মহাভারতে রাজনীতি – ১৮
আগের পর্বে
ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে গর্ভবতী হয়েছেন গান্ধারী। অন্যদিকে কুন্তীর আহ্বানে ধর্মরাজের ঔরসে জন্ম নিয়েছে যুধিষ্ঠির। এ-সংবাদ হস্তিনাপুরে পৌঁছয়নি। পাণ্ডুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্যোধনই ন্যায়ত সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। অন্যদিকে বিদুর, পাণ্ডু এবং ধর্ম জল্পনা শুরু করলেন যুধিষ্ঠিরকে সিংহাসনে বসানোর। যুধিষ্ঠিরের বাহুবল বৃদ্ধির জন্য পাণ্ডু আরও এক পুত্রের কামনা করলেন। কুন্তী আহ্বান জানালেন বায়ুকে। এরপর ডাকলেন ইন্দ্রকে। কিন্তু তাও পাণ্ডুর সন্তানের কামনা মিটল না। তখন তিনি ভাবলেন, তিনি নিজে সঙ্গম করতে পারলে ধৃতরাষ্ট্রের মতো শত পুত্রের জন্ম দিতে পারতেন। কিন্তু শাপগ্রস্ত হওয়ায় তিনি তা পারবেন না। তাই রোগ সারিয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানালেন দেববৈদ্য অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে। তারপর…
অশ্বিনীকুমারদ্বয় হলেন স্বর্গবৈদ্য। তাঁদের জ্যেষ্ঠটির নাম অশ্বিনীকুমার ও কনিষ্ঠের নাম রেবন্ত। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, তাঁদের নাম যথাক্রমে নাসত্য ও দস্র। অহল্যার সঙ্গে সঙ্গম করার অপরাধে গৌতম মুনি দেবরাজ ইন্দ্রের অণ্ডকোষ কেটে নিয়েছিলেন। ইন্দ্র নারী সঙ্গমে অক্ষম হয়ে পড়েন। তখন এই স্বর্গবৈদ্যরা দেবরাজের শরীরে বৃষের অণ্ডকোষ প্রতিস্থাপন করে দিয়েছিলেন। নইলে ইন্দ্র পুত্রের জন্ম দিতে পারতেন না। ইন্দ্র কিন্তু স্বর্গবৈদ্যদের শূদ্র বলে মনে করতেন যেহেতু তাঁরা মানুষের সেবা করেন।
অশ্বিনীকুমার ও রেবন্ত এলেন পাণ্ডুর কনিষ্ঠ পত্নীর কাছে। কুন্তীর শেখানো মন্ত্রে তাঁদের আহ্বান করলেন মাদ্রী। দুই দেবতাকে একত্রে দেখে কুন্তী আহত হলেন। এ আসলে এক ধরনের প্রতারণা। স্বর্গবৈদ্যরা পাণ্ডুকে সুস্থ করে তুলতে পারলেন না, মাদ্রীর গর্ভে তাঁরা দুই পুত্রের জন্ম দিলেন। একজন নকুল—সে অতিশয় রূপবান। অন্যজন সহদেব—বিদ্বানশ্রেষ্ঠ। মাদ্রী কিন্তু ভেবেছিলেন অশ্বিনীকুমারদ্বয় তাঁর স্বামী পাণ্ডুকে সুস্থ করে তুলতে পেরেছেন।
দেবতাদের মধ্যে রাজনৈতিক-সামাজিক বিভাজন ছিল। তাঁদের মধ্যেও বর্ণাশ্রম চালু ছিল। অশ্বিনীকুমারদ্বয় দেবতা হলেও তাঁরা যেহেতু বৈদ্য (মতান্তরে শূদ্র) ছিলেন তাই ইন্দ্রের মতো প্রধান দেবতাদের সঙ্গে এক সঙ্গে বসে মদ্যপান করতেন না। সূর্যপুত্র হওয়ার সুবাদে তাঁরা ব্রাহ্মণ হলেও বৈদ্যবৃত্তির জন্য তাঁরা ছিলেন ব্রাত্য এবং মূল ধারার ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে আঘাত পেয়েছেন বার বার। মহাভারতের কোথাও কোথাও তাঁদের ব্রাহ্মণত্ব নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ হয়েছে। তাঁদের শূদ্রের তকমাও দেওয়া হয়েছে মহাকাব্যে—অশ্বিনৌ তু স্মৃতৌ তপস্যুগ্রে সমাস্থিতৌ। তবে লোমশ মুনি মহাভারতে যে আখ্যান বলছেন, তাতে সমাজের উপকারী বৈদ্যদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার কথা পাওয়া যাচ্ছে। সেই প্রতিষ্ঠার পথটি মোটেও অহিংস ছিল না।
ভৃগুপুত্র চ্যবন একবার ক্রুদ্ধ হয়ে ইন্দ্রের সব ক্রিয়াকর্ম বন্ধ করে দিয়েছিলেন। চ্যবনের পিতা ভৃগু ব্রাহ্মণদের ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছিলেন। এই ভৃগুপুত্র বৃদ্ধ-চ্যবন বিবাহ করেছিলেন যুবতী সুকন্যাকে। চ্যবন মুনিই অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন। তার আগে পর্যন্ত বৈদ্যদের বেশ নীচু নজরে দেখা হত। শূদ্রদের পঙক্তিতে তাঁদের স্থান ছিল। মনুর মতে, বৈদ্যবৃত্তি করতে পারবেন তাঁরাই যাঁরা চতুর্বর্ণের বাইরে অর্থাৎ সঙ্কর। মনু চিকিৎসক-ভিষকদের বেশ নীচু নজরে দেখতেন। ব্রাহ্মণ পিতা ও বৈশ্য মায়ের মিলনে উৎপন্ন সন্তান সেই পেশার অধিকারী। পরাশরকে এমন সঙ্কর বলা যায় কেননা তাঁর পিতা শক্ত্রি ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং মা অদ্দৃশন্তী ছিলেন বৈশ্য চিত্রমুখের কন্যা।
অশ্বিনীকুমারদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার জন্য সব চেষ্টা করেছিলেন ভৃগুর পুত্র চ্যবন এবং সফলও হয়েছিলেন। সেই উপাখ্যান এই রকম—
নর্মদার কাছে বৈদূর্য পর্বতে দীর্ঘ কাল ধ্যান করে চ্যবন মুনির দেহে বল্মীক ও গাছপালায় আবৃত হয়। একদিন রাজা শর্যাতি তাঁর চার হাজার স্ত্রী ও সুন্দরী কন্যা সুকন্যাকে নিয়ে বৈদূর্য পর্বতে বেড়াতে আসেন। সুন্দরী সুকন্যাকে দেখে মোহিত হয়ে বল্মীক স্তুপ থেকে চ্যবন তাঁকে ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকেন কিন্তু সুকন্যা সেই আওয়াজ শুনতে পান না। সুকন্যা স্তুপের মধ্যে দুটি জোনাকিসম বিন্দু দেখতে পেয়ে কাঁটা দিয়ে তাদের বিদ্ধ করেন। এতে চ্যবন মুনি রেগে গিয়ে রাজা শর্যাতির সৈন্যদের মলমূত্র নিরোধ করে দেন। সব কিছু জানতে পেরে রাজা শর্যাতি কন্যার হয়ে চ্যবন মুনির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। চ্যবন মুনি জানান, দর্প ও অহঙ্কারের বশে সুকন্যা এই কাজ করেছেন। তিনি ক্ষমা করতে পারেন যদি সুকন্যা তাঁকে বিবাহ করেন। তখন শর্যাতি সৈন্যদের কথা ভেবে কন্যাকে চ্যবন মুনির হস্তে সম্প্রদান করেন।
একদিন চ্যবন-পত্নী সুকন্যা স্নান করতে গিয়েছেন। তাঁর নগ্ন রূপ দেখে অশ্বিনীকুমারদ্বয় তাঁকে বিবাহ করতে চান। সুকন্যা সম্মত হলেন না; বলেন, তিনি তাঁর স্বামী চ্যবনের প্রতি অনুরক্ত। তাঁকে ত্যাগ করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। অশ্বিনীকুমারদ্বয় তখন যুবতী সুকন্যার বৃদ্ধ স্বামীর জরা ও বার্ধক্যেরর কথা বলে তাঁকে স্বামীকে ত্যাগ করে তাঁদের একজনকে বেছে নিতে বলেন। কিন্তু তাতে করেও সুকন্যার পতি-অনুরাগ হ্রাস পায় না।
তখন প্রীত হয়ে অশ্বিনীকুমারদ্বয় জানান, তাঁরা সুকন্যার স্বামীকে যৌবন প্রদান করতে ইচ্ছুক। তবে শর্ত একটাই--চ্যবন মুনির যৌবন পাওয়ার পরে তাঁদের তিন জনের মধ্যে একজনকে সুকন্যাকে বরণ করতে হবে। সুকন্যা সব কথা চ্যবন মুনিকে জানালে তাতে মুনি সম্মত হলেন। তার পর ‘চ্যবনপ্রাশ’ নামক ঔষধির সাহায্যে মুনির জরা দূর করে যৌবন ও রূপ দান করতে সমর্থ হন বৈদ্য দুই ভাই। তখন অশ্বিনীকুমারদ্বয় কন্যাকে বলেন, তুমি এই বার যে কোনও একজনকে স্বামীত্বে বরণ করো। যত্র বাপ্যভিকামাসি তং বৃণীস্ব সুশোভনে। সুকন্যা জানান, আপনারা তিন জন এক রূপ ধারণ করে আমার সামনে আসুন। অশ্বিনীকুমারদ্বয়সমেত চ্যবন মুনি-- তিন জন একই রূপ ধারণ করলে সুকন্যা নিজ স্বামী চ্যবনকেই বরণ করলেন। মুনি নিজ পত্নীর উপর অত্যন্ত প্রীত হলেন, তার চেয়ে বেশি খুশি হলেন অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের উপর। চ্যবন মুনি দুই বৈদ্য ভাইয়ের শূদ্রত্ব মোচনের চেষ্টায় রত হলেন। সোমরসের ভাগ দিলে তাঁরা সম্ভ্রান্ত বলে বিবেচিত হবেন।
এই ঘটনার পূর্বে অশ্বিনীকুমারদ্বয় দেবতাদের মধ্যে ব্রাত্য ছিলেন। অশ্বিনীকুমারদের আর্তি প্রথম শুনেছিলেন সুকন্যা ও তাঁর স্বামী চ্যবন মুনি। চ্যবন মুনি যুবক হয়ে যাওয়ার পর পুরস্কার হিসাবে সুকন্যা বলেছিলেন, কুরুক্ষেত্রের পুণ্যদেশে যজ্ঞ চলছে সেই খানে দেবতাদের মধ্যে তোমাদের স্থান করে দেবো। ঘটনা এখানেই শেষ নয়।
চ্যবন মুনির যৌবন প্রাপ্ত হওয়ার সংবাদ চলে গেল রাজা শর্যাতির কাছে। পিতার সুকন্যার যে কষ্ট ছিল সেটাও দূর হয়ে গেল। জামাই শ্বশুরকে যজ্ঞ করতে বললেন। বিরাট যজ্ঞের আয়োজন হল। সেই অনুষ্ঠানে চ্যবন মুনি অশ্বিনীকুমারদের উদ্দেশে আহুতি দেওয়ার জন্য সোমপাত্র গ্রহণ করলেন—অগৃহ্নাচ্ চ্যবনো সোমম্ অশ্বিনোর্দেবয়োস্তদা।
কিন্তু মন্ত্র পাঠ করার পর যখন আহুতি দিতে গিয়ে তাঁর হাতটাকে কেউ যেন আটকে দিয়েছে। কে? দেবরাজ ইন্দ্র। ইন্দ্র চান না যে অশ্বিনীকুমারদ্বয় জাতে উঠুক। চ্যবন মুনিকে ইন্দ্র বললেন, শুনুন মহর্ষি! এই দুই বৈদ্য আমার মতো সোমরসের অর্ঘ্য-সম্মান পেতে পারেন না। তাঁরা সামান্য চিকিৎসকমাত্র। তাঁরা ভিষক্ বৈদ্য, দেবতা নন মোটেও। ওঁরা দেবতাদের চিকিৎসা করেন, ওঁরা হলেন কর্মকর। রোগির মলমূত্র, ক্ষত, পুঁজ ইত্যাদি নিয়ে যাঁরা কারবার তাঁরা আমার সঙ্গে সমান আসনে বসবেন, এ হতে পারে না। আপনি এই কাজ থেকে সরে আসুন।
চ্যবন মুনি দেবরাজের কথা না শুনে পুনরায় সোমরসের পাত্র নিয়ে প্রস্তুত হলেন অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের জন্য। এই বার ইন্দ্র প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে মুনিকে বললেন, এক ফোঁটা সোমরস যদি অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের উদ্দেশে আহুতি হিসাবে পড়ে আমি তোমাকে বজ্র প্রহার করবো। শূদ্র চিকিৎসক কখনওই ব্রাহ্মণের মর্যাদা পেতে পারে না।
তাচ্ছিল্যভরে চ্যবন মুনি সোমরসের পাত্র নিজের হাতে ধরলেন আহুতি দেওয়ার জন্য। ইন্দ্র বজ্র প্রহার করতে উদ্যত হলেন। চ্যবন মুনি সিদ্ধ পুরুষ। তিনি মন্ত্রবলে ইন্দ্রের দুই বাহু স্তব্ধ করে দিলেন এবং ইন্দ্রকে ধ্বংস করে দেওয়ার উদ্দেশে আগুন থেকে এক মারণ-দেবতার সৃষ্টি করলেন। সে দেবতার নাম ‘কৃত্যা’। সেই দেবতা এই বার এগিয়ে গেল দেবরাজকে ইন্দ্রকে ভক্ষণ করার জন্য। ইন্দ্র ভীত হয়ে চ্যবন মুনিকে বললেন, আপনার কথা মেনে নিচ্ছি। এবার থেকে অশ্বিনীকুমারদ্বয়ও ব্রাহ্মণ্য যজ্ঞে আমাদের মতোই সোমপায়ী অভিজাত দেবতা হিসাবে মান্য হবেন। আপনি আমাকে হত্যা করবেন না, ওই মৃত্যু-দেবতাকে অন্য কাজে লাগান।
চ্যবন মুনি এই বার অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে সোমরস গ্রহণ করতে বললেন। ইন্দ্রকে সেই পঙক্তিতে বসিয়ে সোমরস পান করালেন। চ্যবন মুনি এই ভাবে ইন্দ্রের রাজনীতিকে প্রথমত অহিংসভাবে ও পরে সহিংসভাবে খণ্ডন করলেন।
অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা
Powered by Froala Editor