বিবেকানন্দ ব্যায়ামাগারের চত্বরে হরেমামা বসে গল্প করছিল। টিভি চলছে না, ফলে সংবাদমাধ্যমের প্রাত্যহিক তর্কাতর্কির উৎপাত বন্ধ।
হরেমামার জন্ম থেকে আজকের প্রৌঢ়ত্ব, সবই এই ঊষা অঞ্চলেই। একসময়ে ঊষার কারখানাতেই সে কাজ করত। বাংলায় একটা অদ্ভুত টান লক্ষ করেছি। জিজ্ঞাসা করলাম – “তোমার এমনিতে দেশ কোথায় ছিল?”
মামা তালের বড়া খাচ্ছিল। খেতে খেতে উত্তর দিল – “বাবা-মায়ের দেশ ছিল বরিশালে। বাংলাদেশে।”
মনে মনে ভাবি, বরিশাল চিরকাল মামাদের কাছে ‘বাবা-মায়ের দেশ’ হয়েই থেকে যাবে, ‘আমাদের দেশ’ হয়ে উঠবে না।
আরও পড়ুন
‘পঞ্চপাণ্ডবের রথের চাকার দাগ দেখছি, তেড়ে এল ভালুক’
ব্যায়ামাগার তৈরি হয়েছে ১৯৫৯-এ। হরেমামার জন্ম তার কিছু বছর পরেই। তাদের ছেলেবেলায় ক্লাবের পাকা ঘর ছিল না। দরমার বেড়া দেওয়া থাকত। হরেমামারা এখানে ব্যায়াম করত, মাঠে ফুটবল খেলত। আরও নানা দস্যিপনা করত। নিজেই বলে – “বিশাল চেহারা ছিল আমার। সকাল-বিকেল বাড়ি থেকে পালাতাম। আমার কী নেশা ছিল জানো, নারকেল গাছে উঠে ডাব-নারকেল পাড়া। পুরো গাছ-বাঁদর ছিলাম আমি।”
যে মাঠে ফুটবল অনুশীলন হত, সে মাঠ আমি রোজ দেখতে পাই আমার অফিসঘর থেকে। আয়তনে বিশাল। সন্ধের পরে ফুরফুরে হাওয়া ভেসে আসে ওদিক থেকে। ঊষা কোম্পানির নিজস্ব জায়গা, লোকেমুখে তাই নামই হয়ে গেছে ঊষার মাঠ। সন্ধের পর সেভাবে লোক চলাচল থাকে না, শুনেছি, ১৪৪ ধারা জারি আছে।
ঊষার মাঠের চারধারে গাছপালার ঘন আচ্ছাদন। হরেমামাদের ছোটোবেলায় গাছের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই বেশি ছিল। অনেকটা এলাকা জুড়ে বিরাট বিরাট আম-কাঁঠাল-নারকেল-খেজুরের গাছ। মাঠে ফুটবল খেলা, আর খেলার ফাঁকে গাছে চড়ে ফলাহার। সেসব গাছের অলিখিত মালিকানা নিয়ে ফেলেছিল আজন্ম-দস্যি, বেপরোয়া, সুঠাম চেহারার হরিশঙ্কর দাস। যখন ইচ্ছে, তখনই গাছে চড়ে ফল খাওয়া কিংবা লম্বা ঘুম। তাকে রোখার সাহস এ তল্লাটে কারও ছিল না।
কিন্তু, ওই ডাব পাড়তে গিয়েই একদিন এক কাণ্ড। সেদিন হরিশঙ্কর দাস সত্যিই ভয় পেয়েছিল।
এই গল্পটা যেদিন হচ্ছিল, সেদিন রবিবার। তখন সন্ধেবেলা। ভারী বৃষ্টি হয়ে গেছে তার আগেই। তেলেভাজার দোকানে বাঙালিয়ানার ভিড়। তালের বড়া শেষ করে এক ঠোঙা করে তেলেভাজা-মুড়ি নিয়ে আমরা হরেমামার গল্প শুনব বলে গুছিয়ে বসেছি। গল্পটা শুরু করতে যাবে, তখনই একটা ফোন আসে তার। সে এখন গাড়ির ড্রাইভারি করে, সেই সংক্রান্ত ফোন। ফোন রাখা হলে আমিও তার কাজের ব্যাপারে দু-একটা প্রশ্ন করি। একজন চেনা-জানা ড্রাইভার হাতে থাকলে বড়ো সুবিধা হয়। কেজো কথা শেষ হলে তাকে মনে করিয়ে দিই গল্পটার কথা।
সে তখন শুরু করে – “আমি সেবার রাতের বেলায় পালিয়ে গেছি। সঙ্গে আমার দুই বন্ধুও ছিল। ঊষার মাঠের ওখানে একটা গাছ থেকে নারকেল পেড়েছি। তিনজনে তিনটে। তারপর সেগুলো নিয়ে গিয়ে উঠেছি ঊষা স্কুলে। স্কুলের বারান্দায় বসে দাঁত দিয়ে ছাড়াচ্ছি। তখন তো দাঁতে লোহার মতো জোর।”
এই পাড়া থেকে ব্রহ্মপুরের দিকে কিছুদূর এগোলেই ঊষার কারখানা। বিশাল জায়গা জুড়ে কারখানা, তার আশেপাশের সমস্ত জমিও তাদেরই। সেখানে কর্মীদের আবাস, ক্যান্টিন, জামাকাপড়ের দোকান। তারই সঙ্গে ঊষা স্কুল। কর্মীদের ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে বানানো। একচালা সারি সারি ঘরে চলত পঠনপাঠন। প্রাইমারি স্কুলই ছিল সেটা। দিনে স্কুল, আর রাতে হরেমামাদের দুঃসাহসের পরীক্ষাকেন্দ্র।
যে সময়ের কথা বলছে মামা, বাজারে তখন ঊষার পাখার একচেটিয়া আধিপত্য। অন্য ব্র্যান্ডের কথা ভাবতেই পারে না কেউ। সেই খ্যাতি কলকাতার গণ্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বাইরেও। উদারবাদী অর্থনীতি-পূর্ববর্তী সেই যুগে নিম্নবিত্ত ঘরে ঊষা কোম্পানিতে চাকরির ব্যাপক সম্মান। এমনকি পাত্রের চাকরি না থাকলেও হবে, বাপ-দাদা যদি ঊষার কর্মী হয়, তাহলেই মেয়েকে পাত্রস্থ করবে বাবা-মা।
তারপর দিন বদলাল। ইউনিয়নের স্বার্থসিদ্ধি জিতে গেল। কর্মী সংখ্যা পড়তির দিকে। একের পর এক কারখানা বন্ধের ইতিহাসে ঊষারও নাম উঠে এল। যদিও এই এলাকার কারখানাটি একবছর বন্ধ থাকার পরই আবার চালু হয়ে গেছিল, কিন্তু আগেকার জৌলুস আর ছিল না। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের ধারে যে চত্বরে এখনকার সাউথ সিটি, সেখানে ছিল ঊষার আরও এক নামকরা প্রোডাক্ট সেলাই মেশিনের কারখানা। জয় ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস। ওই কারখানাটিও পরে এখানে চলে এসেছিল, কিন্তু তারও প্রোডাকশন বন্ধ আজ কত বছর।
আমরা ফিরে যাই সেই স্কুলবাড়ির বারান্দায় ডাব খাওয়ার রাতে। মামাকে জিজ্ঞাসা করলাম – “তখন তোমার কত বয়স ছিল?”
সে উত্তর দিল – “আঠেরো-কুড়ি হবে। রাত দেড়টা বেজে গেছে তখন।”
সময় শুনে চোখ কপালে উঠে গেল আমার। এই ভাব দেখে মামা বলল – “এটা এমন কিছুই নয়। ঊষার মাঠের ওখানে প্রায় গোটা পঞ্চাশেক আমের গাছ ছিল। সেখানে কতদিন সারারাত শুয়ে থেকেছি।”
তারপর কিছুক্ষণ থেমে যোগ করল – “সেদিন হেবি বৃষ্টি। আমরা বারান্দায় বসে ডাব খাচ্ছি। তখন রাত প্রায় সাড়ে তিনটে হবে, হঠাৎ দেখি, একটা বুড়ি, সাদা ঘোমটা টানা, কোথাও যাচ্ছে। প্রথমে অতটা গুরুত্ব দিইনি। তারপরে ভাবলাম, দেখি তো কোথায় যাচ্ছে। ওখানে একটা টিউকল ছিল, সেদিকেই হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিল। এগিয়ে গেছি, বললে বিশ্বাস করবে না, বুড়িটা আমার থেকে দশ মিটার দূরত্বে ছিল। কিছুক্ষণ পরেই দেখি, আর নেই।”
অবিশ্বাস্যই মনে হচ্ছে, তবু আবহ-নষ্টের কথা ভেবে কিছু বললাম না। আমার মতোই হরেমামাও নাকি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি। সেও ভেবেছিল, চোখের ভুলই হবে। কিন্তু অতিপ্রাকৃতের টান নেশার মতো, সাহসী মানুষকেও সে নেশা কাবু করে ফেলে, তার কৌতূহল সীমা ছাড়িয়ে যায়। হরেমামার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। সে বলছে – “মন থেকে খটকাটা গেল না। ভাবলাম, আরেকটু খুঁজি। কিছুক্ষণ পরে, ওখানে একটা শিবমন্দির ছিল, এখন আর নেই, সেখানে আবার দেখলাম বুড়িটাকে। আবার ওর দিকে এগোচ্ছি, কিছুক্ষণ পরেই দেখি, আর নেই। পুরোপুরি গায়েব। এই নিয়ে দু’বার এরকম হল।”
এমন ঘটনা সবসময়ে একাধিক বারই ঘটে থাকে বলে শুনি। বস্তুত, একবার মাত্র ঘটলে তাকে মনের ভুল হিসেবে উড়িয়ে দেওয়াই মানুষের ধর্ম। তাই বুঝি পঞ্চেন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা জগত অন্তত দু-তিনবার তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে যায়। ভাষা-সংস্কৃতি নির্বিশেষে পৃথিবীতে অলৌকিকতা নিয়ে যত গল্প-উপন্যাস-ছায়াছবি তৈরি হয়েছে, সবখানেই এই এক রীতি।
সুতরাং, হরেমামাও সেই বুড়িকে দু’বার দেখে ফেলল। দু’বারই সে তাকে ফাঁকি দিয়ে মিলিয়ে গেল হাওয়ায়।
অবশ্য এখানেই দর্শন-পর্বের সমাপ্তি নয়। আরও একবার সে দেখেছিল বুড়িকে। ঊষা মাঠের ওখানে নেপালী দারোয়ানদের কোয়ার্টার ছিল। হরেমামারা তাকে নেপালী কোয়ার্টার বলত। সেই নেপালী কোয়ার্টারের ওখানেও বুড়িকে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এবারও হাওয়ায় মিলিয়ে যায় সে। দুই পৃথিবীর মধ্যে কোনোরকম যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ সে হরিশঙ্কর দাসকে দেয়নি।
আমি প্রশ্ন করি – “নেপালী দারোয়ান মানে যারা ঊষা ফ্যাক্টরিতে কাজ করত?” বন্ধু সৌমেন্দুর মুখে জনৈক বাহাদুরের কথা শুনতাম ছোটোবেলায়। বাহাদুরের সঙ্গে তার বেশ সখ্য ছিল।
মামা বলল – “হ্যাঁ, যারা ফ্যাক্টরির দারোয়ান ছিল, তারা থাকত ওই কোয়ার্টারে।”
ঊষার স্কুলটা চিনি। অনেক কিছুর মতো ওই স্কুলও কবেই বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু চালাঘরগুলো রয়েছে, আলো জ্বালিয়ে রাখা হয়। স্কুলের পাশে আরও একটা মাঠ, সেই মাঠের এপাশে এক সময়ের স্টাফ কোয়ার্টার। মাঝেমধ্যেই নির্জনতা উপভোগ করতে সন্ধের সময়ে চলে গেছি ওই চত্বরে। এখন পরিত্যক্ত। আবাসের মজবুত কাঠামোগুলো কোনোক্রমে টিকে আছে, এদিক-ওদিক থেকে গজিয়ে উঠেছে বট-অশ্বত্থের যৌথ সংসার। ঊষার স্কুলে আলো জ্বললেও ওই পরিত্যক্ত চত্বরে আলোর ব্যবস্থাও করেনি কেউ। সন্ধে নামলে ওদিকে আর জনমনিষ্যির পা পড়ে না।
ওখানেই সেই কতদিন আগে হরেমামা ভূত দেখেছিল। অথচ, তখন চারিদিকে কত লোক, হইহই অবস্থা। ভূতের সাহস আছে বলতে হবে।
শেষে কী হল জানতে চাইলে মামা বলল – “পরদিন সকালে ওখানকার লোকজনকে বলেছি। ওরা বলল, সাদা শাড়ি পরা তো? ও অনেকেই দেখেছে। তারপরে আমায় কী বলল, জানো? বলল, তুই যদি ভয় পেতিস, তাহলে তোর অবস্থা খারাপ করে দিত। আমার তো তখন ভয় বলে জিনিস ছিল না শরীরে। সেইজন্যে কিছু করতে পারেনি।”
মাথার উপরে ব্যায়ামাগারের আলো ঝলমল করছে, সামনের দোকানে বর্ণালীদি যত্ন করে চপ ভেজে চলেছে, সেখানে বাদলা রবিবারের ভিড়, এসবের মাঝেই কল্পনা করি দৃশ্যটা। চারিদিক অন্ধকার, তার মাঝে একা সাদা শাড়ি পরে হেঁটে চলেছে কেউ, থেকে থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় সে। ভয় পেলেই সে জীবন্ত মানুষের অবস্থা খারাপ করে দেবে।
অর্থাৎ, নিজের নিয়মে চালনা করবে বর্তমানকে।
আচ্ছা, সব ভূতই কি এমন হয়? এমন ফ্যাসিস্ট-মার্কা?
অলংকরণ - অমর্ত্য খামরুই
Powered by Froala Editor