মহাভারতে রাজনীতি - ২৯
আগের পর্বে
নতুন যুবরাজ দুর্যোধন রাজ্য পরিভ্রমণ করতে করতে এলেন একলব্যের কাছে। তাঁর পরিণতির জন্য শোক প্রকাশ করলেন। দ্রোণের জাতিবিদ্বেষের বিরোধিতা করে জানালেন, তিনি এর প্রতিকার করবেন। একলব্যও পরিস্থিতির সাপেক্ষে দুর্যোধনের পক্ষ নেওয়াই উচিৎ মনে করলেন। তাঁকে সমস্ত অরণ্যের রাজা ঘোষণা করে দুর্যোধন চলে গেলেন শ্বশুরগৃহ কলিঙ্গে। এই সময় খাণ্ডব বন ধ্বংস হওয়ার ঘটনায় চমকে উঠল নিষাদরা। তারা দুর্যোধনের কাছে কারণ জানার জন্য অপেক্ষে করতে চাইল। কিন্তু দুর্যোধন আগেই অন্য রাস্তা ধরে হস্তিনায় ফিরে গিয়েছে।
কথক উত্তর দেয়, আগেই বলেছি, খাণ্ডব বন হল দেবশত্রুদের বাসস্থান। তাদের মেদ পান করলে অগ্নি তুষ্ট হবেন। শুনেছি ভয়াবহ সেই আগুন। হাতিরা শুঁড়ে করে জল ঢালছে কিন্তু আগুন নিয়ন্ত্রণে আসছে না। নাগরাও নানা উপায়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। জানি না কী হবে! আস্তে আস্তে সব বনাঞ্চলকে এইভাবে পুড়িয়ে খাক করে দেওয়া হবে। অধিবাসীদের মেরে ফেলা হবে আগুনে পুড়িয়ে। জায়গা চাই ওদের, ওরা প্রাসাদ বানাবে ওই কবরখানায়।
একলব্য আপনমনে বিড়বিড় করে বলে, আমাকে হস্তিনার সমস্ত বনাঞ্চলের রাজা ঘোষণা করেছেন যুবরাজ দুর্যোধন। অতএব, আমারও কিছু কর্তব্য আছে। তার পর চলে যান গৃহে। প্রাতঃকালে বেরিয়ে পড়বেন হস্তিনার উদ্দেশে। সেই রাতে একলব্যের স্ত্রী অঙ্গাগ্রণী যমজ পুত্রসন্তান প্রসব করে। একলব্য তাদের নাম রাখে জরাত্র ও মৃত্যুঞ্জয়।
বেশ কিছু দিন পর যখন খাণ্ডব বনে এসে পৌঁছলেন তখন দেখতে পেলেন, বনের দক্ষিণে বহু প্রাণীর একদেশ দগ্ধ হয়ে গিয়েছে। হাজার হাজার পশুপাখি বিশীর্ণ ও গলিতাঙ্গ। কেউ কেউ আলিঙ্গনাবস্থায় মারা গিয়েছে। পক্ষ, চঞ্চু ও চরণ দগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছে পাখিরা।
একটু এগিয়ে একলব্য খেয়াল করলেন, জলাশয়ে মৃত জলপ্রাণীর শবদেহ ভাসছে। জল উত্তপ্ত হয়ে কচ্ছপ ও মাছেরা প্রাণত্যাগ করেছে। পাখিরা উড়ে বাইরে যেতে গিয়েও পারেনি, সর্বত্র আগুনের লেলিহান শিখায় তারা মারা পড়েছে। চার দিক থেকে অগ্নিদেবের যোদ্ধারা বাঁচতে চাওয়া পশু-পাখিদের জ্বলন্ত বনের উপর নিক্ষেপ করেছে।
আরও পড়ুন
বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ হারানোর প্রতিশোধ নিতে, দুর্যোধনকে সমর্থন জানালেন একলব্য
এমন সব কাণ্ড ঘটে গেল, অথচ দেশের লোক চুপচাপ বসে বসে দেখল! না। একলব্য বনের চারপাশে যে সব বসতি আছে, তাদের অধিবাসীদের কাছে শুনতে পেলেন—তারা দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে গিয়ে বলেছিল, অগ্নি কি সমস্ত প্রাণী, মানুষকে দগ্ধ করছেন? প্রলয়কাল কি তবে চলে এল? দেবতারাও তাদের কথা সমর্থন করলেন। তখন ইন্দ্র নড়েচড়ে বসেছিলেন। তখনও বন জ্বলছে। ইন্দ্রের আদেশে মেঘেরা জপমালার মতো বড়ো বড়ো বিন্দুর শত সহস্র জলধারা বর্ষণ করেছিল। কিন্তু অগ্নি এতই প্রবল ছিল যে সেই জলধারা বাষ্প হয়ে আকাশে উঠে গেল। ভয়ঙ্কর ধোঁয়ায় বন ও তার চার পাশ ভরে গেল। চন্দ্র যেমন নীহার দ্বারা জগৎ আচ্ছাদিত করে, অর্জুন তেমনি বাণ দিয়ে খাণ্ডব বনকে আচ্ছাদিত করলেন।
অর্জুনের কথা শুনে একলব্য সামান্য রুষ্ট হলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, খাণ্ডব বনের অধিপতি তক্ষক কোথায় ছিলেন? তিনি কি মারা গিয়েছেন?
বনাঞ্চলের বাইরে বাস করা এক সৌগত শূদ্র বলল, না তিনি জীবিত। যখন বনে আগুন লাগানো হয় তখন তক্ষক সেখানে ছিল না, সে গিয়েছিল কুরুক্ষেত্রে; তবে তার স্ত্রী আর পুত্র মহাবল অশ্বসেন বনে ছিল।
একলব্য উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তারা বেঁচে আছে তো?
আরও পড়ুন
একলব্যকে হত্যার আদেশ দিলেন বিদুর, ভীত দ্রোণাচার্য
সৌগত শূদ্র জবাব দিলেন, অশ্বসেনের মা ওই প্রবল আগুন থেকে পুত্রকে বাঁচানোর জন্য কোলের মধ্যে তাকে রেখেছিল। আগুনের তাপে তক্ষকজায়া মারা যায়, সেই সময় পিতৃবন্ধু ইন্দ্র অশ্বসেনকে উদ্ধার করেন। তাতে ইন্দ্রের উপর বেজায় চটে যান অগ্নি, কৃষ্ণ ও অর্জুন। অশ্বসেন কেন জীবিত পুড়ে মরল না, এই অভিযোগে ওই তিন মূর্তি তক্ষকপুত্রকে অভিশাপ দেন, তুই নিরাশ্রয় হবি।
একলব্যের মাথায় তখন আগুন জ্বলছে।
সৌগত শূদ্র বলতে লাগলেন, এর পর ইন্দ্র ও অর্জুনের ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হল। যুদ্ধে ইন্দ্র এঁটে উঠতে পারলেন না। আশেপাশের নাগদের গণহত্যা শুরু হল। গরুড় প্রভৃতি পক্ষীরা অর্জুনের বশ্যতা স্বীকার করে বেঁচে গেল। কৃষ্ণের চক্র দৈত্য আর দানবদের কচুকাটা করল। দেবতারা একজোট হয়ে কৃষ্ণার্জুনকে আক্রমণ করলেন। যম নিলেন কালদণ্ড, কুবের গদা, বরুণ পাশ ও বজ্র, কার্তিক শক্তি, অশ্বিনীকুমাররা ওষধি, ধাতা নিলেন ধনু, জয় মুষল, মহাবল ত্বষ্টা পর্বত, মৃত্যুদেব পরশু, সূর্য পরিঘ, মিত্র-পূষা-ভগ-সবিতার হাতে সুধাচক্র, একাদশ রুদ্র-অষ্ট বসু-ঊনপঞ্চাশ বায়ু ধনু ও তরবারি নিয়ে কৃষ্ণার্জুনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কিন্তু সকলে পরাজিত হলেন। কৃষ্ণ যমের ন্যায় সহস্র সহস্র পিশাচ, পক্ষী, নাগ ও পশুদের হত্যা করতে লাগলেন।
হঠাৎ ঐশী বাণী এল, কৃষ্ণার্জুন অপরাজেয়—এদের হারানো যাবে না। খাণ্ডব বন আরও তেজে জ্বলতে লাগল। কান্না ও আর্তনাদে আকাশ বাতাস মুখরিত হতে লাগল। ভয় নামক অপদেবতা এসে চাদরে মুড়ে ফেলল গোটা বনাঞ্চল। এই সময় ‘ময়’ নামক দানব তক্ষক ভবন থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। কৃষ্ণ তাকে মারতে গেলেন। সে অর্জুনের দ্বারস্থ হয়ে বলল, এই বনে সে পাণ্ডবদের প্রাসাদ বানিয়ে দেবে। অর্জুন তখন নমুচির ভ্রাতা ময়কে বাঁচালেন। প্রাণরক্ষা হল ময়, অশ্বসেন ও চারটি খঞ্জন পাখির। মোট ছয় জন বেঁচে রইল, বাকিরা সব পুড়ে মরে গেল।
আরও পড়ুন
কুকুরের চিৎকারে বিরক্ত একলব্য, নিক্ষেপ করলেন একসঙ্গে সাতটি তীর!
একলব্য শ্বাস ছেড়ে বললেন, তা ওই শার্ঙ্গক পক্ষীদের দগ্ধ করা হল না কেন?
সৌগত শূদ্র বললেন, ওরা ছিল ব্রহ্মবাদী ঋষি মন্দপালের পুত্র। বেদপাঠী, ধর্মনিরত, তপস্বী ও জিতেন্দ্রিয় মন্দপাল ঋষি এক সময় ছিলেন নিঃসন্তান। পুত্র উৎপাদন না করলে তাঁর পরিত্রাণ নেই, এই কথা ভেবে তিনি খঞ্জনপক্ষীর রূপ ধরে জরিতা নামের এক পক্ষিণীর সঙ্গে রমণ করতে লাগলেন। তাঁদের চারটি বেদবাদী পুত্র জন্মায়। কার্যসিদ্ধি হওয়ার পর মন্দপাল ঋষি জরিতাকে ত্যাগ করে লপিতা নামে আর একটি খঞ্জনপক্ষিণীর সঙ্গে বাস করতে লাগলেন। এমন সময় বনে আগুন লাগে। মন্দপালের পুত্রদের কথা মনে পড়ে। তারা এখনও অল্পবয়সী, নিজেদের বাঁচাতে অক্ষম। ঋষি অগ্নির কাছে গিয়ে বললেন, হে সুন্দর, তুমি আমার চার পুত্রের প্রাণ রক্ষা করো। অগ্নি বললেন, ঠিক আছে; তোমার পুত্রদের প্রাণভিক্ষার আবেদন আমার মাথায় রইল। চার শার্ঙ্গক পক্ষীশাবক নিয়ে জরিতা ওই ভীষণ অগ্নিকাণ্ডে দিশেহারা, সে মন্দপালকে ঋষিকে ভৎর্সনা করে পুত্রদের ডানা দিয়ে আবৃত করে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। পুত্ররা বলল, মা তুমি অন্যত্র চলে গিয়ে বাঁচো; তোমার পক্ষ আছে। জরিতা বলল, তাই হয় নাকি, এখানে একটা ইঁদুরের গর্ত আছে; তোমাদের সেখানে রেখে মাটি চাপা দিয়ে যায়; পরে আগুন নিভে গেলে আবার বের করে নিয়ে যাব। পুত্ররা সম্মত হল না। তারা বলল, উপরে আগুন আর মাটির নীচে গর্তে ইঁদুর; ভক্ষিত হওয়ার চেয়ে দগ্ধ হওয়া ভাল। জরিতা জানাল, এই গর্তের ইঁদুরটিকে কয়েক দিন আগে একটি শ্যেনপক্ষী খাদ্য হিসাবে নিয়ে গেছে আমি জানি, তোমাদের কোনও ভয় নেই। তখন জ্যেষ্ঠ পুত্র জরিতারি জানাল, ওই গর্তে অন্য ইঁদুর নেই এ কথা আপনাকে কে বলল? দ্বিতীয় পুত্র সারিসৃক্ক বলল, নিশ্চিত মৃত্যু অপেক্ষা সন্দিগ্ধ মৃত্যু শ্রেয় অতএব আমরা গর্তে প্রবেশ করব না। তৃতীয় পুত্র স্তম্বমিত্র বলল, মা আপনি সুন্দরী ও যুবতী; উড়ে গিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচান; বেঁচে থাকলে আবার নতুন পতি ও পুত্র পাবেন। কনিষ্ঠ দ্রোণ কাঁদতে লাগল। জরিতা উড়ে গেল। চারটি শাবক এক মনে অগ্নির স্তব করতে লাগল। অগ্নি তাদের স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে তাদের প্রাণরক্ষা করলেন। তখন শাবকরা অগ্নিকে বলল, এই বনের বেড়ালরা খুব উৎপাত করে, এদের দগ্ধ করুন। অগ্নি তখন বৈড়ালব্রতের সাধক বৈশেষিকদের হত্যা করতে লাগলেন। সমস্ত কাণ্ড শেষ হয়ে যাওয়ার পর অগ্নি আনন্দিত চিত্তে ফিরে গেলেন। কৃষ্ণ, অর্জুন ও ময় দানব মনোহর নদীতীরে সম্মিলিত হয়ে উপবেশন করলেন।
একলব্য ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন হস্তিনার দিকে।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ডাক পড়ল হস্তিনার রাজসভায়, দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষা প্রার্থনা একলব্যের