালুক’
এই মুহূর্তে ওই প্রসঙ্গ ভালো লাগছিল না। ফুটবলটাই বরং শ্রেয়। জিজ্ঞাসা করি – “কোন পজিশনে খেলতে তুমি?”
হরেমামা বলে – “স্ট্রাইকার। গোল করবই, এমন ছিলাম।”
সফল খেপ খেলোয়াড় ছিল সে। এখনকার খেপ খেলার জগতেও টাকার ছড়াছড়ি। মামা সেসব খবর ভালোই রাখে। খেললেই পাঁচশো, হাজার, দু’হাজার, তিন হাজার, পাঁচ হাজার অবধি পেয়ে যাচ্ছে ছেলেরা। তাদের ছোটোবেলায় ম্যান অফ দ্য ম্যাচ বা ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্টের পুরস্কার বলতে একজোড়া কেডস বা বড়জোড় একটা কিটব্যাগ।
“তাতেই আমরা কত খুশি। আর খাবার বলতে ওই ছোলা, মুড়ি, এসব।”
এমন ফুটবল ম্যাচ হলেই সকালে ক্লাবের কর্তারা বাজারে যেতেন ফলের অর্ডার দিতে। মুসাম্বি লেবুই সাপ্লাই হত বেশি। হাফটাইমের বাঁশি বাজলেই ক্লাবের দুজন থালা-ভর্তি করে লেবুর কোয়া নিয়ে ছুটত মাঠের মাঝখানে। মাঠে বসে থাকা খেলোয়াড়দের হাতে লেবু তুলে দিত। গরমকাল হলে বরফের টুকরোও। তখন গ্রাম-শহর নির্বিশেষে পাড়ার পাড়ায় ফুটবল ম্যাচ হয়, কোনও বিশেষ জনের অনুপ্রেরণা ছাড়াই।
হরিশঙ্কর দাস বুঝি মনের কথা পড়ে ফেলেন। “আর কী দিত, জানো? লেবুর সরবত। আমি তো তিন-চার গ্লাস লেবুর সরবত খেয়ে ফেলতাম।”
আমি বলি – “বরফ চোষাও তো ছিল, না?” সে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।
ফুটবল নিয়ে কিছু বলার সুযোগ পেলে তার ভারী আনন্দ। বেশ গর্বভরেই বলে যায় – “আমার খেলা দেখতে প্রচুর দর্শক আসত, জানো তো! আর আমি না লোককে চমকে দিতাম। কী করে বলো তো? এই ধরো, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বল এসে লাগল মাথায়। আমি পুরো সোজা হয়ে এক সাইডে পড়ে যেতাম। পড়ে যাওয়ার সময়ে শরীর ভাঁজ হত না একটুও। লোকজন তো হাঁ-হাঁ করে ছুটে আসত। হরের কী হল, হরের কী হল! আমি তারপর আবার উঠে খেলতে শুরু করে দিতাম। সব অবাক হয়ে যেত।”
আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল বহুবছর আগে দেখা যোগেশ মাইম থিয়েটার কক্ষে এক মূকাভিনয় প্রদর্শন। মাধ্যমিক শেষে লম্বা ছুটি চলছে তখন। চারবন্ধু মিলে গিয়েছিলাম মূকাভিনয় দেখতে। একটি লম্বা ছেলে গাছের ভূমিকায় অভিনয় করছিল। গাছটাকে কেটে ফেলা হল, এই দৃশ্যে সে তখন অমন সোজা হয়ে স্টেজের ওপর পড়ে গিয়েছিল। চূড়ান্ত ফিটনেস ও ফ্লেক্সিবিলিটি না থাকলে ও জিনিস সম্ভব নয়। সেই দৃশ্য আমায় আক্ষরিক অর্থেই বিস্মিত করেছিল।
“কোথায় কোথায় খেলতে যেতে?”
“সে অনেক জায়গায়। এমন কোনও জায়গা নেই জানো, যেখানে খেলতে যাইনি।”
একথা বলার পর কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ করে যায় সে। টেলিভিশনে কোলাহল পুরোদমে। কানে ভেসে আসছে যুক্তির জাল, ক্লাবে উপস্থিত বাকিরা হাঁ করে গিলছে সেসব। আমি অপেক্ষা করছি হরেমামার পরবর্তী সংলাপটির জন্য। অবশেষে কয়েক মিনিটের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে সে বলে – “এই গল্পটা তোমায় বলি। সেবার গেছি বেলতলা মোটর ভেহিকলসের ওখানে খেলতে।”
নিমেষের মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে গেল বঙ্গ-রাজনীতি। এক ঘোর বাস্তব কুনাট্য রঙ্গ আর সেই নিয়ে একদল খেউড়বাজের চিৎকার চাপা পড়ে যায় বিধানপল্লী বিবেকানন্দ ব্যায়ামাগারের প্রাণ হরিশঙ্কর দাসের ফুটবল দিনের গল্পে।
“ও আচ্ছা, শরৎ বোস রোডের ওখানে।”
“হ্যাঁ, ভবানীপুরের দিকে। ওখানে আমার মামারবাড়িও ছিল।”
চকিতে ভেসে ওঠে গত দশকের প্রথম দুটো বছর। তখন হায়ার সেকেন্ডারি। ওই যোগেশ মাইমে মূকাভিনয় দেখার ঠিক পরবর্তী বছরগুলো। গড়িয়া অবধি মেট্রোর সম্প্রসারণ হয়ে গেছে, আমরা রোজকার যাত্রী। আশি রাইডের চুম্বক-লাগানো টিকিট, স্টুডেন্ট কনসেশনের দৌলতে ছ’টাকার জায়গায় দু’টাকায় যাতায়াত। যতীন দাস পার্ক স্টেশনে নেমে হাজরা মোড় থেকে হেঁটে সেন্ট লরেন্স হাইস্কুল। অটোস্ট্যান্ড থেকে বাঁদিকে বাঁক নিলে প্রিয়নাথ মল্লিক রোড, সেটা ধরে নফর কুণ্ডু রোডে গিয়ে পড়া, তারপর আরও হেঁটে বেলতলা রোড ধরতাম। পথে পড়ত কাসা দেই বাম্বিনি মন্টেসসরি স্কুল, প্রাদেশিকতা বিষয়ে অসচেতন, অপরিণত আমরা মজা করে বলতাম, ‘কষে দেয় বাম্বু’। কখনও অন্য রুট নিতাম। হাজরা মেন রোড ধরে সোজা হেঁটে গিয়ে টাউনসেন্ড রোড হয়ে বেলতলা রোড। টাউনসেন্ড রোডের নাম অবশ্য বদলে গেছে ততদিনে, ‘দেশের কথা’-খ্যাত সখারাম গণেশ দেউসকরের নামে হয়ে গেছে। আমরা সাদা জামা, গাঢ় নীল প্যান্ট-টাই পরে স্কুলে চলেছি, রাস্তার পাশে তখন কর্পোরেশনের জলে স্নান করছে উচ্ছিষ্ট দক্ষিণ কলকাতা। কেউ সাবান মাখছে, কেউ রোদ। টাইমকলটা গোড়া থেকে ভেঙে গিয়েছিল, জলটাকে দেখে মনে হত, সুড়ঙ্গ ফুঁড়ে উঠে আসছে।
মামাকে বললাম – “বুঝতে পেরেছি। ও জায়গা খুব চিনি।”
ততক্ষণে আরও একটু এগিয়ে এসেছি আমরা। টাউনসেন্ড রোড আর বেলতলা রোডের সংযোগস্থলে একটা চৌমাথা, সেখানে দুটো ছোটো ত্রিকোণ পার্ক। কিছুটা এগিয়ে শ্যামানন্দ রোডের ওপরে বেলতলা গার্লসের লাল স্কুলবাড়ি, বেমানান নীল শতবর্ষ তোরণ তৈরি হয়েছে বছর তিনেক আগে। তার একটু আগে পড়বে রাধাবল্লভের মন্দির, ১২ নং বেলতলা রোড, স্থাপিত – ১২৫৯ সন। সে মন্দিরে সকালের ওই সময়ে গাছে জল দিত একজন পুরোহিত। উল্টোদিকের চায়ের দোকান তখন আড়মোড়া ভেঙেছে সবে।
একা থাকলে দেখা হয়ে যেত সকালের কচুরি-বিক্রেতাটার সঙ্গে, একটা কাচের বাক্স নিয়ে নেতিয়ে যাওয়া কচুরি আর দুর্ধর্ষ ঝাল আলুরদম ফেরি করে বেড়াত, টাকায় একটা হিসাবে। বেলতলা রোড শক্তি সংঘের পুজো হয় যেখানে, সেখানে বিক্রি হত সিদ্ধি, কদাচিৎ। সামনেই একটা গলি সোজা গিয়ে পড়ছে শরৎ বোস রোডে। নাম ল্যান্সডাউন লেন। মুখেই একখানা আটচালা শিবমন্দির। গলির মধ্যে এক ঐতিহাসিক স্কুলবাড়ি, সাউথ ক্যালকাটা ন্যাশনাল স্কুল, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ এবং প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। আমার ঠাকুরদার আলমা মাটের সে স্কুলও শতবর্ষ পার করল ২০২১ সালে।
মামা বলল – “ওখানে আমাকে হায়ার করে নিয়ে গেছিল। চক্রবেড়িয়া ফুটবল ক্লাব, ওদের হয়েই খেলতে গেছিলাম। পরদিন ছিল হরতাল, তখন তো প্রায়ই এসব বনধ-হরতাল হত। সেজন্যে আগের দিন আমাকে নিয়ে চলে গেছিল। ক্লাবেই থাকতে দিয়েছিল। শরৎ বোস রোডের ওখানে একটা তিনকোণা মাঠ ছিল। সেখানে খেলা।”
তিনকোণা মাঠ অর্থে সাদার্ন সমিতির মাঠ। বেলতলা রোড শেষ হয়ে আসছে এবার। চওড়া হয়ে গিয়ে মিশে যাচ্ছে শরৎ বোস রোডের সঙ্গে, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে মাঠটা। তখনও ওর রেলিঙের গায়ে নীল-সাদার প্রলেপ পড়েছি। বকুলবাগান রোডও এসে পড়ছে, ওই বাঁকের মুখে ফুটপাথের ওপরে বসে বিকেলে বিড়ি বাঁধত একটা লোক, স্কুলফেরতা দেখতাম। শরৎ বোস রোডের ওপারেই শুরু হচ্ছে বালিগঞ্জ। হাঁটতে থাকলে এক পাশে পালিত স্ট্রিট, অন্য পাশে আর্ল স্ট্রিট, পালিত স্ট্রিটে রায়বাহাদুর বিজয়নারায়ণ কুণ্ডুর প্রাসাদোপম বাড়ি, সোজা এগিয়ে গেলে সুবিশাল জায়গা জুড়ে ম্যাডক্স স্কোয়ার, আরও ডানদিকে ঘুরলে ক্লার্ক রোডের ইউরোপীয় স্থাপত্যের বাড়ি, আর ম্যাডক্স স্কোয়ারের পাশ দিয়ে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের দিকে যেতে গেলে পথে পড়বে রিচি রোড। তারপরেই আমাদের স্কুল। ব্রিটিশ-সদৃশ অভিজাত দক্ষিণ কলকাতা ছড়িয়ে আছে ওপাশের এলাকা জুড়ে। ফাঁকে ফাঁকে হিন্দিভাষীদের তৃতীয় বিশ্ব। ঘেঁষাঘেঁষি সব ঘর। কারও মুদি দোকান, কেউ জামাকাপড় ইস্ত্রি করে।
আর ওদিকে না ঢুকে যদি শরৎ বোস রোড ধরে ল্যান্সডাউন মার্কেটের দিকে এগোই, সেই রাস্তায় কিছুদূর গেলেই পড়বে সাউথ ক্যালকাটা গার্লস কলেজ, এলাকাটা গড়চা। গার্লস কলেজের পরেই একটা লাল বাড়ি, অভিজাত দক্ষিণ কলকাতার ট্রেডমার্ক নিও ক্লাসিক্যাল স্থাপত্য শৈলী। এখন হেরিটেজ তকমা-প্রাপ্ত, ভুল তথ্য-সহ নীল প্লাস্টিকের বোর্ডে লেখা আছে বাড়িটি কিংবদন্তি চিত্রগ্রাহক সুব্রত মিত্রের। নোনা দেওয়ালের জায়গায় জায়গায় গাছ বেরিয়ে গেছে। বাড়ির পাশ দিয়ে চওড়া গলি ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে, সেটাও বেলতলা রোড। আর সেখানেই ‘পাবলিক ভেহিকলস ডিপার্টমেন্ট, গভর্নমেন্ট অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’, মামা এবং আরও অনেক লোকের ‘মোটর ভেহিকলস’।
“থ্রি-আ সাইড খেলা। এদিকে আমরা ঊষায় নাইন-ইচ করে খেলি, আর ওখানে কিনা তিনজন মাত্র একটা দলে।”
“বলো কী? থ্রি-আ সাইড? ফাইভ-আ-সাইড শুনেছি, এটা এই প্রথম শুনলাম।”
এই শুনে মামা সায় দিল আমায় কথায় – “হ্যাঁ, আমিও তার আগে শুনিনি। তাও আবার সেটা একখানা টুর্নামেন্ট! যাইহোক, আমি তো ভাবছি আমরা নাইন-আ সাইড খেলি, আমি ওখানে গিয়ে গোলের মালা পরিয়ে দেব একদম।”
আমি বোধহয় অধৈর্য হয়ে উঠেছিলাম। মামার কথার ছন্দভঙ্গ করে বলে ফেলি – “তারপর? পরালে মালা?”
হরেমামা বলে – “শোনোই না। প্রথম আমাদের বিপক্ষ দল সেন্টার করছে। বলে মেরে তার প্লেয়ারকে পাস দিতে গেছে, বল পৌঁছয়নি তার পায়ের কাছে, আমি তার আগেই বল ধরে নিয়েছি। মারলাম একদম, গদা-আ-আ-আ-আ-ম করে, গোল। খেলা শুরু হতে না হতেই এক গোল দিয়ে দিয়েছি। আবার সেন্টার করছে। আবার পাস দিয়েছে, আবার আমি বল ধরে নিয়েছি। আবার ছুটে গিয়ে ওই আগের মতো গদা-আ-আ-আ-ম করে মেরেছি, বল গোলে ঢুকে গেছে।”
-বাবা রে! এ তো পরপর গোল গো!
হরেমামা বেঁকা হাসি হেসে বলে – “আরে দাঁড়াও। এরপর তো আসলি খেল শুরু। তিন নম্বর গোলটা যেই করেছি, ওদের লোকজন সব গোলপোস্টের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা বলটা মেরে ভেতরে করে দিয়েছে। রেফারি গোলের হুইসল দিয়েছে, কিন্তু ওরা বলছে, না, গোল হয়নি। এই নিয়ে লেগে গেল ঝামেলা। মারামারি-কাটাকাটি। হঠাৎ কোত্থেকে একটা বোমা এসে পড়ল মাঠের মধ্যে। রেফারি তো মাঠের মধ্যেই আধমরা হয়ে শুয়ে রইল। আমি দেখলাম, ছুটে পালাতে হবে। ওখানে সব মনোহরপুকুর রোডের বস্তির লোকজন থাকে, আমি জানতাম, এরা একেবারে ডেঞ্জারাস। শিশুমঙ্গলের দিকের যে রাস্তাটা, ওটা ধরে ছুটছি। আমার পিছনে পঞ্চাশ-ষাটজন লোক।”
বলতে বলতে সে ঘেমে উঠছে। তখন ভাদ্র মাস। দাবদাহের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে জলীয় বাষ্প। গুমোট পৃথিবীতে বাতাসের শক্তি কমে আসে। গাছের পাতা নড়ে না। পাখার হাওয়াতেও দরদর করে ঘাম গড়ায় শরীর বেয়ে। হরেমামা সেই ঘাম মুছে নেয় হাতের কবজি দিয়ে। পঞ্চাশ-ষাট সংখ্যাটা অতিরঞ্জিত মনে হচ্ছে, তবু আমি আর কথা বলছি না এখন।
ঘাম মুছে নিয়ে হরেমামা বলতে থাকে – “পঞ্চাশ-ষাটজন লোকের সঙ্গে কি আর দৌড়ে পারি? ধরে ফেলল আমাকে। তারপর মার। রাস্তায় ফেলে মারতে শুরু করল। সকলে মিলে মারছে।”
-পঞ্চাশ-ষাটজন লোক তোমাকে মারছে? সেখান থেকে বাঁচলে কীকরে?
-ও না না না। পঞ্চাশ-ষাটজন হবে না, জনা কুড়ি লোক ছিল। পাশের একটা দোতলা বাড়ি থেকে একজন দেখতে পেয়েছিল, সে এসে সকলকে হটিয়ে দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছিল সেবার। হাতের কনুই-টনুই সব কেটে-ছড়ে গিয়েছিল।
-এসব কতদিন আগের ঘটনা?
এই প্রশ্নে কিছুক্ষণ ধরে ভাবে সে। তারপর বলে – “সে অনেককাল। এইট্টি নাইনে খেলা ছেড়েছি, সেই বছরেই বিয়ে করলাম। তার আগেই হবে। বছরটা মনে নেই আর।”
একটা বিষয় জানার কৌতূহল হচ্ছিল। এবার সাহস করে জিজ্ঞাসা করেই ফেলি – “খেলা ছাড়লে কেন?”
মামার গলা শুকনো হয়ে আসে –
“বিয়ে করে ফেলেছি, বউকে তো খাওয়াতে হবে। ঊষার কারখানায় কাজ করতাম। তারপর ঊষার কারখানা ওই এইট্টি নাইনেই বন্ধ হয়ে গেল। খাব কী? তখন আলুর ব্যাবসা শুরু করলাম। এক বন্ধু বলেছিল, আরামের কাজ। মালিকের থেকে আলু নিয়ে বাজারে বসতাম। দিনের শেষে সব হিসাবপত্র মিলিয়ে টাকা ফেরত দিয়ে দিতাম। আমার লাভ হত কুড়ি-পঁচিশ টাকা। তারপর সে আলুর ব্যাবসায় আর কুলোল না। তখন গাড়ি চালানো ধরলাম। ড্রাইভারিটা শিখেছিলাম। আমার বন্ধু একদিন বড়ো রাস্তায় নিয়ে গেল আমাকে। আমি তার আগে বড়ো রাস্তায় যাইনি। সেই ড্রাইভারিই এখনও করে যাচ্ছি। ওই করেই খাচ্ছি। এসব করেই আর ফুটবল হল না।”
ততক্ষণে চ্যানেলের ধোপদুরস্ত অতিথিরা তখন চিৎকার করে ভরিয়ে তুলেছে স্টুডিও।
Powered by Froala Editor