মহাভারতে রাজনীতি - ২৬
আগের পর্বে
কামারের কাছে হস্তিনাপুরের পুরনো কাহিনি শুনলেন একলব্য। তাঁকেই জিজ্ঞাসা করলেন, কীভাবে আচার্য দ্রোণের সঙ্গে দেখা করা যায়। কামার জানাল, এক অচেনা কিশোর বাজারে এসেছে, এই খবর এতক্ষণে রাজসভায় পৌঁছে গিয়েছে। পরদিন সকালেই একলব্যের ডাক পড়ল রাজসভায়। সেখানে ভীষ্ম তাঁর পরিচয় এবং হস্তিনাপুর আসার কারণ জানতে চাইলেন। একলব্য সত্যি কথা জানালে তাঁর সঙ্গে দ্রোণের আলাপ করিয়ে দেওয়া হয়। দ্রোণ তাঁকে ‘নিষাদ’ পরিচয়ের অর্থ জিজ্ঞাসা করেন। একলব্য বলতে পারেন না। তারপর…
দ্রোণ বললেন, নিষাদ হল অনার্য বর্বর, ছোটজাত। অধার্মিক ও প্রজাপীড়ক রাজা বেণকে মহর্ষিরা হত্যা করেন। মৃত বেণের দক্ষিণ ঊরু মন্থন করলে এক খর্ব কদাকার দগ্ধ কাষ্ঠতুল্য পুরুষের আবির্ভাব হয়। ঋষিরা তাকে বলেন, ‘নিষাদ’—উপবেশন করো। এই পুরুষ থেকে জলজঙ্গলপর্বতবাসী নিষাদ ও ম্লেচ্ছদের উৎপত্তি। আর বেণের ডান হাত মন্থন করে উৎপন্ন হন ক্ষত্রিয় রাজা পৃথু, তিনি ধনুর্বাণধারী শাস্ত্রপারঙ্গম। শস্ত্রবিদ্যায় অধিকার ক্ষত্রিয়দের, নিষাদদের নয়।
একলব্য মনে মনে ভেঙে পড়ে। সে দ্রোণের দগ্ধ কাষ্ঠতুল্য চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। তার পর নিজের অজান্তে প্রশ্ন করে ফেলে, আপনি তো বামুন, তাহলে কী করে অস্ত্রবিদ্যা শেখাচ্ছেন। এই বিদ্যা তো ব্রাহ্মণের নয়।
সহসা দ্রোণাচার্য ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েন। নিষাদ বালকের এই ধৃষ্টতা দেখে তিনি হতবাক। ভীষ্ম জানতে পারলে ওর যে কী শাস্তি হবে, তা ও জানে না। ক্রোধ সংবরণ করে তিনি একলব্যকে ফিসফিস করে বললেন, সূতপুত্রকেও আমি শিষ্য করেছি কিন্তু তোমাকে নিতে পারব না। তাহলে আমার চাকরি থাকবে না। ব্যস এটুকুই। বাড়ি যাও। নিজে নিজে ধনুর্বিদ্যা শেখো, নিষাদরা চেষ্টা করলে নগরবাসী ক্ষত্রিয়দের থেকেও অনেক ভালো ধনুর্ধর হতে পারে।
আরও পড়ুন
ডাক পড়ল হস্তিনার রাজসভায়, দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষা প্রার্থনা একলব্যের
দ্রোণাচার্য স্থান পরিত্যাগ করলেন। একলব্যকে পথে দেখিয়ে রাজসভার চত্বর থেকে বের করে দিল রাজপ্রহরী। নিষাদ রাজকুমার ভাবল, সে আজই নিজের রাজ্যে ফিরে যাওয়ার জন্য যাত্রা শুরু করবে। যাওয়ার আগে কামারের বাড়ি যাবে একবার, নিষাদরা কখনও অকৃতজ্ঞ হয় না।
বিদায় দেওয়ার সময় কামারের সঙ্গে ছিল বেশ কয়েক জন সঙ্গী। তাদের কথাবার্তা শুনে একলব্যের কেমন যেন মনে হয় যে তারা তারই লোক, আত্মীয়; অথচ সে আগে এদের কখনও দেখেনি।
কামার তাদের একজনকে বলল, এই যুবক হল জরাসন্ধের সেনানায়ক হিরণ্যের পুত্র। ওর সম্পর্কে আমি অনেক কিছু জানি, জানাটাই আমার কাজ। ছুরি শান দেওয়ার ফাঁকে আমার কাজ বার্তা সংগ্রহ করা, কেবল ভর্জিত বার্তাকু ভক্ষণ নয়।
একজন সিড়িঙ্গে মতো লোক বলল, রাজপ্রাসাদে শুনছি সব বলাবলি করছে।
আরও পড়ুন
হস্তিনানগরীর উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন একলব্য, বিচিত্র অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলেন পথে
তার সঙ্গী খর্বকায় লোকটি বলল, ভয়! শঙ্কাই ওদের শেষ করে দেবে। একলব্য যদি ভাল ধনুর্ধর হয়ে হস্তিনাপুর থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে নগরের শিক্ষা অরণ্যে চলে যাবে, তার পর একদিন অরণ্যবাসীরা ওদের থেকে নেওয়া শিক্ষায় ওদের মেরে ফেলবে।
কামার বলে, না। দ্রোণাচার্য বলেছেন যে একলব্য শিষ্য হিসাবে নিলে অন্য রাজপুত্রদের মধ্যে ওর অনার্যতা সংক্রামিত হবে। আর সেটা হলে দ্রোণের চাকরি থাকবে না। বহু কষ্টে এই চাকরি তিনি পেয়েছেন। এতদিন তো খেতে পরতে পেতো না।
একজন স্থূল লোক জানায়, অরণ্যের লোক মানেই হল হস্তিনার শত্রু। তাদের জ্ঞানগম্যি ভয়ঙ্কর।
কামার বলে, একলব্যের উদ্দেশ্য নিয়ে ওরা সন্দেহ প্রকাশ করেছে। একলব্য ধনুর্বিদ্যা শিখে অপপ্রয়োগ করবে। যেন ওরা অস্ত্রচালনা শিখে মানুষের মৃত্যুর বদলে জন্ম দেবে!
আরও পড়ুন
দ্রোণাচার্যকে রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষার ভার দিলেন ভীষ্ম, দ্বিধাগ্রস্ত দ্রোণ
সিড়িঙ্গে বলে, নিষাদরা হল ক্রোধী, ওদের তীরধনুকের শিক্ষা দিলে মানুষ মেরে বেড়াবে।
খর্ব লোকটি খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলে, বামুনের ছেলে অশ্বত্থামা বুঝি খুব শান্ত? ওর মতো রাগী ছেলে নাকি ভারতে আর একজনও নেই!
কামার বলল, কী বললি, ভারত?
খর্ব লোকটি হাত জোড় করে বলে, ভুল হয়ে গেছে কামার মশাই, কুরুপ্রদেশ বলি?
আরও পড়ুন
গুরুপত্নীতে আসক্ত চন্দ্র, ক্রুদ্ধ বৃহস্পতি হাজির ইন্দ্রের দরবারে
কামার রেগে জবাব দেয়, না! শোন, অশ্বত্থামা ক্রোধী হয়েছে কেন জানিস? ছেলেবেলায় খেতে পেত না বেচারা। যাক গে, একলব্যের বেলা বইয়ে দিয়ে লাভ নেই কোনও। তুমি যাও বাছা। জয় মহাদেবের জয়!
একলব্যের ঘোড়া ছুটতে লাগল টগবগ! কামারের কন্যা তাকিয়ে রইল অপলক, যতক্ষণ না একলব্য দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।
নিষাদরাজ্যে ফিরে এসে মন ভাল নেই একলব্যের। সে সর্বক্ষণ ভাবে, কেন দ্রোণ তাকে শিষ্য হিসাবে নিলেন না? সে কি শুধুই রাজনীতির কারণে, নাকি সে জাতিতে ম্লেচ্ছ বলে! ম্লেচ্ছ বা নিষাদের ব্যাপারটা খুব জোরালো প্রমাণ বলে মনে হয় না তার। আসলে রাজরোষের ভয়ে, চাকরি যাওয়ার আশঙ্কায় একলব্যকে দ্রোণ গ্রহণ করতে পারেননি। রাজপ্রাসাদের আশঙ্কা, নিষাদের ছেলে রাজকুমারদের গুরুর কাছে শিক্ষালাভ করবে, এটা কোন ধরণের দুঃসাহস! তার চেয়েও বড় আশঙ্কা হল, নিষাদ মানেই বিদ্রোহী। প্রাসাদ জঙ্গলের মানুষদের ভয় পায়। দ্রোণাচার্যকে মন্দ লাগেনি একলব্যের। না খেতে পাওয়া একজন কৃশকায় মানুষ, নিজের ব্রাহ্মণ্যবৃত্তি ছেড়ে শুধু পেটের দায়ে স্বদেশ পাঞ্চাল ছেড়ে হস্তিনায় এসে বাস করছেন! তিনি একলব্যকে কেন শিষ্যত্বে বরণ করতে পারছেন না, সে কথা ঠারে ঠারে বুঝিয়েও দিয়েছেন।
মূর্তি বানাতে বানাতে এই কথাগুলি ভাবছিল একলব্য আর তার তৈরি মূর্তি যেন একটি বঞ্চনার প্রতিমূর্তি হয়ে উঠছিল ক্রমশ। কৃষ্ণা অঙ্গাগ্রণী মাঝামধ্যে বলছিল, নাকটা ঠিক হয়নি; কাদা দিয়ে কি দাড়ি বানানো যায় নাকি! সে সব কথায় বেশ মজাই পাচ্ছিল একলব্য। মূর্তি তৈরি হতে বেশি সময় লাগল না। কিন্তু শুকনো বেশ ঝামেলার। তখন ফেটে যায় মূর্তির নানা অঙ্গ। সে সময় সেই ফাটল সারতে অনেক হ্যাপা পোহাতে হয়।
দ্রোণাচার্যকে সেই একবারই দেখেছিল একলব্য। রোদে মূর্তি যত শুকোয় তত যেন ফাটল বাড়তে থাকে। একলব্য ভাবে, এই ফাটল আসলে দ্রোণাচার্যের মন। শেষমেশ যখন মূর্তি শুকনো হল, তখন গাছের বাকল আর ফুল নিঙড়ে তারা যে রং বানায়, তাই শন দিয়ে আস্তে আস্তে বুলিয়ে দিল অঙ্গা।
অঙ্গাগ্রণীর রঙের বোধ বেশ খারাপ। দাড়ির একদিক করেছে সাদা আর একদিক কালো। এমনকি একটি হাতের রঙ লাল, অন্যটি সবুজ। একলব্য ভেবে পায় না এসবের কী মানে! অঙ্গাকে জিজ্ঞাসা করলে বলে, লোকটা ভাল আবার খারাপ, তাই এমন রঙ। একলব্য একটু রুষ্ট হয়, সে বলে—এই মূর্তি আমার গুরু, তাঁকে লোকটা বলছিস অঙ্গা!
অঙ্গা জবাব দেয়, মূর্তিকে বলিনি, দ্রোণাচার্যকে লোক বলেছি। সে তো লোকই। তবে এই মূর্তিটা তার চেয়ে ভাল, আমাদের বানানো তাই এত সুন্দর। একলব্য ও অঙ্গাগ্রণী দুজনে মূর্তিটির সামনে গড় হয়ে প্রণাম করে।
একলব্য তীরধনুক নিয়ে প্রতিদিন সেই মৃন্ময় মূর্তির কাছে আসে, পাঠ নেয় আর চলে যায় বনের দুর্গম এলাকায়। মহাদেবের মন্ত্র পড়ে শর নিক্ষেপ করে। এই ভাবে সমগ্র ধনুর্বিদ্যা তার করায়ত্ত হয় কয়েক মাসে। অঙ্গাগ্রণী তখন গর্ভবতী।
এমনই সময় একদিন অরণ্যে বিস্তর কোলাহল দেখা দিল। অনেক লোকজন নানা রকমের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বনের মধ্যে প্রবেশ করল। তাদের দ্রুতগামী রথ বনের প্রান্তসীমায় রাখা। সেই সব লোকজনের কারও হাতে দড়ি, কেউ বা জাল, বল্লম, তীরধনুক ইত্যাদি মৃগয়ার উপকরণ নিয়ে বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগল। শিকারী কুকুররা ছূতে বেড়াচ্ছে। লোকজনের মধ্যে কারও কারও বেশভূষা একটু অন্য রকম, তাদের দেখে রাজপুত্র মনে হয়।
একলব্য একমনে ধনুর্বিদ্যার নানা কৌশল ও নিয়মকানুন স্মৃতি থেকে বর্তমান অভিজ্ঞতায় তুলে এনে পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন। এমন সময় একটি কুকুরের আওয়াজে তার মনোসংযোগের বিঘ্ন ঘটে। কুকুরটি বোধ হয় এমন মানুষ আগে দেখেনি, সে ক্রমাগত ঘেউ ঘেউ করেই যাচ্ছে। একলব্য প্রথম দিকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু চিৎকার যখন সহ্যের বাইরে চলে গেল, সে একসঙ্গে সাতটি বাণ কুকুরের মুখে নিক্ষেপ করল। একে বলে শব্দহরণ বাণ। যে-কোনো জীবের স্বরনির্গমনের দ্বারে এই সপ্ততীর নিক্ষিপ্ত হলে সেই প্রাণীর সপ্তস্বর সাময়িকভাবে বিনষ্ট হয়ে যায়। কুকুরটিরও তাই হল। সে ছুটে গিয়ে প্রভুদের কাছে উপস্থিত হল। প্রভুরা ছিলেন হস্তিনাপুরের পাণ্ডব রাজকুমার—যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব। শরবিদ্ধ কুকুরটিকে দেখে তাঁরা চমকে গেলেন। কে সেই তীরন্দাজ যে এমন অদ্ভুত শরশাস্ত্র সম্পর্কে বিদ্বান! সম্ভবত তাঁদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যও এই শব্দহরণ শরনিক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত নন। তাঁরা তীরন্দাজের খোঁজে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলেন।
Powered by Froala Editor