মহাভারতে রাজনীতি – ৪
আগের পর্বে
রাজনীতির জগতে ব্যাসদেব ও ভীষ্মদেবের লড়াই হল সূর্যবংশ বনাম চন্দ্রবংশের লড়াই। এই লড়াইয়ের সূচনা রাজনীতিতে যুক্তিবিদ্যার ভূমিকা নিয়ে। দর্শনের এই বৈপরিত্য দেখা যায় দেবতাদের সঙ্গে অসুরদেরও। তা রাজনীতি বা অস্ত্রযুদ্ধ— যে কোনো বিষয়েই। মহাভারতে সূর্যপুত্র কর্ণকে নরকাসুর বলেও পরিচয় দেওয়া হয়েছে। যে কারণে অর্জুনের সঙ্গে তাঁর জন্মগত বৈরিতা। তাঁদের দর্শন এবং রাজনীতিও ভিন্ন। এই লড়াই শুধু দর্শনেই আবদ্ধ ছিল না, নেমে এসেছিল সাম্প্রদায়িক সংঘাতেও।
এটা ভাবা অস্বাভাবিক নয় যে, আস্তিকতা ও নাস্তিকতা দুটি বিপরীত মেরু, কখনও কখনও বিরুদ্ধ মেরুও বটে। নাস্তিকতা জগতকে জড় দিয়ে ব্যাখ্যা করে, চৈতন্য আসে সেই জড় থেকে; এটাকে তাই জড়বাদ বললে অত্যুক্তি হয় না। পক্ষান্তরে, আস্তিকতা জগতকে চৈতন্য দিয়ে ব্যাখ্যা করার পক্ষপাতী, যে চৈতন্য জড় থেকে উদ্ভূত নয়। আস্তিকের কাছে চৈতন্য মুখ্য, জড় গৌণ। কিন্তু নাস্তিক ভাবেন, জড় হল মুখ্য। মহাভারতে কৌরব ও পাণ্ডবের যে লড়াই তা একদিক থেকে ঔরসজাত (স্বাভাবিক) ও ক্ষেত্রজ (পরিবর্ত, বদলি, by proxy) সন্তানদের লড়াই। সূর্য বংশ ও চন্দ্র বংশের যুদ্ধের অনুরূপ এই লড়াই। নাস্তিকতা বনাম আস্তিকতা আসলে সৌর বংশ বনাম চন্দ্র বংশ অথবা স্বাভাবিক ঔরসজাত সন্তান বনাম পরিবর্ত ক্ষেত্রজদের লড়াই। জড় থেকে যে চেতনার উৎপত্তি, সেই চেতনাকে যদি আলোর সঙ্গে তুলনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে সূর্যের সে আলো আছে আবার ঔরসজাত সন্তান পিতার বীর্যে ভাস্বর। পক্ষান্তরে চাঁদের যে আলো তা ধার করা, ঠিক তেমনি ক্ষেত্রজ সন্তানরা মায়ের বিবাহিত স্বামীর বীর্যে উৎপন্ন নয়; ধার করা বীর্য থেকে তাদের জন্ম। চৈতন্যরূপ আলো ভূমিজ কিনা, নাকি তা বাইরে থেকে আগত, সেই প্রশ্ন নাস্তিক ও আস্তিকদের ক্ষেত্রে উঠলে দেখা যাবে নাস্তিক বলবেন চৈতন্য হল জাগতিক জড়-উপাদান থেকে উদ্ভূত কিন্তু আস্তিক বলবেন, চেতনা বহিরাগত।
এই দর্শন থেকে অর্থনীতির জায়গাটা পরিষ্কার হয়ে যায়। সেটি নিয়ে দু চার কথা বলা প্রয়োজন। সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে মহাভারতে বেশ কয়েকটি স্তর আছে। যৌথ মালিকানা, গোষ্ঠী মালিকানা থেকে ক্রমে পরিবারের হাতে সম্পদের মালিকানা চলে যাচ্ছে এবং আরও পরে ব্যক্তি মালিকানার সূচনা হচ্ছে। শব্দতত্ত্ব পালটে যাওয়ার সেটি একটি বড়ো কারণ। শব্দ ও অর্থের মধ্যে যে স্বাভাবিক ও নিত্য সম্বন্ধ যৌথ মালিকানার সমাজে প্রচলিত ছিল, কালক্রমে পণ্যবাহী সমাজে সেই শব্দার্থতত্ত্ব বদলে গিয়ে শব্দ ও অর্থের মধ্যে একরৈখিক ও আরোপিত সম্পর্ক মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। যৌথ মালিকানার জায়গাটি একটু দেখে নেওয়া যাওয়া যাক।
সূর্যবংশের কুলগুরু বশিষ্ঠ মুনি ছিলেন অসুরগুরু শুক্রাচার্যের রাজনীতির উত্তরসাধক। স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালের যে বিপুল ঐশ্বর্য তা দেবতারা দাবি করলে অসুরদের সঙ্গে দেবতাদের বিরোধ বাধে। দেবতারা বৃহস্পতিকে (যাঁর ক্ষেত্রজ পুত্র বুধ—যিনি চন্দ্রবংশের প্রথম পুরুষ) এবং অসুররা শুক্রাচার্যকে গুরুর পদে বরণ করেন। এই দুই গুরুর মধ্যে তীব্র বিরোধ ছিল—তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক উভয় ক্ষেত্রেই। তাত্ত্বিক দিক থেকে বিরোধ হল, বৃহস্পতি অর্থনীতি ও রাজনীতিশাস্ত্রকে পৃথক বা স্বতন্ত্র বলে মানতেন। মহাভারতের রাজনীতি যেহেতু নীতিশাস্ত্র থেকে পৃথক নয়, তাই তাই বৃহস্পতির অর্থনীতি নৈতিকতাশূন্য। কল্যাণমূলক অর্থনীতির যে ধারণা আমরা ইদানীংকালে পাই এবং প্লেটোর ডায়ালগসমূহে পেয়েছি, তা থেকে বৃহস্পতি সম্পূর্ণ অন্য ধারার মত পোষণ করতেন। অন্য দিকে শুক্রাচার্যের অর্থনীতি নৈতিকতাসম্পন্ন। অসুররা ছিলেন প্রাকৃতিক শক্তির পূজারী। অপর দিকে দেবতারা দুর্ধর্ষ যুদ্ধবাজ এবং সম্পদ কুক্ষিগত করার নেশায় আচ্ছন্ন। বেদে রয়েছে, অসুররা উন্নত সভ্যতার অধিকারী ছিলেন। অসুররা ছিলেন যৌথ মালিকানার পক্ষে। সূর্যংশীয়রাও তাই। কিন্তু দেবতারা বা অধ্যাত্মবাদীরা কিংবা ক্ষেত্রজ পুত্ররা কেউই যৌথ মালিকানায় বিশ্বাসী ছিলেন না।
যৌথ মালিকানার এই ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন ইক্ষ্বাকু তথা সূর্যবংশীয় সমস্ত রাজা। তাঁদের গুরু বশিষ্ঠও ছিলেন এই রাজনীতির অন্যতম পুরোধা। যদিও চন্দ্রবংশীয় দেবব্রত-ভীষ্ম শাস্ত্রশিক্ষা করেছিলেন মহর্ষি বশিষ্ঠের কাছ থেকে, কিন্তু তিনি যেহেতু চন্দ্রবংশীয় তাই তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি এবং পরবর্তী সময়ে যাতে চন্দ্রবংশ থেমে যায়, সেই জন্য আজীবন ব্রহ্মচারী থাকার শপথ নেন। বিমাতা সত্যবতীর অনুরোধে বৈমাত্র ভ্রাতার বধূদের গর্ভে নিয়োগ প্রথায় সন্তান উৎপাদনে সম্মত হননি। তখন সত্যবতী আহ্বান করেন তাঁর কানীনপুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসকে। এই বেদব্যাস বশিষ্ঠ মুনির বংশধর, তিনি অদৃশ্যন্তী-শক্ত্রির পৌত্র এবং মৎস্যগন্ধা-পরাশরের পুত্র।
আরও পড়ুন
যৌথ মালিকানা থেকে পরিবার হয়ে ব্যক্তি মালিকানার সূচনা; সাক্ষী মহাভারত
‘বশিষ্ঠ’ শব্দের অর্থ অতিশয় বশী। তাঁর স্ত্রীর নাম অরুন্ধতী---‘অরুন্ধতী’ শব্দের অর্থ হল, যাকে রুদ্ধ করা যায় না। অরুন্ধতীর আর এক অর্থ জিহ্বা। এই দুই পরস্পরবিরোধী প্রত্যয় থেকে আসে শক্তি। তাঁদের পুত্র শক্ত্রির নামের তাৎপর্য এমনই। বশিষ্ঠের ছিল এক কামধেনু, যার নাম নন্দিনী। ‘নন্দিনী’ মানে আনন্দয়িত্রী, সে সুরভিকন্যা। নন্দিনীর কাছ থেকে চাইলেই পাওয়া যায় জীবনধারণের সব উপাদান—অন্নরাশি, ডাল, দই, ঘি, মিষ্টান্ন, মদ—এমনকি জামাকাপড়ও। বশিষ্ঠের যে সিস্টেম বা তন্ত্র, তাতে খাদ্য-বস্ত্রের জন্য মানুষকে কেবল নিজের শ্রমের উপর নির্ভর করতে হত না, যৌথ সমাজ তার ব্যবস্থা করত। একদা বিশ্বামিত্র এসে এই নন্দিনীকে নিজের, অর্থাৎ ব্যক্তিমালিকানার অধীন করতে চান। বশিষ্ঠ তাতে সম্মত হননি। বিশ্বামিত্র তখন এই তন্ত্র ভেঙে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। কে এই বিশ্বামিত্র? তিনি গাধির পুত্র, তাই তাঁকে গাধেয় বলা হয়। গাধি হলেন রাজা কুশের পুত্র, যে কুশ পুরুবংশের রাজা। পুরু যযাতির পুত্র, যযাতির পূর্বপুরুষ যথাক্রমে পুরূরবা ও বুধ; অর্থাৎ বিশ্বামিত্র হলেন চন্দ্রবংশীয় রাজা। সেই বিশ্বামিত্র সূর্যবংশের কুলগুরু বশিষ্ঠের সঙ্গে বিরোধে মাতোয়ারা হলেন।
বশিষ্ঠকে বলা হল, কেন তিনি বিশ্বামিত্রের কাজে বাধা দিচ্ছেন না। জবাবে ঋষি বললেন, ব্রাহ্মণের বল ক্ষমা। তাঁর যৌথ মালিকানাতন্ত্রের যদি বল থাকে, সে আপনাআপনিই টিকে যাবে। তখন পহ্লব, দ্রাবিড়, শক, যবন, শবর, পৌণ্ড্র, কিরাত, সিংহল, বর্বর, খোশ, পুলিন্দ, চীন, হূন, কেরল, ম্লেচ্ছ প্রভৃতি সৈন্যরা বশিষ্ঠের হয়ে যুদ্ধ করলেন এবং বিশ্বামিত্রকে পরাজিত করলেন। কারা যুদ্ধ করেছিলেন নন্দিনীকে বা যৌথতন্ত্রকে রক্ষা করতে, নামগুলো দেখে আন্দাজ করা যায় যে তাঁরা কেউই সে যুগের নিরিখে তথাকথিত উন্নত জাতি বলে চিত্রিত নন। বিশ্বামিত্র তখন ক্রুদ্ধ হয়ে বশিষ্ঠের প্রতি নানা রকমের শর নিক্ষেপ করতে লাগলেন। বশিষ্ঠ কেবলমাত্র দণ্ডনীতি বা রাজনীতি দিয়ে সে সব রুখে দিতে সক্ষম হলেন। সেই দণ্ডের নাম ছিল ব্রহ্মদণ্ড। বিশ্বামিত্র ও বশিষ্ঠ কিন্তু সেখানেই থামলেন না। তাঁরা এই লড়াইকে নিয়ে গেলেন রক্তপাতের অঙ্গনে। বিশ্বামিত্রের শত পুত্র বশিষ্ঠের দ্বারা নিহত হয়। আবার বিশ্বামিত্রের প্ররোচনায় শাপগ্রস্থ কল্মাষপাদ রাক্ষস বশিষ্ঠের শত পুত্রকে ভক্ষণ করেন। রক্তপাতের রাজনীতিতে দু জনেই তখন সমানে পাল্লা দিচ্ছেন কিন্তু তাত্ত্বিক যুদ্ধে বিশ্বামিত্র বার বার বশিষ্ঠের কাছে পরাজিত হচ্ছেন। নন্দিনীকে বা যৌথতন্ত্রকে কোনও ভাবেই বিশ্বামিত্র ভেঙে দিতে পারছেন না। জল, জঙ্গল, জমি কোনও প্রকারেই অরণ্যচারী ‘বর্বর’ মানুষের যৌথ মালিকানা থেকে নিজের মালিকানায় আনতে পারছেন না। বিশ্বামিত্র ক্রমে বুঝতে পারলেন, ব্রাহ্মণ বা মেধাজীবীর সঙ্গে লড়তে গেলে শুধু তেজ বা ক্ষত্রিয়ের অস্ত্রবল দিয়ে লড়া সম্ভব নয়। বশিষ্ঠের রাজনীতি বা ব্রহ্মদণ্ডের আশ্চর্য ক্ষমতা দেখে নিজের ক্ষত্রিয় বলের প্রতি ধিক্কার জন্মাল তাঁর। তিনি সম্যকরূপে বুঝতে পারলেন এই রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক যুদ্ধ তাত্ত্বিক, অতএব তিনি সাধনায় বসলেন।
আরও পড়ুন
কর্ণ ও অর্জুনের বিবাদ নেমে এসেছিল সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক সংঘাতেও
ব্রাহ্মণ বশিষ্ঠ তখন ভাবছেন, চন্দ্রবংশীয় তথা ব্যক্তিমালিকানার পক্ষাবলম্বীদের শায়েস্তা করতে কী করা উচিত তাঁর? তিনি ভাবছেন, শূদ্ররা তাঁর সঙ্গে রয়েছে। পহ্লব, দ্রাবিড়, শক, যবন, শবর, পৌণ্ড্র, কিরাত, সিংহল, বর্বর, খোশ, পুলিন্দ, চীন, হূন, কেরল, ম্লেচ্ছ—তাঁরা তো সকলে শূদ্র। বাকি রইল বৈশ্য বর্ণ। ক্ষত্রিয় বিশ্বামিত্রের সঙ্গে লড়াইয়ে বশিষ্ঠদেব পাশে পেতে চাইলেন বৈশ্যদের। বৈশ্য চিত্রমুখ তখন ওই বর্ণের নেতা। তাঁর একটি সুন্দরী কন্যা আছে—নাম ‘অদৃশ্যন্তী’। বশিষ্ঠ তাঁর পুত্র শক্ত্রির বিবাহের প্রস্তাব পাঠালেন। সেই সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিধি অনুযায়ী, এই বিবাহ অসঙ্গত। কেননা, ব্রাহ্মণ শক্ত্রির সঙ্গে বৈশ্যকন্যা অদৃশ্যন্তীর মিলনে যে সন্তান উৎপন্ন হবে, সে হবে বর্ণবহির্ভূত, তার জাতি হবে সঙ্কর। সেই সন্তান ‘অম্বষ্ঠ’ বলে পরিচিত হবে। অম্বষ্ঠরা হয় বৈদ্যের কাজ করবেন নয়তো মাহুতবৃত্তি হবে তাঁদের জীবিকা নির্বাহের উপায়। বশিষ্ঠ ভাবলেন, অত ভেবে কাজ নেই। বৈশ্যদের পাশে পেতে গেলে তাঁকে এই বিবাহ দিতেই হবে।
অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা
আরও পড়ুন
রাজনৈতিক নেতা হবেন সংকীর্ণ ধর্মগুণের ঊর্ধ্বে, এমনই শিক্ষা দেয় মহাভারত
Powered by Froala Editor