মহাভারতে রাজনীতি - ১৯
আগের পর্বে
মাদ্রীর সঙ্গে মৈথুনকালে পাণ্ডুর মৃত্যু হল। কুন্তীর অপমানে মাদ্রীও সহমরণে গেলেন। পাঁচ পুত্রকে নিয়ে কুন্তী থেকে গেলেন বনের মধ্যে। অন্যদিকে ১০১ পুত্রকন্যা এবং দাসীপুত্র যুযুৎসুকে নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের সুখের সংসার। কিন্তু বিদুর তাঁকে পুত্রত্যাগের পরামর্শ দিলেন। ধৃতরাষ্ট্র তাতে রাজি হলেন না। ব্যাসদেবের পরামর্শে সত্যবতী অম্বিকা এবং অম্বালিকাকে নিয়ে বানপ্রস্থে গেলেন। পাণ্ডবরা হস্তিনাপুরে ফিরে এল। কিন্তু তাদের পাণ্ডুর সন্তান বলে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না অনেকেই। এমনকি যুধিষ্টিরকে বিদুরের ঔরসজাত বলেও মনে করতেন কেউ কেউ। তারপর…
ধৃতরাষ্ট্র জানেন, একাকী রাজ্য পরিচালনা করা অসম্ভব। তাই তিনি যুবরাজ দুর্যোধনের সাহায্য নেওয়া মনস্থির করলেন। সমস্ত রাজকুমারদের রাজনীতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে আচার্য ঠিক করলেন। শুধু রাজনীতি নয়, ধর্মশিক্ষা, অস্ত্রশিক্ষা সব কিছু শেখানোর বন্দোবস্ত হল। ধৃতরাষ্ট্র জানেন, যতই ধীর, বীর এবং জিতেন্দ্রিয় হোন না কেন, একমাত্র তিনি কিছুতেই সমগ্র রাজ্যের বিভিন্ন বিভাগের পরিচালন করতে সমর্থ নন। ন হ্যেকো ভৃত্যরহিতো রাজা ভবতি রক্ষিতা। সুতরাং প্রত্যেক বিভাগের জন্য অধ্যক্ষ প্রয়োজন। অবশ্য সব কিছুতে তিনি স্বয়ং সর্বময় কর্তা। মন্ত্রী, মিত্র, সেনাপতি, গ্রামাধিপতি অধিকরণিক প্রমুখ পাত্রমিত্রের সাহায্যে রাজা দেশ শাসন করবেন। যদপাল্পতরং কর্ম্ম তদপোকেন দুষ্করম্। পুরুষেণাসহায়েন কিমূ রাজ্ঞা পিতামহ।।
দুর্যোধন প্রজারঞ্জনে ও রাজনীতিতে তুখোড়। আর মধ্যম পাণ্ডব নানাবিধ ক্রীড়ায় সর্বাধিক শক্তি প্রদর্শন করতেন। এতে করে কৌরব ভ্রাতাগণ তাঁর সঙ্গে ক্রীড়ায় নাজেহাল হতেন। প্রায়ই বাহুযুদ্ধে কৌরবদের উপর নিপীড়ন করতেন তিনি। ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের পরস্পরের মাথা ঠোকাঠুকি করে, জলে ডুবিয়ে এবং অন্যান্য নানা প্রকারে নিগ্রহ করতেন মধ্যম পাণ্ডব। বাহুযুদ্ধে, গমনের বেগে, ব্যায়ামের অভ্যাসে কেউ তাঁকে হারাতে পারতেন না। তাঁর এই রকম অকারণ অত্যাচারের জন্য তিনি কৌরব ভাইদের কাছে অপ্রিয় হলেন।
কৌরবগণ ভীমের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নতুন এক রাজনীতির ফাঁদ তৈরি করলেন। গঙ্গার তীরে প্রমাণকোটি নামক জায়গায় একটি সুসজ্জিত ভবন নির্মাণ করলেন। তার পর সেখানে পাণ্ডব ভাইদের নিমন্ত্রণ করলেন। নানা রকম খাদ্য ও নেশার দ্রব্য ভক্ষণ করতে লাগলেন তাঁরা। ভীমকে দুর্যোধন কালকূট খাওয়ালেন। কালকূট হল অবসাদক দ্রব্য। এই অবসাদক খেলে কালের বা সময়ের বোধ স্বল্পকালের জন্য লুপ্ত হয়। ভীম ওই নেশার দ্রব্যের প্রভাবে গঙ্গার তীরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে রইলেন। কৌরব ভ্রাতারা তার হাত পা লতা দিয়ে বেঁধে দিল। এত দিনের সব অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে পেরে প্রত্যেকে বেশ প্রসন্ন। সংজ্ঞাহীন ভীম জলে নিমগ্ন হয়ে নাগলোকে উপস্থিত হলেন। মহাবিষ সর্পগণের দংশনে ভীমের শরীরে কালকূট নামক বিষ নষ্ট হল।
মহাভারতে নাগদের রাজনীতি কিঞ্চিৎ ভিন্ন। এদের সাধারণত অতিলৌকিক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কিন্তু শাব্দিক সংজ্ঞা অনুধাবন করলে বোঝা যায়, নাগদের সঙ্গে পর্বতের সম্পর্ক আছে এবং ‘নাগ’ শব্দের দ্বারা হস্তীকেও বোঝায়। নাগ-এর সংস্কৃত প্রতিশব্দ হল ‘সর্প’। এই ‘সর্প’ শব্দের আছে তিনটি অর্থ—এক, বিত্তবান; দুই, এঁকেবেঁকে চলা ও তিন, ক্যামোফ্লেজ। যেজন্য তক্ষককে আমরা সর্প বলে জানি। সে নাগবিশেষ হলেও বিত্তবান এবং ইন্দ্রের সখা। বিপদের সময় সে দেবরাজের উত্তরীয়তে আত্মগোপন করে।
আরও পড়ুন
যুধিষ্ঠিরকে হস্তিনাপুরের রাজা করতে চাইলেন বিদুর, ক্ষুব্ধ দুর্যোধন
বাসুকিকে সাধারণত নাগরাজ বলা হয়ে থাকে। এই বাসুকি হলেন ভীমের মাতামহের মাতামহ। সেই সূত্রে বাসুকি ভীমকে উদ্ধার করলেন। বাসুকির রাজত্ব হল পাতাললোকে, সে এক গুঢ় জগৎ। মহাকাব্যে উল্লিখিত বাসুকি সর্পকুলের রাজা অর্থাৎ নাগরাজ। বাসুকি ছিলেন শিবের ভক্ত। তাঁকে শিবের সর্প হিসাবে বিবেচিত করা হয়, মনসা হল তাঁর ভগ্নী। বাসুকি মহাদেবের স্কন্ধে বিরাজমান থাকেন। দেবতারা যখন সমুদ্র মন্থনের জন্য যান তখন বাসুকিকে রজ্জু হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। বৌদ্ধ সাহিত্যে বাসুকির উল্লেখ দেখা যায় বেশি। কশ্যপ ও তার স্ত্রী কদ্রুর জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসাবে তাঁর পরিচিতি। তিনি শেষনাগ, আদিশেষনাগ ও বাসুকি--এই তিন নামে পরিচিত। মাতা কদ্রুর অন্যায় আদেশ অমান্য করায় কদ্রু বাসুকি-কে অভিশাপ দেন যে, তিনি জনমেজয়ের সর্প-যজ্ঞে দগ্ধ হয়ে মারা যাবেন। নানা পবিত্র তীর্থে কঠোর তপস্যার পর অনন্তনাগ ব্রহ্মার দেখা পান। ব্রহ্মা তাঁকে বলেন, বন-সাগর-জনপদাদি-সমন্বিত চঞ্চল পৃথিবীকে নিশ্চল করে ধারণ করতে। বাসুকি বা শেষনাগ পাতালে গিয়ে মাথার ওপর পৃথিবী ধারণ করলেন। ব্রহ্মার অশীর্বাদে তাঁর বৈমাত্র ভ্রাতা বিনতাপুত্র গরুড় তাঁর সহায় হলেন এবং পাতালের নাগগণ তাকে নাগরাজ বাসুকিরূপে বরণ করলেন। ইনি শেষনাগ হিসাবে অভিহিত হয়ে থাকেন। এঁর ফণার সংখ্যা মোট ছয়টি এবং তা পদ্মফুলের মতো বিস্তৃত। নাগদের মধ্যে ইনিই সর্বশ্রেষ্ঠ। ইনি পৃথিবীকে তার ধারণ স্কন্ধে ধারণ করে আছেন। ইনি যখন পৃথিবীকে তার এক স্কন্ধ থেকে অন্য স্কন্ধে ধারণ করেন তখন সমস্ত পৃথিবী কম্পিত হয়। এ হেন নাগরাজের সঙ্গে আত্মীয়তা আছে ভীমসেনের।
পাণ্ডবদের প্রথম রাজনৈতিক মিত্র হল নাগ বা সর্পকুল, যদিও পরবর্তীকালে নাগরা পাণ্ডবদের উত্তরপুরুষদের শত্রুপক্ষে পর্যবসিত হয়। বাসুকিকে ভীমকে আলিঙ্গন করে সর্পদের বললেন, একে ধনরত্ন দিয়ে সুখি করো। একজন সর্প বলল, এই বালক ধন নিয়ে কী করবে! একে রস পান করান। বড়োই বেরসিক বালক। তখন নাগেরা ভীমকে রসায়ন কুণ্ডের কাছে নিয়ে গেল। নীলকন্ঠ এই রসায়নের অর্থ করেছেন দিব্যদেহতাপাদক, সহজ কথায় বিড়ঙ্গ বা বীর্য্যাশ্রয়। রসায়ন আসলে এক ধরণের ঔষধ। তন্ত্রশাস্ত্রে এর নাম রসসিদ্ধি এবং যাঁরা এই বিদ্যায় পারদর্শী তাঁদের রসসিদ্ধিপ্রদায়ক বলা হয়। গ্লানিপরিহারক রসায়নকে এই ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে—ষাড়্গুণ্য মূপযুঞ্জীত শক্ত্যপেক্ষো রসায়নম্। সৌগত বা নাস্তিক বাসুকি তথা সর্পকুল এই ভাবে ভীমকে রাজনীতির প্রথম পাঠ দিলেন।
আরও পড়ুন
বর্ণাশ্রম প্রথা ছিল দেবতাদের মধ্যেও, ইন্দ্রের সঙ্গে মদ্যপানে মানা অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের!
ওদিকে পাণ্ডব ও কৌরবরা জলক্রীড়া করার পর গঙ্গার তীরে ভীমকে দেখতে না পেয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। কুন্তী অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলেন। বিদুর, যুধিষ্ঠির কেউই ভীমকে খুঁজে পেলেন না। রসায়ন কুণ্ডের আটটি কুণ্ড পান করে অষ্টম দিনে ভীম বাড়ি ফিরে এলেন। তাঁর শরীর ও মনে তখন অযূত হস্তীর বল। তিনি কৌরব সিংহদের অনায়াসে পরাজিত করতে পারবেন বলে মনে আর আনন্দ ধরে না। ভীম ফিরে আসায় ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত প্রীত হলেন। তিনি পাণ্ডব ও কৌরব রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষার জন্য গৌতমগোত্রজ কৃপাচার্যকে নিযুক্ত করলেন। কৃপাচার্য যে রাজনীতির পাঠ পেয়েছিলেন তা গৌতম মুনির ন্যায়শাস্ত্র থেকে আহরিত। দেবগুরু বৃহস্পতির পিতা অঙ্গিরা নিজের পুত্রকে বেশি ভালবাসার কারণে অন্য শিষ্যদের কম শিক্ষা দান করতেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে অঙ্গিরার এক শিষ্য অসুরদের গুরু শুক্রাচার্য মহর্ষি গৌতমের কাছে পাঠ নেন। গৌতম সব শিষ্যদের সমানভাবে পাঠ দিতেন। গৌতমের পুত্র শরদ্বান এবং শরদ্বানের পুত্র হলেন কৃপাচার্য। শারদ্বত কৃপ ছিলেন অযোনিজ সন্তান।
মহর্ষি গৌতম শিষ্য শুক্রাচার্য এবং পৌত্র কৃপাচার্য উভয়কে শিখিয়েছিলেন, দুনিয়ায় চার বিদ্যা—ত্রয়ী, বার্তা, আন্বীক্ষিকী ও দণ্ডনীতিকে মানা হয় বটে কিন্তু আসল বিদ্যা হল একটি—সেটি দণ্ডনীতি। বার্তা বা জ্ঞান, যুক্তি সব কিছু দণ্ডনীতিতে লীন হয়ে যায়। আন্বীক্ষিকী বা যুক্তিবিদ্যা অর্থাৎ ন্যায়শাস্ত্রকে তিনি একটি বিদ্যা না বলে ‘পদ্ধতি’ বলেছিলেন যা সর্বকালের একমাত্র শ্রেষ্ঠ বিদ্যা রাজনীতিতে কাজে লাগে। আন্বীক্ষিকীকে কেন রাজনীতির পদ্ধতি বলা হয়, সে নিয়ে অনেক প্রতর্ক আছে। আন্বীক্ষিকী হল হেতুভিরন্বীক্ষমনা অর্থাৎ যেটা হেতু দিয়ে বোঝা যায়। মহাকাব্য আন্বীক্ষিকীকে জাতিগত ধারণা হিসেবে বিবেচনা করেনি বরং একটি পদ্ধতি হিসেবেই গ্রহণ করেছে। যে পদ্ধতি কোনও এক বিশেষ জায়গায় সীমাবদ্ধ নয়। কেউ কেউ আন্বীক্ষিকীকে জটিল (Difficult) ও ছল (Elusive) হিসেবে দেখেছেন। তবে ব্যুৎপত্তিগত অর্থে আন্বীক্ষিকী হল সেই তদন্তমূলক শাস্ত্র (Investigative Science) যেখানে হেতু (Reason) হল মূল অস্ত্র। এই হেতুই বলে দেয়, কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক। এই পদ্ধতি রাজনীতির আলোকবর্তিকাস্বরূপ। সুতরাং ‘আন্বীক্ষিকী’ সেই অর্থে পৃথক কোন শাস্ত্র নয়। এটি একটি পদ্ধতি।
আরও পড়ুন
বরং ইন্দ্রের ঔরসে গর্ভবতী হোন কুন্তী, পরামর্শ দিলেন স্বামী পাণ্ডু
শারদ্বত কৃপাচার্য শিক্ষা দিতে লাগলেন কুরুবালক ও পাণ্ডবদের। এখানে কৃপাচার্য সম্পর্কে আরও কিছু বলা দরকার। শাস্ত্রে আছে, সপ্ত চিরজীবীর অন্যতম হলেন কৃপাচার্য। কেন? কী তাঁর ভূমিকা ছিল! কৃপাচার্য ছিলেন সৎ ও নির্ভীক, তিনি সর্বদা শুক্ল বস্ত্র পরিধান করতেন এবং তাঁর রথের ধ্বজে বৃষ চিহ্ন অঙ্কিত থাকত। এখান থেকে বোঝা যায়, তিনি ছিলেন শিবের অনুগামী এবং যৌথ মালিকানার স্বপক্ষে। রাজনীতির প্রসঙ্গে কৃপাচার্য সব সময় সত্যের পক্ষে ছিলেন। তিনি নীতি, ধর্ম—দেশধর্ম ও যুগধর্ম সব কিছু মেনে চলতেন। সপ্ত চিরজীবীর প্রত্যেকেই রাজনীতির সর্বজনীন আদর্শ মেনে চলেছেন। কৃপাচার্য দৈহিক ভাবে মৃত্যুহীন এই কথার অর্থ হল তিনি রাজনীতির পবিত্র আদর্শকে প্রাণ দান করে গিয়েছেন। চরম বিপদের কালেও তিনি সৎ রাজনীতির আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। পক্ষান্তরে তাঁর ভগ্নীপতি দ্রোণাচার্য অন্য গোত্রের মানুষ ছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পেছনে যে রাজনীতি তার বীজ প্রথম পুঁতেছিলেন দ্রোণাচার্য।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
যে শাসক প্রজাকে সর্বদা প্যাঁচে ফেলতে চায়, তাকে হত্যা করা উচিৎ; মত ব্যাসদেবের