যুধিষ্ঠিরের রাজলক্ষ্মী-কে তুলে দেবেন দুর্যোধনের হাতে, প্রস্তাব শকুনির

মহাভারতে রাজনীতি - ৩৩
আগের পর্বে

কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুনের মগধ যাত্রার খবর পেয়ে খুশি হলেন দুর্যোধন। কর্ণ ও একলব্য দুজনেই নিশ্চিন্ত ছিলেন যে জরাসন্ধের হাতে তিনজনের মৃত্যু হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জরাসন্ধেরই মৃত্যু সংবাদ এল। উপবাসক্লিষ্ট জরাসন্ধকে সহজেই হত্যা করলেন ভীম। শকুনি বললেন, যুধিষ্ঠির সম্রাট হলে তবেই আসল খেলা শুরু হবে। কারণ সম্রাট না হলে তাঁকে দূতক্রীড়ায় আহ্বান জানানো যাবে না। একলব্য জানালেন এরকম ছল করায় তাঁর আপত্তি আছে। যুধিষ্ঠিরের ইন্দ্রপ্রস্থ দেখে সকলেই মুগ্ধ হলেন। তিনি রাজসূয় যজ্ঞের দায়িত্ব দিলেন ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, কর্ণ এবং কৌরব ভাইদের উপরেই।

একসময় এল অর্ঘ্য দেওয়ার পালা। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, হে ভরতনন্দন এখন রাজাদের মধ্যে থেকে যোগ্য লোকের পূজা করো। গুরু, পুরোহিত, সম্বন্ধী (শ্বশুর বা জামাতা), স্নাতক, সুহৃৎ ও রাজা—এই ছয় জন অর্ঘ্যদানের যোগ্য। তিনিই হবেন পুরুষোত্তম।

যুধিষ্ঠির হলেন সম্রাট। কিন্তু কে হবেন পুরুষোত্তম? সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ কে? ভীষ্ম জানেন, যুধিষ্ঠিরের সম্রাট হওয়ার পেছনে আসল মস্তিষ্ক হলেন বাসুদেব—তিনি রাজা বানানোর কারিগর। যুধিষ্ঠিরকে পিতামহ ভীষ্ম বললেন, তেজ, বল ও পরাক্রমে বৃষ্ণিকুলসম্ভব কৃষ্ণই শ্রেষ্ঠ, তাঁকেই অর্ঘ্য দাও। সহদেব তা দিলেন এবং কৃষ্ণ সেই অর্ঘ্য গ্রহণ করলেন। 

চেদিরাজ শিশুপাল গর্জে উঠলেন। তিনি ভীষ্ম ও যুধিষ্ঠিরকে ভর্ৎসনা করে বিদর্ভরাজ ভীষ্মকের কন্যা রুক্মিনীর পতি শ্রীকৃষ্ণের নিন্দা করতে লাগলেন। কৃষ্ণ কেন সর্বশ্রেষ্ঠ হিসাবে পুরুষোত্তমের মর্যাদা পাবেন? তিনি তো রাজাই নন। বয়োবৃদ্ধ হিসাবে বসুদেব এই সম্মান পেতে পারেন, পাণ্ডবহিতৈষী হিসাবে দ্রুপদ এই উপাধির যোগ্য, আচার্য হিসাবে দ্রোণ, পুরোহিত ধরলে দ্বৈপায়ন, পুরুষশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম আছেন, সর্বশাস্ত্রবিদ অশ্বত্থামা রয়েছেন, রাজেন্দ্র দুর্যোধন উপস্থিত। কৃষ্ণের অর্চনা করা যদি আপনাদের উদ্দেশ্য হয়, তবে রাজাদের ডাকলেন কেন! 

এখানে উপস্থিত আছেন নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র আচার্য একলব্য, যিনি হস্তিনার জলজঙ্গলপর্বতের রাজা, তাঁকে অর্ঘ্য দিন। 

আরও পড়ুন
শুরু হবে রাজসূয় যজ্ঞ, কৌরবদের কাছে অনুগ্রহ প্রার্থনা করলেন যুধিষ্ঠির

চেদিরাজ জানালেন, তাঁরা রাজা যুধিষ্ঠিরকে কর দিয়েছেন, কৃষ্ণকে নয়। আসলে এই সভা কৃষ্ণকে উপহাস করছে। নপুংসকের বিবাহ, অন্ধের রূপদর্শনের সঙ্গে তুলনীয় হল কৃষ্ণের রাজা না হয়েও রাজযোগ্য এই পূজা। শিশুপাল সভা ত্যাগ করতে উদ্যত হলেন। ভীষ্ম তখন বললেন,

অস্যাং হি সমিতৌ রাজ্ঞামেকমপ্যজিতং যুধি।

আরও পড়ুন
জরাসন্ধকে একা পেলে তবেই হত্যা, পরিকল্পনা আঁটলেন কৃষ্ণ

ন পশ্যামি মহীপালং সাত্বতীপুত্রতেজসা।।

এই সভায় এমন একজন রাজাকেও দেখছি না যিনি কৃষ্ণের কাছে পরাজিত হননি। 

আরও পড়ুন
যুধিষ্ঠিরকে কীভাবে রাজা বানানো যায়? নারদের কাছে পরামর্শ চাইলেন সহদেব

একলব্য জানালেন, তিনি কৃষ্ণের কাছে পরাজিত হননি। এই সভায় এমন কেউ নেই, যাঁর কাছে তিনি পরাজিত হয়েছেন, এমনকি রাজেন্দ্র দুর্যোধনের কাছেও নয়। 

ভীষ্ম একলব্যের কথায় কর্ণপাত না করে বলতে লাগলেন, কৃষ্ণ স্বয়ং হৃষীকেশ, তাঁর পূজায় সকলের পূজা সম্পন্ন হয়, তিনি সনাতন পরমাত্মা। গঙ্গাপুত্র কৃষ্ণের দৈহিক শক্তির অনন্যসাধারণ বর্ণনা দিলেন। বহু রাজা শিশুপালকে সমর্থন করলে সেই সব নৃপতিদের ভীষ্ম শৃগাল বলে গালি দিলেন, শিশুপালকে সারমেয় বললেন। শিশুপাল কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। তিনি ভীষ্মকে বললেন, জ্ঞানবৃদ্ধ হয়ে গোপের স্তব করতে চাও? তুমি কুলাঙ্গার! শাস্ত্রে আছে, স্ত্রী-গো-ব্রাহ্মণ-অন্নদাতা-আশ্রয়দাতাকে হত্যা করতে নেই। কৃষ্ণ গোহত্যা, স্ত্রীহত্যা করেছে। হে ভীষ্ম, তুমি প্রাজ্ঞ? তুমি ক্লীব, তোমার আবার ধর্ম! এই কৃষ্ণ অন্যায়ভাবে ধার্মিক রাজা জরাসন্ধকে হত্যা করেছে, একে আমরা মানব না। কৃষ্ণ বুঝলেন, শিশুপালের নেতৃত্বে বিরাট রাজবাহিনী তাঁকে আক্রমণ করতে উদ্যত। তখন বাসুদেব সুদর্শন চক্র দিয়ে শিশুপালের শিরশ্ছেদ করলেন। একলব্য ও অন্যান্য রাজারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেও ভয়ে কিছু বলতে পারলেন না। দুর্যোধন নীরব হয়ে বসে রইলেন। রাজসূয় যজ্ঞ শেষ হল। যুধিষ্ঠির রাজা হলেন। একলব্য রাগে গর গর করতে লাগলেন। দুর্যোধন তাকে বললেন, অক্রোধ হল সর্বজনীন ধর্ম; নিষাদপুত্র তুমি ক্রোধ সংবরণ করো।

আরও পড়ুন
ভস্মীভূত খাণ্ডব বনের অজস্র প্রাণ, ক্ষুব্ধ একলব্য

একলব্য দেখলেন দুর্যোধনের চোখ থেকে জল পড়ছে। সে জিজ্ঞাসা করে, কী হয়েছে রাজেন্দ্র, আপনার কী শরীর খারাপ, মাথার যন্ত্রণা আবার বাড়ল? নাকি কোমরে চোট পেয়েছিলেন সেই বেদনা আবার চাগাড় দিয়ে উঠল?

দুর্যোধন বললেন, আমার মনে খুব কষ্ট একলব্য। তোমার মনে আছে দেখছি। আঘাত তো লেগেছিল মনে। পাণ্ডবদের এই সভায় স্ফটিকময় স্থান দেখে জল ভেবে কাপড় তুলেছিলাম তখন কেমন খ্যাক খ্যাক করে হাসলো ওরা দেখলে তো! আবার পদ্মশোভিত সরোবরকে যখন স্ফটিকময় স্থান ভাবলাম তখন তো পড়ে গিয়ে ভিজেই গেলাম। কোমরেও লেগেছিল একটু। তখন পাণ্ডবদের হাসি খ্যাক খ্যাক থেকে হ্যা হ্যা-তে পরিণত হয়েছে। অসভ্য বর্বর হলে যা হয়! নেহাত তুমি বিকল্প পরিধান এনে দিলে তাই! তার পর মনে পড়ে, দরজা ভেবে বেরোতে গেলাম কোথা একটা দেখে, দেখলাম সেটা মিথ্যে, মাথায় জোর আঘাত পেলাম। তখনও কী হাসি ভীমার্জুনের! আবার কপাট লাগানো আছে ভেবে যে দ্বারটাকে পরিত্যাগ করলাম পরে জানলাম সেটাই বেরনোর রাস্তা। একলব্য তুমি না থাকলে যে কী বিপদে পড়তাম! তোমার মনে নেই এগুলো?

একলব্য বলে, বিলক্ষণ মনে আছে, আমিই তো আপনার মাথায় জল দিলাম, সরোবর থেকে ওঠার পর বস্ত্র দিলাম, কোমর মর্দন করে দিলাম, মনে থাকবে না! চলুন আমরা হস্তিনায় যাই। মামার সঙ্গে একটু কথা বললে আপনার শারীরিক-মানসিক দুঃখ থেকে মুক্তি পাবেন।

দ্রুতগামী রথ ছুটল হস্তিনার দিকে।

শকুনি দুর্যোধনকে দেখে বললেন, কী হে ভাগিনেয়! এত ঘন ঘন শ্বাস ফেলছ কেন, তাও আবার দীর্ঘনিঃশ্বাস?

একলব্য বলে, হবে না? আপনারা সব রথী-মহারথী ওখানে গিয়ে পানভোজনে মত্ত রইলেন আর শিশুপালকে বাসুদেব হত্যা করলেন কেউ গিয়ে বাঁচালেন না তাকে আবার প্রতিবাদ না করে পালিয়ে এলেন হস্তিনায়! ছি!

শকুনি হাসলেন। বললেন, ঠিক আছে নিষাদপুত্র, ধরেই নিলাম আমরা সব শঠ ও দুর্বৃত্ত, কিন্তু মহাবীর একলব্য কী করছিলেন যাঁকে শিশুপাল পুরুষোত্তম হিসাবে অর্ঘ্য দেওয়ার প্রস্তাব রেখেছিলেন?

একলব্য ক্রুদ্ধ হয়ে জবাব দেন, তখনই হেস্তনেস্ত হয়ে যেত, নেহাত রাজা দুর্যোধন বারণ করলেন তাই চুপ করে গেলাম।

শকুনি প্রশ্ন করেন, কেন হে ভাগিনেয়, এই বীরপুরুষকে বারণ করলে কেন, ওর পরিণতি শিশুর মতো হবে ভেবে?

একলব্য রাগে ফোঁস ফোঁস করতে থাকেন।

দুর্যোধন জবাব দেন, মাতুল! পিতার বারণ না থাকলে পাণ্ডবদের সমূলে নাশ করতাম। কিন্তু আর নয় মামা, অনেক হয়েছে, অনেক সহ্য করেছি, আপনি পিতাকে বলুন তাঁর ভাই পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ পুত্রদের নিকেশ জরুরি হয়ে পড়েছে।

শকুনি বলেন, খামোখা পাণ্ডবদের উপর রাগ করছ! ওরা নিজেদের যোগ্যতায় ফল পেয়েছে, তাছাড়া ভাগ্যও ওদের সহায়। তাছাড়া ওরা তোমার কোনো ক্ষতি না করে হস্তিনার বাইরে গিয়ে বাস করছে, ময় দানবকে দিয়ে সভা বানিয়েছে, রাক্ষস কিঙ্করদের প্রহরী রেখেছে। তুমি তোমার মতো থাকো। তোমার শত ভাই রয়েছে, মাথার উপর আছেন ভীষ্ম-কৃপ-দ্রোণ। কর্ণ-একলব্যের মতো বন্ধু আছে। তুমি ইচ্ছা করলে নিজের বীরত্বে বসুন্ধরা জয় করতে পারো। 

দুর্যোধন বললেন, মাতুল, আপনি অনুমতি দিন, আমি অবশ্যই বসুন্ধরা জয় করব। পাণ্ডব, কৃষ্ণ, সপুত্র দ্রুপদ সব কটাকে দাসের মতো রেখে দেব।

একলব্য মুখ খুললেন, পারবেন রাজেন্দ্র? যা দিনকাল পড়েছে! রাজধর্ম তো এখন অধর্মে ভরা। কে কখন কোথায় জিতে কিংবা হেরে যায়, মরে কিংবা হেজে যায় তার কোনও যুক্তি আমি পাচ্ছি না।

শকুনি বলেন, একলব্য ভুল খুব বলেনি। অধর্মে ছেয়ে গিয়েছে রাষ্ট্র। তাছাড়া পাণ্ডব, বাসুদেব, সপুত্র দ্রুপদ মনে হচ্ছে অপরাজেয়। শোনো, অন্য একটা বুদ্ধি দিই। যুধিষ্ঠির পাশা খেলা ভালবাসে কিন্তু আনাড়ি, মানে খেলতে পারে না। কিন্তু ডাকলে আসবে, ওর জুয়ার নেশা ভয়ঙ্কর। তুমি ওঁকে দ্যুতক্রীড়ায় আহ্বান করো, কথা দিচ্ছি ওর রাজলক্ষ্মী আমি তোমার করে দেব। তুমি শুধু ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি নাও।

দুর্যোধন বলেন, মামা আপনি পিতাকে বোঝান। আমার কথা উনি শুনবেন না। আপনিই ওঁকে বোঝাতে সক্ষম। 

দুর্যোধন ও একলব্যকে সঙ্গে নিয়ে শকুনি গেলেন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। তিনি মহারাজকে বললে, আপনি নিজের পুত্রের উপর খেয়াল রাখুন। ওর চেহারা দেখেছেন?

ধৃতরাষ্ট্র হো হো করে হাসতে লাগলেন। তার পর বললেন, হে শ্যালক মহাশয়, তুমি কি আমার সঙ্গে রঙ্গতামাশা করছ, আমি কি চোখে দেখি!

সুবলনন্দন শকুনি বললেন, আপনার পুত্র, আমার ভাগিনেয় রাজেন্দ্র দুর্যোধন দুর্ভাবনায় পাণ্ডু হয়ে পড়েছেন।

ধৃতরাষ্ট্র অস্থির হয়ে বললেন, সে কী আমার অনুজ পাণ্ডু তো প্রয়াত হয়েছেন।

Powered by Froala Editor

More From Author See More