মহাভারতে রাজনীতি - ৬
আগের পর্বে
বশিষ্ঠপুত্র শকিত্রের সঙ্গে অদৃশন্তীর বিবাহ হয়। তবে বিশ্বামিত্রের প্ররোচনায় পুত্রের জন্মের আগেই শকিত্রকে ভক্ষণ করে কল্মাষ্পাদ রাক্ষস। তাঁদের পুত্র পরাশর চতুর্বর্ণের মধ্যে পড়তেন না। ছিলেন অম্বষ্ঠ। তাঁর হাত ধরেই সৃষ্টি হল মনুসংহিতার। মনুই পৃথিবীর আদি রাজা। অন্যদিকে হস্তিনার রাজা শান্তনু বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন গঙ্গা এবং মৎস্যগন্ধার সঙ্গে। নিজের সাত পুত্রকে হত্যা করেছিলেন গঙ্গা। অষ্টমপুত্রকে শান্তনুর কথাতেই বধ করেননি তিনি। তবে শর্ত ভাঙায় বিদায় নেন গঙ্গা। অন্যদিকে মৎস্যগন্ধার জন্ম আদ্রিকা নামের এক অপ্সরার গর্ভে। যিনি যমুনার মৎসী হয়েছিলেন ব্রাহ্মাশাপে। তাঁর সহোদরকে গ্রহণ করেন উপরিচর বসু। আর মৎস্যগন্ধা বা ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্গাতাদের সঙ্গে পরাশরদের মিলন হল।
পরাশর-মৎস্যগন্ধার মিলন ছিল একেবারেই রাজনৈতিক। মৎস্যগন্ধা ধীবর দাসরাজের কাছে লালিত পালিত হয়। সে পিতার কাজে সাহায্য করত। যমুনায় খেয়া পারাপার করে পারানির কড়ি নিত তখনকার যুগে যা ছিল নিন্দিত। পরাশর বা মেধাজীবী অর্থাৎ আধুনিক পরিভাষায় বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে কুয়াশাঘেরা দ্বীপে মিলন হল তাঁদের। চুক্তিও হল। সেই চুক্তির বলে পরাশর পেলেন একটি পুত্র, মৎস্যগন্ধার কৌমার্য অটুট থাকল এবং তাঁর গায়ের আঁশটে ও নিন্দিত গন্ধ পালটে গিয়ে হল পদ্মগন্ধ। মৎস্যগন্ধা সমাজে নন্দিত হলেন। ব্যক্তিমালিকানার পক্ষে পরাশরের এই সিলমোহর মৎস্যগন্ধাকে সত্যবতী করে তুলে সোজা হস্তিনার রাজপ্রাসাদে ঢুকিয়ে দিল। বিপত্নীক শান্তনুর পুত্র দেবব্রত এর ফলে ব্রহ্মচারী হলেন, তাঁর কোনও সন্তান হবে না এবং বসু দেবব্রতকে সিংহাসনের দাবি থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হল। শান্তনুর বংশ উৎপন্ন হল সত্যবতীর গর্ভে—চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য।
চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য মহাভারতের যুগসন্ধিক্ষণের দুই পুরুষ। অর্থনৈতিক ধারণা বদলের সঙ্গে সঙ্গে তখন রাজনীতির ধারণা আমূল বদলে যাচ্ছে। রাজনিয়োগে প্রজাসাধারণের অধিকারের কথা মহাভারতে থাকলেও সব সময় তা যে মানা হত, এমন নয়। প্রাসাদের রাজনীতি-মহলে যে আন্দোলন চলত তার ভিত্তিতেই রাজা নিয়োগ হত। প্রাসাদের রাজনীতির সর্বময় কর্ত্রী ছিলেন মৎস্যগন্ধা ওরফে সত্যবতী। শান্তনু গত হয়েছেন। চিত্রাঙ্গদ বালক ও বিচিত্রবীর্য গর্ভে। প্রজাদের একটা বড় অংশ দেবব্রতকে রাজপদে দেখতে চাইলেও সত্যবতীর অনিচ্ছায় এবং দেবব্রতের প্রতিজ্ঞায় তা সম্ভব হয়ে উঠল না। আদর্শ শাসকের যে সব গুণাবলির কথা মহাভারতের শান্তিপর্বে ভীষ্মের মুখে উচ্চারিত হয়েছে, তা বালক চিত্রাঙ্গদের ছিল না, থাকাটা স্বাভাবিকও ছিল না। আদর্শ শাসকের গুণাবলির কথা পরে আলোচনা করা হবে। চিত্রাঙ্গদের প্রসঙ্গে আসা যাক।
সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণ চিত্রাঙ্গদকে হস্তিনার সিংহাসনে বসানো হল। তিনি ছিলেন বলদর্পিত পুরুষ। সেই অহঙ্কার তাঁর কাল হল। তিনি নিজেকে শ্রেষ্ঠ বীর ভাবতেন। চিত্রাঙ্গ হল শবলদেহ। চিত্রাঙ্গ দান করেন যিনি তিনিই চিত্রাঙ্গদ। শবল হল কর্ব্বুর বা বিচিত্র। আর একটু শক্ত ভাষায় বললে, শবল মানে অনন্তরবৃত্ত্যুপাত্ত—অর্থাৎ ব্রাহ্মণের ক্ষত্রিয়বৃত্তিতে, ক্ষত্রিয়ের বৈশ্যবৃত্তিতে ও বৈশ্যের শূদ্রবৃত্তিতে অর্জিত ধন হল শবল। ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণ্যবৃত্তিতে, ক্ষত্রিয়ের ক্ষত্রিয়বৃত্তিতে, বৈশ্যের বৈশ্যবৃত্তিতে এবং শূদ্রের শূদ্রবৃত্তিতে অর্জিত ধন হল শুভ্র। কিন্তু শূদ্রের অন্য বৃত্তিতে অর্জিত ধন বা বৈশ্যের ক্ষত্রিয়বৃত্তিতে কিংবা ব্রাহ্মণ্যবৃত্তিতে উপার্জিত অর্থ, ক্ষত্রিয়ের ব্রাহ্মণ্যবৃত্তিতে অর্জিত অর্থ হল কৃষ্ণ ধন। ‘শবল’ হল শুভ্র ও কৃষ্ণের মধ্যবর্তী অর্থাৎ ধূসর অর্থ। রাষ্ট্র তাকে মান্যতা দিলে তা শুভ্র হবে নচেৎ কৃষ্ণ ধন হিসাবে নিষিদ্ধ হবে। চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য দুই ভাইয়ের পিতা ক্ষত্রিয় শান্তনু কিন্তু মাতা দাশরাজকন্যা অর্থাৎ শূদ্রকন্যা। উপরিচর বসুর উপাখ্যান পরে সংযোজিত হয়েছে। অনুলোম বিবাহের নিয়মানুযায়ী ক্ষত্রিয়-শূদ্রার মিলনে উৎপন্ন পুত্র হবে উগ্র, যার পেশা হল গর্তের প্রাণি মেরে বেড়ানো। এই হল মনুর রাজনৈতিক-সামাজিক নিয়ম। কিন্তু যেহেতু পরাশরের পূর্বতন স্ত্রী (গান্ধর্বমতে বিবাহ হয়েছিল) সত্যবতী মনুর নিয়মানুযায়ী পুনর্ভু হতে পারেন না, ফলে শান্তনুর সঙ্গে গন্ধকালী বা সত্যবতীর বিবাহকালে মনুর এই নিয়ম পরাশর বদলে ফেলেন। তিনি জানালেন, নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ/পঞ্চস্বাপৎসু নারীনাং পতিরণ্যে বিধীয়তে। তৃতীয় যুক্তির নিরিখে সত্যবতী পরাশরকে বাদ দিয়ে শান্তনুর পাণিগ্রহণ করেছেন। ঠিক একই নিয়মে চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্যের উগ্র থেকে ক্ষত্রিয়করণ করা হল মুখ্যত দুটি উপায়ে। এক, উপরিচর বসু ও স্বর্গবেশ্যা অদ্রিকার অলৌকিক উপাখ্যান এনে এবং দ্বিতীয়ত সংকর জাতি থেকে চতুর্বর্ণে ফিরিয়ে আনা-রূপ পরাশর-সংহিতার বলে।
এতে করে গন্ধর্ব পুরুষরা বেজায় চটে গেলেন। তাঁদের বার্তা বা অর্থনীতি এবং দণ্ডনীতি বা রাজনীতি কিঞ্চিৎ ভিন্ন। গন্ধর্বরা হলেন দেবযোনিবিশেষ। লিঙ্গ মানে হল জ্ঞানসাধন হেতু, পক্ষান্তরে যোনি হল উৎপত্তিস্থান। আধুনিক পরিভাষায়, যোনি যদি হার্ডওয়্যার হয় তাহলে লিঙ্গ হল সফটওয়্যার। এ প্রসঙ্গে অমৃতলিঙ্গম্ ও ব্রহ্মযোনির কথা ভাবা যেতে পারে। গন্ধর্ব চিত্রাঙ্গদ হত্যা করেন গন্ধকালীপুত্র চিত্রাঙ্গদকে। কী ছিল হত্যার কারণ? গন্ধর্বরাজ চিত্রাঙ্গদ গন্ধকালীজ চিত্রাঙ্গদকে বললেন, তোমার আমার একই নাম; হয় তুমি অন্য নাম নাও অথবা আমার সঙ্গে যুদ্ধ করো। কুরুক্ষেত্রের হিরণ্মতী নদীর তীরে তাঁদের যুদ্ধ শুরু হল। কেন নদীর নাম হিরণ্মতী? সে স্বর্ণময়ী, তার উপর ভাসে পণ্যের তরণী এবং সে চন্দ্রানুগত—অন্যের শ্রমে ভাস্বর।
আরও পড়ুন
একে একে সাত পুত্রকে হত্যা করলেন গঙ্গা, দুঃখে শোকে অস্থির শান্তনু
রাহুর কিরণে হিরণ-কিরণ শেষ হবে ভেবে গন্ধর্বরাজ ও গন্ধকালীজের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে নিহত হন শান্তনুপুত্র। মনে রাখতে হবে, পুঁজির প্রশ্নে শান্তনু ও সত্যবতীর পুত্র গন্ধর্বরাজের প্রতিযোগী হয়ে উঠেছিলেন। গন্ধর্বদের মতো যক্ষরাও দেবযোনিবিশেষ। বিচিত্রবীর্য অগ্রজের প্রদর্শিত পথে হেঁটেছিলেন, তা তার নাম ও কর্ম অনুধাবন করলেই বোঝা যায়। ‘বিচিত্র’ হল শবল অর্থ। চিত্র ও বিচিত্রের মধ্যে তফাৎ তেমন নেই। বিচিত্র হল বিশেষ চিত্র। বীর্য হল শক্তি বা ধন। চিত্রাঙ্গদ মারা যাওয়ার পর বিচিত্রবীর্য রাজা হলেন। রাজনীতি ও অর্থনীতি একই রইল। শূদ্রদের শ্রমে গড়ে উঠল সাম্রাজ্য। বহু জনের শ্রমের ফসল কতিপয়ের হাতে কেন্দ্রীভূত হল। সে অর্থ শুভ্র নয়, আদতে কৃষ্ণ। কিন্তু রাষ্ট্রের মদতে তা হয়ে উঠল ধূসর বা শবল অর্থ, পরে ‘বৈধ’ সম্পদ। বিচিত্রবীর্যের বিবাহ হল কাশীরাজের দুই কন্যার সঙ্গে। এই বিবাহসম্পর্ক ছিল রাজনৈতিক। কাশী শিবপুরী হলেও সেখানে রাজত্ব করতেন যে চন্দ্রবংশীয় রাজা তিনি রাজা কাশের উত্তরপুরুষ। কাশীরাজরা যদুবংশের বিরোধী ছিলেন। কাশীরাজের তিন কন্যা—অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকা। শেষ দুজনের সঙ্গে বিচিত্রবীর্যের বিবাহ হয় এবং তাঁদের সঙ্গে অতিরিক্ত কামক্রীড়ার ফলে বিচিত্রের মৃত্যু হয়।
আরও পড়ুন
যৌথ মালিকানা থেকে পরিবার হয়ে ব্যক্তি মালিকানার সূচনা; সাক্ষী মহাভারত
প্রথম কন্যা অম্বা পরে দেবব্রত-ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হন। অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকা শব্দের মূল উৎপত্তি হল ‘অম্ব্’, যেখান থেকে অম্বষ্ঠ শব্দটিও এসেছে। পরাশর ছিলেন অম্বষ্ঠ। অম্ব্ ধাতু আকাশকে নির্দেশ করে, যা গতিশীল। গতিশীল জল তার আর এক অর্থ। চিত্রাঙ্গদের মৃত্যুর কারণ যেমন গন্ধর্ব চিত্রাঙ্গদ, তেমনি বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর নিমিত্ত কারণ হলেন অম্বিকা ও অম্বালিকা, অব্যবহিত কারণ যক্ষ্মা—যা এসেছে ‘যক্ষ্’ (যক্ষের উৎপত্তিও একই ধাতু) ধাতু থেকে। যক্ষ দেবযোনিবিশেষ। পরবর্তীকালে অম্বা দ্রুপদের ঘরে কন্যা হিসাবে জন্মান এবং যক্ষ স্থূণাকর্ণের সঙ্গে লিঙ্গবিনিময় করে পুরুষ হন। তিনি শিখণ্ডী। তিনি বিনাশ করেন শান্তনুপুত্র দেবব্রত-ভীষ্মকে। এই ভাবে শেষ হয় শান্তনুর বংশধরেরা। শান্তনু নষ্টপ্রায় বংশের রক্ষক বলে তার নাম ছিল ‘শান্তনু’। মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ বলেছেন, শান্তস্যোপরতস্য বংশস্য সন্তানো বিস্তার ইতি শান্ততনুঃ, ততস্তকারলোপেন ‘শান্তনু’-রিতি নাম।
আরও পড়ুন
কর্ণ ও অর্জুনের বিবাদ নেমে এসেছিল সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক সংঘাতেও
হস্তিনায় তখন কোনও রাজা রইল না। অরাজক রাজ্য বলতে যা বোঝায় তাই হল কুরুরাজ্য। বৃহস্পতি, বিশালাক্ষ, কাব্য বা উশনাঃ, মহেন্দ্র, ভরদ্বাজ, গৌরশিরা সে যুগের রাজনীতিশাস্ত্রপ্রণেতা। তাঁরা সকলেই জানালেন, রাজ্যকে রাজাহীন রাখা চলবে না। রাজা চেন্ন ভবেল্লোকে পৃথিব্যাং দণ্ডধারকঃ/জলে মৎস্যার্নিবাভক্ষ্যণ্ দুর্ব্বলং বলবত্তরাঃ। রাজদণ্ডের তথা রাজনীতির ভয়ে প্রজারা কর্তব্য ও অধিকারে প্রতিষ্ঠিত থাকে। দেবব্রত সিংহাসনে বসতে পারবেন না। এমতাবস্থায় রাজমাতা সত্যবতীর আর এক পুত্র রয়েছেন, যদিও তিনি শান্তনুর ঔরসপুত্র নন। কিন্তু যেহেতু সেই পুত্র সত্যবতীর গর্ভে জাত, বা এক মতানুযায়ী, ওই পুত্র হলেন কানীন। রাজনৈতিক ও সামাজিক সংহিতায় রয়েছে, পুত্র দ্বাদশ প্রকারের। তাদের মধ্যে কানীন পুত্র ‘ঔরস’ না হলেও তাকে বলা হয়—ব্যবহিত-ঔরসপুত্র। এই পুত্র বন্ধুদায়াদ অর্থাৎ পিতার সম্পত্তির অধিকারী। সেই হিসাবে ব্যাসদেব শান্তনুর সম্পত্তির অধিকারী, অর্থাৎ তিনিই সিংহাসনের দাবিদার। অন্তত স্মৃতিশাস্ত্র সে কথা বলে। যেহেতু দুজন ঔরসপুত্র মৃত ও একজনকে সিংহাসন দেওয়া যাবে না। ফলে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস ছাড়া আর কোনও উত্তরসূরী রইল না চন্দ্রবংশের রাজা শান্তনুর। যদিও ব্যাসদেব জৈবিক পিতার দিক থেকে সূর্যবংশের কুলগুরু বশিষ্ঠের বংশধর।
সত্যবতীর ডাকে ব্যাসদেব এলেন হস্তিনার রাজপ্রাসাদে। রাজনীতি বাঁক নিল অন্য পথে।
আরও পড়ুন
রাজনৈতিক নেতা হবেন সংকীর্ণ ধর্মগুণের ঊর্ধ্বে, এমনই শিক্ষা দেয় মহাভারত
অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা
আরও পড়ুন
বাগ-দেবী সরস্বতীর হাত ধরেই সৃষ্টি দণ্ডনীতি বা রাজনীতির
Powered by Froala Editor