মহাভারতে রাজনীতি - ২৮
আগের পর্বে
একলব্য জানাল তার গুরুর নাম দ্রোণাচার্য। অন্যদিকে দ্রোণ জানালেন, তিনি নিজেই শব্দভেদী বাণ নিক্ষেপ করতে জানেন না। সব শুনে একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে আনার আদেশ দিলেন বিদুর। কৃপী দ্রোণকে বললেন চাকরি ছেড়ে দিতে। অন্যদিকে অশ্বত্থামা ধৃতরাষ্ট্রকে সব কথা জানাতে বললেন। একলব্য দ্রোণকে জানাল তাঁর অদেয় কিছুই নেই। কিন্তু বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দান করার ক্ষেত্রে জানাল, এর অর্থ স্বাধীনতা হারানো। আর পরাধীনের দেয় কিছুই থাকে না। হতাশ এবং ক্ষুব্ধ দ্রোণ ফিরে এলেও গোপনে একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে নিয়ে গেল কেউ। হস্তিনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন বলে জানালেন হিরণ্যধনু।
বেশ কিছু কাল পর, কুরুবংশের যুবরাজ দুর্যোধন এলেন দণ্ডকারণ্যে। শোনা যায়, তিনি প্রজারঞ্জক শাসক। পিতা রাজা ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হওয়ার জন্য যুবরাজ রাজকার্য দেখাশুনো করেন। হস্তিনানগরে যুবরাজকে প্রজারা শিবের অংশ বলে মনে করে। দীর্ঘদেহী, আজানুলম্বিত বাহু, মাতঙ্গসমবিক্রম, গৌরকান্তি দুর্যোধনের মাথার চুল পিঠের উপর লুটিয়ে পড়েছে। গদাযুদ্ধে তাঁর মতো কৃতী আর কেউ নেই, তিনি বলরামের শিষ্য। ধ্বজের হেমময় কেতু উড়িয়ে হস্তিনার সেই বীরপুরুষ এলেন নিষাদরাজ্যে। কাছাকাছি তাঁর শ্বশুরবাড়ি। কলিঙ্গের রাজা চিত্রাঙ্গদের কন্যা ভানুমতীর সঙ্গে কিছুদিন পূর্বে তিনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন।
দুর্যোধন একলব্যের এই পরিণতির জন্য শোক প্রকাশ করলেন। দ্রোণাচার্যের মধ্যে জাতিবিদ্বেষ যে বহুল পরিমাণে আছে, তা তিনি জানেন। অস্ত্রশিক্ষা প্রদর্শনের একটি অনুষ্ঠানে কৌরব ও পাণ্ডব বীরেরা যখন নানা রকম কেরামতি দেখাচ্ছেন—অশ্বত্থামা গুপ্তাস্ত্রের কৌশল প্রদর্শন করছেন, আমি গদার ভেলকি দেখাচ্ছি, নকুল-সহদেব অসি চালাচ্ছে, অর্জুন শর নিক্ষেপ করছে, সেই সময় সূত অধিরথের পুত্র কর্ণ, যিনি দ্রোণের শিষ্য, তিনি এলেন। অর্জুনের শর নিক্ষেপের তুলনায় তিনি কিছু কম যান না। সেই সময় ভীম তাঁকে সূতপুত্র বলে উপহাস করল, কুকুরের সঙ্গে তুলনা করল এবং শর ছেড়ে কশা নিয়ে কুলধর্ম পালন করতে বলল। আমি সেই অন্যায়ের প্রতিবাদে কর্ণকে অঙ্গ দেশের রাজা ঘোষণা করি। দ্রোণের এতে প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল, সবচেয়ে বেশি যিনি দায়ী তিনি পিতামহ ভীষ্ম। আমি ভীমকে বলি, বীরের আবার কুলধর্ম কী, বীরত্বেই তার পরিচয়। ওই দ্রোণ জন্মেছেন কলস থেকে, গৌতম এসেছেন শরস্তম্ব থেকে, পাণ্ডবদের জন্মকাহিনিও সকলের জানা।
দ্রোণাচার্য পাণ্ডব ও ভীষ্মকে খুশি করে চলেছেন একটি কারণে। তিনি পাঞ্চালরাজকে জব্দ করতে চান। তো একদিন দলবল নিয়ে গিয়ে তাঁকে আক্রমণ করে পরাস্তও করে এলেন। দিনে দিনে পাণ্ডবরা অসহ্য হয়ে উঠছিল। ওরা কুরু বংশের কেউ নয়। ওদের পিতারা ধর্ম, পবন, ইন্দ্র, অশ্বিন ও রেবন্ত। ইন্দ্র অস্ত্র নিয়ে কারবার করেন।
একলব্য এতক্ষণ মন দিয়ে সব শুনছিল। কিন্তু এই বার সে মুখ খুলল, হে যুবরাজ! যে যুক্তিতে পাণ্ডবরা কৌরব বংশের কেউ নয়, সেই একই যুক্তিতে আপনিও কুরু বংশের কেউ নন।
আরও পড়ুন
একলব্যকে হত্যার আদেশ দিলেন বিদুর, ভীত দ্রোণাচার্য
দুর্যোধন জানান, তিনি ধৃতরাষ্ট্রের ঔরস পুত্র, আর ওরা পাঁচ ভাইয়ের কেউ পাণ্ডুর ঔরসে জন্মায়নি।
একলব্য জানায়, আপনার পিতা বা পাণ্ডু কেউ বিচিত্রবীর্যের ঔরসজাত নন, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসের সন্তান তাঁরা। ফলে কুরু বংশ না বলে আপনি বশিষ্ঠের বংশধর বলতে পারেন।
দুর্যোধন বলেন, হ্যাঁ তুমি যথার্থ বলেছ নিষাদ রাজকুমার। তবে আমার যুক্তি হল, আমার পিতা রাজা সুতরাং তার পর আমি রাজা হব। পাণ্ডবদের অত্যাচারে ক্লিষ্ট হয়ে তাদের বারণাবতে বেড়াতে পাঠালাম। কেননা হস্তিনায় তাদের মন্ত্রণাদাতা হলেন চতুর বিদুর আর পিতামহ ভীষ্ম। ভীষ্ম-বিদুরের শলায় দ্রোণকে শিখণ্ডী খাড়া করে পাণ্ডবদের ভাড়াটে লোক তোমার দক্ষিণ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কর্তন করেছে। যা বলছিলাম, বারণাবতে পাণ্ডবরা এক মহা অন্যায় করে বসল।
গভীর রাতে স্থানীয় পাঁচ নিষাদ যুবক ও তাঁদের মাকে ভরপেট মদমাংস খাইয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় ঘরের দরজা লাগিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে মারে, তারপর চলে যায় বনের দিকে। পাণ্ডবদের উদ্দেশ্য ছিল আমাদের বোকা বানানো। কিন্তু অচিরেই আমরা জেনে গেলাম যে ওরা জীবিত এবং বিভিন্ন বনে উপদ্রব করে বেড়াচ্ছে। হিড়িম্ব ও বককে ওরা হত্যা করেছে। হিড়িম্বার বোন হিড়িম্বার সঙ্গে ভীম কয়েক দিন ফষ্টিনষ্টি করে সন্তানসহ সেই অরণ্যবাসী মহিলাকে ত্যাগ করেছে। এখন পাঁচ পাণ্ডব একজন নারীকে বিবাহ করেছে আর সেই নারী হল পাঞ্চালরাজের পালিতা কন্যা দ্রৌপদী। ভাগের বউ দ্রৌপদীর ঘরে পালা করে এক-এক ভাই যায়। যুধিষ্ঠির-দ্রৌপদী ঘরে থাকাকালীন অর্জুন সেই ঘরে ঢুকে পড়লে শাস্তি হিসাবে ব্রহ্মচর্য ও বনবাস পালন করতে হয়। এমন নিয়ম যে, ওই সময় অর্জুন ঊলূপী, চিত্রাঙ্গদাকে বিবাহ করল; সুভদ্রাকে হরণ করল অথচ বলরাম তার সঙ্গে আমার বিবাহের সম্বন্ধ করেছিলেন। ভাগের বউয়ে কী আর মন ভরে! তাই যুধিষ্ঠির গোবাসন রাজার কন্যা দেবিকাকে বিয়ে করল, ভীম কালী ও বলন্ধরাকে; বলন্ধরা আবার বিমাতা মাদ্রীর আপন বোন। নকুল, সহদেবও অন্যান্য বিবাহ করল। সে করুক। দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র, সুভদ্রার এক, দেবিকার এক; ঊলূপী-চিত্রাঙ্গদা প্রত্যেকের গর্ভে পুত্র জন্মালো। পত্নী আর উপপাণ্ডবদের নিয়ে পাণ্ডবদের এখন বিরাট সংসার। তারা হস্তিনায় এসে ভীষণ জ্বালাতন করছে। বলছে, তাদের অর্ধেক রাজত্ব দিতে হবে। কিন্তু সে ভাগ তো সম্ভব নয়। অর্ধেক কেন, একটা গ্রামও ওদের দিতে সম্মত নই। পিতা ধৃতরাষ্ট্র বললেন, হস্তিনা থেকে একটু দূরে রয়েছে যে খাণ্ডব বন সেখানে পাণ্ডবদের বসতি গড়ে দিলে কেমন হয়? আমি ভেবে দেখলাম, দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো। ওদের ওখানে পাঠানো মনস্থির করেছি। হে একলব্য, তোমার কাছে এসেছি আমি বিশেষ প্রয়োজনে।
আরও পড়ুন
কুকুরের চিৎকারে বিরক্ত একলব্য, নিক্ষেপ করলেন একসঙ্গে সাতটি তীর!
একলব্য প্রশ্ন করে, কী প্রয়োজনে যুবরাজ?
হস্তিনার অধীনে যত বনাঞ্চল, পাহাড়-পর্বত ও নদী আছে; সে সবের রাজা আমি তোমাকে ঘোষণা করতে চাই।
একলব্য ভেবে দেখলেন, তার দক্ষিণ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের বদলা নিতে গেলে দুর্যোধনের দলে ভিড়তে হবে। ভীষ্ম-দ্রোণ-বিদুর ও পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে দুর্যোধনই ভরসা। একলব্য দুটি হাত একত্রিত করে মাথায় তুলে বলল, মহারাজ দুর্যোধনের জয় হোক।
এই ঘোষণা করে দুর্যোধন চলে গেলেন শ্বশুর কলিঙ্গরাজ চিত্রাঙ্গদের রাজ্যে। নিষাদদের পল্লীতে শুরু হল উৎসব। মদ-মাংস আর নাচ-গান। সেই একটানা উৎসবের মধ্যে খবর এল, উত্তরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভয়াবহ আগুন লেগেছে। অধিবাসী থেকে শুরু করে পশু-পাখি জ্যান্ত পুড়ে মরছে।
আরও পড়ুন
ডাক পড়ল হস্তিনার রাজসভায়, দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষা প্রার্থনা একলব্যের
রাজা হিরণ্যধনু বললেন, আগুন লাগানো হয়েছে। বন-জঙ্গল রাখবে না ওরা। যুবরাজ দুর্যোধন এই পথ দিয়েই কলিঙ্গ থেকে হস্তিনায় ফিরবেন। তাঁর রথ আটকে আমি জিজ্ঞাসা করব, এমন যুবরাজ থাকতে এমন প্রাণীমেধ যজ্ঞ কী ভাবে হয়?
কিন্তু কথক ঠাকুর এসে খবর দিল যে কলিঙ্গ থেকে ভিন্ন পথে যুবরাজ দুর্যোধন হস্তিনায় দ্রুত ফিরে গিয়েছেন। তাঁর কাছে বার্তা এসেছিল, অগ্নিদেব নামের এক প্রখর দেবতা খাণ্ডব বন দগ্ধ করছে। বহু দিন ধরে তিনি চেষ্টা করছিলেন কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্রের বাধায় তা সম্ভব হয়নি।
একলব্য জিজ্ঞাসা করে, কে এই অগ্নি দেবতা?
কথক ঠাকুর জানায়, ইন্দ্রের পরেই সেই দেবতা, তিনি যুবা যবিষ্ঠ, প্রমন্থ ও ভরণ্য। তিনি ঘৃতপৃষ্ঠ, জ্বালাকেশ, তীক্ষ্ণদ্রংষ্টা ও হিরণ্যদন্তা। পৃথিবীর সম্পদরূপ যে বনরাজি তা তিনি ধ্বংস করেন। বহু দিন ধরে তাঁর নজর ছিল খাণ্ডব বনের উপর। ইন্দ্র ওই বনের রক্ষক বলে কিছু করে উঠতে পারছিলেন না। শ্বেতকী রাজার যজ্ঞ থেকে ফিরে অগ্নি নর ও নারায়ণরূপী অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণের দ্বারস্থ হয়ে খাণ্ডব বনে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন
হস্তিনানগরীর উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন একলব্য, বিচিত্র অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলেন পথে
একলব্য বলে, কিন্তু তার কারণ?
কথক জবাব দেয়, কারণ হল খাণ্ডব বনে নাগ, হস্তীরা বাস করে। তারা দেববিরোধী। বেদ মানে না। তক্ষক নাগ তাদের দলপতি। সৌগত মত প্রচার করে তারা। অগ্নি বহু চেষ্টা করেছিল কিন্তু ইন্দ্র প্রতিবার তার প্রচেষ্টায় জল ঢেলে দিয়েছিলেন। এখন ইন্দ্রপুত্র অর্জুন এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাহায্যে অগ্নিদেব স্বমহিমায় খাণ্ডব বনে জ্বাজল্যমান।
একলব্য প্রশ্ন করে, নানা প্রাণিসমন্বিত খাণ্ডববনটিকে ইন্দ্র রক্ষা করছিলেন, এই অবস্থায় অগ্নি তা দগ্ধ করতে করেছিলেন কেন?
Powered by Froala Editor