মহাভারতে রাজনীতি – ৫
আগের পর্বে
আস্তিকতা এবং নাস্তিকতা দুটি বিপরীত মেরু ভাবা অস্বাভাবিক নয়। তবে এই দুটি ধারণাই জন্মায় জড় এবং চৈতন্য থেকে। আস্তিকতার ক্ষেত্রে চৈতন্য মুখ্য। এবং নাস্তিকতার ক্ষেত্রে মুখ্য জড়। এই দর্শন থেকে উঠে আসে অর্থনীতির তাৎপর্য। চন্দ্রবংশীয় রাজা বিশ্বামিত্রের সঙ্গে সূর্যবংশের কুলগুরু বশিষ্ঠের বিরোধ বাঁধে। যুদ্ধে বিশ্বামিত্রের সমস্ত শর বশিষ্ঠ রুখে দেন দণ্ডনীতি দিয়েই। রাজনীতিতে দু’জনের পাল্লা সমান থাকলেও তাত্ত্বিকযুদ্ধে বার বার পরাজিত হন বিশ্বামিত্র। তাঁর ধিক্কার জন্মায় ক্ষত্রিয় বলের প্রতি। তিনি সাধনায় বসলেন। অন্যদিকে বশিষ্ঠে এই যুদ্ধে বৈশ্যদের পাশে পেতে পুত্রকে বৈশ্যকন্যার সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাব পাঠালেন তারপর...
রাজনীতির অঙ্গ হিসাবে যথাকালে বশিষ্ঠপুত্র শক্ত্রির সঙ্গে বৈশ্য চিত্রমুখের কন্যা অদৃশ্যন্তীর বিবাহ সম্পন্ন হল। অদৃশ্য শক্তি রচনা করেও শেষরক্ষা হল না। চন্দ্রবংশীয় ক্ষত্রিয় রাজা বিশ্বামিত্রের প্ররোচনায় কল্মাষপাদ রাক্ষস ভক্ষণ করল সূর্যবংশের কুলপুরোহিত বশিষ্ঠপুত্র শক্ত্রিকে। গর্ভবতী চিত্রমুখকন্যা বিধবা হলেন। যথাকালে তিনি একটি পুত্রের জন্ম দিলেন, সেই পুত্রের নাম ‘পরাশর’। মনুসংহিতা অনুযায়ী, এই পুত্র চতুর্বর্ণের মধ্যে পড়েন না, তিনি সংকর। পরাশর হলেন অম্বষ্ঠ। পিতামহ বশিষ্ঠ তাঁর ব্রাহ্মণ্যকরণ করলেন। পরাশর এইবার সূর্যবংশের কুলপুরোহিত বশিষ্ঠের রাজনীতির হাল ধরলেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তাঁর পিতা ও পিতামহ ব্রাহ্মণ বা মেধাজীবী হলেও মা হলেন বৈশ্যা, মাতামহ চিত্রমুখও প্রখ্যাত ব্যবসায়ী। ব্রাহ্মণ-বৈশ্যের হাত ধরে রচিত হল রাজনীতির নতুন সংহিতা, কালক্রমে যা চন্দ্রবংশীয় রাজাদের রাজধর্ম ও সামাজিক ধর্মের মূল গ্রন্থ মনুসংহিতার জায়গা দখল করে নিল। কীভাবে তা সম্ভব হল, সেই রাজনৈতিক আলোচনায় প্রবেশ করা যাক।
শান্তিপর্বের রাজকরণাধ্যায়ে বলা হয়েছে, সমাজে বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হলে মানুষ পিতামহ ব্রহ্মার শরণ নেন। ব্রহ্মা মনুকে পৃথিবীর রাজপদ গ্রহণ করার আদেশ দেন। মনু প্রাথমিকভাবে গররাজি থাকলেও তিনি অবশেষে সেই ভার গ্রহণ করেন। মনুই পৃথিবীর আদি রাজা। রাজা না থাকলে সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। আবার অকর্মণ্য ও অযোগ্য রাজার দ্বারাও শাসনকার্য চলতে পারে না। হস্তিনার রাজা তখন প্রতীপপুত্র শান্তনু। শান্তনুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দেবাপি বনে চলে গেলে শান্তনু হস্তিনার রাজা হন। তিনি গঙ্গার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। যিনি পাপহরণ করেন, দুঃখ বিনাশ করেন; সুখদাত্রী, মোক্ষদাত্রী, পরম গতি—তিনিই গঙ্গা। কলিযুগে অবতার হলেন কল্কি, শাসক হল ধনলোভী এবং বুদ্ধিজীবী শাস্ত্রহীন কিন্তু গঙ্গাই পরম তীর্থ। শান্তনুর সময়কাল অবশ্য দ্বাপর যুগে। পাশার যে দিকে দুটি বিন্দু থাকে তাকে বলে দ্বাপর। পাশার যে দিকে এক বিন্দু থাকে সেই পাশ হল কলি। পাশাকে যদি রাজনীতি বলা হয়, যে রাজনীতির পরম ভক্ত ছিলেন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির—তাহলে দেখা যাবে, দ্বাপরের রাজনীতি ছিল মিশ্র—সম্পত্তির যৌথ মালিকানার সঙ্গে তখন ধীরে ধীরে ব্যক্তিমালিকানার আবির্ভাব হচ্ছে। কলিতে অর্থাৎ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরে যে যুগের সূচনা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ পারিবারিক/ ব্যক্তিমালিকানার যুগ। অর্থনীতির এই জায়গাকে ঘিরে তখনকার রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে। এখানে শান্তনুর দুই পত্নী—গঙ্গা ও মৎস্যগন্ধার ভূমিকা গুরুতর। গঙ্গা আদতে শুভ্র পণ্যপ্রবাহ, তা ধীরে ধীরে জ্যোৎস্নাবর্ণ থেকে চন্দন, তার পর আবার আস্তে আস্তে বর্ণহীন হতে শুরু করল। সেই স্থানে এল যমুনার প্রবাহ, এই যমুনায় খেয়া পারাপার করতেন মৎস্যগন্ধা, যিনি পারানির কড়ি নিতেন বলে তাঁর গায়ে ছিল আঁশটে গন্ধ। সমাজে তিনি ছিলেন নিন্দিত। মৎস্যগন্ধার গায়ে মৎস্য অর্থাৎ নিজস্ব মালিকানার গন্ধ ছিল। গঙ্গার ক্ষেত্রে যা ছিল না। সূর্যবংশের কুলগুরু বশিষ্ঠের যৌথ সম্পত্তি নন্দিনীকে চুরি করতে এসেছিলেন তেত্রিশ কোটি দেবতার যে আট কোটি বসু তাঁদের বাঁচাতে মর্ত্যে মানবী হিসাবে এসেছিলেন শুভ্র প্রবাহের গঙ্গা। ‘বসু’ শব্দের ধাতু ‘বস্’-এর একটি অর্থ হল অপহরণ।
ইক্ষাকুরা সূর্যবংশীয়। ইক্ষাকু বংশের একদা রাজা ছিলেন মহাভীষ। মহাভীষ ‘পুনর্জন্ম’ লাভ করেন চন্দ্রবংশীয় রাজা প্রতীপের ঔরসে, সুনন্দার গর্ভে। তাঁর নাম হয় ‘শান্তনু’। তিনি নষ্টপ্রায় বংশের রক্ষক ছিলেন বলে এই রকম নামকরণ—শান্ততনু। শান্তনু যুবক হলে প্রতীপ তাঁকে জানান, একজন দিব্য রমণী আসবেন, কোনও পরিচয় না জানতে চেয়ে শান্তনু যেন তাঁকে বিবাহ করেন। এই কথা বলে প্রতীপ বাণপ্রস্থে চলে গেলেন। শান্তনু হস্তিনার রাজা হওয়ার পর এক সময় গঙ্গা তাঁর উদ্দেশ্য সফল করতে এলেন। শান্তনু তাঁকে স্ত্রী হিসাবে পাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিলেন। অষ্টবসুর কথা ভাবতে ভাবতে শরীরিণী গঙ্গা প্রতীপপুত্রকে বললেন,
ভবিষ্যমি মহিপাল মহিষী তে বশানুগা।
যত্তু কুর্য্যামহং রাজন্ শুভং বা যদিবাশুভম্।
ন তদ্বারয়িতব্যাস্মি ন বক্তব্যা তথাপ্রিয়ম্।
-- মহারাজ, আমি যা করব, ভাল হোক বা মন্দ, তুমি বাধা দেবে না এবং আমাকে কোনও অপ্রিয় কথা বলবে না। সেরূপ করলে তখনই তোমাকে ত্যাগ করব। তুমি এই শর্তে সম্মত হলে আমি তোমার মহিষী হতে রাজি আছি।
একে একে সাত পুত্রের জন্ম দিয়ে গঙ্গা তাদের জলে ডুবিয়ে হত্যা করলেন। শান্তনু চুক্তিবদ্ধ তাই কিছু বলতেন না কিন্তু দুঃখ-শোকে তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন। অষ্টম পুত্র জন্মানোর পর শান্তনু গঙ্গাকে বললেন, পুত্রঘাতিনী, তুমি কে, কেন এই মহাপাপ করছ? হে পুত্রঘ্নি, তোমার পাপের সীমা নেই। গঙ্গা জবাব দিলেন, তুমি পুত্র চাও অতএব এই পুত্রকে বধ করব না, কিন্তু তোমার সঙ্গে আমি আর থাকব না। আমি বিদায় নিচ্ছি।
আরও পড়ুন
যৌথ মালিকানা থেকে পরিবার হয়ে ব্যক্তি মালিকানার সূচনা; সাক্ষী মহাভারত
অহং গঙ্গা জহ্নুসুতা মহর্ষিগণসেবিতা।
দেবকার্য্যার্থ-সিদ্ধ্যর্থমুষিতাহং ত্বয়া সহ।
আমি মহর্ষিদের দ্বারা সেবিতা জাহ্নবী গঙ্গা। দেবতাদের কার্যসিদ্ধির জন্য তোমার সঙ্গে এতকাল বাস করেছি। গঙ্গা নিজের সম্যক পরিচয় দিলেন এবং বসুগণের কাহিনি সবিস্তারে বললেন। সূর্যবংশের পুরোধা বশিষ্ঠদের যৌথ সম্পত্তি চুরি করেছিল অষ্টবসু। তাই তারা অভিশপ্ত হয়ে মর্ত্যে এসেছিল। আমি ছিলাম গর্ভধারিণী। আট জনের মধ্যে ‘দ্যু’ নামক বসুর অপরাধ ছিল সবচেয়ে বেশি, তাই সে বেশি দিন মর্ত্যে থাকবে। এই পুত্রকে গঙ্গার দান বলে মনে করবে। গঙ্গা নবজাতককে সঙ্গে নিয়ে অন্তর্হিত হলেন। শান্তনু শোকাকুল হয়ে প্রাসাদের অভ্যন্তরে চলে গেলেন। কিন্তু জীবিত পুত্রকেও ‘রক্ষা’ করতে পারলেন না চন্দ্রবংশীয় রাজা শান্তনু। গঙ্গা দেবব্রতকে নিয়ে চলে গেলেন। খুবই আশ্চর্যের কথা দেবব্রতকে রাজনীতির পাঠ দিলেন বশিষ্ঠ মুনি। আর পরশুরামের কাছে দেবব্রত শিখলেন শস্ত্রজ্ঞান।
মহেষ্বাসমিমং রাজন্ রাজধর্ম্মার্থকোবিদম্।
ময়া দত্তং নিজং পুত্রং বীরং বীর গৃহং নয়।
হে রাজন, মহাধনুর্ধর ও রাজধর্মার্থজ্ঞানী এই পুত্রটিকে তোমার হাতে দিচ্ছি। হে বীর, তোমার এই বীর পুত্রটিকে নিজ গৃহে নিয়ে যাও।
শান্তনু ফেরত পেলেন পুত্রকে। এর পর গঙ্গাকে আর দেখতে পাওয়া যায় না। সেই শুভ্র প্রবাহের জায়গায় এলেন কৃষ্ণ জলপ্রবাহের বা পণ্যপ্রবাহের খেয়ানি মৎস্যগন্ধা। তার পিছনে ছিল বশিষ্ঠের রাজনীতি। বশিষ্ঠের পৌত্র পরাশরের নিয়মিত যাতায়াত ছিল হস্তিনায়। হস্তিনায় এই সময় বিপত্নীক শান্তনু রাজত্ব করছেন, রয়েছেন যুবরাজ দেবব্রত যিনি গঙ্গাপুত্র। এমন সময় পরাশর বা পরপরিশ্রমজীবী অর্থাৎ মেধাজীবী গাঁটছড়া বাঁধলেন হস্তিনারই এক শূদ্রকন্যা মৎস্যগন্ধার সঙ্গে। তাঁর শূদ্রত্বের ক্ষত্রিয়করণ করা হল, যেমন অম্বষ্ঠ পরাশরের ব্রাহ্মণ্যকরণ হয়েছিল। তাঁকে শোনানো হল অলৌকিক উপাখ্যান।
আরও পড়ুন
কর্ণ ও অর্জুনের বিবাদ নেমে এসেছিল সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক সংঘাতেও
পুরুবংশজাত উপরিচর বসু চেদি দেশের রাজা ছিলেন। তাঁর পত্নীর নাম গিরিকা। গিরিকা ছিলেন কোলাহল পর্বত ও শুক্তিমতী নদীর কন্যা। স্ত্রীযোনিই শুক্তির উৎপত্তিস্থান। রাজধানীর পাশেই পাশেই ছিল শুক্তিমতীর প্রবাহ বা পল্লী। কোলাহলের ‘হল্’ ধাতুর অর্থ হল কর্ষণ। ‘কোল’ মানে হল সংঘাত বা aggregate। এক কথায়, ‘কোল’ হল সাধারণ জনগণ যারা কর্ষণের জন্য মুখিয়ে থাকে। তারাই যায় শুক্তিমতীর কাছে। এমনই এক মিলনে উৎপন্ন এক পুত্র ও এক কন্যাকে উপরিচর প্রাসাদে আনেন। ছেলেটি হয় সেনাপতি, মেয়েটি ভার্যা। ওই কন্যার নাম গিরিকা। একবার মৃগয়ায় গিয়ে পত্নীকে স্মরণ করে উপরিচর বসুর শুক্র স্খলন হয়। সেই স্খলিত শুক্র এক শ্যেনপক্ষী পত্রপুটে নিয়ে উড়ে যায়। পথে অন্য আর একটি শ্যেনপক্ষীর আক্রমণে শুক্র যমুনার কৃষ্ণবর্ণ জলে পতিত হয়। যমুনার জলে বাস করত এক মৎসী যে ছিল ব্রহ্মশাপগ্রস্থ অপ্সরা অদ্রিকা। অপ্সরা বা স্বর্গবেশ্যা অদ্রিকা গর্ভবতী হয়। দশম মাসে ওই মৎস্যরূপী অপ্সরা ধীবরের জালে ধরা পড়লে তার পেট চিরে একটি পুত্র ও এক কন্যা পাওয়া যায়। পুত্রটিকে উপরিচর বসু গ্রহণ করলেও কন্যাটিকে ধীবরের কাছে রেখে চলে যান। পুত্রের নাম মৎস্য আর কন্যাটি মৎস্যগন্ধা। এই মৎস্যগন্ধা বা ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্গাতাদের সঙ্গে পরাশরদের মিলন হল।
অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা
আরও পড়ুন
রাজনৈতিক নেতা হবেন সংকীর্ণ ধর্মগুণের ঊর্ধ্বে, এমনই শিক্ষা দেয় মহাভারত
Powered by Froala Editor