মহাভারতে রাজনীতি - ১৯
আগের পর্বে
অশ্বিনীকুমার এবং রেবন্ত— অর্থাৎ অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের প্রকৃত পরিচয় নিয়ে অনেক মতবাদ আছে। কোথাও তাঁদের শূদ্র বলে মনে করা হয়েছে, আবার কোথাও তাঁরা অন্যান্যদের সঙ্গে সমাজের উচ্চ স্থানে আসীন। কাজের জায়গায় বৈদ্য হওয়ার দরুন ইন্দ্র-সহ অনেক দেবতাও এঁদের মান্য করতেন না। তাঁদের কাছে এঁরা ছিলেন ব্রাত্য। কিন্তু ঋষি ভৃগুর পুত্র চ্যবনের চেষ্টায় তাঁরা মর্যাদা ও সম্মান ফিরে পায়। দেবরাজ ইন্দ্রের প্রতিরোধও দমন করেন চ্যবন। কুন্তীর শেখানো মন্ত্র পড়ে এই অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে আহ্বান করলেন পাণ্ডুর আরেক স্ত্রী, মাদ্রী। পরবর্তীতে এঁদেরই ঔরসে মাদ্রীর গর্ভে জন্ম হল নকুল আর সহদেবের। তারপর…
পাঁচটি ক্ষেত্রজ পুত্রের জনক হওয়ার পরেও পাণ্ডুর মনে সুখ নেই। রাজ্য থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন বলা যায়। বিদুরের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। অগ্রজ ধৃতরাষ্ট্র নানা রকমের দ্রব্য নিয়মিত পাঠিয়ে থাকেন। ইতিমধ্যে বসন্ত কাল এল। চৈত্র ও বৈশাখের মাঝামাঝি সময়। বনের মধ্যে নানা বর্ণের ফুল ফুটেছে। সুন্দরী মাদ্রীর সঙ্গে পাণ্ডু বিহার করছেন। মাদ্রী সূক্ষ্ম বস্ত্র পরেছিলেন। পাণ্ডুর শরীরে কামদেব ভর করলেন। তিনি নির্জনে মাদ্রীর সঙ্গে মৈথুনে প্রবৃত্ত হলেন। দীর্ঘদিন সহবাসে অনভ্যস্ত মাদ্রী পাণ্ডুর শরীরের কথা ভেবে সম্মত ছিলেন না। অবশ্য মাদ্রী জানতেন, স্বর্গবৈদ্যরা পাণ্ডুকে সুস্থ করে তুলেছেন। কিন্তু মৈথুন চলাকালে পাণ্ডুর মৃত্যু হল। মাদ্রীর চিৎকার এসে পৌঁছলো কুন্তীর কানে। কুন্তী সব দোষ চাপালেন মাদ্রীর ঘাড়ে। মাদ্রী পাণ্ডুকে প্রলুব্ধ করে স্বামীর মৃত্যুর কারণ হয়েছেন। কুন্তীর ভৎর্সনায় ও স্বামীর শোকে-দুঃখে মাদ্রী পতির চিতা অনুসরণ করবেন স্থির করলেন। সহমরণের তেমন প্রচলন না থাকলেও মাদ্রী স্বামীর চিতায় উঠে জীবন বিসর্জন দিলেন। কুন্তী পাঁচ পুত্রকে নিয়ে বনেই রইলেন।
পাণ্ডুর মৃত্যু সংবাদ শুনে ধৃতরাষ্ট্র শোকে আকুল হলেন এবং তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়াসমূহ সম্পাদন করলেন। তার পর ভাবলেন, রাজ্যশাসন মোটেও সহজ কাজ নয়, তা সুমহান ভারবিশেষ। প্রমাদ ও প্রমোদ এই দুটি বিষয় রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে অনুকূল নয়। অপ্রমাদী, উদ্যোগী, বুদ্ধিমান নরপতি সেই গুরুভার বহনে সমর্থ। সৈনাধ্যক্ষ পাণ্ডুর মৃত্যু হয়েছে। রাজা ধৃতরাষ্ট্রের এখন দায়িত্ব উপযুক্ত লোকসংগ্রহ। বিশেষ করে গুণী সচিব নিয়োগ। যে রাজার সচিবেরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে ও শাস্ত্রে অভিজ্ঞ এবং প্রভুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল সেই বিশ্বস্ত শাসক উপযুক্ত রাজা। যাঁর রাজ্যে সুবিচারের ব্যবস্থা থাকে, তাঁর ঐশ্বর্য চিরস্থায়ী। বিচারহীন রাষ্ট্র হল অরাজক। যিনি রাজধর্ম সম্যক অবগত থেকে সন্ধিবিগ্রহ প্রভৃতি ষড়বর্গে অভিজ্ঞ এবং প্রজাদের মনোরঞ্জনে যত্নশীল, তিনিই রাজ্যপালনে ধর্ম লাভ করতে পারেন। ষড়বর্গ হল মনঃষষ্ঠ পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়। আবার কামাদি ষড় রিপুও ষটসমবায় বা ষড়গণ। তবে জ্যোতিষে এটি কিঞ্চিৎ ভিন্ন। জন্মকালে শুভাশুভফলসূচক গ্রহচক্রবিশেষ। রাজনীতিতে তা সন্ধিবিগ্রহাদি।
গান্ধারী স্বামীকে বললেন, পাণ্ডুর জন্য শোক করবেন না। অবশেন্দ্রিয় পুরুষ দীর্ঘদিন ঐশ্বর্য ভোগ করতে পারেন না। বিজিতাত্মা মেধাবী পুরুষই রাজ্যভোগের উপযুক্ত। অসংযত অশ্ব যেমন সারথিকে বিপন্ন করে থাকে, সেই রকম অজিতেন্দ্রিয় নৃপতি কামক্রোধাদি রিপুর তাড়নায় পথভ্রষ্ট হয়ে থাকেন। বশ্যেন্দ্রিয়, জিতামাত্য এবং অসাধুর দণ্ডদাতা রাজা সুদীর্ঘকাল ঐশ্বর্য ভোগ করে থাকেন। কাম, ক্রোধ, লোভ ও দর্পকে যিনি উপযুক্ত পথে জয় করতে পারেন তিনিই মহীপতি হওয়ার উপযুক্ত। যিনি কামক্রোধাদি রিপুর তাড়নায় মিথ্যা ও কপট আচরণে প্রবৃত্ত হন, রাজলক্ষ্মী তাঁকে অচিরেই ত্যাগ করেন। যিনি সুহৃদের পরামর্শ গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক, তিনি শত্রুদের আনন্দ বর্ধন করে থাকেন।
একজন শাসকের আদর্শ গৃহীর সমস্ত সদগুণ থাকতে হবে। শাস্ত্রবিশারদ, ধীর, অমর্ষী, শুচি, তীক্ষ্ণ, শুশ্রূষু, শ্রুতবান, যুক্তিবিৎ, মেধাবী, ধারণাযুক্ত, ন্যায়ানুবর্তী, দান্ত, প্রিয়ভাষী, ক্ষমাশীল, দানশীল, শ্রদ্ধালু, সুখদর্শন, আর্তশরণ, অমাত্যপ্রিয়, অনহঙ্কার, সুখদুঃখসহিষ্ণু, সুবিবেচক, ভক্তজনপ্রিয়, সংগৃহীতজন, অস্তব্ধ, প্রসন্নবদন, ভৃত্যজনাপেক্ষী, অক্রোধন, মহচ্চিত্ত, সমুচিতদণ্ডদাতা, ধর্মকার্যরত, চরনেত্র, প্রজাবেক্ষণতৎপর, ধর্মার্থকুশল শাসক সর্বজনবাঞ্ছিত। একজন আদর্শচরিত্র গৃহীর যে সকল সদগুণ থাকা উচিত, তার মধ্যে কিছুই বাদ দেওয়া হয়নি। যে রাজা নানা রকমের বস্তুর সংগ্রহে আগ্রহশীল, মিত্রাঢ্য এবং উদ্যোগী, তিনিই রাজসত্তম। সে জন্য মহাভারতে বলা হয়েছে—
আরও পড়ুন
বর্ণাশ্রম প্রথা ছিল দেবতাদের মধ্যেও, ইন্দ্রের সঙ্গে মদ্যপানে মানা অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের!
এতৈবের গুণৈর্যুক্ত রাজা শাস্ত্রবিশারদঃ।
সর্ব্বসংগ্রহণে যুক্তো নৃপো ভবতি যঃ সদা।
উত্থানশীলো মিত্রাঢ্য স রাজা রাজসত্তম।।
ময়ূর যেমন বিচিত্রবর্ণের বর্হ ধারণ করে, সেই রকম নৈতিক বা ধর্মশীল শাসক অবস্থা-বিবেচনায় বাহ্যিক ব্যবহার করবেন। তীক্ষ্ণত্ব, কৌটিল্য, অভয়প্রদত্ব, সত্য ও আর্জব—এই সকল গুণে একান্ত অনুরক্ত না হয়ে যনি সত্ত্বগুণ অবলম্বন করেন, তিনিই সুখী হতে পারেন। সত্ত্ব, রজো ও তমোগুণের সাম্য থাকলে মনে কোনো আধি জন্মায় না। যে সময়ে যে অবস্থায় থাকা মঙ্গলজনক, তাইই সেই সময়ের রূপ, অর্থাৎ দণ্ডদানকালে ক্রূরতা এবং অনুগ্রহকালে শম প্রদর্শন করতে হয়। বহুরূপধারণে অভ্যস্ত নরপতির কোনও বিষয়ে কণামাত্র ক্ষতি হয় না।
আরও পড়ুন
বরং ইন্দ্রের ঔরসে গর্ভবতী হোন কুন্তী, পরামর্শ দিলেন স্বামী পাণ্ডু
ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর ১০১ জন পুত্রকন্যা জন্মেছে। ধৃতরাষ্ট্র তাঁর বৈশ্য দাসীর গর্ভে ‘যুযুৎসু’ নামক এক পুত্র উৎপাদন করেছেন। বেশ সুখের সংসার। কিন্তু ইতিমধ্যেই পারশব বিদুর বলতে শুরু করেছেন, দুর্যোধনাদি ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের পরিত্যাগ করতে। বিদুর বললেন, তিনি তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও পাণ্ডিত্য প্রয়োগ করে বুঝতে পারছেন, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা কুরুকুলের ক্ষয়ের কারণ হবে। চারিদিকে নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাঁর নজরে পড়ছে। দেশের সব কিছু বদলে যাবে বলে তিনি আশঙ্কা বোধ করছেন। ক্ষত্তা বিদুর অগ্রজ ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন—
ত্যজেদেকং কুলস্যার্থে গ্রামস্যার্থে কুলং ত্যজেৎ।
গ্রামং জনপদস্যার্থে আত্মার্থে পৃথিবীং ত্যজেৎ।।
--কুলকে রক্ষা করার নিমিত্ত প্রয়োজন হলে ব্যক্তিবিশেষকে ত্যাগ করা উচিত। গ্রামকে রক্ষা করবার নিমিত্ত কুলকেও ত্যাগ করতে হয়। জনপদের মঙ্গলের নিমিত্ত প্রয়োজন হলে গ্রামকে ত্যাগ করতে হয়। আপনাকে রক্ষা করবার নিমিত্ত পৃথিবীকে যদি ত্যাগ করতে হয়, তবে তাই করা উচিত।
আরও পড়ুন
যে শাসক প্রজাকে সর্বদা প্যাঁচে ফেলতে চায়, তাকে হত্যা করা উচিৎ; মত ব্যাসদেবের
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, দুর্যোধন কোনও সাধারণ ব্যক্তি নন; তিনি তাঁর পুত্র, যে পুত্র ধর্মজ্ঞ ও মেধাবী। স্বয়ং পিতা পত্নীর উদরে পুত্র হয়ে জন্মান। তাই পুত্রকে রক্ষা করা মানে নিজেকে রক্ষা করা। আপনাকে রক্ষা করার জন্য পৃথিবী ত্যাগ করতে হয়, তবে তাই করবো কিন্তু পুত্রদের ত্যাগ করতে পারব না।
বিদুর প্রমাদ গণলেন। ওদিকে যুধিষ্ঠির প্রভৃতি পাঁচ ভাইয়ের হস্তিনার সম্পদ পাওয়ার আশা ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে। একে পাণ্ডু নেই, দ্বিতীয়ত পুত্ররা কেউই পাণ্ডুর ঔরসজাত নয়। সংহিতা অনুযায়ী, ক্ষেত্রজ পুত্রদের থেকে ঔরসপুত্রদের অধিকার বেশি। তাছাড়া দুর্যোধনাদি প্রমুখ স্বয়ং ভগবান ব্যাসের উত্তরসূরী। যুধিষ্ঠিরগণ তা নন। উপরন্তু কুন্তী ও বিদুর ছাড়া তাঁদের হয়ে রাজনীতির ময়দানে লড়বেন এমন ব্যক্তি বিরল বললেই চলে। তবে শতশৃঙ্গবাসী তপস্বীরা কুন্তীকে ভালবাসতেন। পুত্রাদিসহ কুন্তীকে তাঁরাই দেখভাল করতেন। এরই মধ্যে একদিন ঠিক হল, কুন্তী পুত্রদের নিয়ে হস্তিনায় আসবেন। সেই মোতাবেক পাণ্ডু ও মাদ্রীর চিতাভস্ম নিয়ে তাঁরা হস্তিনায় ফিরলেন। যে সময় হস্তিনাপুরে পঞ্চপাণ্ডব প্রবেশ করলেন তখন যুধিষ্ঠিরের বয়স ষোলো, ভীমের পনেরো, অর্জুনের চোদ্দো, নকুল ও সহদেবের তেরো বছর। শতশৃঙ্গের ঋষিদের নিয়ে যখন হস্তিনায় প্রবেশ করলেন পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তী, তখন কৌরবগণ প্রণত হয়ে তাঁদের সংবর্ধনা করলেন। ঋষিদের মধ্যে যিনি বৃদ্ধতম, তিনি পাণ্ডু ও মাদ্রীর মৃত্যুর বিবরণ সবিস্তারে বললেন এবং এই পাঁচ পুত্র যে পাণ্ডুতনয় সে কথাও জানাতে ভুললেন না। ঋষিরা বিশ্রাম না করেই হঠাৎ অন্তর্হিত হয়ে গেলেন। এই ঘটনা সভাস্থ সকলকে বিস্মিত করে তুলল। ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে বিদুর পাণ্ডু ও মাদ্রীর চিতাভস্ম যথাবিধ সৎকারে প্রয়াসী হলেন। ত্রয়োদশ দিবসে শ্রাদ্ধাদি সম্পন্ন হল।
আরও পড়ুন
প্রবল বিতর্কের মধ্যে দিয়েই হস্তিনাপুরের রাজা হলেন ধৃতরাষ্ট্র
ইতিমধ্যে হস্তিনায় এসেছেন ব্যাসদেব। যোগবলে তিনি সবই জানতে পারেন। ধৃতরাষ্ট্র সত্যবতীর আদেশে হস্তিনার রাজা হয়েছেন। এখন ধৃতরাষ্ট্রপুত্র ও পাণ্ডবদের সংঘর্ষ অনিবার্য বুঝলেন তিনি। মাতা সত্যবতীকে তিনি পরামর্শ দিলেন হস্তিনা ছেড়ে বনে যেতে। কেননা, এই পারিবারিক তথা রাজনৈতিক কলহ তাঁর পক্ষে সহ্য করা মুশকিল হবে। সত্যবতী অম্বিকা ও অম্বালিকাকে সঙ্গে নিয়ে হস্তিনা ছাড়লেন। পাণ্ডবরা পিতৃগৃহে সুখে দিনযাপন করতে লাগলেন। হস্তিনাবাসী অবশ্য তাঁদের পাণ্ডুর পুত্র মেনে নিতে সম্মত হলেন না। ধৃতরাষ্ট্রের ভয়ে তাঁরা অবশ্য বেশি কথা বলতে সাহস পেলেন না। কিন্তু আড়ালে আবডালে কুন্তীপুত্রদের নিয়ে নানা রকম গুঞ্জন চলতে লাগল। কেউ বলল, কুন্তীর পুত্ররা বোধ হয় বিদুরের ঔরসজাত। বিদুর ইতিমধ্যে ধর্মের অংশাবতার হিসাবে নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন। অণীমাণ্ডব্য মুনির শাপে স্বয়ং ধর্ম বা যম মর্ত্যে শূদ্রযোনিতে বিদুররূপে জন্মগ্রহণ করেছেন। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির হিসাবে যাঁকে রাজা করতে চাইছেন বিদুর, সে আসলে বিদুরের পুত্র। দুর্যোধনাদি ভ্রাতৃগণও তাঁদের রাজত্বের নতুন অংশীদারদের সুনজরে দেখলেন না।
অলংকরণ – প্রণবশ্রী হাজরা
Powered by Froala Editor