মহাভারতে রাজনীতি - ৩০
আগের পর্বে।
খাণ্ডব অরণ্যে আগুন লাগার কথা শুনে রুষ্ট হলেন একলব্য। দুর্যোধন তাঁকে হস্তিনার সমস্ত বনভূমির রাজা ঘোষণা করেছেন। তিনি ভাবলেন, তাঁরও কিছু কর্তব্য আছে। আরও শুনলেন, খাণ্ডব অরণ্যের রক্ষক দেবরাজ ইন্দ্রও অরণ্যকে বাঁচাতে পারেননি। অর্জুনের সঙ্গে তাঁর প্রবল যুদ্ধ হয়। কিন্তু তাতে এই কথাই প্রমাণিত হয়, কৃষ্ণার্জুন অপরাজিত। খাণ্ডবের রাজা তক্ষক হস্তিনায় থাকায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন। তাঁর পুত্র অশ্বসেনকে রক্ষা করেছেন ইন্দ্র। আর চারটি খঞ্জন পাখি অগ্নির স্তব করে বেঁচে গিয়েছেন। পাণ্ডবদের প্রাসাদ বানিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রক্ষা পেয়েছেন ময়। সব শুনে হস্তিনার উদ্দেশে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন একলব্য।
দুর্যোধন তাঁকে প্রাপ্য সম্মান দিয়ে হস্তিনার প্রাসাদে রাখলেন। ভীষ্ম ও বিদুর একলব্যকে প্রাসাদে না রাখার ব্যাপারে একজোট হয়ে দুর্যোধনকে বোঝাতে লাগলেন। দুর্যোধন ভীষ্মকে বললেন, হে পিতামহ কোন যুক্তিতে একলব্য প্রাসাদে ঠাঁই পাওয়ার যোগ্য নন?
ভীষ্ম জবাব দিলেন, সে রাজা নয়।
দুর্যোধন জানালেন যে তিনি একলব্যকে সমস্ত বনাঞ্চলের রাজা ঘোষণা করেছেন।
বিদুর বললেন, কিন্তু ও জাতিতে নিষাদ, ছোটো জাত।
আরও পড়ুন
ভস্মীভূত খাণ্ডব বনের অজস্র প্রাণ, ক্ষুব্ধ একলব্য
দুর্যোধন হাসলেন। তার পর বিদুরের কথার উত্তর দিলেন, হে ক্ষত্তা, আপনার জন্ম শূদ্রা দাসীর গর্ভে সে হিসাবে আপনাকে পারশব না মৃততুল্য বলা হয়; আপনি যদি প্রাসাদে থাকতে পারেন তবে নিষাদ একলব্যও পারে।
বিদুর ও ভীষ্ম প্রস্থান করলে দুর্যোধন দ্রোণাচার্যকে ডেকে পাঠালেন। তার পর একলব্যকে দেখিয়ে বললেন, “একে চিনতে পারছেন আচার্য? একলব্য, তোমার দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাও।”
একলব্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দুর্যোধনকে বললেন, হে রাজন, আপনি আচার্যকে মিছিমিছি লজ্জিত করছেন।
দ্রোণাচার্য কুণ্ঠিত কণ্ঠে দুর্যোধনকে বললেন, ইনি নিষাদ রাজপুত্র মহাবীর একলব্য। প্রণাম জানাই।
আরও পড়ুন
বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ হারানোর প্রতিশোধ নিতে, দুর্যোধনকে সমর্থন জানালেন একলব্য
ধৃতরাষ্ট্রপুত্র দ্রোণকে চলে যেতে বললেন। তার পর একলব্যকে বললেন, হে বনাঞ্চলের অধিপতি, তুমি কি জানো ময় দানব দগ্ধ খাণ্ডব বনের উপর প্রকাণ্ড সভাগৃহ নির্মাণ করছে।
একলব্য জবাব দেয়, আপনি বাধা দিচ্ছেন না কেন?
“দেখো, পিতা জ্ঞাতিদ্বন্দ্ব রোধ করার জন্য ওদের খাণ্ডবপ্রস্থে পাঠিয়েছে। এখন আমি যদি এখন ওদের উপর বলপ্রয়োগ করি তাহলে পিতার কথার দাম থাকে না।”
“তাই বলে ওরা বনাঞ্চল পোড়াবে? মেরে ফেলবে প্রাণীদের?”
আরও পড়ুন
একলব্যকে হত্যার আদেশ দিলেন বিদুর, ভীত দ্রোণাচার্য
দুর্যোধন বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ, ওদের আর বাড়তে দেওয়া ঠিক হবে না। শুনছি খাণ্ডববনের নাম বদলে ওরা প্রথমে রেখেছিল খাণ্ডবপ্রস্থ, এখন করবে ইন্দ্রপ্রস্থ, অর্জুনের পিতার নামে আর কি!
“পিপ্পলি বৃক্ষের আধিক্যের কারণে খাণ্ডব বন ছিল! বাহ রে! তো এই সভা বানাতে রাজি হল নমুচির ভাই ময় দানব? সে তো এককালে অসুরদের বিশ্বকর্মা ছিল!”
“হ্যাঁ। ময়কে প্রাণে বাঁচিয়েছেন অর্জুন, তাই সেই বিশ্বকর্মা ও মহাকবি প্রত্যুপকারে যুধিষ্ঠিরের জন্য সভা নির্মাণ করছে। এখন শ্রীকৃষ্ণ সেখানে নেই, তিনি গিয়েছেন দ্বারকায় পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।”
একলব্যের মনে পড়ে, নিজের জৈবিক পিতা দেবশ্রবার কথা যাঁকে তিনি চোখে দেখেননি। তিনি তো শ্রীকৃষ্ণের পিতা বসুদেবের অনুজ। চুপ করে বসে রইলেন একলব্য।
আরও পড়ুন
কুকুরের চিৎকারে বিরক্ত একলব্য, নিক্ষেপ করলেন একসঙ্গে সাতটি তীর!
দুর্যোধন একলব্যের নীরবতা দেখে বললেন, কী এত ভাবছ? শোনো, ওই সভা হতে সময় লাগবে চোদ্দো মাস। সেই ক দিন তুমি এখানে থেকে যাও একলব্য, তার পর দেখো কী ঘটে। ওরা আমাকে চেনে না!
একলব্য বললেন, থাকতে পারি কিন্তু আমার জন্য পৃথক বাড়ির বন্দোবস্ত করে দিতে হবে রাজন। কেন সেকথা জিজ্ঞাসা করবেন না মহারাজ!
দুর্যোধন বললেন, তথাস্তু।
একলব্যের জন্য নতুন গৃহ ঠিক হল। ঠিক হল পরিচারিকা যা তাকে দু বেলা অন্ন প্রস্তুত করে দেবে। দ্রোণ, ভীষ্ম ও বিদুর মুখে কিছু না বললেও বুঝতে পারলেন যে তাঁদের কথা এখন রাজসভায় চলবে না।
কিছু দিন পর কর্ণের সঙ্গে আলাপ হল একলব্যের। কর্ণই দিলেন খবরটা। সারা রাজ্য জুড়ে অসংখ্য লোক ভুল বার্তা রটাচ্ছে। অন্য দিকে চার পণ্ডিতও নেমেছেন পাণ্ডবদের হয়ে প্রচারে। সেই চার জন হলেন মন্দপাল ঋষির চার পুত্র—তাঁদের নতুন নাম হয়েছে পারিজাত, রৈবত, সুমুখ ও সৌম্য। তাঁরা জীব ও ব্রহ্মের ঐক্য, ভৌতিক দেহে আত্মার সম্বন্ধ, জীবের নানাত্ব ও জীবের ব্রহ্মে লয় বিষয়ে নতুন কথা প্রচার করছেন। এত দিন হস্তিনানগর ও অন্যান্য অঞ্চলে ভৌতিক দেহে বহিরাগত আত্মার কথা স্বীকৃত ছিল না। চাঁদের আলো যেমন তার নিজের নয় তেমনি দেহে আত্মা আসে বাইরে থেকে। সূর্যের সাধক ও মহাদেবের পূজারীরা জানতেন, শরীরের চৈতন্য তার আত্মা, শরীরের নাশে তার বিলুপ্তি। কিন্তু নতুন প্রচারকরা বলছেন, আত্মা নিত্য এবং শরীর অনিত্য। মানুষকে মেরে ফেললেও তার আত্মাকে মারা যায় না। এর ফলে হত্যাকাণ্ডের সপক্ষে অনেক যুক্তি সাজাচ্ছেন ওই প্রচারকেরা। চার পণ্ডিত--পারিজাত, রৈবত, সুমুখ ও সৌম্য হলেন সুবক্তা, চতুর, মেধাবী, স্মৃতিশাস্ত্রজ্ঞ ও কবি। সাংখ্যজ্ঞান ও যোগজ্ঞানের বৈষম্য তাঁরা জানেন। সাম-দান-ভেদ-দণ্ডনীতি সম্পর্কেও তাঁরা অভিজ্ঞ। অনুমানের বিভাগ, বিশেষ রাজনীতি ও কূটনীতি সম্পর্কে জ্ঞানী চার পুরুষ সর্বশাস্ত্রবিশারদ। তাঁরা কলহপ্রিয় ও সঙ্গীতপ্রিয়, ক্রোধ তাঁদের শরীরে নেই। দুর্যোধনের বন্ধু চার্বাক, ধৃতরাষ্ট্রের শ্যালক শকুনির পুত্র উলূক, পাষণ্ড ভিক্ষু তক্ষক সকলেই ভাবতে লাগলেন, তাঁদের হত্যার জন্য ফাঁদ পেতেছে ব্রহ্মবাদী ঋষিরা। সারা দেশ জুড়ে এক অরাজক পরিস্থিতি। প্রজাদের মনে শান্তি নেই, তাদের আরাধনা ও উপাসনার পদ্ধতি এবং বিষয় সম্পর্কে তারা ক্রমশ সন্দিহান হয়ে উঠছে। লাগাতার প্রচারের ফলে বিদ্বেষ বাড়ছে জনসাধারণের মধ্যে।
একলব্যের চোদ্দো মাস এমন ভাবেই কেটেই গেল। চোদ্দো মাসে তার কাজ ছিল দুর্যোধনের গুপ্তচর বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া। খাণ্ডবপ্রস্থ ততদিনে তৈরি হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে গুপ্তচরেরা খবর দিল, নারদ এসেছেন খাণ্ডবপ্রস্থে। একদা উচ্ছিষ্ট অন্ন আহার করে তিনি নিজের পাপমোচন করেছিলেন। গন্ধর্বরাজ চিত্রপর্ণের পঞ্চাশ কন্যাকে বিবাহ করার পরেও রম্ভার নাচ দেখে তিনি কামার্ত হন ও তাঁর বীর্যপাত হয়। ব্রহ্মা নারদকে তাই অভিশাপ দেন এবং নারদ নরলোকে জন্ম নেন। এর কথা তাকে, তার কথা আরেক জনের কানের তুলে তিনি প্রসন্ন হন। সেই নারদ এলেন খাণ্ডবপ্রস্থে। যুধিষ্ঠির তাঁকে গো, মধুপর্ক ও অর্ঘ্য দান করলেন। নানাবিধ রত্ন ও অভীষ্ট সমস্ত বস্তু দিয়ে নারদের পূজা করলেন পাণ্ডবেরা। নারদ খুশি হয়ে তাঁদের অনেক উপদেশ ও শলাপরামর্শ দিয়ে বললেন, হে পাণ্ডবগণ! কৃষি ও বাণিজ্যপথের আট নীতি তোমরা কঠোরভাবে মেনে চলো।
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন, কী সেই আট নীতি?
“কৃষির নিমিত্ত জলাশয় খনন, কৃষকদের বীজ দান, ফসলের এক ষষ্ঠাংশ কর হিসাবে গ্রহণ, কৃষিঋণে সুদ গ্রহণ। মনে রাখবে, পাপের ফলে মানুষ কৃষক হয়। বণিকদের সবচেয়ে বেশি সুবিধা দিতে হবে। বিদেশি ব্যবসায়ীদের নগরে ও গ্রামে সর্বত্র নিরুদ্বেগে সসম্মানে পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করতে দেওয়া, রাজসভায় বৈশ্যদের আদর ও অধিকার সুনিশ্চিত করা, অস্ত্রব্যবসায়ীদের সম্পূর্ণ করমুক্ত করা এবং শূদ্রদের উপর বৈশ্যদের আধিপত্য কায়েম রাখা।”
মধ্যম পাণ্ডব বললেন, আর কিছু?
নারদ জানালেন। স্ত্রীদের সঙ্গে মধুর বাক্য বলুন এবং তাদের সুরক্ষা দিন কিন্তু ভুলেও তাদের গোপন কথা বলবেন না।
অর্জুন বললেন, কেমন দেখছেন এই সভাগৃহ?
নারদ জবাব দিলেন, দারুণ! যম-ইন্দ্র-বরুণ-কুবেরের সভা দেখেছি। তাঁদের থেকেও উত্তম।
ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে রূপবান নকুল বললেন, আপনি বুঝি সবাইকে এরকমটাই বলে থাকেন!
পণ্ডিত সহদেব তঁকে বললেন, তুই চুপ কর দাদা। নারদ মুনিকে একটা প্রশ্ন রয়েছে। সবাই যে অগ্রজ যুধিষ্ঠিরকে রাজা-রাজা বলে ডাকছে কিন্তু তিনি তো নৃপতি নন। আপনি বলে দিন, যুধিষ্ঠিরকে কীভাবে রাজা বানানো যায়?
নারদ বললেন, দাঁড়াও দাঁড়াও, আমার মনে ছিল না। তোমাদের পিতা পাণ্ডুই তো আমাকে পাঠিয়েছেন, সেই জন্য আসা, এই দেখেছ আসল কথাটাই ভুলে মেরে দিয়েছি। তোমাদের পিতা মহারাজ পাণ্ডু তো এখন স্বর্গে। তিনি রাজা হরিশচন্দ্রর অতুল সম্পদ দেখে বিস্মিত হয়ে যুধিষ্ঠিরকে পৃথিবী জয় করতে বলেছেন। সেই বার্তা নিয়ে আমি এসেছি। যুধিষ্ঠির পৃথিবী জয় করতে সমর্থ কারণ তাঁর ভাইরা তাঁর অনুগত। এখন তোমাদের উচিত রাজসূয় যজ্ঞ করা। এই যজ্ঞ করা অবশ্য খুব দুরূহ কাজ। যজ্ঞনাশক ব্রহ্মরাক্ষসেরা এর ছিদ্রান্বেষণ করে। রাজসূয় যজ্ঞ ক্ষত্রিয়নাশক, পৃথিবীক্ষয়ের কারণ। অতএব, এখন ভেবেচিন্তে যা করার তোমরা করো, আমাকে দ্বারকায় যেতে হবে।
Powered by Froala Editor