‘ছেলেটার নামই হয়ে গেল ডেডবডি’

“আমাদের খালের দু’পাড়ের রাস্তা একসময় কাঁচা ছিল জানো?”

একটা বিড়ি ধরিয়ে প্রশ্নটা আমাকে করলেন হরিশঙ্কর দাস, তার হাতে চায়ের কাপ।

তখন নভেম্বর মাস পড়ে গিয়েছে। হাওয়ায় শীতের টান। হাত-পায়ের চামড়ায় শুকনো ভাব। দুর্গা, কালীর পাট চুকে গিয়ে জগদ্ধাত্রীর পর্বও সম্পন্ন হয়ে গেল। বিধানপল্লীর ‘আমরা সবাই’ ক্লাবে সেদিন রাতে খিচূড়ি-ভোজনের পাত পড়েছে। এরপর যাঁর আসার কথা, অর্থাৎ, অন্নপূর্ণা বা বাসন্তী, তিনি যদ্দিনে আসবেন, তদ্দিনে আমরা আবার ঘাম জবজবে দিনে ফিরে যাব। 

বিবেকানন্দ ব্যায়ামাগারের চত্বর ফাঁকা। মামা আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই। উৎসব শেষের মনকেমন। কালো বোর্ডটায় কয়েক সপ্তাহের পুরনো সভ্যদের মিটিংয়ের খবরটা রয়েছে এখনও। আর আনন্দের রেশ বলতে যেটুকু পড়ে আছে, তা একপাশে টাঙানো হলুদ রঙের ফ্লেক্সে। সপ্তাহের শেষেই ক্লাবে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন হয়েছে, তারই প্রচার। 

টেলিভিশনে স্থানীয় কেবিল নেটওয়ার্কের চ্যানেলে একটা পুরনো বাংলা ছবি চলছিল, সেটা আমার আগে কয়েকবার দেখা। ‘আত্মীয়স্বজন’। রাজা সেনের ছবি। যৌথ পরিবারের কাহিনি। ভাই-বোনদের মধ্যে ভাঙনের উপসর্গ সুস্পষ্ট, সম্পর্কের চেয়েও বারবার মুখ্য হয়ে উঠছে অর্থনৈতিক জোর, স্টেটাস বজায় রাখার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, সেই অবক্ষয়ী দুনিয়াতে অবস্থায় বাবা-মায়ের অবস্থান কীরকম হওয়া উচিত, তেমন এক বক্তব্য ছিল ছবিটাতে। নয়ের দশকের বাংলা ছবির ‘টিপিক্যাল ফ্যামিলি ড্রামা’-র যে ঢং, তার বাইরে বেরিয়ে গল্প এবং নির্মাণ নিয়ে যথেষ্ট পরীক্ষানিরীক্ষাও ছিল। 

আমি যে মুহূর্তে উপস্থিত হলাম, সেই মুহূর্তে বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে ছোটো ছেলের বাড়ি ছাড়ার বিষয়টি নিয়ে শীতল আলোচনা চলছে। ব্যাপারটা খোলসা করে বলতে গিয়ে ছেলের যে অস্বস্তি, তা চোখ এড়ায় না বাবার। এক বাড়িতে থেকেও বাবাকে সে যেভাবে ‘তুমি কেমন আছ?’ জিজ্ঞাসা করে, তাতেই পরিষ্কার হয়ে যায় দুই প্রজন্মের পারস্পরিক ব্যক্তি-সংঘাত। 

ছোটো ছেলে শেষপর্যন্ত আবহাওয়া হালকা করতে মাংস খাওয়ানোর কথা পাড়ে, সঙ্গে সঙ্গে বাবা মনে করিয়ে দেন – “তুমি যখনই মাংস খাওয়াবার প্রস্তাব দিয়েছ, তখনই বুঝেছি তোমার নিজস্ব কোনও কথা আছে। আগেও তো দুবার সারা পরিবারকে মাংস খাইয়েছ। যেমন, যখন তোমার বিবাহের সংবাদ দিলে, রেজিস্ট্রি করবার পর বলেছিলে এবং সবাইকে মাংস খাইয়েছিলে।”

বাবার সামনে কপটতার নগ্ন চেহারাটা প্রকাশ হয়ে পড়াটা ছেলের সহ্য হয় না, সে তাই পাল্টা বাবাকেই দোষারোপ করতে চায় – “নিজস্ব কথা আবার কী! বাবা, তুমি না কেমন সিনিক হয়ে যাচ্ছ! একটা আলোচনা করার ছিল।”

বাবা বুদ্ধদেবের ভূমিকায় ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং ছোটো ছেলে সুদেবের চরিত্রটা করেছিলেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একবার মামার গাড়িতে উঠেছিলেন, একইদিনে দুবার। সেকথা শুনেছি স্বয়ং চালকের কাছেই।

‘আত্মীয়স্বজন’ নয়ের দশকের শেষ দিকের ছবি। ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন পড়ে গেছে, খোলা বাজার অর্থনীতি এসে বদলে দিয়েছে শিল্পনির্মাণের দৃষ্টিভঙ্গি, জ্যোতি বসু নোকিয়া কোম্পানির মোবাইল হ্যান্ডসেট কানে লাগিয়ে ‘হ্যালো’ বলে দিয়েছেন, আফগানিস্তানে তালিবান শাসন কায়েম হয়ে গেছে, অ্যাপল কোম্পানি লঞ্চ করছে সর্বজন-সাশ্রয়ী আইম্যাক জি৩। এরকম এক অদ্ভুত জগাখিচূড়ির মাঝে পুরনো সামাজিক পরিকাঠামো হাঁসফাঁস করছে। ছবির গল্প জুড়ে সেই হাঁসফাঁসানি। 

হরেমামাদের চেনা জগতটাও বদলে যাচ্ছিল আস্তে আস্তে। 

সেই চেনা জগতে আসলে কী ছিল? ছিল খালপাড়ের ওই কাঁচা রাস্তা, যেখানে সন্ধের পরেই লোক চলাচল আসত কমে। ছিল মস্তানদের দাপট। আর ছিল পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, যে ফাঁকফোকরের অজুহাতে মাঝেমধ্যেই পড়ে থাকত দু-একটা লাশ। 

আজকের আগে এসব আমার জানা ছিল না। 

কাঁচা রাস্তা-সংক্রান্ত প্রশ্নটার জবাবে আমার ‘না’ শুনে হরেমামা বলল – “এসব পাকা রাস্তা তখন কোথায়! কাঁচা মাটির রাস্তা ছিল, আর খালে জানো তো, এই কয়েক হাত লম্বা চড়া পড়ে যেত।”

তারপরে যোগ করল – “ওই রাস্তায় একবার এক কাণ্ড করেছিলাম, বুঝলে তো?”

-কী কাণ্ড?

-তোমায় তো বললামই যে তখন মাঝেমধ্যেই ওখানে ডেডবডি পড়ে থাকত। সন্ধের পরে ওদিক দিয়ে আর কেউ যেত না। কিন্তু আমার তো ভয়ডর বলে কোনও জিনিস ছিল না। আমি একদিন দিনের বেলায় চিৎপাত হয়ে ওই রাস্তার ওপরে মড়ার মতো নিঃশ্বাস বন্ধ করে পড়ে ছিলাম। 

-তারপর?

-তারপর আর কী! এপাশ দিয়ে লোকজন যেতে গিয়ে দেখে, কে একজন পড়ে আছে। ব্যস, দূর থেকে ওই দৃশ্য দেখেই তাদের হয়ে গেছে, আর কেউ এগোচ্ছে না। আবার ওপাশ দিয়েও লোকজন আসছে, তারাও দেখে আর কাছে ঘেঁষেনি। ‘ডেডবডি পড়ে আছে, ডেডবডি পড়ে আছে’ বলতে বলতে সব ছুটে পালিয়ে গেছে। আরও লোকজন ডেকে নিয়ে আসবে। আসলে, প্রায়ই মার্ডার হত তো, মানুষের মনে ভয় ঢুকে গেছিল। তাই কাছে এসে ভালো করে দেখার সাহস পায়নি।

তার কথা শুনছি আর হাসছি। আরও হাসি পেল শেষটুকু শুনে। 

“দুদিকের লোকজন যেই ভেগেছে, আমি সেই ফাঁকে উঠে পড়েছি। তারপর যেন কিছুই হয়নি, এমন মুখ করে পাড়ায় ঢুকে গেছি। অলিগলি তো সব চেনা ছিল, কেউ দেখতেও পায়নি। তারপরে যারা লোকজন ডাকতে এসেছিল ‘ডেডবডি’ দেখাবে বলে, তাদের সঙ্গেই ওখানে আবার গেছি। কেউ নেই দেখে সবাই তো অবাক। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে – “এক্ষুনি তো এখানে লাশ পড়ে ছিল! এর মধ্যে কোথায় গেল!” আমিও তাদের সঙ্গে সেসব কথায় যোগ দিয়েছি। তারপর ওদের সঙ্গেই আবার ফিরে এলাম। কেউ কিচ্ছু টের পেল না।”

টেলিভিশনের পর্দায় তখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়েছে। তাদের এই ঝগড়ার মাঝে নিস্ফল মধ্যস্থতা করে যায় একটি কলেজপড়ুয়া, প্রাণবন্ত মেয়ে। সম্পর্কে মেয়েটির ছোটো পিসি-পিসেমশাই তারা। 

বাবুদা সেই মুহূর্তে সেখানে এসে উপস্থিত। টিভির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল – “এটা তো টেলিফিল্ম। অনেকবার দেখেছি।”

আমি বললাম – “না না। ‘আত্মীয়স্বজন’ টেলিফিল্ম নয়, হলে রিলিজ করেছিল।”

একথা শুনে আরও কিছুক্ষণ সে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া তখন চরমে পৌঁছেছে, ক্রমশ অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে তাদের ব্যক্তি-আক্রমণের ভাষা। বাবুদার চোখেমুখে জিজ্ঞাসা। এ ছবিটা কি তাহলে সে যেটার কথা ভেবে ‘টেলিফিল্ম’ বলল, সেটা নয়?

যদিও বেশিক্ষণ ভাবার অবকাশ সে পেল না। মামা তাকে জিজ্ঞাসা করে – “বাবু, তোর অসীমকে মনে আছে?”

বাবুদা ভেবে নিয়ে বলল – “ও, সেই ডেডবডি তো?”

মামা হেসে ফেলে বলে – “হ্যাঁ হ্যাঁ। সে-ই।”

মামার বন্ধু ছিল অসীম। জলট্যাঙ্কের সামনের রাস্তাটা ধরে সোজা চলে গেলে একদম শেষ যে বাড়িটা, সেই বাড়ির ছেলে ছিল সে। কাজ করত মদের ডিলারশিপে। সেই কাজই বোধহয় তার কাল হয়েছিল। অত্যধিক নেশায় ডুবে গিয়ে শেষপর্যন্ত লিভারের অসুখে মৃত্যু। তার আগেই টিবিতে চলে গেছে তার দাদা। তাদের ছোটোভাইটি আত্মহত্যা করেছিল। পাশের পাড়ার এক ধনী পরিবারের মেয়ের প্রেমে পড়ে জীবন শেষ করে দিয়েছিল সে। তাদের খুড়তুতো বোনটিও মারা যায় তাড়াতাড়ি। রাস্তার প্রান্তে ওদের বড়ো বাড়িটায় এখন বাসিন্দা শুধু অসীমের স্ত্রী আর মেয়ে।

হঠাৎ এতদিন পর অসীমের প্রসঙ্গ উঠতে বাবুদা মামাকে জিজ্ঞাসা করে – “অসীমের কথা বললে কেন আজকে?”

-আমার এই ভাগ্নাকে আমার ডেডবডি সেজে শুয়ে থাকার কথা বলছিলাম। সেটা বলতে গিয়েই ওর কথা মনে পড়ল।

-সেটা বলো আমার এই ভাইকে।

বাবুদার কথায় হরিশঙ্কর দাস তাঁর দ্বিতীয় কাহিনিতে ঢুকলেন – “অসীমের দুটো বাড়ি পরেই থাকত আমার আরেকটা বন্ধু, আশীষ। সে-ও মারা গেছে। সে-ও মদ খেত, কিন্তু অসীমের মতো অত নয়। ওদের দুজনেই প্ল্যান করে কাণ্ডটা ঘটিয়েছিল।”

বাবুদাও সায় দেয় তার কথায়। 

মামার বন্ধু, সেই আশীষ ‘ডেঞ্জারাস’ ছেলে ছিল। সর্বক্ষণ বদবুদ্ধি ঘুরছে মাথায়। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে থাকত পাড়া-বেপাড়ার লোকজন। তার অজস্র উপদ্রবের মধ্যে যেটার কথা এখনও লোকের মুখে মুখে ফেরে, সেটা ছিল, ঊষার মাঠের পাশের শিবমন্দিরে গিয়ে শিবলিঙ্গের মাথায় পেচ্ছাপ করে আসা। কুকীর্তিটি করে এসে আশীষ বলেছিল, শিবের মাথায় জল ঢেলে এলাম। 

মামা বলে – “তারপরে কী হল, জানো? ওর সারা পা-হাতে মাছের আঁশের মতো চাকা চাকা দাগ বেরোল, পা ফুলে গোদ হয়ে গেল। অনেকদিন ভুগেছিল। আরে, ঠাকুরের একটা জোর নেই?”

যতই ডাকাবুকো হোক, ভূত-প্রেত-দেবতা এসব বিষয়ে মামার বিশ্বাস এবং ভয় দুইই সমপরিমাণে আছে। ঊষার মাঠের চারপাশে বন-জঙ্গল, সেসময় তো আরোই ঘন ছিল তা। হাজার না হোক, শতাধিক পোকামাকড়ের আবাসস্থল ওই জায়গা। তাদের মধ্যে কোন মশা বা মাছিটি ফাইলিরিডিদের বহন করছে, সে খবর কে রাখে! কিন্তু মামাদের আজীবনের ওই বিশ্বাস, তাকে খণ্ডানোর সাধ্যি কার!

-ওই আশীষের মাথা থেকেই বেরিয়েছিল এসব। অসীমের চেহারা তো ছিল ছোটোখাটো। ওকে একটা বস্তার মধ্যে পুরে লোকের বাড়ির সামনে রেখে দিয়ে আসত, তারপরে দরজায় ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যেত। লোকে দরজা খুলে বেরিয়ে দেখছে, একটা বস্তা পড়ে আছে, তার মধ্যে একটা মানুষ শুয়ে আছে। তারপরে ভয়ে ভয়ে বস্তা খুললেই অসীম বেরিয়ে আসত, বেরিয়েই দে দৌড়। 

শেষটুকু বলতে বলতে মামা হেসে উঠল। দৃশ্যটা কল্পনা করে আর মামার বলার কায়দার অভিঘাতে হো-হো করে হেসে উঠলাম আমিও। 

আমাদের হাসির রেশ মিলিয়ে আসতে মামা বলল – “সেই থেকে অসীম বলে ছেলেটার নামই হয়ে গেল ডেডবডি।”

তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল – “ডেডবডি সত্যি সত্যিই একদিন ডেডবডি হয়ে গেল। মদ খেয়ে খেয়ে শেষ হয়ে গেল ছেলেটা! নয়তো ওটা কি একটা যাওয়ার বয়স?”

টেলিভিশনের পর্দায় বুদ্ধদেব চৌধুরী তখন জানাচ্ছেন তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামী বন্ধুর সদ্যপ্রয়াণের খবর। ১৭৩ জন চেনা বন্ধু-পরিজনদের নাম-ঠিকানার তালিকা-ভর্তি খাতা থেকে সেই বন্ধুর নামটা কিছুক্ষণ আগেই ঢ্যারা দিয়ে কেটে দিয়েছেন তিনি।

মামার দিকে তাকালাম। সে-ও বুদ্ধদেব চৌধুরীকে শুনছে।

মামারও কি অমন একটা খাতা নেই?

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More