মহাভারতে রাজনীতি – ১৫
আগের পর্বে
গান্ধার দেশের সুবলের কন্যা গান্ধারী। তাঁর সঙ্গে বিবাহ হয় ধৃতরাষ্ট্রের। শিবের ভক্ত, ধর্মশীল গান্ধারী ছিলেন চাক্ষুষী বিদ্যার অধিকারী। তবে গান্ধারী ছিলেন আদপে বিধবা। তাঁর সঙ্গে একটি ছাগলের বিবাহ দিয়ে সেই ছাগলকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই ঘটনা গোপন রেখেই ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর বিবাহ দেওয়া হয়। যার কারণে গান্ধার রাজ্য আক্রমণ করেন ভীষ্ম। বন্দি হন রাজা সহ গান্ধারীর সমস্ত ভাই-বোন। অনাহারেই মৃত্যুর হয় তাঁদের। একমাত্র পরিত্রাণ পান শকুনি। তিনিও ছিলেন শিবের একনিষ্ঠ সাধক। কুমারী অবস্থাতেই শিবের থেকে গান্ধারী পেয়েছিলেন শতপুত্রলাভের বর।
রাজনৈতিক প্রতিপত্তির বিচারে ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর যোগ্য পাত্র, সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু ভীষ্ম প্রমুখ ভেবেছিলেন, গান্ধারীর পিতা সুবল অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে জামাতা করবেন কিনা। সুবল কন্যার সম্মতি না নিয়ে এই বিবাহ-প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। গান্ধারীর কিছু করার ছিল না। তিনি এই জগতের রূপ দেখবেন না স্থির করে সেই বিবাহ মেনে নিলেন। এটিই ছিল তাঁর প্রতিবাদ। তবে সুবল হস্তিনাপুরকে রাজনৈতিক কারণে চটাতে চাননি এবং ক্ষুদ্র রাজ্য হিসাবে হস্তিনার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ককে তিনি আশীর্বাদ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। গান্ধার ও হস্তিনাপুর দুটো দেশের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক তফাৎ অনেক। তাছাড়া গান্ধারী দ্বাপর ও কলিযুগ দুটোতেই ছিলেন। ফলে দেশ-রাজনীতি ও যুগ-রাজনীতি সম্পর্কে তাঁকে ওয়াকিবহাল হতে হয়েছিল। হস্তিনায় যেহেতু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব ছিল তাই গান্ধারী রাজবধূ হিসাবে এসে লোকস্থিতি রক্ষা করায় ব্রতী হয়েছিলেন।
গান্ধার দেশ যেহেতু যৌথ-মালিকানার পক্ষে ছিল তাই গান্ধারী সেই দেশধর্ম ও কুলধর্মের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। কুলধর্ম অপেক্ষা ব্যাপকতর অর্থে জাতিধর্মের প্রয়োগ দেখা যায়। গান্ধারের মানুষদের যেহেতু ‘শূদ্র’ বলে গণ্য করত হস্তিনাপুর, তাই শূদ্র-অর্থনীতি ও রাজনীতিকে হস্তিনাপুর ভয় পেত খুব বেশি। ব্রাহ্মণের, ক্ষত্রিয়ের, বৈশ্যের ও শূদ্রের জাতিগত অধিকার ও আচরণীয় হিসাবে যে সব কর্মের কথা শাস্ত্রে বলা হয়, তাই হল জাতিধর্ম। জাতিধর্মের আর এক নাম স্বধর্ম বা সহজ কর্ম। মৎস্যগন্ধার ক্ষত্রিয়করণের পর তিনি শূদ্রের স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন কিন্তু গান্ধারী সে পথে হাঁটেননি। পিতৃপিতামহের আচরিত রাজধর্ম থেকে গান্ধারী কখনই সরে আসেননি, শাস্ত্রে আছে—কোনও অবস্থাতেই কুলধর্ম পরিত্যজ্য নয়।
জাতিশ্রেণ্যধিবাসানাং কুলধর্ম্মাশ্চ সর্ব্বতঃ।
বর্জ্জয়ন্তি চ যে ধর্ম্মং তেষাং ধর্ম্মো ন বিদ্যতে।।
প্রত্যেক ব্যক্তি আপন আপন কুলধর্ম অবশ্যই পালন করবেন। দেশবিশেষে রাজনীতির তফাৎ হয়। গান্ধারী হস্তিনায় এসে গান্ধারের রাজনীতি খুঁজে পাননি, যদিও তাঁর স্বামী ধৃতরাষ্ট্র ধর্মানুসারী ছিলেন, যে রাজধর্ম প্রজাদের অনুকুলে যায়, যে রাজধর্ম প্রজাদের সমানাধিকারে বিশ্বাসী। সত্যবতী গান্ধারীকে উপদেশ দিয়েছিলেন, যে দেশে যে রাজধর্ম তাই পালন করা উচিত। গান্ধারী বুঝেছিলেন, আন্তরিকতা না থাকলে এমন দেশধর্ম পালন করা সুখের হয় না। তিনি তখন দেশধর্মের স্থলে সর্বজনীন রাজধর্ম পালনে মনোযোগী হন। গান্ধারী যুগ-রাজধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু কখনোই সর্বজনীন রাজধর্ম থেকে বিচ্যুত হননি কারণ তিনি মনে করতেন, যুগ পালটালেও সর্বজনীন রাজধর্ম পালটায় না। পরম কল্যাণের সঙ্গে মানুষের যে যোগ তাই সত্যযুগের সূচক। কোনো মানুষ যদি পরম কল্যাণের সঙ্গে নিজের যোগ স্থাপন করতে পারেন, তাঁর কাছে তখন সেটাই সত্যযুগ। ত্রেতাযুগে রাজধর্মের এক চরণ হ্রাস হয়, সেটাও তেমন মন্দ ছিল না। দ্বাপর যুগে অর্ধেক রাজধর্ম ক্ষীণ হয়ে যায়, মানুষ সত্য ও সাম্য থেকে অনেক দূরে চলে যায়। কলিযুগে মাত্র এক পাদ ধর্ম অবশিষ্ট থাকে, মানুষের জীবন কলুষিত হয়ে ওঠে, নানা রকম মানসিক ও শারীরিক ব্যাধিতে মানুষ ভোগে, মানব জীবন তীব্র অশান্তিতে ভরপুর হয়ে ওঠে। এর জন্য দায়ী রাজধর্ম—কেননা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে নীতিশাস্ত্র ও অর্থনীতিসহ সমস্ত বিদ্যাকে।
ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর মধ্যে কে রাজা হবেন, তা নিয়ে হস্তিনাপুর ছিল দ্বিধাবিভক্ত। একটি ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী চাইছিল, ধৃতরাষ্ট্র যেহেতু জ্যেষ্ঠ তাই তাঁর রাজা হওয়া উচিত। কিন্তু আর এক দল চাইছিল পাণ্ডু সিংহাসনে বসুন। তাদের যুক্তি ছিল, ধৃতরাষ্ট্র যেহেতু জন্মান্ধ তাই তিনি শাসক হওয়ার উপযুক্ত নন। কিন্তু এমন বিধান মনু বা অন্য কোনও আচার্য দিয়ে যাননি। এই রাজনীতিটা করেছিলেন স্বয়ং বিদুর। অন্য দিকে ধৃতরাষ্ট্রকে রাজা করতে চেয়েছিলেন দেবব্রত-ভীষ্ম। পাণ্ডুরও যেহেতু নানা জন্মদোষ ছিল এবং তিনি ধৃতরাষ্ট্রানুজ তাই তাঁকে রাজা করার পক্ষপাতী ছিলেন না ভীষ্ম। শেষমেশ ঠিক হয়, হস্তিনার উত্তরাধিকারী বাছবেন স্বয়ং রাজমাতা সত্যবতী যিনি ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুরের ঠাকুমা। সত্যবতীও চেয়েছিলেন তাঁর বড় নাতি শাসক হোন কেননা তিনি শাস্ত্রজ্ঞ, বলবান ও বীরক্ষত্রিয়, পক্ষান্তরে পাণ্ডু ধনুর্ধর হলেও বলবান নন, রোগাভোগা মানুষ। বিদুর ও ভীষ্মের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা হল। সেই আলোচনায় ধৃতরাষ্ট্রকে রাজা হিসাবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।
যথাসময়ে ভীষ্ম সত্যবতীর আদেশে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বিদুরের নাম ঘোষণা করলেন। এর পর সৈনাধ্যক্ষ হিসাবে পাণ্ডুর নাম ঘোষিত হল। এর পর যখনই রাজা হিসাবে ধৃতরাষ্ট্রের নাম ভীষ্মদেব বলতে গেলেন সেই সময় বেঁকে বসলেন নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী বিদুর ও সৈনাধ্যক্ষ পাণ্ডু। বিদুর জানালেন, যিনি চোখে দেখেন না তিনি হবেন রাজা! পুরাণের নানা উদাহরণ টেনে বিদুর অন্ধকে রাজা করার তীব্র বিরোধিতা করলেন। প্রজাগণ ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষে থাকলেও রাজপ্রাসাদের কিচেন-ক্যাবিনেটের রাজনীতিতে পরাজিত হলেন ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, এমনকি রাজমাতা সত্যবতীও। শেষমেশ ঠিক হল, পাণ্ডু রাজা হলেও হস্তিনা রাজ্যের অর্ধেক মালিক হবেন ধৃতরাষ্ট্র।
আচার্য মনুর মতে, যাঁর বেদে দীক্ষা নেই তিনি রাজা হতে পারেন না। সেই হিসাবে ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন যোগ্যতম ব্যক্তি। ধৃতরাষ্ট্র বেদ, ধনুর্বেদ, গদাযুদ্ধ, অসিযুদ্ধ, গজশিক্ষা, নীতিশাস্ত্র, ইতিহাস, পুরাণ প্রভৃতি বিষয়ে পণ্ডিত ছিলেন। পক্ষান্তরে, পাণ্ডু এগুলো জানলেও তিনি সন্তান-উৎপাদনে অক্ষম ছিলেন। তার উপর ধৃতরাষ্ট্র অগ্রজ এবং পাণ্ডু অনুজ। দুজনেই তাঁরা ক্ষত্রিয়া মাতার সন্তান। বিদুর সুস্থ দেহের অধিকারী হলেও দাসীপুত্র এবং শূদ্র (পারশব), তাই তাঁর বেদ-পাঠে অধিকার নেই। এই কারণে তিনি রাজা হিসাবে মনোনীত হতে পারেননি। দাসীপুত্র বলে নয়, তিনি পারশব বলে রাজা হতে পারেননি।
আরও পড়ুন
অধম মানুষের রাজধর্মে অংশগ্রহণ জগতের পক্ষে প্রতিকূল, জানায় মহাভারত
পাণ্ডুকে রাজমুকুট পরিয়ে সিংহাসনে বসালেও হস্তিনায় রাজা-বিতর্ক কিন্তু থেমে গেল না। প্রজাদের একটা বড় অংশ এবং প্রাসাদের একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী ধৃতরাষ্ট্রকে শাসক হিসাবে দেখতে চাইলেও বিদুরের রাজনীতির চালে পাণ্ডু রাজা হলেন। ফলে সমস্ত রাষ্ট্রক্ষমতা মন্ত্রী বিদুরের হাতে কেন্দ্রীভূত হল।
ভীষ্ম একান্তে বলতে লাগলেন, পাণ্ডুর মনোনয়ন বেদসম্মত নয়। ঋগ্বেদে উল্লেখ আছে, প্রজারা যাঁকে চাইবেন তিনিই হবেন রাজা। অথর্ববেদও সেই কথা সমর্থন করে। পাণ্ডুর চেয়ে ধৃতরাষ্ট্রের জনসমর্থন বেশি। এই সব বিতর্কের মধ্যে সন্তান-উৎপাদনে অক্ষম পাণ্ডু রাজ্যপাট ছেড়ে বনে যাওয়া মনস্থির করলেন। দুই পত্নীকে নিয়ে তিনি বন ও পাহাড়ে পশু শিকার করতে চলে গেলেন, হস্তিনায় ফিরে এলেন না। রাজা হলেন ধৃতরাষ্ট্র।
সপ্তাঙ্গ রাষ্ট্রের প্রথম অঙ্গ যে রাজা, ধৃতরাষ্ট্র সেই নরপতি হলেন। মনু অবশ্য ‘রাজা’ শব্দটি বলার পক্ষপাতী নন। মহাভারতেও মনুর মতের সমর্থন আছে। ধৃতরাষ্ট্র এই উভয় মতে ‘স্বামী’—হস্তিনাপুর নামক রাষ্ট্রের সমস্ত অপরিণত বস্তুর বা সম্পত্তির অধিকারী। লক্ষণীয়, পাণ্ডু যখন রাজা ছিলেন তখন অর্ধেক রাজত্বের অধিকারী ছিলেন ধৃতরাষ্ট্র কিন্তু পাণ্ডু বনে চলে যাওয়ার পর হস্তিনাপুর পেল একজন পূর্ণাঙ্গ রাজা বা স্বামী। সিংহাসনে বসে ধৃতরাষ্ট্র প্রজাদের সব রকম সুরক্ষা ও তাদের হিতচিন্তায় মন দিলেন। ‘রাজা’ শব্দের ধাতু ‘রনজ্’-এর মানে হল প্রজারঞ্জন। সেই দিক থেকে ধৃতরাষ্ট্রকে স্বামীর পাশাপাশি রাজা বলা অযথার্থ নয়।
আরও পড়ুন
আদর্শ রাজা তিনিই, যাঁর কাছে রাষ্ট্র ও শাসকের ফারাক থাকে না কোনো
অবশ্য ‘স্বামী’ শব্দ ব্যবহার করলে রাষ্ট্রের তন্ত্রটি হয়ে পড়ে রাজতন্ত্র। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রকে স্বামী বা রাজা যাই বলা হোক না কেন, তিনি হয়ে উঠেছিলেন গণরাজ্যের গণাধিপতি। কারণ তাঁর রাজ্যে প্রজাদের শাসনকার্যে অংশগ্রহণ ছিল মুখ্য। তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধৃতরাষ্ট্র কিছুই করতেন না।
রাজা হয়ে ধৃতরাষ্ট্র প্রথমে প্রজাসাধারণের সন্তুষ্টির দিকে মন দিলেন। কে রাষ্ট্রের উপর সন্তুষ্ট, আর কে নয়—সেই সব পর্যালোচনা করার জন্য তিনি অমাত্যদের নিয়োগ করলেন। রাজ্যের প্রজারা সুখে আছে কিনা, না থাকলে কী তাদের সমস্যা এবং সেই সব সমস্যাসমূহের সমাধান কী, তা নিয়ে ধৃতরাষ্ট্র মনোযোগী হলেন। কর-ব্যবস্থা ও দণ্ড-বিধানের আমূল পরিবর্তন হল এই সময়ে। ধৃতরাষ্ট্র প্রজাদের কাছ থেকে কর নিতেন তাঁদের হিতসাধনের জন্য, নিজের বিলাসব্যসনের জন্য নয়। প্রজারা রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে সম্পদ দিতেন, রাজা পরিবর্তে দিতেন যোগক্ষেম। রাজনীতিতে এই যোগক্ষেম ব্যাপারটিকে বোঝা দরকার।
অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা
আরও পড়ুন
কুন্তীর উপস্থিতি সত্ত্বেও, কেন মাদ্রীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন পাণ্ডু?
Powered by Froala Editor