মহাভারতে রাজনীতি - ৩২
আগের পর্বে
নারদের কথা শুনে চিন্তিত হয়ে ওঠেন যুধিষ্ঠির। ইন্দ্রপ্রস্থে তখন শান্তিতে রাজকর্ম চলছে। কিন্তু যুধিষ্ঠির ভাবতে থাকলেন রাজসূয় যজ্ঞের কথা। কৃষ্ণ জানালেন, মগধের রাজা জরাসন্ধকে বধ করতে না পারলে রাজসূয় যজ্ঞ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। যুধিষ্ঠির যজ্ঞের পরিকল্পনা বাতিল করার কথা ভাবলেও অর্জুন ও ভীম তার বিরোধিতা করেন। কৃষ্ণ ফন্দি আঁটলেন। গোপনে জরাসন্ধের কাছে যাবেন তিনজন। তারপর তাঁকে একা পেলে তবেই আক্রমণ করবেন।
দুর্যোধন একলব্যের গুপ্তচর বাহিনীর কাছে সমস্ত খবর শুনে উল্লসিত হলেন। তাহলে কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন নিজেরা বাঘের মুখে যাচ্ছে। ব্যাঘ্র খাঁচার মধ্যে থাকলেও সে হিংস্র। জরাসন্ধের ভবনে ওই তিন জন প্রবেশ করলে আর ফিরে আসবেন না। বাকি রইলেন যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেব। যুধিষ্ঠির ভীতু ও দ্যুতপ্রিয়। নকুল রূপচর্চা করে সময় কাটায়, সহদেব বিদ্যাচর্চা করে। সুতরাং ওই শত্রুরা আমাদের বান্ধব জরাসন্ধের গৃহে গিয়ে তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদেরই উপকার করেছে।
একলব্য বললেন, জরাসন্ধকে সংবাদ পাঠালে কেমন হয়?
কর্ণ স্মিত হেসে জানালেন, তার প্রয়োজন নেই। জরাসন্ধের গুপ্তচর বাহিনী প্রবল। তাছাড়া তার ভবনে প্রবেশ করা অসম্ভব কাজ। কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন মগধে গেলে আর ফিরে আসবে না, এই আমি বলে রাখলাম; মিলিয়ে নিও।
একলব্য বললেন, তবে আমি অরণ্যে ফিরে যাই।
আরও পড়ুন
জরাসন্ধকে একা পেলে তবেই হত্যা, পরিকল্পনা আঁটলেন কৃষ্ণ
দুর্যোধন জবাব দিলেন, এতদিন যখন হস্তিনায় রইলে তখন আর কয়েকটা দিন থেকে ওই তিন জনের মৃত্যু উদযাপন করে তার পরে যেও।
কিছু দিন পর হস্তিনায় খবর এল, জরাসন্ধকে যজ্ঞগৃহে ভীম হত্যা করেছেন। কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন খাণ্ডবপ্রস্থ থেকে বেরিয়ে কুরুজঙ্গলের ভিতর দিয়ে হেঁতে কালকূটদেশ অতিক্রম করে গণ্ডকী, মহাশোণ, সদানীরা, সরযু প্রভৃতি নদী পার হয়ে পূর্ব কোশল দেশ ঘুরে চর্মন্বতী নদী পেরিয়ে মিথিলায় গিয়ে বিশ্রাম নেন। তার পর পূর্ব দিকে গঙ্গা নদী ও শোণ নদ অতিক্রম করে মগধে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে অনেক পশু, বারো মাস সে রাজ্যে জল থাকে। পাঁচটি মঙ্গলময় পর্বত রয়েছে। চৈত্যক পর্বতের ভিতর দিয়ে তিন জন গিরিব্রজনগরে প্রবেশ করেছিলেন। তখন জরাসন্ধ যজ্ঞে প্রবৃত্ত হয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করছেন। উপবাসে ক্লিষ্ট জরাসন্ধের কাছে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে অদ্বার দিয়ে তিন জন পৌঁছে গেলেন। জরাসন্ধ তাঁদের স্বাগত জানিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। কিন্তু তিন জনের অদ্ভুত পোশাক দেখে জরাসন্ধের সন্দেহ হয়। তিনি বুঝতে পারেন যে আগত পুরুষরা ব্রাহ্মণ নন, তাঁরা ক্ষত্রিয়; আবার অদ্বার দিয়ে প্রবেশ করেছেন। তখন কৃষ্ণ জরাসন্ধকে জানালেন যে তাঁরা ব্রাহ্মণ নন; যে সব রাজাদের বন্দি করে আনা হয়েছে তাদের ন্যায়ের জন্য বসুদেবপুত্র ও পাণ্ডুপুত্রদের আগমন।
আরও পড়ুন
যুধিষ্ঠিরকে কীভাবে রাজা বানানো যায়? নারদের কাছে পরামর্শ চাইলেন সহদেব
জরাসন্ধ উত্তরে বললেন, তিনি জয় না করে কাউকে ধরে আনেননি। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম হল বিক্রম প্রকাশ করে অন্যদের বশে আনা। এখন তোমরা অদ্বার দিয়ে ঢুকেছ, বলো কীভাবে তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব? একা, না সৈন্য নিয়ে? আমি একা আর তোমরা তিন জন মিলিত হয়ে লড়বে, নাকি আলাদা আলাদা করে যুদ্ধ হবে?
জরাসন্ধ তাঁর পুত্র সহদেবকে রাজ্যে অভিষিক্ত করার আদেশ দিলেন। তার পর কৃষ্ণকে বললেন, এসো যুদ্ধ হোক। বসুদেবপুত্র জরাসন্ধকে যাদবদের অবধ্য মনে করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন না। বললেন, আমাদের মধ্যে সব থেকে শক্তিশালী হল ভীম, তুমি ইচ্ছা করলে ভীমের সঙ্গে লড়তে পারো।
আরও পড়ুন
ভস্মীভূত খাণ্ডব বনের অজস্র প্রাণ, ক্ষুব্ধ একলব্য
ভীম ও জরাসন্ধের মল্লযুদ্ধ শুরু হল। উপবাসে ক্লিষ্ট জরাসন্ধকে খুব সহজেই শক্তিশালী ভীম হত্যা করলেন।
সব শুনে দুর্যোধন হতাশ হয়ে বললেন, আমার অতিরিক্ত বিশ্বাসের জন্য জরাসন্ধের আজ এই পরিণতি হল। তার চেয়ে একলব্যের কথা শুনে মগধরাজকে বার্তা পাঠালে আজ এমন দুর্দশার সম্মুখীন হতে হত না।
আরও পড়ুন
বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ হারানোর প্রতিশোধ নিতে, দুর্যোধনকে সমর্থন জানালেন একলব্য
কর্ণ বললেন, মহারাজ! দুশ্চিন্তা করবেন না। যুধিষ্ঠির এই বার রাজসূয় যজ্ঞ করুক, তার পর আমরা মাঠে নামব।
দুর্যোধনের মাতুল শকুনি এতক্ষণ সব কথা চুপচাপ শুনছিলেন। তার পর বললেন, আগে যুধিষ্ঠিরকে সম্রাট হতে দাও। তার পর দ্যুতাসক্ত যুধিষ্ঠিরের সাম্রাজ্য আমি কয়েক মুহূর্তে দুর্যোধনের অধীনে এনে দেব।
কর্ণ ও একলব্য একযোগে বলে উঠলেন, সেটা কী রকম?
শকুনি বললেন, আগে রাজসূয় যজ্ঞ হোক, তার পর দেখতে পাবে।
বার্তা এল, কৃষ্ণ দ্বারকায় ফিরে গিয়েছেন। ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছেন। দুর্যোধন ও একলব্যের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল। কর্ণ শুধু বলে যাচ্ছেন, কিছুই হবে না দেখে নিও। শকুনি আনন্দে আছেন, তিনি কেবলই অপেক্ষায় আছেন কখন যুধিষ্ঠির রাজা হবেন, রাজা না হলে তো তাঁকে দ্যুতক্রীড়ায় আহ্বান জানানো যাবে না। তিনি দুর্যোধনকে বললেন, এখন চুপচাপ দেখে যাওয়া তোমার কর্তব্য; যুধিষ্ঠিরকে সময় দাও। তার পর আমার খেলা শুরু হবে। একলব্য জানালেন, কপট ক্রীড়ায় তাঁর মত নেই; সম্মুখ সমরে পাণ্ডবদের তিনি একাই বধ করতে পারবেন। শকুনি স্মিত হেসে বললেন, নিজের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ রক্ষা করার ক্ষমতা নেই যে নিষাদ বালকের তার মুখে এমন কথা শোভা পায় না। একলব্য নীরব হয়ে বসে রইলেন। ওদিকে অর্জুন উত্তরে কুলিন্দ, আনর্ত, শাকলদ্বীপ জয় করে প্রাগজ্যোতিষপুরে গিয়ে ভগদত্তকে পরাজিত করলেন। ভগদত্ত তাঁর কিরাত চীন সৈন্যদের নিয়েও এঁটে উঠতে না পেরে অর্জুনকে কর দিতে সম্মত হলেন। উত্তরপ্ররবতের রাজ্যসমূহ, কাশ্মীর, লোহিতদেশ, ত্রিগর্ত, সিংহপুর, সুহ্ম, চোল, বাহ্লীক, কম্বোজ, দরদ জয় করলেন তিনি। তার পর শ্বেত পর্বত অতিক্রম করে কিম্পুরুষ, হাটক ও গন্ধর্ব দেশ জয় করে হরিবর্ষে গেলেন। প্রত্যেকেই কর দিতে সম্মত হলেন। ভীমসেন পূর্বে পাঞ্চাল, গণ্ডকীয়, বিদেহ, দশার্ণ, পুলিন্দ গিয়ে কর আদায় করলেন। চেদিরাজ শিশুপালও হেসে কর দিয়ে দিলেন। অযোধ্যা প্রমুখ রাজ্য জয় করে তিনি মগধ, অঙ্গ, পুণ্ড্র, বঙ্গ প্রভৃতি ম্লেচ্ছ দেশ জয় করে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরলেন। সহদেব মৎস্য, অবন্তী, ভোজকট, কিষ্কিন্ধ্যা, মাহীষ্মতী, ত্রিপুরা, দ্রাবিড়, কেরল, অন্ধ্র, কলিঙ্গ, লঙ্কার রাজাদের পরাধীন করলেন। নকুল মালব, মদ্র, দ্বারকা প্রমুখ রাজ্যের অধিপতিদের কর আদায় করলেন।
এই বার যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ আরম্ভ হবে, তার তোড়জোড় শুরু হল। কৃষ্ণ দ্বারকা থেকে এলেন ইন্দ্রপ্রস্থে। ব্যাসদেব, ধৌম্য উপস্থিত হলেন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন, এই বার যজ্ঞ আরম্ভ হোক। যুধিষ্ঠির যজ্ঞের দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহের নির্দেশ দিলেন। সহদেব ও মন্ত্রীদের উপর সেই সব তদারকির ভার পড়ল। বেদব্যাস হলেন যজ্ঞের ব্রহ্মা, সুসামা উদ্গাতা, যাজ্ঞবল্ক্য প্রধান অধ্বর্য্যু, ধৌম্য ও পৈল হলেন হোতা। বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণরা সদস্য হিসাবে থাকলেন।
যুধিষ্ঠির সহদেবকে বললেন চার বর্ণের সবাইকে নিমন্ত্রণ করতে। নট ও নর্তকদের আমন্ত্রণ জানানো হল। অতিথিদের উপহার হিসাবে আনা হল প্রচুর গরু, পরিচারিকা ও সোনা। যুধিষ্ঠিরের আদেশে নকুল পৌঁছলেন হস্তিনায়। তিনি প্রথমে ভীষ্ম, বিদুর, কৃপ ও ধৃতরাষ্ট্রকে নিমন্ত্রণ করলেন। তার পর এলেন দুর্যোধনের কাছে। কৌরব ভাইদের আমন্ত্রণ জানিয়ে কর্ণ, একলব্য, গান্ধাররাজ সুবল, মহাবল শকুনি, অচল, বৃষক, শল্য, বাহ্লীক, সোমদত্ত, ভূরি, ভূরিশ্রবা, দেশের সব রাজা, পৌণ্ডড়ক, শিশুপাল ও যাদবগণকে একের পর এক আমন্ত্রণ জানানো হল।
নির্দিষ্ট দিনে দুর্যোধনের সঙ্গে একলব্য গেলেন ইন্দ্রপ্রস্থে। সেখানে গিয়ে একলব্য অবাক হয়ে গেলেন। সভা এই রকম হতে পারে, তা ছিল একলব্যের কল্পনার বাইরে।
একলব্য দেখতে পেলেন, ইন্দ্রপ্রস্থের বাসভবনগুলি পর্বতের শৃঙ্গের ন্যায় উচ্চ, মনোহর, অলঙ্কৃত ও শুভ্র প্রাচীরবেষ্টিত। প্রাসাদের কক্ষগুলিতে উৎকৃষ্ট আসন ও পরিচ্ছদ, পুষ্পমাল্যে শোভিত, অগুরুর সৌরভবিশিষ্ট। বাড়িগুলির বর্ণ হংস ও চন্দ্রের ন্যায় শুভ্র। প্রাসাদের সকল দ্বার সমসূত্রপাতে নির্মিত। সেই সব দেখতে দেখতে হঠাৎ সেখানে যুধিষ্ঠির প্রবেশ করলেন।
তিনি ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন ও অন্যান্য কৌরবদের অনুনয় করে বললেন, এই যজ্ঞে আপনারা সর্বপ্রকারে আমার প্রতি অনুগ্রহ করুন। এখানে যে রাশি রাশি ধন আছে সে সব আপনাদেরই। সুতরাং আপনারা আমাকে ইচ্ছানুসারে পরিচালনা করুন।
যজ্ঞদীক্ষিত যুধিষ্ঠির এই কথা বলে প্রত্যেককে দায়িত্ব দিলেন। খাদ্য ও পেয় দ্রব্য রইল দুঃশাসনের হাতে, ব্রাহ্মণদের আপ্যায়নের দায়িত্ব পেলেন ব্রাহ্মণ অশ্বত্থামা, রাজাদের দেখভালের ভার পড়ল সঞ্জয়ের উপর। কৃত ও অকৃতকার্যের অনুসন্ধানের দায়িত্বে রইলেন ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য। অর্থ বিভাগ রইল কৃপাচার্যের হাতে। কর্ণ দানবিভাগে, বিদুর ব্যয়কার্যে এবং দুর্যোধন রইলেন আপ্যায়ন ও উপহার গ্রহণে। একলব্যকে দেওয়া হল অতিথিদের উপর তীক্ষ্ণ নজরদারির ভার। যজ্ঞ আরম্ভ হল।
Powered by Froala Editor