মহাভারতের রাজনীতি - ২১
আগের পর্বে
একা রাজত্ব সামলানো সম্ভব নয় বুঝে যুবরাজদের সঙ্গে নিয়ে রাজ্যপরিচালনা শুরু করলেন ধৃতরাষ্ট্র। এদিকে প্রজারঞ্জনে ও রাজনীতিতে দুর্যোধন তুখোর হলেও নানা ক্রীড়ায় ভীমের কাছে রোজই পর্যুদস্ত হতেন কৌরবরা। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দুর্যোধন ভীমকে কালকূট খাওয়ালেন এবং ফেলে দিয়ে এলেন গঙ্গার ধারে। ভীম তলিয়ে গেলেন নাগলোকে। সেখানে তাঁর মাতামহীর মাতামহী বাসুকি নাগের কারণে সুস্থ হয়ে উঠলেন। নাগেদের কাছ থেকেই ভীম পেলেন রসসিদ্ধি বিদ্যা। তাদের কাছেই ভীমের রাজনীতির প্রথম পাঠ। এদিকে ভীমকে খুঁজে না পেয়ে হস্তিনাপুরে সকলেই অস্থির। ৮ দিন পর ভীম ফিরে আসায় খুশি হলেন ধৃতরাষ্ট্র। কৌরব ও পাণ্ডবদের শিক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হল সপ্ত-চিরজীবির অন্যতম গৌতম-পৌত্র কৃপাচার্যের উপর। রাজনীতির ক্ষেত্রে ন্যায়ের পক্ষে তিনি। অন্যদিকে ভগ্নীপতি দ্রোণাচার্য ছিলেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। তিনিই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বীজ বপন করেছিলেন।
‘দ্রোণ’ মানে দগ্ধকাক, দাঁড়কাক। শব্দটি এসেছে ‘দ্রু’ নামক ধাতু থেকে। দ্রুপদ ছিলেন দ্রোণের বন্ধু। ‘দ্রুপদ’ হল যূপকাষ্ঠের প্রদেশবিশেষ। যূপ হল যজ্ঞে বলিপ্রদত্ত পশুকে বেঁধে রাখার কাঠ। দ্রুপদের পিতা পৃষত ও দ্রোণের পিতা ভরদ্বাজ ছিলেন মিত্র। দ্রুপদ ভরদ্বাজের আশ্রমে প্রায়ই আসতেন। দ্রুপদ ও দ্রোণ একসঙ্গে খেলাধূলা ও পড়াশুনা করতেন। এই প্রসঙ্গে জেনে নেওয়া দরকার যে, দ্রোণ ছিলেন অযোনিজ সন্তান। এবং তিনি ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও ক্ষত্রিয়বৃত্তি করেছেন। অর্থাৎ স্বধর্ম থেকে চ্যুত হয়েছেন। তাঁর যে উপার্জিত অর্থ তা শুভ্র নয়, আবার যেহেতু তিনি রাষ্ট্রের অধীনে কাজ করতেন তাই তাঁর অর্থ কৃষ্ণও নয়। এখানে তাঁর উপার্জিত অর্থকে শাস্ত্রমতে ‘শবল’ বলা যায়। সে প্রসঙ্গে আসা যাবে।
দ্রোণের পিতা ভরদ্বাজ ছিলেন নামকরা ঋষি। তাঁর পিতা দেবগুরু বৃহস্পতি। দেবগুরু বৃহস্পতির সঙ্গে অসুরগুরু শুক্রাচার্যের দ্বন্দ্ব শুধু প্রায়োগিক যুদ্ধে সীমাবদ্ধ ছিল না। বৃহস্পতি অর্থনীতিকে রাজনীতি থেকে পৃথক করে একটি আলাদা বিদ্যা বলার পক্ষপাতী ছিলেন। পক্ষান্তরে, শুক্রাচার্য অর্থনীতিকে রাজনীতিরই একটি শাখা বলেছিলেন। ভরদ্বাজ মুনিও অযোনিজ সন্তান। মহাভারতে অযোনিজ সন্তানদের উৎপত্তি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। বৃহস্পতির অগ্রজ উতথ্যের স্ত্রীর নাম মমতা। মমতা তখন গর্ভবতী, এমন সময় দেবর বৃহস্পতি তাঁর কাছে সঙ্গম প্রার্থনা করেন। উতথ্য তখন গৃহে ছিলেন না। মমতা সম্মত হলেন না। তিনি জানালেন যে তিনি গর্ভিনী এবং একই উদরে দুজন সন্তানের বাস অসম্ভব যেহেতু তাঁর গর্ভস্থ শিশু পরিণত, আবার দেবগুরু বৃহস্পতির বীর্য অমোঘ; তাই এই সঙ্গম অসম্ভব। বৃহস্পতি মমতার কথায় কর্ণপাত না করে তাঁকে ধর্ষণ করলেন। গর্ভস্থ শিশু পা দিয়ে পিতৃব্যের রেতঃস্খলন আটকে দিলেন, ফলে বৃহস্পতির বীর্য ভূমিতে পড়ে গেল। বৃহস্পতি গর্ভস্থ শিশুকে অন্ধ হওয়ার অভিশাপ দিলেন। ভূমিতে পতিত বীর্য থেকে যে সন্তান জন্মালেন তাঁর নাম ‘ভরদ্বাজ’। ভরদ্বাজ যেহেতু মমতার সঙ্গে বৃহস্পতির সঙ্গমের ফলে বীর্য থেকে উৎপন্ন তাই তিনি এক অর্থে উতথ্যের ক্ষেত্রজ পুত্র যদিও এখানে ক্ষেত্র হল ভূমি। আবার তিনি বৃহস্পতির ঔরসপুত্র। কে তাঁকে প্রতিপালন করবেন এই নিয়ে বিবাদ দেখা দিলে মরুৎগণ এই শিশুকে পালন করেন। তিনি মরুৎগণের দ্বারা ‘ভর’ (পালিত) হয়েছিলেন বলে এবং দুইয়ের দ্বারা উৎপন্ন বলে ‘দ্বাজ’ অর্থাৎ সঙ্কর। শাস্ত্রে এই ধরণের সন্তানদের দ্বৈম্যুষায়ণ বলা হয়। ভরদ্বাজের রাজনীতি ছিল কিঞ্চিৎ গোলমেলে। মরুৎগণ ছিলেন সংখ্যায় সাত এবং তাঁরা যেহেতু কশ্যপের পুত্র এবং দিতির গর্ভজাত তাই তাঁদের ‘দৈত্য’ বলা হয়। দেবগুরুর পুত্র হওয়া সত্ত্বেও ভরদ্বাজ দৈত্য বা অসুরদের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তবে কোথাও কোথাও মরুৎদের রুদ্রের সন্তান বলা হয়েছে। সেই অর্থে রুদ্র বা মহাদেবের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন ভরদ্বাজ। যে জন্য ভরদ্বাজ ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও অর্থনীতির চর্চা করেছেন অর্থাৎ বৈশ্যবৃত্তির অভ্যাস করেছেন, তিনি ইন্দ্রের কাছে আয়ুর্বেদশাস্ত্রের পাঠ নিয়ে ভিষক-বৈদ্যের কাজ বা শূদ্রবৃত্তি করেছেন। এবং সর্বোপরি তিনি ধনুর্বিদ্যার চর্চা করেছেন। যে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন ছিল চতুর্বর্ণের মধ্যে, ভরদ্বাজ মুনি তা নিজের জীবনেই ভেঙেচুরে দিয়েছিলেন। কৌটিল্য তাঁর রাজনীতির আলোচনায় বার বার ভরদ্বাজ মুনির প্রসঙ্গ টেনেছেন। সমাজের উন্নয়নের জন্য, দরিদ্রদের ক্ষুণ্নিবৃত্তি নিবারণের জন্য মন্দিরের অর্থ এবং ধনী লোকদের সম্পদ বাজেয়াপ্তের কথা বলেছিলেন ভরদ্বাজ। তাঁর লেখা নীতিশাস্ত্রের গ্রন্থটিতেও রাজনীতির আলোচনা আছে।
ভরদ্বাজের বন্ধু ছিলেন রাজা পৃষত। ‘পৃষত’ শব্দটি এসেছে ‘পৃষ্’ ধাতু থেকে যার অর্থ হিংসা। পৃষত পাঞ্চাল দেশের রাজা, তাঁর অন্য নাম বাজ্জসেন। পঞ্চাল-অধ্যুষিত রাজ্যকে ‘পাঞ্চাল’ বলে। পঞ্চাল কী? যে দেশের রক্ষণে মুদ্গল-প্রভৃতি ‘পঞ্চ’ রাজা ‘অলম্’ (সমর্থ) তাই পঞ্চাল। এই রাজ্যটি ছিল মহাজনপদ। সেই সময় যে ষোলোটি মহাজনপদ ছিল তার মধ্যে দুটিতে অভিজাতদের গণতন্ত্র ও বাকি চোদ্দোটিতে রাজতন্ত্র বহাল ছিল। পাঞ্চাল রাজ্যে পাঁচটি বংশ ছিল বলে জানা যায়—কৃবি, তুর্বসু, কেশী, সৃঞ্জয় ও সোমক। পাঞ্চালদের সঙ্গে কুরুবংশের লড়াই সুবিদিত। এমনও হয়েছে যে, পাঞ্চালদের আক্রমণে কুরুদের পালিয়ে গিয়ে সিন্ধু নদীর তীরে বসতি গড়তে হয়েছে। রীক্ষ নামের পাঞ্চালের এক রাজা দোর্দণ্ডপ্রতাপ ছিলেন। রীক্ষের পুত্র সম্বরণের রাজত্বকালে পাঞ্চাল দেশ এক ভয়ঙ্কর খরা ও দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। সম্বরণ রাজ্য ছেড়ে বনে পালিয়ে যান। এই বংশের রাজা হলেন সোমক। তাঁর একটিমাত্র পুত্র ছিল যার নাম জন্তু। শত পুত্রলাভের কামনায় সেই পুত্রকে অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হয়। জন্তুর একটি পুত্র ছিল তাঁর নাম পৃষত যিনি উত্তর পাঞ্চালের রাজা ছিলেন। মুদ্গলের একাদশতম উত্তরপুরুষ হলেন রাজা পৃষত।
আরও পড়ুন
কালকূট খাওয়ালেন দুর্যোধন, গঙ্গার তীরে বেহুঁশ মহাপরাক্রম ভীম
ঋষি ভরদ্বাজের অযোনিজ পুত্রের বিবাহ নিয়ে গোলযোগ দেখা দিল। অবশেষে একটি অযোনিজ কন্যা পাওয়া গেল যাঁর নাম কৃপী, তিনি মহর্ষি শরদ্বানের দুহিতা, তাঁর সঙ্গে বিবাহ হল দ্রোণের। ভরদ্বাজের মৃত্যুর পর পিত্র আশ্রমে থেকে ধনুর্বিদ্যার চর্চা করতে লাগলেন দ্রোণ। একদিন তিনি শুনলেন পুরুষশ্রেষ্ঠ পরশুরাম যিনি ব্রাহ্মণ হয়েও বড় যোদ্ধা এবং ক্ষত্রিয়কুলের একদা শত্রু তিনি তাঁর সমস্ত সম্পদ দান করে দিচ্ছেন। দরিদ্র দ্রোণ সেখানে গেলেন সম্পদের আশায়। পরশুরাম বললেন, সোনাদানা যা ছিল সব ব্রাহ্মণদের দান করেছি, সমগ্র পৃথিবী দিয়েছি কশ্যপকে; এখন শুধু আমার শরীর আর অস্ত্রশস্ত্র পড়ে রয়েছে, এখন তুমি কী চাও আমাকে বলো। দ্রোণ বললেন, আমাকে আপনার সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র দিন, তাদের প্রয়োগবিধি ও প্রত্যাহারের নিয়মসমূহ শিখিয়ে দিন। দ্রোণাচার্যকে পরশুরাম সব দিলেন। অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দ্রোণ মহেন্দ্র পর্বত থেকে সোজা পাঞ্চালে গেলেন। সেখানে পৃষত রাজার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্রুপদ রাজা হয়েছেন। দ্রপদ দ্রোণের বাল্যসখা। একদা দ্রুপদ বলেছিলেন, তাঁর রাজ্যের অর্ধেক হল দ্রোণের। কিন্তু দ্রুপদ তাঁকে অপমান করলেন। বললেন, ধনীর মিত্র দরিদ্র কখনও হতে পারে না। অপমানিত দ্রোণাচার্য হস্তিনায় এসে শ্যালক কৃপের গৃহে গোপনে বাস করতে লাগলেন। কৃপাচার্য ছিলেন শরদ্বানের অযোনিজ পুত্র যাঁকে প্রতিপালন করেছেন রাজা শান্তনু। কৃপ কৌরবদের অস্ত্রগুরু।
কৃপের গৃহে কিছুকাল বাস করার পর একদিন দ্রোণ বাইরে বেরোলেন। দেখলেন, কৌরব বালকরা সম্মিলিত অবস্থায় হস্তিনার মাঠে ডাং গুলি খেলছে। হঠাৎ তাদের সেই ডাং গুলির বীটা অর্থাৎ গুলিটা একটি কূপের মধ্যে পড়ে যায়। সকলে অনেক চেষ্টা করেও কূপ থেকে তা উদ্ধার করতে পারে না। এ ওঁকে দোষ দিতে লাগল। খেলাও গেল বন্ধ হয়ে। এমন সময় বালকরা দেখল, দূরে শ্যামবর্ণ, শুক্লকেশ ও কৃশ শরীরের একজন মানুষ। সকলে তাঁকে ঘিরে দাঁড়াল। একজন বালক বলল, আমাদের বীটাটা কূপ থেকে উদ্ধার করে দেবেন? মানুষটি অর্থাৎ দ্রোণ বললেন, ধিক তোমাদের! ভরতবংশে জন্মে সামান্য বীটা উদ্ধার করতে পারো না? এই দেখ, আমি আমার আংটি কূপে ফেলে দিয়ে ঈষিকা অর্থাৎ নলখাগড়া দিয়ে ওটা তুলে দেব। কিন্তু বিনিময়ে আমাকে এক সন্ধ্যার খাদ্য দিতে হবে।
আরও পড়ুন
যুধিষ্ঠিরকে হস্তিনাপুরের রাজা করতে চাইলেন বিদুর, ক্ষুব্ধ দুর্যোধন
দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত দ্রোণকে বালকদের একজন বলল, মহাশয়, কৃপাচার্যের অনুমতি হলে আপনি প্রত্যহ খাদ্য লাভ করবেন।
দ্রোণ প্রথমে একটা ঈষিকা নিয়ে বীটাটিকে বিদ্ধ করলেন, তার পর আর একটা দিয়ে দ্বিতীয় ঈষিকাকে। এই ভাবে একের পর এক ঈষিকা সংযোগে বীটা উদ্ধার হল। বালকরা বিস্মিত হল। দুর্যোধন বললেন, বিপ্রর্ষি, আপনার আংটিও তুলুন। দ্রোণ তখন বাণ দ্বারা সেই আংটিকে বিদ্ধ করে উপরে তুললেন। সকলে আবার অবাক হয়ে গেল।
আরও পড়ুন
বর্ণাশ্রম প্রথা ছিল দেবতাদের মধ্যেও, ইন্দ্রের সঙ্গে মদ্যপানে মানা অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের!
দুর্যোধন বললেন, বিপ্রর্ষি আমরা আপনাকে অভিবাদন করি। কেননা, এমন ক্ষমতা আর কারও নেই। আমরা বিনীতভাবে জানতে চাই, আপনি কে, কার লোক? আমরা আপনার জন্য কী করতে পারি?
দ্রোণাচার্য বললেন, তোমরা রাষ্ট্রের কাছে গিয়ে বলো, আমার আকৃতি ও গুণের কথা। রাষ্ট্র অর্থাৎ ভীষ্মদেব আমার কর্তব্যের বিষয় বুঝতে পারবেন। এটুকুই তোমরা আমার জন্য করলে প্রসন্ন হব।
আরও পড়ুন
বরং ইন্দ্রের ঔরসে গর্ভবতী হোন কুন্তী, পরামর্শ দিলেন স্বামী পাণ্ডু
অলংকরণ – প্রণবশ্রী হাজরা
Powered by Froala Editor