মহাভারতে রাজনীতি – ১০
আগের পর্বে
অম্বিকার পর ব্যাসদেব মিলিত হলেন দাসী অম্বালিকার সঙ্গে। তিনি মিলনকালে চোখ বন্ধ না করলেও ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিলেন। রাজমাতা সত্যবতী জানালেন এর ফলে তাঁদের সন্তানও সুস্থ হবে না। সেই পুত্র, পাণ্ডু হল শ্বেতবর্ণ। অর্থাৎ জন্ডিস-আক্রান্ত। অন্যদিকে মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র। দুই পৌত্রই সিংহাসনের উপযুক্ত না হওয়ায় ব্যাসদেব আরও এক দাসীর সঙ্গে মিলিত হলেন। তাঁদের উৎপাদিত পুত্র, বিদূরের মধ্যে উপস্থিত রাজার সকল গুণই। কিন্তু তৈরি হল সমস্যা। শুদ্র হওয়ার জন্য সিংহাসনে বসানো যাবে না তাঁকে।
শাসক সর্বদা জনগণের কল্যাণ চিন্তা করবেন। কল্যাণ কী? লোকস্থিতি যার উপর নির্ভর করে। লোক হল ভুবন। স্থিতি হল ভারসাম্য। এই কল্যাণ হল জনসাধারণের সুখ, তাদের সমৃদ্ধি। ভ্রমর যেমন গাছের কোনও ক্ষতি না করে তার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করতে পারে, তেমনি রাজা প্রজার কোনও ক্ষতি না করে উদ্বৃত্ত অংশ থেকে কোশের পুষ্টি সাধন করবেন। দেশ, কাল ও পাত্রবিবেচনায় আপনার এবং প্রজার মঙ্গল ও প্রতিপাল্যপ্রতিপালক-সম্বন্ধের যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, সেই ভাবে অর্থবৃদ্ধির চেষ্টা করতে হয়। গাভীকে দোহন করার সময় তার বাছুরের কথা খেয়াল রাখতে হয়। ব্যাঘ্রী যেমন শাবককে ঘাড়ে কামড় দিয়ে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যায় অথচ শাবকের কোনও কষ্ট হয় না, ঠিক তেমন প্রজাকে ব্যথা না দিয়ে তাদের কাছ থেকে কর গ্রহণ করে কোশের উন্নতি সাধন করতে হয়। এক রকমের ইঁদুর আছে, তারা নিদ্রিত ব্যক্তির পায়ের নীচের মাংস মৃদু কামড়ে ছিঁড়ে নিয়ে যায়, ঘুমন্ত লোক কোনও ব্যথা অনুভব করে না। সঙ্গতিসম্পন্নদের কাছ থেকে কর নিতে হয়। অকালে, আকালে, অস্থানে এবং অন্যায়ভাবে কর নিতে নেই। সকল শ্রেণির প্রজা থেকে কর গ্রহণ করবে না। দরিদ্র, অনাথ, বিধবা, বিপন্ন ব্যক্তি এবং তপস্যারতদের থেকে কর নেওয়া চলবে না। রাজার অর্থক্ষুধা প্রবল হলে প্রজারা তাঁকে বিশ্বাস করতে পারে না, শ্রদ্ধা তো অনেক দূরের ব্যাপার।
সংবেক্ষ্য তু তথা রাজ্ঞা প্রণেয়াঃ সততং করাঃ।
নোচ্ছিদ্যাদাত্মনো মূলং পরেষাং চাপি তৃষ্ণয়া।।
শাস্ত্রানুসারে, রাজা বণিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত কর এবং অন্যান্য জায়গা থেকে পাওয়া অর্থ থেকে দরিদ্র প্রজার সম্বৎসরের খরচ বহন করতে ধর্মত বাধ্য। দরিদ্রদের থেকে কর তো নেওয়া চলবে না, বরং তাদের খরচ বহন করতে রাজা বাধ্য। কোথা থেকে আসবে সেই অর্থ? ধনী বৈশ্যের প্রদত্ত করে ওই ব্যয়নির্বাহ করা হবে। প্রজাপীড়নে আপাতত ধনবৃদ্ধি হলেও সেই ধন স্থায়ী হতে পারে না। প্রজার অশ্রদ্ধা থেকে উদ্ভূত বিদ্রোহের আগুন রাজাকে ধনেপ্রাণে দগ্ধ না করে নিবৃত্ত হয় না।
দুঃখাদান ইহ হ্যেষ স্যাত্তু পশ্চাৎ ক্ষয়োপমঃ।
অভিগম্যমতীনাং হি সর্ব্বাসামেব নিশ্চয়ঃ।।
আরও পড়ুন
দক্ষ শাসক হবেন সু-অভিনেতা, উপেক্ষা করতে হবে লোকনিন্দাও - মহাভারতের শিক্ষা এমনই
রাজকোষ প্রজাদেরই ন্যস্ত সম্পত্তি। প্রজার জীবিকার নিমিত্ত রাজা দায়ী। যার রাজত্বে কোনও প্রজা খিদের জ্বালায় চুরি করতে বাধ্য হয় সেই রাজার অযোগ্য। জীবিকার সংস্থান থাকলে চুরি ইত্যাদি কাজে লিপ্ত হওয়ার কোনও কারণ নেই। যে রাজার রাজ্যে গৃহস্থ ক্ষুধায় অবসন্ন হয়, তাঁর রাজ্য ক্ষয় পায়,... ‘আমি তোমাদের রক্ষক’ এই কথা বলে যে রাজা রক্ষা করেন না, প্রজারা মিলিত হয়ে সেই উন্মত্ত ও আতুর রাজাকে কুকুরের ন্যায় হত্যা করবে। (অনুশাসনপর্ব, খণ্ড ৩৯, পৃষ্ঠা ৭৬১, হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ, মহাভারতম্)।
রাজা যদি প্রমাদগ্রস্থ হন, তবে সমস্তই ধ্বংস হয়। কারও জীবনে সুখশান্তির আশা থাকে না। রাজা অধার্মিক হলে হাতি ঘোড়া উট গরু প্রভৃতি জন্তুরাও অবসন্ন হয়ে পড়ে। রাজাই রক্ষক আবার রাজাই বিনাশক। রাজা যদি অনৈতিক অস্বীকারকারী হন, তবে প্রজারা সর্বদা উদ্বেগের সঙ্গে সময় নির্বাহ করে।
আরও পড়ুন
ঐশ্বরিকতা নয়, রাজ্য এবং রাজা সৃষ্টির পিছনে প্রধান নিয়ামক রাজনীতিই
রাজৈব কর্ত্তা ভূতানাং রাজৈব চ বিনাশক।...
অথ যেষাধর্ম্মজ্ঞো রাজা ভবতি নাস্তিকঃ।
শূদ্রকন্যা মৎস্যগন্ধা পরাশরের ক্ষেত্র হলেও তাঁর সঙ্গে শান্তনুর বিবাহ হয়েছিল অলৌকিক উপাখ্যান ও সংহিতা পরিবর্তনের ফলে। নারী পুনর্ভূ হতে পারেন না, মনুর এই বিধান পরাশর বদলে দিয়েছিলেন। তেমনি দাশরাজের কন্যাকে ক্ষত্রিয় উপরিচর বসুর কন্যা হিসাবে পরিচিত করানোর অলৌকিক উপাখ্যানও ঋষিপ্রবর সৃষ্টি করেছিলেন। বিদুর দাসীপুত্র। বিদুরের জননী অপ্সরার ন্যায় সুন্দরী কিন্তু তাঁর শূদ্রত্ব ঘোচানোর জন্য ব্যাসদেব কোনও উপায় যখন পেলেন না তখন বিদুরকে স্বয়ং ধর্ম হিসাবে পরিচিত করালেন। ধৃতরাষ্ট্রকে চেনালেন অরিষ্টপুত্র হংসনামা নামক গন্ধর্ব হিসাবে আর পাণ্ডুকেও হংসনামানুজ হিসাবে। দিব্যগন্ধর্বরা হলেন সূর্যের অশ্বের নিয়ন্তা। হংস হল মন্দগামী। এই সবই তাঁদের পূর্বজন্মের ইতিহাস। কিন্তু ধর্ম হলেন দেবতা, তিনি অন্ত্যজদের কাছে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের থেকেও উচ্চ স্থানে অবস্থিত। শব্দতত্ত্ববিদদের মতে, ‘বিদুর’ ঈশ্বরতত্ত্বজ্ঞ, নাগর ও পণ্ডিত।
আরও পড়ুন
কোনো অবস্থাতেই সত্যের অপলাপ করতে পারবেন না শাসক, নির্দেশ মহাভারতকারের
পুংকোকিলের মতো ব্যাসদেব ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুরকে কাকবৎ দেবব্রত-ভীষ্মের কাছে রেখে গেলেন। ভীষ্ম তাঁদের রাজনীতিশাস্ত্র ও শস্ত্রবিদ্যার পাঠ দিতে লাগলেন। ধৃতরাষ্ট্র অসাধারণ বলবান, পাণ্ডু মহাপরাক্রান্ত ধনুর্ধর, বিদুর অসাধারণ রাজধর্মপরায়ণ। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ ও বিদুর দাসীপুত্র বলে পাণ্ডুকে ভীষ্ম রাজপদে বসালেন।
পাণ্ডু বেদ, ধনুর্বেদ, গদাযুদ্ধ, অসিযুদ্ধ, গজশিক্ষা, নীতিশাস্ত্র, ইতিহাস-পুরাণ প্রভৃতি রাজনীতিশিক্ষা করেন। তার পর বের হন দিগ্বিজয়ে। রাষ্ট্রের যে সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব তার অন্যতম হল জনপদ—যার মধ্যে আবার রয়েছে জমির মালিকানা। পাণ্ডু রাজনীতির এই জায়গায় মন দিলেন। পাণ্ডু যেহেতু সার্বভৌম শাসক তাই ভূমির উপর তাঁর কর্তৃত্ব ছিল। জমির উপর যে সব সম্প্রদায়ের কর্তৃত্ব বা মালিকানা ছিল, সেই নিয়ন্ত্রণ পাণ্ডু নিজের জাতে নিয়ে নিলেন। যেমন দশার্ণ, মগধ, মিথিলা, কাশী, সুহ্ম, পুণ্ড্র প্রভৃতি দেশের গোষ্ঠিপতিদের পরাজিত করে জমির মালিকানা এল হস্তিনাধিপতি পাণ্ডুর নিয়ন্ত্রণে। জমির মালিক রাষ্ট্র, যে ব্যক্তি জমির ব্যবহারের জন্য কর দিচ্ছে না, রাষ্ট্র তার থেকে জমি কেড়ে নিতে পারে। সমস্ত জমির উপর কেবল রাজারই অধিকার আছে---ভূমেরধিপতির্হি সঃ। এমনকি ভূমির নীচে যে ধনসম্পদ আছে, তার অধিকারীও রাজা। তবে মানুষ যে সব জায়গায় বাস করে, যে জমি চষে জীবিকানির্বাহ করে বা যে ভূমিতে ধর্মাচরণ পালন করে তা যেন রাজা কেড়ে না নেন। তা হবে রাজনীতি ও ধর্মনীতির পরিপন্থী।
আরও পড়ুন
সিংহাসনে বসবেন না ভীষ্ম, রাজাহীন হস্তিনাপুরের ভার নিতে আহ্বান ‘কানীনপুত্র’ ব্যাসদেবকে
এমতাবস্থায় রাজা পাণ্ডুর বিবাহ হল সূর্যের ক্ষেত্র কুন্তীর সঙ্গে। যেহেতু সূর্যের সঙ্গে কুমারী পৃথা অর্থাৎ কুন্তীর গন্ধর্বমতে বিবাহ হয়েছিল এবং তাঁদের একটি পুত্রও জন্মায়, তাই পৃথাকে সূর্যের ক্ষেত্র বলা যায়—আচার্য মনুর মতে। যেমন সত্যবতী পরাশরের ক্ষেত্র। সংহিতা বদলের ফলে কুন্তীও পুনর্ভু হতে পারলেন। কুন্তীর সঙ্গে পাণ্ডুর বিবাহ হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। একটি হল, তিনি যদুশ্রেষ্ঠ শূরের কন্যা। দ্বিতীয়ত, তিনি সূর্যের পুত্রের জননী।
প্রথমটি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। শূর হলেন যদুপতি দেবমীঢ়ের পুত্র। দেবমীঢ়ের একজন স্ত্রী ক্ষত্রিয়কন্যা এবং অন্য স্ত্রী ছিলেন বৈশ্যকন্যা। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে জন্মান শূর এবং অন্য স্ত্রীর সন্তান হলেন পর্জন্য। শূরসেনের দশ পুত্র ও পাঁচ কন্যা। তাঁদের মধ্যে দুই কন্যা—পৃথা ও শ্রুতশ্রুবা। পৃথাকে বাল্যকালেই কুন্তিভোজের কাছে দান করা হয় আর শ্রুতশ্রবার সঙ্গে বিবাহ হয় চেদিরাজের, যাঁদের পুত্র হলেন শিশুপাল। যদুবংশের কেউ কোনও দিন সার্বভৌম রাজা হতে পারবেন না, এমন অভিশাপ পূর্বপুরুষ যযাতি দিয়ে গিয়েছিলেন, যিনি যদুর পিতা। ‘শূর’ শব্দের ধাতু ‘শূর্’-এর প্রাথমিক অর্থ হল হিংসা, দ্বিতীয় অর্থ—স্তম্ভন, জড়ীভাব। শূরের পিতৃষ্বসার পুত্র কুন্তি বা কুন্তিভোজ ছিলেন যদু বংশের আর এক গোষ্ঠিপতি—তাঁর হাতে পৃথাকে দেওয়া হয়। কুন্তিভোজ ওই কন্যার উপর অতিথিসেবার ভার দিয়েছিলেন। প্রসঙ্গেক্রমে জেনে নেওয়া ভাল যে কন্যাটির নাম পৃথা, যার অর্থ হল বিক্ষিপ্ত। আবরণ ও বিক্ষেপ ক্যামোফ্লেজের দুই দিক। ‘কুন্ত’ মানে ‘অন্ত যা থেকে’, কুৎসিত ও অপ্রতিক্রিয়। কুন্তিভোজের কাছে পৃথাকে দান করে দেওয়া বিষয়টি পৃথা নিজেই মানতে পারেননি। কুন্তী পরবর্তীকালে বলেছেন, নিজের দুর্গতির জন্য তিনি দুর্যোধনদের দোষ দেন না, দেন তাঁর নিজের জৈবিক পিতাকে। কুন্তী বলছেন, আমার পিতা আমাকে দান করে অনেক মান পেলেন।
আরও পড়ুন
একে একে সাত পুত্রকে হত্যা করলেন গঙ্গা, দুঃখে শোকে অস্থির শান্তনু
পিতা তাঁকে কেন কুন্তিভোজকে দান করেছিলেন? জরাসন্ধবিরোধী যে সব রাজা, অতিথি, মুনি-ঋষিরা আসবেন তাঁদের সেবা করবেন পৃথা। সেই সময় থেকেই জরাসন্ধবিরোধী একটি বৃত্ত তৈরি হচ্ছিল যদুবংশীয়দের মধ্যে। পৃথা কুন্তিভজের প্রাসাদে আসার পর কুন্তিভোজের পুরুজিৎ প্রভৃতি দশটি পুত্র জন্মায়। এই পুরুজিৎ ছিলেন জরাসন্ধ-বিরোধী রাজগোষ্ঠীর অন্যতম নেতা।
অলংকরণ – প্রণবশ্রী হাজরা
Powered by Froala Editor