মহাভারতে রাজনীতি – ২২
আগের পর্বে
দেবগুরু বৃহস্পতির ঔরসজাত ভরদ্বাজ। আবার তিনি ছিলেন উতথ্যের ক্ষেত্রজ সন্তান। তিনি অযোনিসম্ভব। মরুৎগণ ভরদ্বাজের প্রতিপালন করেন। এর ফলে অসুরদের রাজনীতির প্রভাব পড়ে ভরদ্বাজের জীবনে। তিনি ব্রাহ্মণ হয়েও অর্থনীতি এবং ধনুর্বিদ্যার চর্চা শুরু করেন। ভরদ্বাজের পুত্র দ্রোণও অযোনিসম্ভব। তিনিও পিতার মতোই ধনুর্বিদ্যা অনুশীলন করেন। পরশুরাম তাঁকে সমস্ত অস্ত্র ও তা ব্যবহারের শিক্ষা প্রদান করেন। দ্রোণের বন্ধু দ্রুপদ। কিন্তু আভিজাত্যের অভাবে সেই বন্ধুত্বে ভাঙন ধরে। দ্রোণ আশ্রয় নেন শ্যালক কৃপের কাছে। একদিন পাণ্ডব ও কৌরবদের খেলার মাঝে তিনি অদ্ভুত ক্ষমতার পরিচয় দেন। দুর্যোধন তাঁকে সহায়তার কথা বললে দ্রোণ জানান, তাঁর বর্ণনা এবং প্রতিভার কথা রাষ্ট্র অর্থাৎ ভীষ্মের কাছে পৌঁছে দিলেই হবে।
কৃপাচার্যের গৃহে বিশ্রাম নিতে নিতে দ্রোণাচার্য ভাবতে লাগলেন পিতামহ বৃহস্পতির কথা। এবং বৃহস্পতি-শুক্রের রাজনৈতিক বিরোধের উপাখ্যান। দেবগুরু বৃহস্পতির সঙ্গে শুধু অসুরগুরু শুক্রাচার্যের লড়াই ছিল না। এক সময়ে দেবতাদের রাজা সোম বা চন্দ্রের সঙ্গেও বৃহস্পতির লড়াই তুঙ্গে ওঠে। সেও ছিল নীতি নিয়ে লড়াই। বৃহস্পতির অন্যতমা পত্নী তারা একদিন উদ্যানে বিহার করছিলেন, সেই সময় চন্দ্র তাঁকে দেখে মোহিত হন। তারাও চন্দ্রের প্রতি আসক্ত হন। চন্দ্রের সাতাশ জন স্ত্রী রয়েছেন, যাঁরা প্রত্যেকে দক্ষের কন্যা। আবার প্রজাপতি কর্দমের স্ত্রী ও বিভাবসুর পত্নীর মতো বহু দেবরমণী চন্দ্রে আসক্ত। তারা চলে গেলেন চন্দ্র-ভবনে। বহু দিন পর যখন তারা ফিরলেন না বৃহস্পতির গৃহে, তখন বৃহস্পতি তাঁর এক শিষ্যকে পাঠালেন চন্দ্রগৃহে। চন্দ্র তারাকে ফিরিয়ে দিলেন না। বার বার দূত পাঠানো সত্ত্বেও যখন চন্দ্র তারাকে ফেরত দিলেন না তখন ক্রুদ্ধ বৃহস্পতি নিজেই গেলেন চন্দ্রভবনে। তিনি চন্দ্রকে জানালেন, বৃহস্পতি হলেন দেবতাদের গুরু, সেই হিসাবে চন্দ্রেরও গুরু, সুতরাং তারা হলেন চন্দ্রের গুরুপত্নী। গুরুপত্নী মাতৃস্থানীয়া। গুরুতল্পগমনের শাস্তি হল আত্মহত্যা, তবেই এই পাপ স্খলিত হয়। বৃহস্পতি কিন্তু একবারও তারাকে কোনও দোষ দিলেন না। চন্দ্র বৃহস্পতির কথা অবজ্ঞাভরে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ব্রাহ্মণের এত ক্রোধ থাকা ভাল নয়; সময় হলে তারা নিজেই বৃহস্পতির বাড়িতে যাবেন। বৃহস্পতি বাড়ি চলে গেলেন। তারা চন্দ্রের কাছে সুখেই আছেন। কামাতুর ও পরাজিত বৃহস্পতি পুনরায় চন্দ্রের বাড়ি এলেন। এই বার তাঁকে বাধা দিলেন দারোয়ান। দরজায় দাঁড়িয়ে হম্বিতম্বি করতে লাগলেন দেবগুরু। চন্দ্র হাসিমুখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, স্ত্রীলোক নিজের যোগ্য স্বামী খুঁজে বেড়ায়। তারা সুন্দরী, তাঁর যোগ্য চন্দ্র ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। সুতরাং তারাকে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। বৃহস্পতি অভিশাপের ভয় দেখাতে লাগলেন। চন্দ্র দমবার পাত্র নন। তিনি বললেন, পালিয়ে যাওয়া একজন স্ত্রীলোকের প্রতি এত ভালবাসা দেখে আপনার উপর আমার মায়া হচ্ছে গুরুদেব। যে কর্ষণ করে ক্ষেত্র তাঁরই। অতএব তারার কথা ভুলে যান।
ক্রুদ্ধ ও অপমানিত দেবগুরু এলেন দেবরাজের কাছে। তখন দেবতাদের রাজা ইন্দ্র। ইন্দ্র দেবগুরুকে বললেন, আপনি একটুও চিন্তা করবেন না গুরুদেব, তারাকে আমি ফিরিয়ে দেব, প্রয়োজনে চন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করব। ইন্দ্র প্রথমে একজন দূতকে পাঠালেন চন্দ্রের কাছে। সেই দূত গিয়ে বললেন, তুমি নীতিজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি, এত সব সুন্দরী থাকা সত্ত্বেও তোমার কি গুরুপত্নীকে সম্ভোগ করা মানায়? তোমার আরও সুন্দরী প্রয়োজন হলে দেবরাজ তোমার জন্য অপ্সরাদের পাঠাবেন। তারাকে ছাড়তে তোমায় হবেই।
চন্দ্র দূতকে উত্তর দিলেন, তারা বৃহস্পতির স্ত্রী ঠিকই কিন্তু বৃহস্পতি নিজের স্ত্রীকে ছেড়ে অগ্রজের পত্নীকে বলাৎকার করেছেন, অনুজের পত্নীর সঙ্গে সহবাস করেছেন, এতে যে কোনও পত্নী স্বামীর প্রতি রুষ্ট হবেন। তারাও হয়েছেন। দ্বিতীয়ত, বৃহস্পতি নিজেই তাঁর নীতিশাস্ত্রে বলেছেন, কোনও মহিলা যদি স্বেচ্ছায় কোনও পুরুষের সঙ্গে রমণ করেন তবে সেই পুরুষের কোনও পাপ হয় না। বৃহস্পতি তারার স্বামী হলেও চন্দ্র তাঁর প্রেমিক, অতএব তারাকে ত্যাগ করার প্রশ্নই ওঠে না।
আরও পড়ুন
ব্রাহ্মণ হয়েও অর্থনীতির চর্চা, সামাজিক সব গণ্ডি ভেঙে দিয়েছিলেন ভরদ্বাজ
ইন্দ্র অত্যন্ত অপমানিত বোধ করলেন। জমি ও স্ত্রীলোক নিয়ে এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব অবশ্য বেশ পুরনো। ইন্দ্র ঠিক করলেন, দেবগুরুর অসম্মানের জন্য তিনি যুদ্ধ করবেন। দেবতাদের মধ্যে সাজো সাজো রব পড়ে গেল। চন্দ্র এক কালে দেবতাদের নেতা ছিলেন। এখন দেবতাদের রাজা ইন্দ্র। অতএব কে কোন পক্ষ নেবেন সেই নিয়ে চলল তুমুল আলোচনা। ওদিকে অসুররাও বসে নেই। তাঁদের গুরু স্বয়ং শুক্রাচার্য এসে চন্দ্রের পক্ষ নিলেন। দেবতাদের অন্তর্দ্বন্দ্বে অসুরদের লাভ। তাঁরা মারামারি কাটাকাটি করলে অসুররা দেবতাদের থেকে বলীয়ান হয়ে উঠবেন। শুক্রাচার্য চন্দ্রকে বললেন, তারাকে ফেরত দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, আমরা তোমার সঙ্গে আছি।
ওদিকে অসুরদের চন্দ্রপক্ষে যোগ দিতে দেখে স্বয়ং মহাদেব আর বসে থাকলেন না। তিনি এই সব ব্যভিচার দু চোখে সহ্য করতে পারেন না। ব্রহ্মাকেও তিনি শাস্তি দিয়েছেন এক কালে। রুদ্রদেব এক কালে বৃহস্পতির পিতা অঙ্গিরার কাছে শিক্ষালাভ করেছেন। সেই সম্পর্ক ধরে শিব যোগ দিলেন ইন্দ্রের পক্ষে। অসুররা যোগ দিলেন চন্দ্রের পক্ষে।
আরও পড়ুন
কালকূট খাওয়ালেন দুর্যোধন, গঙ্গার তীরে বেহুঁশ মহাপরাক্রম ভীম
মহাদেব ব্রহ্মশির অস্ত্রে চন্দ্রপক্ষের বহু সৈনিককে কোতল করলেন বটে কিন্তু তিনি চন্দ্রের কিছুই করতে পারলেন না। চন্দ্র হলেন বিষ্ণুর বরপুষ্ট। বহু দেবতা চন্দ্রের হাতে মারা পড়ল। অসুররাও মেরে ফেলল অনেক দেবতাকে। দেবাদিদেব মহাদেব কিছুই করতে পারলেন না। জীবিত দেবতারা ভয় পেয়ে চলে গেলেন ব্রহ্মার কাছে। বললেন, অবিলম্বে এই যুদ্ধ বন্ধ করুন প্রভু, নইলে আমরা কেউ বাঁচবো না। ব্রহ্মা রুদ্র-শিব ও শুক্রাচার্যকে বার্তা দিলেন, যুদ্ধ থামাও। শুক্রকে বললেন, তোমার বউকে কেউ নিয়ে পালালে তুমি কী করতে? এক্ষুনি যুদ্ধ বন্ধ করো। আর চন্দ্রকে জানালেন, গুরুপত্নীকে যদি ফিরিয়ে না দাও তাহলে বিষ্ণুকে বলে তোমার এমন হাল করবো যে কোনও দিন কোথাও মুখ দেখাতে পারবে না। চন্দ্র তবুও নির্বিকার। শেষে ব্রহ্মা দ্বারস্থ হলেন চন্দ্রের পিতা অত্রি মুনির কাছে। অত্রি মুনি ব্রহ্মারই মানসপুত্র আবার অত্রি মুনির স্ত্রীর গর্ভে স্বয়ং ব্রহ্মা চন্দ্র হিসাবে জন্মলাভ করেন। পিতা অত্রিমুনির নির্দেশ অমান্য করার মতো সাহস হল না চন্দ্রের, তিনি বৃহস্পতি-জায়াকে ছেড়ে দিলেন। বৃহস্পতি স্ত্রী তারাকে নিয়ে ঘরে ফিরলেন। দেব-অসুরের যুদ্ধ থেমে গেল।
চন্দ্র তারাকে ছেড়ে দিলেন বটে কিন্তু তত দিনে তারা গর্ভবতী হয়েছেন। বৃহস্পতির গৃহে তিনি সযত্নে গর্ভ রক্ষা করলেন। যথাকালে একটি পুত্র প্রসব করলেন তারা। সেই পুত্র দেখতে চন্দ্রের মতো, সমস্ত লক্ষণই তার শুভ। বৃহস্পতি পুত্রমুখ দর্শন করে বড়ো আনন্দ পেলেন। তিনি পুত্রের জাত-কর্মাদি সম্পন্ন করলেন।
আরও পড়ুন
যুধিষ্ঠিরকে হস্তিনাপুরের রাজা করতে চাইলেন বিদুর, ক্ষুব্ধ দুর্যোধন
এদিকে লোকমুখে চন্দ্র শুনতে পেলেন তারার পুত্রলাভের কথা। তিনি দূত পাঠালেন দেবগুরুর বাড়িতে। দূত জানালেন, এই পুত্র বৃহস্পতির নয়, সে চন্দ্রের ঔরসজাত। বৃহস্পতি সে কথা মানলেন না। চন্দ্র ও বৃহস্পতির মধ্যে আবার যুদ্ধপরিস্থিতির সৃষ্টি হল। চন্দ্রের পিতামহ ব্রহ্মা প্রমাদ গণলেন। একবার যুদ্ধ থামানো গেছে, আবারও কি যাবে? তিনি সরাসরি তারার কাছে এলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, বলো তো এই পুত্র কার? তুমি যদি ঠিক কথা বলো তাহলে আবার এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ লাগে না।
পূর্বে অনেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন এই প্রশ্ন। কিন্তু তারা উত্তর দেননি। এখন তারা ব্রহ্মাকে জবাব দিলেন, এই পুত্র চন্দ্রের। সেই নবজাতকের নাম রাখা হল ‘বুধ’। চন্দ্র পুত্রকে নিয়ে চলে গেলেন। বুধ এবং কিম্পুরুষ ইলা-সুদ্যুম্ন (যিনি আদতে ছিলেন সূর্যবংশীয় রাজা)-র পুত্রের নাম হল পুরূরবা। পুরূরবা হলেন হস্তিনার বর্তমান রাজবংশের আদি পুরুষ। এই হেতু ওই রাজবংশ চন্দ্রবংশ। যদিও পুরূরবা পেয়েছিলেন সূর্যবংশীয় রাজা সুদ্যুম্নের রাজত্ব।
আরও পড়ুন
বর্ণাশ্রম প্রথা ছিল দেবতাদের মধ্যেও, ইন্দ্রের সঙ্গে মদ্যপানে মানা অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের!
দ্রুপদ যে রাজ্যের রাজা সেটিও চন্দ্রবংশীয় এবং দ্রুপদের জন্ম মরুদগণের অংশে। দ্রুপদ রাজা ব্রাহ্মণ দ্রোণকে অপমান করেছেন। আবার পিতামহ বৃহস্পতির সঙ্গে চন্দ্রবংশের পুরনো শত্রুতা। দ্রুপদকে শায়েস্তা করা দ্রোণাচার্যের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, তাঁর বৃহত্তর উদ্দেশ্য হল চন্দ্রবংশের পতন।
ভীষ্ম রাজপুত্রদের মুখে দ্রোণ সম্পর্কে সব কিছু অবগত হয়ে তাঁকে ডেকে পাঠালেন। দ্রোণ এলে জিজ্ঞাসা করলেন, বলুন, আপনার অভিপ্রায় কী?
দ্রোণ বললেন, আমি জটাজুটধারী ব্রাহ্মণ হয়েও ধনুর্বেদ শিক্ষার জন্য বহু বছর মহর্ষি অগ্নিবেশের চরণসেবা করেছি। এই সেই অগ্নিবেশ যিনি রাজনীতিশাস্ত্র ও শস্ত্রবিদ্যার সব কিছু জানতেন। তিনি স্বয়ং অগ্নিপুত্র এবং আমার পিতার শিষ্য। আমার পিতা ভরদ্বাজ তাঁকে আগ্নেয় অস্ত্র দান করেন। মহর্ষি অগ্নিবেশের কাছে আমি সেই অস্ত্র পেয়েছি। মহর্ষি অগস্ত্যের কাছে অগ্নিবেশ ধনুর্বিদ্যা শিক্ষালাভ করেন। সেই শিক্ষা তিনি সম্পূর্ণ আমাকে দিয়েছেন। অগস্ত্য যে ব্রহ্মশিরাস্ত্র অগ্নিবেশকে দেন, তা এখন আমার কাছে। এই আমার যোগ্যতা। আপনি কি আমাকে রাজপুত্রদের অস্ত্রগুরু পদে নিয়োগ করবেন?
অলংকরণ – প্রণবশ্রী হাজরা
Powered by Froala Editor