মহাভারতে রাজনীতি – ৮
আগের পর্বে
অরাজক রাজ্যের পরিণতি শাসকের অভাবে হতে পারে ভয়ঙ্কর। সগর রাজা জনগণের মঙ্গলের নিমিত্ত জ্যেষ্ঠ পুত্র অসমঞ্জকে পরিত্যাগ করেন। ফলে দরকার হয়ে পড়ে প্রকৃত শাসকের। যিনি শাস্ত্র বলতে চার বিদ্যাতেই পারদর্শী হবেন। সত্যবতী ভীষ্মকে ভ্রাতাজায়াদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য বললে তিনি রাজি হলেন না। শেষ অবধি সেই দায়িত্ব নিলেন ব্যাসদেব। তিনি স্মরণ করলেন অম্বিকাকে। মানসচক্ষে দেখলেন তাঁর ঔরস জন্মদেবে শতাধিক পুত্রের জনককে। সত্যবতী অম্বিকার কাছে পৌঁছে দিলেন এই খবর। অম্বিকাও এই কথা শুনে প্রফুল্ল হয়ে সজ্জায় মননিবেশ করলেন।
অবশেষে অম্বিকা রাজমাতা সত্যবতীর কথার মর্মোদ্ধার করতে পারলেন। তিনি জানতেন, তাঁর সঙ্গে সঙ্গম করতে আসবেন তাঁর দেবর। চন্দ্রবংশীয় দেবব্রত-ভীষ্ম ছাড়া আর কাউকে তিনি দেবর বলে জানতেন না। তাহলে এই নিকষ কালো জটাজুটধারী ব্যক্তি কে? সুর্যের মতো তেজ তাঁর দুই চোখে, সেই তাপ ও বিরূপতা সহ্য না করতে পেরে অম্বক অর্থাৎ চোখ বন্ধ করে ফেললেন কাশীরাজকন্যা অম্বিকা। এই তবে রাজনৈতিক পরিহাস!
অম্বিকা ভাবতে লাগলেন, রাজ্য এবং রাজা সৃষ্টির পিছনে ঐশ্বরিকতা নয়, রাজনীতিই তবে প্রধান। এই সেই রাজধর্ম যার সঙ্গে অর্থ ও কামের যোগ সুবিদিত। সে সব কিছুকে ঐশ্বরিকতার মোড়কে মুড়ে ফেলার যে কী কারণ তা বুঝে উঠতে পারেন না ক্ষত্রিয়কন্যা। ক্ষত্রিয়ের জীবনে তো মোক্ষ নেই, তাহলে ঈশ্বর আসছেন কোথা থেকে! মোক্ষ থাকলে রাজ্যপাট মাথায় উঠে যাবে!
ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন অম্বিকা। মহর্ষি ব্যাসদেব শৃঙ্গারের কথা ভাবতে পারছেন না। তিনি চিন্তা করছেন অরাজক রাষ্ট্রের কথা। শাসক না থাকলে মানুষ বলবানদের অত্যাচারে যত্রতত্র পালিয়ে বেড়ায় কিংবা লুকিয়ে পড়ে জীবন রক্ষা করে। সেই জন্য ঈশ্বর রাজার সৃষ্টি করেছিলেন। কে এই ঈশ্বর? রাজাই বা কে? ঈশ্বর হলেন তিনি, যিনি অধীনস্ত হন এবং অধিনীকরণ বা জয় করেন। ‘ঈশ্’ ধাতুর অর্থও তাই। ঈশ্+বর (বরচ্) ক। আর যদি তাঁর ধাতু ‘অশ্’ হয়, তাহলে তিনি স্বয়ং সংঘাত। অশ্ (ব্যাপ্তি)+বর (বরট্)ক। ব্যাপ্তিকে যিনি বরণ করেন তিনিই ঈশ্বর। আর যিনি দীপ্তি পান, প্রজারঞ্জন করেন তিনিই রাজা। অসুরগুরু শুক্রাচার্য অবশ্য মনে করেন, যাঁর বিংশতিলক্ষ রৌপ্যমুদ্রা আছে তিনিই ‘রাজা’। সায়ণের মতো পণ্ডিত ভাবেন, মুর্দ্ধাভিষিক্ত হলেন প্রকৃত রাজা। মূর্ধাভিষিক্ত কে? রাজ্যার্পণকালে মস্তকে কৃতাভিষেক প্রথম ক্ষত্রিয়। ব্যাসদেবের পিতা ব্রাহ্মণ (অম্বষ্ঠ পরাশরের ব্রাহ্মণকরণ হয়েছিল) ও মাতা ক্ষত্রিয়কন্যা (উপাখ্যান মতে, সত্যবতী ক্ষত্রিয়কন্যা); তাই অনুলোম মিলনের নিয়মানুযায়ী ব্যাসদেব মুর্দ্ধাভিষিক্ত; ব্যাসদেবই ক্ষত্রিয়, তাই তিনিই রাজা। তিনি অম্বিকার গর্ভে হস্তিনার ভবিষ্যত শাসক উৎপাদন করার যোগ্য।
আগামী শাসকের কথা ভাবতে ভাবতে ব্যাসদেব পুনরায় দেখলেন, অম্বিকা মুদ্রিতনয়না। অম্বিকাকে ‘রাষ্ট্র’ ভাবলে কি খুব অন্যায় হবে! অম্বিকা অবশ্য পার্বতীর অন্য নাম, যদিও আদিতে অম্বিকা ছিলেন শিবের ভগ্নী। ‘অম্বিকা’ নামক রাষ্ট্রের গর্ভে শাসক উৎপন্ন হলে, প্রথমে সেই রাষ্ট্রের কথা সম্যক বলা দরকার। এখন দ্বাপর যুগ, কলি আসতে খুব বেশি দেরি নেই। দ্বাপরের পূর্বে ছিল ত্রেতা, তারও আগে সত্য যুগ। সত্যযুগের ব্যাস হলেন স্বয়ং ব্রহ্মা। তখন না ছিল রাষ্ট্র, না ছিল রাজা। যথা রাজ্যং সমুৎপন্নং যথা কৃতযুগে’ভবৎ। রাষ্ট্রহীন, শাসকহীন দেশে দণ্ড ছিল না, রাজনীতি ছিল না। তবে মানুষ তাঁর নিজের স্বভাববশত এক রকমের শৃঙ্খলা বজায় রাখত। কিন্তু সেই শৃঙ্খলা বেশি দিন স্থায়ী হল না। মানুষের মধ্যে হিংসা আর লোভ এমনভাবে বৃদ্ধি পেতে লাগল যে মানবসমাজে শৃঙ্খলা নষ্ট হতে বেশি দেরি হল না। ‘ঋত’-র মতো যে প্রাকৃতিক নৈতিক শৃঙ্খলা বিরাজ করত তা আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হতে লাগল। এক শ্রেণির মানুষের ক্ষমতা বা প্রতিপত্তির নেশাই সেই বিশৃঙ্খলার কারণ—প্রতিপত্তিবিমোহাচ্চ ধর্মস্তেষামনীনশৎ। সত্যযুগ পার হয়ে তখন মানুষ ত্রেতাযুগে প্রবেশ করছে। ‘পাশক’ নামক দ্যুতের অক্ষত্রয়যুক্ত পার্শ্বের চিৎপাত হল ত্রেতা। মানুষ বনের ফলমূল, গাছের ছায়ায় আর থাকলো না সম্ভবত দুটো কারণে—এক, বনজ সম্পদ অপ্রতুল মনে হচ্ছিল তার; দুই, একঘেয়েমি তাকে গ্রাস করেছিল। মানুষ তখন বাড়িঘর আর কৃষিকাজে মন দিল। এই বার তার মধ্যে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, গোষ্ঠীগত সম্পত্তির চেতনার উদ্ভব হল। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ল লোভ—সে নানা ভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করতে লাগল। প্রাকৃতিক অন্যান্য জীবের মতো সে আর থাকল না। পুরুষ মানুষ প্রথমে দখল করল জমি আর স্ত্রীলোক।
আরও পড়ুন
কোনো অবস্থাতেই সত্যের অপলাপ করতে পারবেন না শাসক, নির্দেশ মহাভারতকারের
এই যে মুদ্রিতনয়না অম্বিকা, সে হল বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্র বা জমি। বিচিত্রের মৃত্যুর পরেও সে বিচিত্রবীর্যেরই ক্ষেত্র। তার শরীর-মন সব এখন রাজমাতা অর্থাৎ মৃত রাজা বিচিত্রবীর্যের মাতা সত্যবতীর মর্জিমতো চলবে। কৃষ্ণ দ্বৈপায়নকে ‘অম্বিকা’ নামক ক্ষেত্রে সত্যবতী নিয়োগ করেছেন। তিনি কর্ষণ করে চলে যাবেন। জমির কোনও মন থাকে না, তার শরীরই সব। অথচ ব্যাসদেব জানেন, ক্ষেত্রেরও মন আছে।
ভগবান ব্যাসদেব ও মুদ্রিতনয়না অম্বিকা (‘অম্বক’ মানে চক্ষু)-র মিলন হল। ভগবানের গায়ে শক্তি আছে এবং তিনি বীর্যবান, পক্ষান্তরে ক্ষেত্রর শক্তি সেই সময় চৈতন্যবিহীন। যার বল আছে তাকে যেমন বলবান বলা হয়, তেমনি যার ভগ আছে তিনিই ভগবান, ঐশ্বর্য্যাদিষড়্গুণশালী। ভগ হল ঐশ্বর্য্য যা ভজনীয়। আবার এক অর্থে ‘ভগ’ হল উৎপাদনের উপায়। ব্যাসদেব এখানে শ্রমিকমাত্র। ‘অম্বিকা’ নামক ভগের আসল মালিক মৃত বিচিত্রবীর্য। বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রে ব্যাসদেব ফসল উৎপন্ন করবেন, তাই সাময়িকভাবে (পরে দেখা যাবে, সাময়িকতা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছেন ব্যাসদেব) তিনি ভগবান। কিন্তু চৈতন্যবিহীন, চক্ষুবিহীন ক্ষেত্রে বীজ বপন করলে ফসলও চক্ষুবিহীন এবং চৈতন্যহীন হতে বাধ্য। তাহলে যে রাষ্ট্রের শাসক উৎপন্নে ব্রতী হয়েছেন সূর্যবংশের কুলগুরু বশিষ্ঠের উত্তরপুরুষ, তাও কি চক্ষুবিহীন বা দৃষ্টিহীন হবে? কেমন হবে সেই শাসকের রাষ্ট্র? ধৃত রাষ্ট্র?
আরও পড়ুন
সিংহাসনে বসবেন না ভীষ্ম, রাজাহীন হস্তিনাপুরের ভার নিতে আহ্বান ‘কানীনপুত্র’ ব্যাসদেবকে
সেই কথাই জানালেন ব্যাসদেব তাঁর গর্ভধারিণী সত্যবতীকে। সত্যবতী বিমর্ষ হলেন। তাহলে এখন উপায় কী? এমন শাসক তো চলবে না তাঁর! অম্বিকাকে কি পুনরায় কর্ষণ করা সম্ভব? কন্যাকে আদেশ জানিয়ে সত্যবতী আবারও ব্যাসকে সেই ক্ষেত্রে গমন করতে বললেন। ব্যাসদেব অম্বিকার শয্যাগৃহে গিয়ে দেখলেন, সেখানে অম্বিকা অনুপস্থিত। অম্বিকা তাঁর ইচ্ছার বশে সেখানে আসেনি বটে, তবে এক সুন্দরী দাসীকে পাঠিয়েছে তারই শয্যায়। সেই দাসী অলঙ্কৃতা এবং সুসজ্জিতা। ব্যাসদেবকে বিচিত্রবীর্যের দাসী প্রীতিবশত সেবা করলেন।
রাজধর্মপ্রকরণে দাসীর অবস্থান কোথায়, ভাবছেন ঋষি বেদব্যাস। শুধু দাসী কেন, নারীদের কোনও রাজনৈতিক অধিকার নেই চন্দ্রবংশীয় রাষ্ট্রে। ব্যতিক্রম রাজমাতা সত্যবতী--তাঁর স্বামী নেই, দুই পুত্র মৃত। একমাত্র ‘কানীন’ পুত্র ব্যাসদেব বনবাসী। নারী বাল্যে পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীন।
আরও পড়ুন
একে একে সাত পুত্রকে হত্যা করলেন গঙ্গা, দুঃখে শোকে অস্থির শান্তনু
পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে।
পুত্রাশ্চ স্থাবিরে ভাবে ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি।।
ক্ষত্রিয়-নারী যুদ্ধে অংশ নিতে পারবেন না। কারণ কী? নারী হলেন সর্বদোষের আকর। তাঁদের পাপপুণ্য, ধর্ম-অধর্ম জ্ঞান নেই। মানুষের চরিত্রে যত রকম দোষ থাকা সম্ভব, সে সবই নারীর চরিত্রে আছে। ভগবান বলেছেন, জন্মান্তরীয় পাপের ফলেই জীব স্ত্রীলোক হিসাবে জন্মগ্রহণ করে।
মাং হি পার্থব্যপাশ্রিতা যেহপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ।
স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেহপি যান্তি পরাং গতিম্।।
আরও পড়ুন
যৌথ মালিকানা থেকে পরিবার হয়ে ব্যক্তি মালিকানার সূচনা; সাক্ষী মহাভারত
অতএব নারীকে রাজনীতিকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া যাবে না। এখন যেমন মনে হচ্ছে, নারী সত্যবতী হস্তিনার রাজনীতি, রাজ্যপাট সব কিছু নিজের হাতে সামলাচ্ছেন, সত্যিই কি তাই? নাকি পরাশর ও ব্যাসদেব হস্তিনার রাজনীতির নিয়ামক?
প্রাসাদের যে সমস্ত দাসী তাঁরা একদা বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত, এখনও তাই। যেহেতু বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রে ব্যাসদেব সন্তান উৎপাদন করবেন তাই ওই দাসীরা এখন ব্যাসদেবের অধীন—এতে বিচিত্রবীর্য্যস্য ক্ষেত্রে দ্বৈপায়নাদপি।
আরও পড়ুন
কর্ণ ও অর্জুনের বিবাদ নেমে এসেছিল সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক সংঘাতেও
ব্যাসদেব সেই শূদ্রা দাসীর সঙ্গে সঙ্গম করতে করতে ভাবলেন—ক্ষেত্রত্বং দাস্যা অপি ইত্যনেনৈব গম্যতে কেচিৎ। সেই দাসী প্রীতিবশত কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের সঙ্গে সর্বপ্রকার রমণ করলেন। ব্যাস ভাবলেন, এর গর্ভে উপযুক্ত রাজনীতিজ্ঞ জন্মাবে কিন্তু সে হবে শূদ্রযোনিজ, ফলে তার রাজসিংহাসনে কোনও অধিকার থাকবে না।
রমণের পর অবশ্য ব্যাসদেব চিন্তা করে দেখলেন, এই যে কুরু বংশ যারা আদিতে ছিল পুরু বংশ, সেই বংশের প্রথম রাজা পুরু ছিলেন যযাতির পুত্র। ক্ষত্রিয় যযাতি বিবাহ করেছিলেন ব্রাহ্মণকন্যা দেবযানীকে যা ছিল গর্হিত কারণ তা প্রতিলোম বিবাহ। দেবযানীর সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর দাসী শর্মিষ্ঠা। শর্মিষ্ঠার গর্ভে পুরু জন্মেছিলেন। শর্মিষ্ঠা অসুরকন্যা। পুরু ছিলেন দাসীপুত্র এবং মায়ের দিক থেকে তাঁর রক্তে মিশে ছিল অসুরশক্তি। দাসীপুত্র হওয়া সত্ত্বেও সে রাজা হতে পেরেছিল। কোন রাজনৈতিক কৌশলে পুরু রাজা হয়েছিলেন?
অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা
Powered by Froala Editor