মহাভারতে রাজনীতি – ১৪
আগের পর্বে
রাজা হলেন পাণ্ডুর অগ্রজ ধৃতরাষ্ট্র। যিনি একজন আদর্শ মহারাজ বা স্বামী। নৈতিক পথে তিনি রাষ্ট্রকে উদ্ধার করেন তাই ধৃতরাষ্ট্র। তাঁর কাছে প্রজা হল অপত্য। পূর্বজন্মে তিনি গান্ধর্ব অরিষ্টার পুত্র। ফলে ধৃতরাষ্ট্র হলেন চন্দ্রবংশীয় রাযা কিন্তু জৈবিকভাবে তিনি আবার সূর্যবংশীয় বশিষ্টের বংশধর। রাজনীতির প্রসঙ্গে শিবের অনুগামী তিনি। ছ’মাস এক পায়ে দাঁড়িয়ে চাক্ষুষী বিদ্যা আয়ত্ত করতে হয়েছিল তাঁকে। গান্ধর্বদেশীয় অশ্বদের বধ করা যায় না। সাত প্রকার সেই অশ্ব আসলে সূর্যের সারথী। তারাই মানুষের কল্যাণে নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি ও দণ্ডনীতিকে।
জগতের হিত ও লোকস্থিতি হল রাজধর্মের উদ্দেশ্য। এই জগতে তিন ধরণের লোক আছে। এক, যারা শুধু নিয়ে যায়—কাউকে কিছু দেয় না—তারা হল অধম। দুই, যারা শুধু দিয়ে যায়, কিছুই গ্রহণ করে না—তারা হল মধ্যম। আর যারা দেওয়া বা নেওয়ার ব্যাপারে বাছবিচার করে না, তারা হল উত্তম। অধম মানুষরা সবচেয়ে হীন, মধ্যমদের দিয়ে কোনো উন্নতি হয় না, উত্তম মানুষরা রাষ্ট্রের সম্পদ। তাঁরাই রাজধর্মের বাহক। হীন বা অধম মানুষদের রাজধর্মে অংশগ্রহণ জগতের হিতের পক্ষে অনুকূল নয়। এই সব মানুষেরা রাজধর্মকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই ব্যবহার করে থাকেন।
এই লোভী মানুষরা গন্ধর্ব তথা ধৃতরাষ্ট্রেদের ভয় পায়। তবে সাধারণ মানুষ ধৃতরাষ্ট্রকে ভয় পায় না। যারা লোভী, সাধারণের সম্পত্তি নিজেদের করায়ত্ত করতে চাই তারাই তাঁকে ভয় পায়। ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন সূর্যবংশীয়, ঔরসজাত, লোকায়ত, অশ্বত্থ ও গঙ্গাপ্রবাহের অনুগামী।
ধৃতরাষ্ট্রের পিতামহী যমুনা হলেও তিনি তাঁর আর এক পিতামহী গঙ্গার পণ্যপ্রবাহে বিহার করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। বিষ্ণুভক্ত তথা চন্দ্রবংশীয়দের পণ্যপ্রবাহ হল যমুনা। গঙ্গার পণ্যপ্রবাহ সাধারণ মানুষের প্রয়োজনের জন্য এবং লোকসাধারণ ওই সম্পদসমূহের মালিক। গঙ্গার শুভ্র জলে লোকস্থিতির অনুকূল পণ্যের প্রবাহ বয়ে যায়। কৃষ্ণবর্ণের যে যমুনাপ্রবাহ, তাতে ভেসে চলে লোভের পণ্য, চড়া মূল্যে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে জনগণ কপর্দকশূন্য হয়ে যায়। ফড়ে দালাল আর মৎস্যগন্ধার দল লাভবান হয়। স্বল্প কিছু বৈশ্য স্ফীত হতে থাকে। সেই সব লোকেরা শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে একে একে অধিকার করতে থাকে পঞ্চভূতের সব সম্পদ। যমুনাকে গঙ্গার নরপ্রবাহে নিবৃত্তা করাই ছিল ধৃতরাষ্ট্রের লক্ষ্য। তাঁর রাজনীতির মূল কথা হল, শেষ বিচারে নরই নারায়ণ। ধৃতরাষ্ট্র বিলক্ষণ জানেন, হস্তিনার বেশির ভাগ মানুষ যুদ্ধে অসমর্থ। শুধু তাই নয়, তারা শান্তিপ্রিয়। দু বেলা খেয়ে পরে বাঁচলে তারা অশান্তি চায় না। সেই সুবিধা প্রত্যেকের জন্মগত অধিকার। কিন্তু একদল মানুষ যখন তাদের সেই অধিকার কেড়ে নিতে চায়, তখন শুরু হয় সংঘর্ষ। ধৃতরাষ্ট্র জনগণের অধিকার সুনিশ্চিত করেন বলে পূজা পান।
হিমালয় শিবের বাসভূমি। শিব মানেই পরম কল্যাণ। তিনিই বার্তার পরম লক্ষ্য। বার্তা ও দণ্ডনীতি পরস্পরের পরিপূরক। শিব বা মহাদেব হলেন লোকসাধারণের দেবতা। হিমালয়ের স্বর্ণমুদ্রা হেমশৃঙ্গ থেকে গঙ্গা নির্গত হয়ে সপ্ত প্রকারে সমুদ্রের জলে মিশেছে। এই জনসমুদ্রের সকল সম্পদ সেই পরম ঈশ্বর শিবের দান। তিনি প্রজাদের কল্যাণের নিমিত্ত গঙ্গাকে মুক্ত করেছেন। গঙ্গার ধারক ওই সত্যম শিব। সুতরাং ওই সম্পদ গায়ের জোরে অধিগ্রহণ করলে প্রজাদের অমঙ্গল হয়। রাজ্য হয়ে পড়ে বিশৃঙ্খলার ক্ষেত্র। সমৃদ্ধি থাকে না সমাজের।
আরও পড়ুন
আদর্শ রাজা তিনিই, যাঁর কাছে রাষ্ট্র ও শাসকের ফারাক থাকে না কোনো
সপ্তপ্রকারের সম্পদ আছে জগতে--গঙ্গা, যমুনা, প্লক্ষজাতা, সরস্বতী, সরযূ, গোমতী ও গণ্ডকী। তৃতীয় প্লক্ষজাতা হল স্থাবর সম্পত্তি। প্লক্ষ অল্পকাল স্থায়ী নয়—তা অশ্বত্থ বৃক্ষের মতো। জল-জমি-বাতাস ক্রয় করা যায় না। কিন্তু বটসংস্কৃতির ধারকরা এই সম্পত্তি কড়ি দিয়ে ক্রয় করে জনগণকে বঞ্চিত করে থাকেন। সরস্বতী হল অস্থাবর সম্পত্তি—-সর বা গমনশীলের আশ্রয়দাত্রী। সরযূ হল শ্রেষ্ঠ সূক্ষ্ম সম্পদ বা ত্রিকাণ্ডশেষ। গোমতী হল বহু গো বা রশ্মি-যুক্তা। যেমন ব্যক্তিমালিকানাভুক্ত সম্পদ। সেই ব্যক্তিমালিকদের রশ্মি বা বীর্য এসেছে ধর্ম, পবন, ইন্দ্র, অশ্বিন ও রেবন্তের থেকে। তাঁদের মাতারা ওই রশ্মি ক্রয় করেছেন। গণ্ডকী হল শ্রেষ্ঠ স্থূল সম্পদ। এই সব সম্পত্তি তারা অচিরেই দখল করবে যুদ্ধ করে, হত্যা করে। তবেই তাদের লোভ নামক পাপ চরিতার্থ হবে।
ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহ হয় গান্ধারীর সঙ্গে। গান্ধার দেশের রাজা সুবলের কন্যা তিনি। সঙ্গীতে স্বরগ্রামের তৃতীয় স্বর হল গান্ধার। গন্ধ (নাসিকা) ও কর্ণ চালিত করে নির্গত হয় বলে তা গান্ধার নামে খ্যাত। ‘গান্ধার’ কথাটি গন্ধ বা সম্পর্ক থেকে এসেছে আর সেই সম্পর্ক উৎপাদনের সম্পর্ক। তাঁকে সচল ও সমাজমুখী করার লক্ষ্যে যে বিদ্যার চর্চা হয় তাকে বলে চাক্ষুষী বিদ্যা। গান্ধারী চর্মচক্ষু তাই ঢেকে রাখতেন। মহাভারতের রাজনীতিতে গান্ধারীর ধর্মশীলতার কথা সুবিদিত—গান্ধার্য্যা ধর্মশীলতাম্। অংশাবতরণ অধ্যায়ে দেখা যায়, গান্ধারী ‘মতি’-র অংশে জন্মগ্রহণ করেছেন। রাজনীতিতে এই মতি হল মননশীলতা, সর্বকল্যাণময় বুদ্ধি ও সংবেদনশীলতা। শিবের অনুগ্রহে তাঁর সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহ হয়, তিনি ছিলেন শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত। ‘মতি’ শব্দটি এসেছে ‘মন্’ ধাতু থেকে যার অর্থ হল বোধ, জ্ঞান। এই মতির অভাব ছিল দ্বাপর ও কলিযুগে। গান্ধারী স্বয়ং মতির অংশে জন্মগ্রহণ করে মহাভারতের রাজনীতিতে মনীষা বা প্রজ্ঞাকে নিয়ে আসেন। যে প্রজ্ঞা বা মনীষার অভাব ইতিপূর্বে হস্তিনায় ছিল। শুধু ধর্মশাস্ত্র দিয়ে রাষ্ট্র চলে না, রাষ্ট্র চালনার জন্য প্রয়োজন হয় সুমতির। একমাত্র সুমতি দিয়ে ধৃত রাষ্ট্র হতে পারে কল্যাণকামী রাষ্ট্র।
আরও পড়ুন
কুন্তীর উপস্থিতি সত্ত্বেও, কেন মাদ্রীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন পাণ্ডু?
অনেকে বলেন, সুবল রাজা কোনও প্রতিশোধের সংকল্প থেকে হস্তিনার রাজপুত্রের সঙ্গে নিজ কন্যার বিবাহ দেন। সুবিশাল ভারত নামক জনপদে এমন বিষয়, বিশেষত রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে হওয়া বিচিত্র কোনো ব্যাপার নয় কিন্তু এমন ঘটনার পেছনে তেমন সুদৃঢ় কোনও পৌরাণিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। আবার এমন কথাও পাওয়া যায় যে, গান্ধারী আদপে ছিলেন বিধবা (যেহেতু তাঁর কুষ্টিতে ছিল যে তিনি বিবাহ করলেই বিধবা হবেন, তাই তাঁর সঙ্গে একটি অজ বা ছাগলের বিবাহ দিয়ে সেই ছাগলটিকে হত্যা করা হয়) কিন্তু সেই ঘটনা গোপন রেখে ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর বিবাহ দেওয়ার জন্য ভীষ্ম প্রমুখ গান্ধার রাজ্য আক্রমণ করে সুবল ও তাঁর পুত্রদের অভুক্ত অবস্থায় বন্দি করে রাখেন। অনাহারে মারা যান সুবল ও তাঁর পুত্ররা। যে স্বল্প খাবার সকলের জন্য দেওয়া হত, তার সবটাই দেওয়া হত শকুনিকে। তাই তিনি বেঁচে যান। পরে শকুনি বেঁচে থাকেন ভাইদের ও বাবার মৃতদেহ ভক্ষণ করে। পিতা সুবলের হাড় থেকে শকুনি তৈরি করেন পাশার ঘুঁটি।
পৌরাণিক ইতিহাসে গান্ধার দেশের চরিত্র বেশ বিচিত্র। মহাভারতে বলা হয়েছে, গান্ধার দেশের মানুষ আর্যসংস্কৃতিবিরোধী এবং সংস্কৃতিচ্যুত। শান্তিপর্বেও এই দেশকে জাতিগতভাবে হীন বলা হয়েছে। গান্ধার হল নারায়ণ-নিরপেক্ষ দেশ। এর অর্থ হল, গান্ধার হল শিব ঠাকুরের আপন দেশ—বিষ্ণুর রাজনীতি ও অর্থনীতিতে তারা বিশ্বাসী ছিল না। একটি শ্লোকে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে গান্ধার নারীর মিলন হলে তাঁদের সন্তান ক্ষত্রিয় হবেন না, হয় বৈশ্য বা শূদ্র হবেন। বলা বাহুল্য, গান্ধার দেশের মানুষদের, বিশেষত নারীদের খুব ভাল চোখে দেখত না হস্তিনাপুর। ‘গন্ধার’ বা ‘গান্ধার’ শব্দটির অর্থ হল—যা সুগন্ধ সৃষ্টি করে। এই সুগন্ধের অর্থ হল উৎপাদন-সম্পর্ক অত্যন্ত মতিবিশিষ্ট ও নন্দিত; ব্যক্তি-মালিকানা বা মৎস্যগন্ধা (যা আসলে আঁশটে ও নিন্দিত) সেখানে ব্রাত্য ছিল।
আরও পড়ুন
ব্যক্তিগত নয়, যৌথ মালিকানার জন্যই আজীবন লড়াই চালিয়েছেন কর্ণ
গান্ধারী বিবাহের পর স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে যথাযথ সঙ্গত করবেন বলে পার্থিব চক্ষুকে পট্টবস্ত্র দিয়ে আবৃত করে রাখলেন।
ততঃ সা পট্টমাদায় কৃত্বা বহুগুণং তদা।
আরও পড়ুন
দরিদ্র প্রজার ব্যয় বহন করতে শাসক বাধ্য, এমনই নীতিশিক্ষা মহাভারতের
ববন্ধ নেত্রে স্বে রাজন পতিব্রতপরায়ণা।।
নাভ্যসুয়াং পতিমহমিত্যেবং কৃতনিশ্চয়া।
আরও পড়ুন
দক্ষ শাসক হবেন সু-অভিনেতা, উপেক্ষা করতে হবে লোকনিন্দাও - মহাভারতের শিক্ষা এমনই
সুবলের অনেক পুত্র ছিল—শকুনি, অচল, বৃষক, বৃহদ্বল, গয়, গবাক্ষ, বৃষভ, চর্মবৎ, অর্জব, শুক প্রমুখ। তাঁদের মধ্যে শকুনি গান্ধারীকে নিয়ে এলেন হস্তিনাপুরে। ভগ্নীর সঙ্গে তিনিও থেকে গেলেন হস্তিনাপুরে। শকুনি ছিলেন শিবের একনিষ্ঠ সাধক। শকুনির পুত্রের নাম উলূক যিনি শৈবশাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। উলূক শিবের অনুগ্রহে বৈশেষিক শাস্ত্র রচনা করেন। উলূকের পিসিমা গান্ধারী নিজেও ছিলেন শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত। কুমারী অবস্থায় তিনি শিবের কাছ থেকে এক শত উপযুক্ত পুত্রলাভের বর পেয়েছিলেন।
আরাধ্য বরদং দেবং ভগনেত্রহরং হরম্।
আরও পড়ুন
ঐশ্বরিকতা নয়, রাজ্য এবং রাজা সৃষ্টির পিছনে প্রধান নিয়ামক রাজনীতিই
গান্ধারী কিল পুত্রানাং শতং লেভে বরং শুভা।।
গান্ধার দেশের মানুষেরা ছিলেন মহাদেবের আদর্শে অনুপ্রাণিত। তাই গান্ধারী কুমারী অবস্থা থেকেই শিবের সাধনা করতেন এবং বৈবাহিক জীবনেও শিবের অনুগ্রহ পাওয়ার প্রতিজ্ঞায় অটল ছিলেন।
অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা
Powered by Froala Editor