যে শাসক প্রজাকে সর্বদা প্যাঁচে ফেলতে চায়, তাকে হত্যা করা উচিৎ; মত ব্যাসদেবের

মহাভারতে রাজনীতি – ১৬

আগের পর্বে

হস্তিনাপুরের সাধারণ মানুষ ধৃতরাষ্ট্রকেই রাজা হিসাবে দেখতে চেয়েছিল। ভীষ্ম এবং সত্যবতীর ইচ্ছাও ছিল তাই। কিন্তু বিদুরের রাজনীতিতে রাজা হলেন পাণ্ডু। হস্তিনার অর্ধেক রাজত্বের মালিকানা পেলেন ধৃতরাষ্ট্র। জন্মান্ধ হওয়ার জন্যই প্রথমে সিংহাসন পেলেন না ধৃতরাষ্ট্র। আচার্য মনুর নির্দেশ যদিও এই যুক্তিকে সমর্থন করে না। পরে রাজত্ব ছেড়ে বনবাসী হয়ে গেলেন পাণ্ডু। ধৃতরাষ্ট্র হলেন সমগ্র হস্তিনাপুরের রাজা। প্রজাদের নিয়েই শাসনকার্য পরিচালনা করতেন তিনি। লোকস্থিতি রক্ষায় ব্রতী হয়েছিলেন রাজবধূ গান্ধারী। যদিও গান্ধারের ধর্ম যৌথ-মালিকানার পক্ষে। হস্তিনাপুরের চোখে সেটা ছিল শূদ্র ধর্ম। সত্যবতীর সঙ্গে বিরোধও তৈরি হয় গান্ধারীর। সার্বজনীন রাজধর্ম পালনেই মনোযোগী হয়েছিলেন গান্ধারী।

 ‘যোগক্ষেম’ শব্দটির অর্থ হল শরীরস্থিতিপালন। এটি হল যোগের সঙ্গে ক্ষেম। যোগ মানে হল যুক্ত হওয়া। যোজন, সংযোগ, সংশ্লেষ, সঙ্গতি, সমবায়, যুক্তি বা জোতা। ‘ক্ষেম’ মানে হল হিত, শুভকর, কুশলী, পালন, রক্ষণ—যস্যাবতারো ভূতানাং ক্ষেমায়। এই হিসাবে যোগক্ষেম হল অপ্রাপ্ত ধনের প্রাপ্তি ও প্রাপ্তের রক্ষণ। আচার্য সায়ণ এমন অর্থ করেছেন। আবার যোগক্ষেমের এমন অর্থ করা হয়—চৌরাদি হতে রক্ষণ ও মঙ্গলপ্রতিবিধান বা রক্ষণাবেক্ষণ। প্রজাদের যোগক্ষেম বা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিলেন ধৃতরাষ্ট্র। এত দিন হস্তিনাপুর ছিল অরাজক রাষ্ট্র। ‘অরাজক’ শব্দের দুটি অর্থ হতে পারে—এক, রাজাহীন; দুই, যোগ্য রাজার অভাব। রাজা না থাকলে বা যোগ্য শাসক না থাকলে রাজদণ্ডও থাকে না। ফলে যারা কৃষিকর্ম করেও কর দিচ্ছে না কিংবা ব্যাবসাবাণিজ্য করে অতিরিক্ত মুনাফা লুট করছে বা লুঠতরাজ চালাচ্ছে তাদের সঠিক পথে নিয়ে আসা সম্ভব হয় না। ধৃতরাষ্ট্র রাজা হওয়ার পর রাজদণ্ড জনসাধারণের যোগক্ষেমসাধনের কাজেই ব্যবহৃত হতে শুরু করল। যেহেতু পাণ্ডু বনে রয়েছেন তাই সৈন্যাধ্যক্ষের দায়িত্বে থাকলেন কৃপাচার্য, সবার উপরে রইলেন ভীষ্ম। বিদুরের প্রতিপত্তি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করল।

মহাভারত উপযুক্ত শাসকের উপর খুব গুরুত্ব দিয়েছে। মহাকাব্য বলছে, আগে দেখতে হবে দেশে উপযুক্ত শাসক আছেন কিনা, তার পর বিবাহের কথা ভাবতে হবে, অর্থসম্পদ রোজগারের কথা আসবে তারও পরে—রাজানাং বিন্দেৎ ততো ভার্যাং ততো ধনম্। 

ওদিকে রাজ্য ছেড়ে দুই স্ত্রীকে নিয়ে সন্তান-উৎপাদনে অক্ষম পাণ্ডু বনে গিয়েছেন। ধৃতরাষ্ট্র তাঁদের নিয়মিত ভোগ্য বস্তু পাঠাচ্ছেন। পাণ্ডু চলে যাওয়ার পর হস্তিনাপুর এমন এক রাজাকে পেল যিনি শাসন বলতে নিয়মকানুনকে বোঝেন, বোঝেন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সেই সব সিদ্ধান্তসমূহকে জনগণের হিতে ব্যবহার করতে। শাস্ত্রসমূহ ও মহাভারতে একেই যোগক্ষেম বলে। হস্তিনাপুর দিনে দিনে হয়ে উঠতে লাগল প্রজাদের কল্যাণকামী রাষ্ট্র। ইতিমধ্যে প্রমাদ গণতে শুরু করেছেন বৈশ্যরা, বিশেষত অস্ত্রব্যবসায়ীরা। যোগক্ষেম বা ভাল শাসনকার্য চললে মুনাফাবাজদের অশেষ দুর্গতি হয়। তারা দল বেঁধে নানা রকম শলা পরামর্শ করতে লাগল। বিদুর ভাবলেন, পাণ্ডু কিংবা তাঁর ক্ষেত্রে উৎপন্ন সন্তানদের হস্তিনার শাসনভার দিলে এই অবস্থার পরিবর্তন হবে। ধৃতরাষ্ট্র স্পষ্ট ভাবে শুক্ল যজুর্বেদের শ্লোক আওড়াতে লাগলেন, আমার প্রজারা যেন সন্তুষ্ট থাকে, আমার পশুপালকরা যেন শান্তিতে বাস করে, যারা কৃষিকাজ করে দারিদ্র যেন তাদের গ্রাস না করে।

ধৃতরাষ্ট্রের জৈবিক পিতা ব্যাসদেব ও পিতামহ পরাশর তাঁকে সাহায্য করতে লাগলেন। যোগক্ষেম নিয়ে ধৃতরাষ্ট্র মনুর ধর্মশাস্ত্রকেও মানতে শুরু করলেন। মনু বলেছেন, যোগ্য শাসক বিনা দেশে অরাজকতা বা নৈরাষ্ট্রবাদ প্রতিষ্ঠা পায়, জনগণ ভীত হয়ে জীবনযাপন করে। কিন্তু যোগ্য শাসক প্রজাদের সর্ববিধ সুরক্ষা দেন, তারা নিশ্চিন্তমনে জীবন নির্বাহ করতে পারে। ব্যাসদেবও বললেন, রাজার প্রধান কর্তব্য হল নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়া। শাসক যদি ভাবেন যে তিনি জনগণকে সর্বদা প্যাঁচে ফেলবেন তেমন শাসককে উন্মাদ সারমেয়র ন্যায় হত্যা করা উচিত। শাসক প্রজাদের বাঁচানোর জন্য সমাজবিরোধীদের শাস্তি দেবেন, আর্থিক কেলেঙ্কারীর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের কঠোর দণ্ড দেবেন। 

আরও পড়ুন
প্রবল বিতর্কের মধ্যে দিয়েই হস্তিনাপুরের রাজা হলেন ধৃতরাষ্ট্র

ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্মের সহায়তায় যোগক্ষেম বা স্থিতিপালন করতে লাগলেন। একদা ব্যাসদেব পুত্র ধৃতরাষ্ট্রকে ডেকে বললেন, যোগক্ষেম মানে কেবল সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণ নয়। সেগুলো তো আছেই কেননা ধর্মের প্রধান কাজ হল ধন প্রদান করা। এর পাশাপাশি আবশ্যক আরও একটি বিষয়—তা হল জনগণের আত্মিক কল্যাণসাধন, তারা যেন নৈতিক গুণসম্পন্ন হয়। নৈতিক গুণ না থাকলে একজন প্রজা জনগণের এবং রাষ্ট্রের অংশ হয়ে উঠতে পারে না। তার জন্য প্রয়োজন সঠিক শিক্ষা। এই শিক্ষা প্রয়োজন সব বর্ণের—শুধু ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় শিক্ষালাভ করবে এমনটি হলে চলবে না। দেশের বড় অংশ যে শূদ্র জনগণ তাদের শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা তাদের চেতনা আনবে এবং সেই চেতনা উৎপন্ন হলে উচ্চ বর্ণের মানুষ তাদের ঠকাতে পারবে না।

মন্ত্রী বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে পরামর্শ দিলেন, চতুর্বর্ণকে যথাযথভাবে রক্ষা করতে হবে। ধর্মসঙ্কর ও বর্ণসঙ্কর থেকে প্রজাকে রক্ষা করা শাসকের কর্তব্য। ধৃতরাষ্ট্র জবাব দিলেন-- তিনি, পাণ্ডু ও বিদুর সকলেই বর্ণসঙ্কর কেননা তাঁরা যে ব্যাসদেব থেকে উৎপন্ন সেই ব্যাসদেব স্বয়ং বর্ণসঙ্কর—ব্যাসের পিতাও বর্ণসঙ্কর। ফলে বর্ণসঙ্কর থেকে প্রজাদের রক্ষা করা সম্ভব নয়। রাজপ্রাসাদ যেখানে সাঙ্কর্য থেকে মুক্ত নয়, সেখানে কোন বলে তিনি প্রজাদের সাঙ্কর্য থেকে মুক্ত থাকতে বলবেন! বর্ণব্যবস্থা মূলত পেশাগত হওয়া উচিত। এমনকি ধর্মসঙ্কর থেকে মুক্তিও সম্ভব নয়। ম্লেচ্ছ, যবন, কিরাত প্রভৃতি ধর্মের মানুষদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে উৎপন্ন সন্তান ধর্মসঙ্কর। সেই মোতাবেক শাসক ধৃতরাষ্ট্রের অনাগত সন্তানরাও ধর্মসঙ্কর হবেন কেননা গান্ধার দেশের সকল মানুষদের ধর্ম হস্তিনার মানুষদের থেকে ভিন্ন। বিদুর তখন চুপ করে রইলেন। ধৃতরাষ্ট্র অনন্তর বললেন, কেবল প্রজাদের হিতচিন্তায় শাসক সতত নিজেকে লিপ্ত রাখবেন। প্রজাদের মঙ্গলের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়ালে নিজের আত্মীয়কেও পরিত্যাগ করতে হয়। রাজা সগর প্রজাদের হিতার্থে নিজের পুত্র অসমঞ্জকে পরিত্যাগ করেন। সগর ছিলেন সূর্যবংশীয় নৃপতি। তাঁর এক স্ত্রীর গর্ভে ষাট হাজার পুত্র জন্মালেও তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় কিন্তু রাজা সগরের অন্য পত্নী শৈব্যার গর্ভে বংশরক্ষাকারী এক পুত্র জন্মায়, তাঁর নাম অসমঞ্জ। অসমঞ্জ পূর্বে বৈশ্য ছিলেন। বনের মধ্যে এক বিশাল গুপ্ত ধনভাণ্ডারের তিনি সন্ধান পান। এবং সেই সম্পত্তি আত্মসাৎ করেন। সম্পদের মালিক দুঃখে শোকে মারা যান এবং তাঁর আত্মা অসমঞ্জের শরীরে প্রবেশ করে। রাজর্ষি অংশুমানের পিতা অসমঞ্জ খুব নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলেন। তিনি অপরের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার পাশাপাশি ছোটো ছোটো ছেলেদের জলে ডুবিয়ে মারতেন। রাজা সগর তাঁকে নির্বাসনের দণ্ড দেন। অসমঞ্জ তখন সেই সব বাচ্চাদের যোগবলে জীবিত করে দেন। তার পর সগর রাজা পুত্রকে ক্ষমা করে দেন। সগরের পর রাজা হন অসমঞ্জ। তিনি ব্যক্তি-মালিকানা থেকে, মুনাফা থেকে সরে এসে প্রজা-হিতে মন দেন, ইক্ষ্বাকু বংশের তথা সূর্য-বংশের কলঙ্কমোচন করেন। 

আরও পড়ুন
অধম মানুষের রাজধর্মে অংশগ্রহণ জগতের পক্ষে প্রতিকূল, জানায় মহাভারত

বিদুর সব শুনে চুপ করে রইলেন। সূর্য-বংশের কুলপুরোহিত বশিষ্ঠের বংশধর ব্যাসদেব, যিনি ধৃতরাষ্ট্রের জৈবিক পিতা, প্রসন্ন হলেন। ভীষ্ম যিনি পূর্বে ছিলেন দ্যু নামক বসু, যিনি যৌথতন্ত্রের সম্পদ চুরির অপরাধে মর্ত্য-যন্ত্রণা ভোগ করছেন, তিনিও প্রসন্ন হলেন। এতদিনে তিনি মাতা গঙ্গার সম্মান রাখতে পারবেন বলে আশ্বস্ত হলেন, চন্দ্রবংশের রাজা শান্তনুর বংশ থেমে যাওয়াতে তিনি খুশি হলেন।

ওদিকে মৃগরূপী কিমিন্দম মুনিকে সঙ্গমরত অবস্থায় হত্যা করার অপরাধে পাণ্ডু অভিশপ্ত হলেন। তাঁর মৈথুন-ক্রিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা নেমে এল। কুন্তী ও মাদ্রী পড়লেন মহা-সমস্যায়। তখন পাণ্ডু কুন্তীকে নিভৃতে ডেকে বললেন, নিয়োগ-প্রথায় দেবতাদের থেকে সন্তান-উৎপাদনের জন্য। পৃথা রাজা ব্যুষিতাশ্বের কথা উল্লেখ করে বলেন, কীভাবে তাঁর রাণী ভদ্রা মৃত পতির সঙ্গে মিলিত হয়ে পুত্রলাভ করেছিলেন। সেই রকম ভাবে পাণ্ডু পত্নীদের গর্ভে মানস-সন্তান উৎপন্ন করতে পারেন। পাণ্ডু বললেন, রাজা ব্যুষিতাশ্বের মতো তাঁর তপস্যার জোর নেই, কুন্তী ও মাদ্রী যেন নিয়োগ-প্রথায় সন্তান-উৎপাদনে মনোযোগী হন। পাণ্ডু তখন পুরাকালের একটি ধর্মকথা বললেন। পুরাকালে নারীরা স্বাধীন ছিল। তাঁরা স্বামীকে ছেড়ে যত্রতত্র যথাবিহার করতেন। উদ্দালকপুত্র শ্বেতকেতু নারীর একপতিত্বের বিধান দেন। শ্বেতকেতুর পিতা উদ্দালক বলেছিলেন, নারীরা গাভীর মতো স্বাধীন। কিন্তু শ্বেতকেতু নারীর স্বাধীনতা মানলেন না। তিনি বললেন, নারীদের একটিই পতি থাকবে, তাঁরা কেবল পতির অনুমতিক্রমে ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপন্ন করতে পারেন। কুন্তী প্রাথমিকভাবে ক্ষেত্রক পুত্র উৎপাদনে অসম্মতি জানালেও অনেক ভেবে পরে সম্মত হলেন। পূর্বে কুমারী অবস্থায় কুন্তী সূর্য-দেবতার ঔরসে একটি পুত্র পেয়েছেন, সেই কথা গোপন রাখলেন। হস্তিনার সিংহাসনের জন্য তিনি দুর্বাসার মন্ত্রের কথা স্মরণ করে সব বৃত্তান্ত পাণ্ডুকে খুলে বললেন। পাণ্ডুর হঠাৎ ধর্মরূপী বিদুরের কথা মনে পড়ল।

আরও পড়ুন
আদর্শ রাজা তিনিই, যাঁর কাছে রাষ্ট্র ও শাসকের ফারাক থাকে না কোনো

শতশৃঙ্গ পর্বতে কুন্তী মন্ত্রবলে ধর্ম দেবতাকে স্মরণ করলেন। এখন এই দেবতাই রাজধর্মকে নিয়ন্ত্রণ করেন।

অলংকরণ – প্রণবশ্রী হাজরা 

আরও পড়ুন
কুন্তীর উপস্থিতি সত্ত্বেও, কেন মাদ্রীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন পাণ্ডু?

Powered by Froala Editor

More From Author See More