‘সুর কী সর্বনাশা’!

শ্রুতিমধুর – ২

আগের পর্বে

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। কবিতা, নাটক, গান সবকিছুই ছুঁয়ে গেছেন গভীরভাবে। তাঁর গান ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ সবাই-ই শিখেছে একদম ছোট্টবয়সেই। অথচ এই গানটি গাওয়ার ক্ষেত্রেই কিছু ভ্রান্তি রয়ে গেছে। ‘ধান্যে’ আর ‘পুষ্পে’ গাইলেও ‘ধনে’ বলা হয় না। এই এ-কারগুলো কেবলই কি বাহুল্য? দ্বিতীয়ত ‘উজল ধারা’-তে ‘ধারা’ বলতে রকম বা ধরণ বোঝানো হয়েছে। মূল কথাটি হল ‘কোথায় উজল এমন ধারা’। এই স্তবকের আরও একটি লাইন বিভ্রান্তিকর। তা হল ‘তার পাখীর ডাকে ঘুমিয়ে, উঠি পাখীর ডাকে জেগে’। এখানে ‘উঠি’ শব্দটা অসমাপিকা ক্রিয়া হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকমভাবে গানটি করেন।

গানদুনিয়ার ‘জুটি’ বলতে প্রথমেই কী মনে পড়ে? কল্পনার গুপি-বাঘা? নাকি বাস্তবের যতীন-ললিত? শঙ্কর-জয়কিষেণ? শিব-হরি? অনেক নামই মনে পড়তে পারে। কিন্তু এই বাংলার অন্যরকম এক জুটির গল্প বলি, যাঁদের হয়ত ততটা মনে রাখিনি আমরা। গত সপ্তাহেই গেছে বন্ধুতার দিন। তাই, আজ দুই বন্ধুর কথা।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপকুমার রায়ের একটা অসামান্য কম্পোজিশন আছে, যার নাম ‘এ যে কোন্ কর্মনাশা’। ডাকনাম শুধু ‘কর্মনাশা’। কেবল কম্পোজিশনই বললাম, কারণ গানটির গীতিকার দিলীপকুমার রায়ের অন্তরঙ্গ বন্ধু নিশিকান্ত রায়চৌধুরী। নিশিকান্ত-দিলীপকুমার জুটির এই গানটি নিয়েই আজকের কথা।

এ-গানটির বিষয়ও গান। গানখ্যাপাদের আত্মজৈবনিক উচ্চারণ বলা যায় তাকে। গানটির কথাকার নিশিকান্ত রবীন্দ্রনাথের আদরের ‘চাঁদকবি’। ঝাঁকড়া চুলের স্কুল-পালানো পাগলাটে ছেলে, বেশিরভাগ সময়েই যাকে পাওয়া যেত বাইরে মাঠেঘাটে; সন্দেশ-জিলিপি-তালের বড়া ইত্যাদির আয়োজন থাকলেই যাকে তাড়াতাড়ি ডেকে নিতেন রবীন্দ্রনাথ; বিশ্বভারতীর হিন্দি ভবনের মূল হোতা সুধাকান্ত রায়চৌধুরী ওরফে রবীন্দ্রনাথের ‘সুধোড়িয়া’-র ছোট ভাই সেই নিশিকান্ত। যে নিশিকান্ত ‘টুকরি’-র লেখক। যে নিশিকান্ত ‘কলাভবনের জাতীয় সঙ্গীত’-এর লেখক। এবং যে নিশিকান্ত অরবিন্দর স্নেহচ্ছায়ায় অজস্র ভক্তিগীতির লেখক। এই তিন নিশিকান্ত একজনই, আবার একজনমাত্র নন। চেতনার বিবর্তনের বাঁক পেরিয়ে ওই শেষ পর্যায়টিতে তাঁর আসা। 

শান্তিনিকেতনে কৈশোর থেকে যৌবনের একটা সময় থেকেছিলেন নিশিকান্ত, রবীন্দ্রনাথের নিবিড় সান্নিধ্যে, দিনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথ-নন্দলালদের প্রশ্রয়ে। সেখানে থাকাকালেই শ্রীঅরবিন্দের লেখালেখি তাঁকে টেনেছিল। ‘আর্য্য’ পত্রিকা পেয়ে পড়তেও আরম্ভ করেছিলেন। শ্রীঅরবিন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণ, মহাত্মা গান্ধী, কাউকেই আগ্রহের নিশানা থেকে বাদ দেননি তিনি। তবে অরবিন্দের প্রভাব নিশ্চয়ই তাঁর ওপর অন্যরকম ছিল। যে কারণে ১৯৩৪ সালে, ২৫ বছর বয়সে, শান্তিনিকেতনের পাট চুকিয়ে, সাংসারিকতার সম্ভাবনাকে সরিয়ে, ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যৎ এড়িয়ে তিনি চলে যান পণ্ডিচেরি, অরবিন্দ আশ্রমে। দিলীপকুমার, রবীন্দ্রনাথের স্নেহের মন্টুকে আগেই একটু একটু চিনতেন নিশিকান্ত, কিন্তু পণ্ডিচেরি-পর্যায়ে তাঁদের এক নিবিড় বন্ধুতা হয়। অসমবয়সি বন্ধুতা। দিলীপকুমারের থেকে বয়সে বারো বছরের ছোট ছিলেন নিশিকান্ত। নিশিকান্তর এই গান ‘কর্মনাশা’ লেখা হয়েছিল দিলীপকুমারকে নিয়েই।

আরও পড়ুন
‘ধন ধান্য’ : ভুলে ভরা

১৯৩৪-এ পণ্ডিচেরি গিয়ে অরবিন্দ আশ্রমে প্রথমেই জায়গা পাননি নিশিকান্ত। সাধক হবার জন্যে আগে তো যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হবে। হোটেলের খুপরি ঘরে ছোট স্টোভে চালডাল ফুটিয়ে খেয়েই প্রস্তুত হচ্ছিলেন। পূর্বপরিচিত দিলীপকুমারের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পর দিলীপই তাঁকে রাজি করান নিজের বাড়িতে অন্তত সারাদিনটুকু থাকার জন্যে। অরবিন্দের ‘আদুরে ছেলে’ দিলীপ তো ১৯২৮ থেকেই পণ্ডিচেরিতে। সেই তাঁদের বন্ধুতাযাপন শুরু। আশ্রমে ঠাঁই মেলার পর যৌথতার পরিসর বাড়ে। আর নিশিকান্তর গান লেখার ক্ষমতা একটু একটু করে প্রকাশ পায়। ‘অধরা দিল ধরা এ ধূলার ধরণীতে’ দিয়ে শুরু হয়ে একের পর এক নিশিকান্ত-দিলীপ জুটির গান তৈরি হতে থাকে। দিলীপকুমার নিজেও সুকবি, কিন্তু নিশিকান্তর লেখাগুলো সত্যিসত্যিই ‘কাব্যগীতি’-র চমৎকার উপাদান হয়ে উঠছিল। সেই পর্বেরই গান এটি। এক গানপাগল বন্ধুকে ভেবে আরেক গানপাগল বন্ধুর লেখা। দিলীপকুমার সারাদিন ধরে এত গান শোনাতেন, গানের গল্প বলতেন, সুরের বৈচিত্র্যবিশ্লেষণ করতেন, নিশিকান্তর আর কোনো কাজ করা হত না। তাই দিলীপের নাম দিয়েছিলেন ‘কর্মনাশা’। তাঁকে উদ্দেশ করে লিখলেন-

এ যে কোন্‌ কর্মনাশা গানের ভ্রমর মর্মেতে মোর বাঁধল বাসা?
সে যে গো দিনেরাতে সকাল সাঁঝে, গান করে আর আমায় গাওয়ায়,
থামায় না গান, থামে না যে,
তারি সেই সুর শুনে মোর মন লাগে না, এ সংসারের কোনোই কাজে।
বুঝি বা বিফল হবে এই তোমাদের কাজের ভবে আমার এ গান গাইতে আসা।

গানের নেশা কাজ ভুলিয়ে দেয়, গোটা গান জুড়ে সেই বিরোধসম্বন্ধই উচ্চারিত। এই বিরোধ নিয়ে আছে একটু আক্ষেপ কিংবা হতাশার এক ভানও। এখানে দিলীপকুমারই হলেন সেই ‘গানের ভ্রমর’, যার গুঞ্জনে সব কাজ পণ্ড হয়ে যায়। আর কথক নিশিকান্ত। দিলীপকুমারের মত গানপাগলের পাগলামি বোঝার জন্যে নিশিকান্তর মতো আরেক উন্মাদের প্রয়োজন ছিল। উন্মাদই তো - প্রাণে, গানে, ভাবে, ধ্যানে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি, দুর্দান্ত ছবি আঁকতেন, তাও এগিয়ে নিয়ে যাননি। যে ঘোর তাঁকে টেনেছিল, শেষমেশ তারই জন্যে ছেড়ে দিয়েছেন আগে থেকে জমতে থাকা যাবতীয় সম্ভাবনা। সংসারের হাট, নিয়মমাফিক জীবনব্যবসা কিছুই তাঁকে আকৃষ্ট করেনি।

নিশিকান্তকে সঙ্গে নিয়ে দিলীপকুমারের এই পর্যায়ের গানগুলির কাঠামো তাঁর প্রথম পর্যায়ের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতনির্ভর গানের থেকে বেশ আলাদা। সরল দাদরায় বাঁধা গান, চলনে বাউলের ছাপ আছে। কিন্তু, ‘দৈলিপী ঢং’-এর প্রভাব যাবে কোথায়! কবীর সুমন দিলীপকুমারের গান নিয়ে যে অব্যর্থ চিত্রকল্প তাঁর গানে তৈরি করেছিলেন, তা এই গান সম্পর্কেও প্রযোজ্য। ওই তিন-তিন ছকে সুরের এক ‘হন্তদন্ত’ অবস্থা করেছেন দিলীপকুমার। বাউলাঙ্গের গানে আপাতভাবে অতিরিক্ত সুরকারিগরি হয়ত প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্যই ছিল বাউলাঙ্গের গানের প্রচলিত অতিসারল্যের অভ্যেসকে টপকে ‘বাউলে সুরের ঐশ্বর্য’ আনা। স্বরলিপির শেষে তিনি বলছেন-

“বাউলে সুরের ঐশ্বর্য আনার বাধা নেই—যাঁরা বলেন এতে বাউলের ক্ষতি হয়, অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে তাঁদের গলায় তানাদির ক্ষমতা একেবারেই নেই—যার জন্য তাঁরা অক্ষমতাকে বাঁচাতে গিয়ে ঐশ্বর্যকে কটাক্ষ করেন... বস্তুত বাউলে সুরের সমৃদ্ধি না এলে ‘লোকসঙ্গীত লোকসঙ্গীত’ বলে হাজার তারস্বরে জয়ধ্বনি করলেও সে সঙ্গীত সত্যিকার রসোত্তীর্ণ হবে না।”

নিশিকান্ত নিজে তাঁর বীরভূমবাসে বাউলসঙ্গ করেছেন, প্রধানত গানসঙ্গ; কিন্তু বাউলগান লেখেননি। তাঁর বাউলগান লেখায় জোয়ার আসে দিলীপকুমারের প্রভাবেই। এবং যেসব গান লিখছেন, তার কথা-সুরের যৌথ ইমারতেই বাউলগানের সামগ্রিক আবেদন ধরা পড়ছে।

করি না বেচা-কেনা, চুকেছে পাওনা-দেনা, ঘুচেছে বেচা-কেনা,
করি না বেচা-কেনা কোনো হাটে কোনো বাটে কাল কাটে না।

গানের সুর এখানে লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। কিন্তু কেবল কথার দিকে তাকিয়ে দেখুন, সদৃশ শব্দের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। একই শব্দ বা শব্দমালা বারবার ব্যবহার করে দিলীপকুমার আনছেন ‘কথার তান’, ব্যবহার করছেন আখর (বা আঁখর), যা বাংলা কীর্তনের আঙ্গিক থেকে গ্রহণ করেছেন তিনি। এতে কী হবে? একই শব্দগুচ্ছ নানা সুরবিন্যাসে গাইলে বৈচিত্র্য তৈরি হবে, আর নানারকম স্বরবিস্তারে পল্লবিত করা যাবে গানের বুনিয়াদি চেহারাকে। এই বিস্তার কিন্তু সুরপ্রধান রাগসঙ্গীতের একটা অভ্যেস। কিন্তু রাগসঙ্গীতের কাব্যগত দৈন্য আর থাকবে না এই কথামালায়। কাব্যগানে অভ্যস্ত কান নেহাত রাগিণীদোলায় সুরঝঙ্কারে চমকাতে বাধ্য হবে না, সে স্পষ্ট শুনবে কথা;- বিমূর্ত সুরের তুলনায় যা তার কাছে অনেক জ্যান্ত। মজাটা হল এই, সেই কথার সিঁড়ি বেয়েই পৌঁছে যেতে হবে সুরের কাছে। যে সুর কেবল রিনরিন করে বেজে যেতে পারে বুকের মধ্যে অনর্গল।

শুনি না কারো কথা, শুধু শুনি অন্তরে গুনগুন করে গো কোন্‌ উদাসী, কোন্‌ সে গুণী (কে অচিন উদাসী)
তারি সেই গুঞ্জনে মোর জীবন হল তারি সুরের সুরধুনী।
চলি তাই বাউল হয়ে, কাজ-ভোলা মোর ছন্দে বয়ে সেই উদাসীর উদাস ভাষা।
কর্মনাশা, গান তার কর্মনাশা,
শোনেনি যে, জানে না সুর কী সর্বনাশা,
ছাড়িয়ে কূলের আশা, সুখের বাসা, বলে সে তরী ভাসা।

গানটা এমনিতে পিলু ভৈরব মেশানো, আর স্বরলিপির শেষে আলাদা করে ‘প্রথম চরণে বৃন্দাবনী সারঙের একটু আমেজ’-এর কথা উল্লেখ করেছেন দিলীপকুমার। ‘প্রথম চরণ’ কোনটি? চরণ, পঙক্তি ও পদ নিয়ে ছান্দসিকদের দীর্ঘ মতপ্রভেদ মাথায় রেখেই বলছি, ‘এ যে কোন্‌ কর্মনাশা’-এটিই গানের প্রথম চরণ। এই ‘চরণে’ বৃন্দাবনী সারঙ-এর আভাস পাওয়া যাবে বিশেষত ‘কর্মনাশা’ শব্দটুকুতে। পাঠককে আমি জোর করে এখন বৃন্দাবনী সারঙের শুকনো পাঠ দেব না। একটু সোজা করে বলছি। আচ্ছা, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘নিঙাড়িয়া নীল শাড়ি’ শুনতে তো অসুবিধে নেই? একবার ওই ‘শ্রীমতী চলে’-র টানটা মনে করে দেখুন, ওই সুরটি বৃন্দাবনী সারঙের বিশেষ লক্ষণ। সমস্ত রাগরাগিণীর একটা করে এমন অংশ থাকে, যা এক ঝলক শুনেই তাকে চেনা যায়। একে বলে ‘পকড়’। ব্যাকরণগতভাবে বৃন্দাবনী সারঙের পকড় অন্য, কিন্তু এই রাগের আধারে তৈরি হওয়া প্রায় সমস্ত গানে অবধারিতভাবেই থেকে যায় কোমল নিষাদে জোরে আঘাত করে মধ্যম অথবা পঞ্চম অব্দি তোলা একটি ঢেউ। তাই ওই ‘শ্রীমতী চলে’-র স্বরমালা প্রায় একইরকমভাবে আমাদের গানে ‘কর্মনাশা’-তেও রয়েছে। কর্‌-ম-না-শা গাওয়া হবে ণ-ম-প-স (কোমল নি- মীড়ে পা ছুঁয়ে যাওয়া শুদ্ধ মা -পা- তারসপ্তকের সা)—এভাবে। একই সুর হবে ‘গাইতে আসা’ আর ‘উদাস ভাষা’-তেও। স্বরলিপিতে স্পষ্ট করে এই স্বরগুলির উল্লেখ আছে।

খুব আশ্চর্যের বিষয়, আপাতত ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে অন্য গায়কদের গাওয়া এ গানের যে ক’টি রেকর্ড ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে, তার প্রায় কোনোটিতেই প্রথম চরণে এই আমেজ নেই। দিলীপকুমার রায়ের স্বকণ্ঠে গীত রেকর্ড আছে, সম্ভবত ১৯৩৭ সালের, সেখানে অবশ্যই আমেজ ষোল আনা। কিন্তু সেই রেকর্ডে সম্পূর্ণ গানটি নেই, শেষ স্তবকটি বাদ। কবীর সুমনের মঞ্চানুষ্ঠানে গানটি শোনার সৌভাগ্য হয়েছে, দিলীপকুমার রায়-কৃত স্বরলিপির অবিকল অনুসরণ করেছেন সুমন গাইবার সময়। বাঙালি শ্রোতা হিসেবে আমরা চিরকৃতজ্ঞ তাঁর কাছে। কিন্তু বাকি রেকর্ড? ক্রমাগত শুনলাম, ওই প্রথম চরণের বৃন্দাবনী সারঙের অতিপ্রয়োজনীয় স্বর কোমল নি হয়ে যাচ্ছে শুদ্ধ গা; মজার কথা, গান্ধার কিন্তু বৃন্দাবনী সারঙের আরোহণ-অবরোহণ দুটিতেই সম্পূর্ণই বর্জিত। অথচ ণ-ম-প-স বারবার হয়ে গেছে গ-ম-প-স। গায়কের পক্ষে সুরের বদল অন্যায় নয়, পুনর্বয়ন তো সময়ের সাপেক্ষে খুবই স্বাভাবিক, এমনকি তাতে রাগের কানুনলঙ্ঘনও মান্য। কিন্তু তার উপযুক্ত প্রেক্ষিত আর প্রয়োজন থাকা তো আবশ্যক। বিনা কারণে কেন স্রষ্টার দেখানো রূপ বদলাবে? সেই তত্ত্বটি মেনে শ্রোতা-আমি বোঝবার চেষ্টা করেছিলাম, স্বরলিপি বদলে ঠিক কী অর্থান্তর ঘটাতে চেয়েছেন শিল্পীরা। কিন্তু শিল্পীদের শ্রোতাকে বুঝিয়ে দেবার মোটেই দায় নেই। কাজের সংসারে ঠাঁই না হবার বেদনাকে, আবার সেই বেদনাকে তুড়ি মারার স্পর্ধাকে, বেচাকেনার হাটকে বুড়ো আঙুল দেখানোর উদাসী রাজকীয়তাকে একটুও আমল না দিয়ে তাঁরা কেবল খেয়ালখুশিতে গেয়ে চলবেন। দুঃখের কথা আর কী বলি!

গান তো কোনোদিনই ‘একাকী গায়কের’ নয়, সবসময় তা ‘অন্তত’ দুজনের। এই গান যেন সমস্ত নির্মাণ দিয়ে সেই ‘দুই’-কে চিনিয়ে যায়। নিশিকান্ত প্রধানত কবি ছিলেন, আঁকিয়ে ছিলেন, গানের ব্যাকরণের সঙ্গে তেমন কিছুই পরিচয় তাঁর ছিল না। নিশিকান্ত গীতিকার হয়ে উঠেছিলেন ‘কর্মনাশা’ দিলীপের জন্যে। আর দিলীপের মার্গসঙ্গীতঘেঁষা আত্মগৌরবী গান আস্তে আস্তে সহজ মরমিয়া পথ পেয়েছিল নিশিকান্তর স্বতঃস্ফূর্ত সারল্যের জোরে। দুই বন্ধু একে অন্যের পরিপূরক ছিলেন। এ গানের পরতে পরতে সেই সম্পর্কের, ভালবাসার, প্রেমের, বন্ধুত্বের রং লেগে আছে। এ গানের আলম্বন সখ্য, যার বিষয় দিলীপ, আর আশ্রয় নিশিকান্ত। এই গান সেই বন্ধুত্ব উদ্‌যাপনের গান। প্রতিটি দিন হোক্‌ বন্ধুদিন। বন্ধুরা ভালো থাকুক!

তথ্যঋণ: ডালিয়া সরকার; ‘কবি নিশিকান্ত’; আনন্দ পাবলিশার্স, জানুয়ারি ১৯৯৬
দিলীপকুমার রায়ের রেকর্ডটি জয়দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে শোনা।

Powered by Froala Editor