শ্রুতিমধুর – ১০
আগের পর্বে
‘আশিতে আসিও না’। সেই সিনেমার কাল্ট একটি সিনে রুমা গুহঠাকুরতার মুখে ভেসে উঠছে গান। তার লাইন অনেকটা এমন, ‘তুমি ময়দা এখন যদি হতে, জলখাবারে লুচি বেলতাম’। রোম্যান্টিক একটি সিনে এমন কথা যেন অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স। কিন্তু এই কথা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। যে চরিত্রের পরিধি হেঁশেলেই সীমাবদ্ধ, তার গানের কথা এমনই হবে বৈকি। এই কথা অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হওয়ার কারণ গানের ভোকাবুলারিতেও পুরুষ নির্ভরশীল মানদণ্ড। নারীর কণ্ঠ সেসময় শোনা যায়নি বাংলা গানে। এমনকি অনিলা দেবী, মমতা মিত্রের মতো ছদ্মনামের পিছনেও লুকিয়ে ছিল পুরুষ-শব্দচরিত।
‘মুখখানি কর মলিন বিধুর যাবার বেলা’...? শ্রুতিমধুর শেষ করতে বসে সম্পাদকদের মুখের দিকে তাকিয়ে এমনই মনে হচ্ছিল। চৌকাঠের এপারে এক পা, ওপারে আরেক। আজকের লেখা সেই দ্বিধাজড়িত বিদায়কে নিয়ে।
বালিকা বিদ্যালয়ের উঁচু ক্লাসে নীল-গোলাপি শাড়ির দল এমনই এক বিদায়কে প্রথম চিনেছিল। সত্যিই চলে যেতে হবে? চিলতে করিডর আর ফ্যাকাশে মাঠের ধুলোমাখা দিনরাত কেবল ডেকে ডেকে ফিরছিল। তাঁতের শাড়ির সাদামাটা একবেণী আর সিল্কমার্কড স্টাইলিশ খোঁপার দ্বন্দ্বে হারিয়ে যাওয়া। উঠতি রোমান্সবেলা। কত চোখ আর কত ইশারার দিনশেষ। খুদে পুকুরের ছলাৎছলে অজান্তেই ভাসিয়ে দেওয়া চিঠির অক্ষরমালা। এতসব থরথর আবেগ বিদায়ীসভায় প্রকাশ পেল আশা ভোঁসলের। ফ্যাঁচফ্যাঁচে নাকে “তুমি ভরে নিও বাঁশি, ওগো সুর থেকে সুরে/ নয় চলে যাব আমি শুধু দূর থেকে দূরে”... ইত্যাদি। যেন আমি চলে যাওয়ায় কত ত্যাগই না স্বীকার করছি। আর ইস্কুলজমি তো উপেনের দুই বিঘার মতো, আমি চলে গেলেই সুখে থাকবে। কী গভীর উদ্ভট অভিমান!
এসব আজগুবি ফেয়ারওয়েল কালে কালে পালটে গেল কলেজবাড়িতে। হলদেটে শ্লোগান-লেখা দেওয়াল আর সিলিং-এরকড়ি-বরগার খাঁজে থাকা চড়ুইপাখিরা আবেগ উথলে দিত ঠিকই, কিন্তু আবেগেরও তো বয়েস বাড়ে। সে আওড়ায় অজয় ভট্টাচার্য -
“আকাশের পার হতে যে তারকা ঝরে যায়, সে যে আজ কয়ে গেল তোমার কথাটি, হায়!
আরও পড়ুন
‘এখানে তুমি সংখ্যালঘু’
যাবে তুমি কোন্ ক্ষণে, ভুলে আছি আনমনে, ভাঙিও না ভুলখানি।”
ভুল যে ভাঙবেই, আর চৌকাঠ ডিঙিয়ে যে যেতেই হবে, এ তার কাছে স্পষ্ট। তবু, মায়াবিভ্রমেই সাময়িক সান্ত্বনা আর কী! সুমনের নাইলন স্ট্রিং গিটারের ঝনকে তেমন সান্ত্বনা পেয়েও আরাম। ফলে সে আরও আওড়ায় জোন বায়েজ। রাজপথ কাঁপিয়ে দেওয়া ঝোড়ো শরতে কিংবা খুনখারাবি তুলকালাম বসন্তে সে এদেখতে পায় ‘স্বপ্নের লাশ’, আকাশের বিষাদ, আকাশের বদলে যাওয়া রং, কিছু মেঘ-কিছু রোদ্দুর, কিছু নির্জন, কিছু নিশানওড়ানো দুপুর তাকে শেখায় ‘আই মাস্ট লিভ ফাস্ট’। কারণ, ‘সময়মত চলে যাওয়াতেই সবকিছুর সৌন্দর্য’। কারণ, অনন্ত ব্যাটিং করে যাওয়া কাজের কথা নয়, কিছু বিদায় নিতেই হয়, ‘চলে যেতে হয়’ বলেই চলে যাওয়া প্রয়োজন।
আরও পড়ুন
‘রক্তে বোনা’ গান...
কৈশোর-পেরনো সেই লালচে বিকেলের আলোয় কিছুতেই বয়ঃসন্ধি ভুলতে না দেওয়া একজন থাকতেন। মান্না দে। চিরবিরহী কণ্ঠ। কানের ভেতর সেঁধিয়ে যাওয়া, গলার কাছে দলা পাকিয়ে থাকা জমাট সেইসব কষ্ট মান্না দে মোটেই ঝেড়ে ফেলতে দিতেন না। বারবার মনে করিয়ে দিতেন, ‘আবার হবে তো দেখা’। পথের মধ্যিখানে ছাড়িয়ে নেওয়া হাত, শেষবার সাইকেলের ঘুরিয়ে নেওয়া হাতল, শেষ উপহার জেনেও যত্নে আটকানো মোড়ক, সব, স—ব মনে করিয়ে দিতেন পুলক বাঁড়ুজ্যে, জানতেন, এ দেখা কিছুতেই শেষ দেখা নয়।
‘শুধু এই কথাটুকু নিয়ে, এ বিদায় দেব খুশি হয়ে,
আরও পড়ুন
‘মলিন মর্ম মুছায়ে’
আবার নয়নদুটি হাসবে, আবার, নয়নদুটি হাসবে,
কথা দাও, আবার আসবে!”
আরও পড়ুন
“ভরসা যেন পড়ায় এবং...”
মান্না দে যখন ওই দ্বিতীয় ‘হাসবে’-টি বলতেন, মনে হত, উপচে পড়া নদীর মত চোখ সত্যিই হেসে ফেলল। শক্তি বলেছিলেন, ‘তোমার মুখ অশ্রু-ঝলোমলো’। ওই ছলছলে জলের আয়না না থাকলে হাসির আলো প্রতিফলিত হবে কীসে? রবীন্দ্রনাথ যেমন শিখিয়েছিলেন, চলে যাওয়া যদি অনিবার্যই হয়, তবে সেই যাওয়াটুকুকেও মধুর করে তোলো। শেষ কথাতেও এমন কিছু বলে দাও, শেষ চাওয়াটুকু এমন করে চেয়ে যাও, যাতে ‘বেদনা হবে পরম রমণীয়’, “আমার মনে রহিবে নিরবধি, বিদায়ক্ষণে ক্ষণেক তরে যদি সজল আঁখি তোলো”।
কিছু বেদনা তেমন ‘রমণীয়’ হয়ে থাকে। অভ্যাসের ক্লান্তি-আবর্তে না ঘুরে ওই চলে যাওয়াই আসলে স্মৃতির অমৃতপাত্র ভরে ভরে তোলে। কিছু নিবিড় ঘুমিয়ে পড়ার প্রান্তে দুয়েকটি রঙ্গনফুল ফুটে থাকে সুধার মত। কিছু মৌন হিরণ্ময় হয়ে থাকে, বাঙ্ময় স্মরণিকার মতই। কিছু ধাতব চক্রযান ধানমাঠের বুক চিরে যেতে যেতেও তাকিয়ে থাকে ফেলে আসা জনপদের দিকে। গরিব নরম ঝুপসি রিক্সাবাহী জনপদও হাত নেড়ে যায়। ‘মাঝেরপাড়া’ স্টেশনের ডিসট্যান্ট সিগন্যালগুলো দেখতে দেখতে মিলিয়ে যায়। মাথার ভেতর গুনগুন করে শুধু বাজে ফিরে আসার প্লুতস্বর, ‘যা----ই’!...
আরও পড়ুন
‘আমার’ ‘আমার’ বলতে লাগে লাজ...
যাওয়া তো আসলে যাওয়া নয়, ও তো এক অর্থে সুভাষিত আসা। আসি তবে?
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
জীবনে বাদল ছাইয়া