মহাভারতে রাজনীতি – ৭
আগের পর্বে
শান্তনু গত হলেন। তাঁর দুই পুত্রের মধ্যে চিত্রাঙ্গদ তখন বালক। বিচিত্রবীর্য সত্যবতীর গর্ভে। বালক চিত্রাঙ্গদের মধ্যে আদর্শ শাসকের গুণাবলি না থাকলেও সিংহাসনে বসলেন তিনি। সংকর জাতি থেকে চতুর্বর্ণে ফিরিয়ে এনে উগ্র থেকে ক্ষত্রিয়করণ করা হল এই দুই ভাইয়ের। তাতে বেজায় চটে গেলেন গন্ধর্বরা। গন্ধর্বপুত্র চিত্রাঙ্গদ হত্যা করেন গন্ধকালীপুত্র চিত্রাঙ্গদকে। বিচিত্রবীর্য হেঁটেছিলেন তাঁর অগ্রজের পথে। অতিরিক্ত কামক্রীড়ায় তাঁর মৃত্যু হয়। ফলে শান্তনুর কোনো উত্তরসূরি রইল না। হস্তিনার রাজনীতি বাঁক নিল অন্য পথে।
হস্তিনার রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর গর্ভধারিণী ও দেবব্রত-ভীষ্মকে অরাজক রাজ্যে শাসকের অভাবে কী কী হতে পারে সেই সব বৃত্তান্ত বললেন। একই সঙ্গে জানালেন, সপ্তাঙ্গ রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান অঙ্গ আদর্শ শাসকের কী কী গুণাবলি থাকা জরুরি। শাসকের চরিত্র বিষয়ে তিনি পুরুষকার ও সত্যনিষ্ঠার কথা উল্লেখ করলেন। উদ্যোগ ছাড়া রাষ্ট্রের কোনও কাজ সুসম্পন্ন হয় না, ফলে কার্যসিদ্ধির জন্য পুরুষকারের চর্চা আবশ্যক। সত্যই কার্যসিদ্ধির প্রধান সাধন। কোনও অবস্থাতে সত্যের অপলাপ করা চলবে না। মৃদুতা ও তীক্ষ্মতা পরিত্যাগ করে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতে হয় স্বামী বা শাসককে। শাসক মৃদুস্বভাব হলে জনগণ তাঁকে মানবে না, আবার অতি তীক্ষ্ম হলে জনগণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বে। শাসক বসন্তসূর্যের মতো হবেন। রাজা হবেন আসক্তিবিহীন অর্থাৎ সকল প্রকার ব্যসন থেকে নিজেকে মুক্ত রাখবেন। গর্ভিণী যেমন গর্ভস্থ সন্তানের মঙ্গলের জন্য নিজের প্রিয় জিনিস ত্যাগ করতে কুণ্ঠিত হয় না, রাজাও সে রকম জনগণের হিতসাধনকে নিজের ব্রত হিসাবে গ্রহণ করবেন। কোনও অবস্থাতে শাসক ধৈর্যহীন হবেন না। প্রজাদের মঙ্গলের জন্য শাসক প্রিয় বস্তুকে বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠা বোধ করবেন না। সগর রাজা জনগণের মঙ্গলের নিমিত্ত জ্যেষ্ঠ পুত্র অসমঞ্জকে পরিত্যাগ করেন। অসমঞ্জ অত্যন্ত দুর্বিনীত ও নিষ্ঠুর ছিলেন। প্রজাদের উপর অত্যাচার করতেন বলে সগর রাজা তাঁকে ত্যাগ করে রাজ্যের বাইরে নির্বাসন দেন। শাসক চাতুর্বর্ণ্যধর্ম রক্ষা করবেন। অর্থাৎ কৃষ্ণ ধন, শুভ্র ধনের তফাৎ করবেন। ধর্মসঙ্কর ও বর্ণসঙ্কর থেকে প্রজাদের রক্ষা করা তাঁর কর্তব্য। মর্মার্থ, কালো ধন ও সাদা ধন যেন মিশ্রিত না হয়ে যায়। কৃষ্ণ ধনের উপার্জনকারীদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন রাজা। এই শাসক হবেন শিক্ষিত, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন এবং তিনি হবেন প্রজারঞ্জক।
অনন্তর ব্যাসদেব ক্ষত্রধর্মের গুরুত্ব বিষয়ে রাজমাতা সত্যবতী ও ব্রহ্মচারী দেবব্রত-ভীষ্মকে অবহিত করলেন। ক্ষত্রিয় বীরেরা প্রজাদের রক্ষা করবেন। বহির্শত্রুর আক্রমণে তাঁরা যেমন রাজ্যকে প্রতিরক্ষা দেবেন, তেমনই রাজ্যস্থিত জনগণকে রাজ্যের অভ্যন্তরে সুরক্ষা দেবেন। সময়ানুবর্তিতা শাসকের অন্যতম প্রধান গুণ। সাম, দান, ভেদ ও দণ্ডনীতির প্রয়োগে শাসকের কালজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন। অনার্যকর্মবর্জন, প্রজাপালন তাঁর অবশ্য কর্তব্য। ‘অনার্যকর্ম’ বলতে এখানে হেয়, নীচ কাজকে বোঝায়। রাজা হবেন বিশ্বস্ত, তিনি কথা দিয়ে কথা রাখবেন। প্রিয়বাদিতা, জিতেন্দ্রিয়তা গুণের পাশাপাশি তাঁর শাস্ত্রাভ্যাস থাকবে। ‘শাস্ত্র’ বলতে চার বিদ্যা বুঝতে হবে—ত্রয়ী, বার্তা, দণ্ডনীতি ও আন্বীক্ষিকী।
সত্যবতী পুত্র কৃষ্ণ দ্বৈপায়নকে বললেন, হস্তিনা রাজ্যের রাজাই নেই। এখন কী উপায়ে শাসক নির্বাচন করা যায়, সে বিষয়ে তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতে চাই।
সত্যবতীর ‘কানীন’ পুত্র ব্যাসদেব উত্তর দিলেন, বিধবা পুত্রবধূদের গর্ভে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ বা উপযুক্ত ক্ষত্রিয়ের দ্বারা, প্রয়োজনে অর্থ দিয়ে, পুত্র উৎপাদন করে তাঁকে শাসক নির্বাচিত করুন। চন্দ্রবংশীয় রাজাদের ক্ষেত্রে এমন সময়ে এই বিধানই প্রচলিত।
আরও পড়ুন
সিংহাসনে বসবেন না ভীষ্ম, রাজাহীন হস্তিনাপুরের ভার নিতে আহ্বান ‘কানীনপুত্র’ ব্যাসদেবকে
ইতিপূর্বে সত্যবতী চন্দ্রবংশীয় রাজা শান্তনুর পুত্র, গঙ্গাতনয় ভীষ্মকে বিধবা ভ্রাতাজায়াদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করতে বললে ভীষ্ম তাঁর ভীষণ প্রতিজ্ঞার কথা উল্লেখ করে সম্মত হননি। সত্যবতী সুর্যবংশের কুলোপুরোহিত বশিষ্ঠের বংশধর ব্যাসদেবকে চন্দ্রবংশীয় বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রে পুত্র উৎপাদন করতে অনুরোধ জানালেন। ব্যাসদেব বললেন, ক্ষেত্র বা কন্যাদের মন প্রস্তুত করতে সময় দিন, নইলে প্রকৃত শাসক ওই গর্ভসমূহ থেকে উৎপন্ন হবে না।
সত্যবতীর বিলম্ব সইল না। ক্ষেত্রের আবার মন কী! তিনি পুত্র ব্যাসদেবকে শীঘ্রই এই কাজে ব্রতী হতে বললেন। ব্যাসদেব মায়ের আদেশ অমান্য করবেন না বলে নিভৃতে চলে গেলেন।
আরও পড়ুন
একে একে সাত পুত্রকে হত্যা করলেন গঙ্গা, দুঃখে শোকে অস্থির শান্তনু
ব্যাসদেব একাকী ভাবতে লাগলেন, তিনি ঋষি। তপস্বীর জ্ঞান, তপ, বৈরাগ্য এবং যোগ এই চারটি গুণ থাকে। হস্তিনার সিংহাসনের জন্য তাঁর গর্ভধারিণীর আসক্তি থাকতে পারে, কিন্তু তাঁর কেন থাকবে! সূর্যবংশের কুলগুরুর বংশজাত ব্যাসদেবের রয়েছে বৈরাগ্য। তবু তাঁকে এমন এক শাসকের জন্ম দিতে হবে, যে শাসকের রয়েছে ষাড়্গুণ্য। সেই ছটি গুণ হল পররাষ্ট্রনীতির প্রয়োগ। সন্ধি, বিগ্রহ, যান, আসন, সংশ্রয় এবং দ্বৈধীভাব। সন্ধি হল সংযোগ, সম্মেলন—কোষভূমিপ্রদানহেতুক প্রণয়বন্ধ। বিগ্রহ হল বিস্তার, প্রসারণ; কখনও তা বিরোধ বা ভেদ—ত্যজত মানমলং বত বিগ্রহৈঃ। যান হল অভিযান। আসন হল স্থিতি বা মঙ্গলময় অবস্থান। শত্রুপীড়িত শাসকের প্রবলতর অন্য শাসকের আশ্রয়গ্রহণ হল সংশ্রয়। স্বার্থসিদ্ধির জন্য নিজের সৈন্যদলের মধ্যে মেরুকরণ হল দ্বৈধীভাব। একজন ঋষির পক্ষে শাসক হওয়া সম্ভব নয়। রাজনীতির এমন আবর্তে তাঁর মতো জ্ঞানজীবীর থাকা শোভন নয়, কিন্তু হস্তিনার সিংহাসনে একজন রাজা দরকার যিনি আদর্শ শাসক হবেন। চন্দ্রবংশীয় রাজা বিচিত্রবীর্য, যিনি ব্যাসদেবের সহোদর কিন্তু বৈপিতৃক ভ্রাতা, তাঁর বিধবা বধূদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করলে কী হবে আগামী রাজনীতির অঙ্গন!
এই সব ভাবতে ভাবতে আশ্রমে ফিরে গেলেন ব্যাসদেব। তিনি মা সত্যবতীকে বলে এসেছেন, বধূদের মন প্রস্তুত করতে সময় দিন। কিন্তু সত্যবতী বিলম্ব করতে সম্মত নন। কিছু দিনের মধ্যে আবার ডাক এল ব্যাসদেবের।
আরও পড়ুন
যৌথ মালিকানা থেকে পরিবার হয়ে ব্যক্তি মালিকানার সূচনা; সাক্ষী মহাভারত
হস্তিনার রাজপ্রাসাদে পুনরায় আগমন ঘটল ব্যাসদেবের। তাঁর গাত্রবর্ণ ঘোর কৃষ্ণ (ভগবান কৃষ্ণ ও দ্রুপদকন্যা কৃষ্ণার ন্যায়), জটা ও দাড়ির রঙ কপিল (তৈর্থিক নিরীশ্বরবাদী কপিল মুনির ন্যায় পিঙ্গল), দুটি চোখ অক্ষপাদের ন্যায় সমুজ্জ্বল। গাত্রগন্ধও বনবাসী তাপসের মতো। ওদিকে সত্যবতী অম্বিকা ও অম্বালিকাকে জানিয়ে রেখেছেন, তাঁদের দেবর তাঁদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের নিমিত্ত তাঁদের সঙ্গে রমণ করতে আসবেন। বধূরা সুসজ্জিতা হয়ে প্রাসাদের শয়নকক্ষে অপেক্ষা করবেন। ব্যাসদেব পুনরায় ভাবতে লাগলেন, আদর্শ শাসকের বৈশিষ্ট্যের কথা। শাসক বা রাজা কাম ও ক্রোধকে জয় করবেন। যে রাজা চিত্রাঙ্গদের মতো ক্রোধ জয় করতে পারেন না কিংবা বিচিত্রবীর্যের ন্যায় কামক্রীড়ায় মাতোয়ারা হন, তাঁরা নিতান্তই কৃপার পাত্র। অতিরিক্ত কামের চর্চা ক্ষত্রিয়কে ত্রিবর্গের প্রথম দুই পুরুষার্থ ধর্ম ও অর্থ থেকে ভ্রষ্ট করে—ধর্ম্মায় রাজা ভবতি ন কামকরণায় তু। তবে অতি ধার্মিক রাজা কিংবা অতি নিরীহ শাসক রাজ্যশাসনের উপযুক্ত নন। শুধু করুণাতে রাজ্য রক্ষা হয় না। শাসক ধর্মের প্রতিপালক, যথেচ্ছ ভোগ তিনি করবেন না। রাজধর্ম পালনে দেবত্ব লাভ হয়, রাজধর্ম পালনে অপটু শাসক নরকে যান। জীবজগত রাজধর্মে বিধৃত, শাসক সেই রাজধর্মের সেবকমাত্র। যিনি ধর্ম বা রাজধর্ম পালনে সমর্থ নন, তিনি সিংহাসনেরও উপযুক্ত নন। প্রজাদের উন্নতিতে রাজ্যের উন্নয়ন—অথ যেষাং পুনঃ প্রাজ্ঞো রাজা ভবতি ধার্ম্মিকঃ।
এই সব ভাবতে ভাবতে ব্যাসদেব অম্বিকার কথা স্মরণ করলেন। ‘অম্বক’ শব্দের একটি অর্থ হল চক্ষু, যেজন্য ত্রিনয়ন শিবকে ‘ত্র্যম্বক’ বলা হয়। রুদ্র যেমন ধ্বংসের প্রতীক, তেমনি অম্বিকাও ধ্বংসের প্রতীক। আবার ‘অম্বু’ মানে জল, সে জীবনেরও প্রতীক। ব্যাসদেব অম্বিকাকে মানসচক্ষে দেখতে পেলেন। এই নারীই তাঁর ঔরসে জন্ম দেবে সেই অসামান্য পুরুষকে যিনি শতাধিক পুত্রের জনক হবেন।
আরও পড়ুন
কর্ণ ও অর্জুনের বিবাদ নেমে এসেছিল সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক সংঘাতেও
তে চাপি বৃহতীশ্যামে নীলকুঞ্চিতমূর্দ্ধজে।
রক্রতুঙ্গনখোপেতে পীনশ্রোণিপয়োধরে।।
কন্যারা বৃহতী (সপ্তপর্ণ) পুষ্পের ন্যায় রক্তাভ তপ্তকাঞ্চনবর্ণ, তাঁদের কেশগুচ্ছ ঘনকৃষ্ণ ও কুঞ্চিত, তাঁদের নখগুলি লোহিতবর্ণ ও প্রশস্ত।
সত্যবতী পুত্র ব্যাসকে বললেন, অরাজক রাষ্ট্রে কালাতিপাত করা উচিত হবে না। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন যেন শীঘ্রই মায়ের অভিলাষ পূর্ণ করেন। ব্যাস জানালেন, যদি এক্ষুনি বধূগণের গর্ভে আগামীর শাসকের জন্ম আপনার অভিপ্রেত হয়, তবে কন্যারা আমার দেহের রূপ, গন্ধ প্রভৃতি বিরূপতা সহ্য করার জন্য প্রস্তুত হন। এতে তাঁদের ব্রতপালন করা হবে এবং তাঁরা উৎকৃষ্ট পুত্র অর্থাৎ আগামীর শাসক লাভ করবেন। সুন্দর পোশাক পরে, অলঙ্কারে সেজে শোওয়ার ঘরে তাঁদের অপেক্ষা করতে বলুন।
সত্যবতী অম্বিকার কাছে গেলেন। আজ তাঁর গর্ভে পুত্র অর্থাৎ হস্তিনার শাসক উৎপন্ন করবেন তাঁরই দেবর—এই কথা শুনে অম্বিকা প্রফুল্ল হয়ে সাজসজ্জায় মন দিলেন।
অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা
Powered by Froala Editor