শ্বেতশুভ্র বিবর্ণতার অন্তঃস্থলেও কখনো অন্তঃসলিলা হয়ে বইতে থাকে রামধনু। শেষ বলে আসলে কিছু হয় না, শেষ আসলে আরেকরকম শুরু। উদয়ের কাছে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গেল অমলার। আর সেই ধূসর দিনগুলিতেই কেমন নিরুচ্চার তৈরি হয়ে গেল এক ভিনধারার সাঁকো। যেন এপার-ওপার হতে লাগল মৃদু চাওয়া-পাওয়ার এক পানসি। বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন উদয়, কী অ-সুখ তাড়িয়ে বেড়ালো তাঁকে, তবু সম্পর্কের প্রতি থাকতে চেয়েছেন উষ্ণ। উদয়ের কাছে যেতেন অমলার বাপের বাড়ির পরিজন, অমলার মা-ও। থমথমে মেঘ-ভারি দিন তবু এইসব ক্ষেত্রে ছায়া ঘনিয়ে উঠতে দেননি উদয়। অমলার নাচের স্কুলের শিক্ষক ছিলেন রাঘবন। তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, অমলার কাজে তাঁকে একলা ফেলে কখনও না-যেতে। তিনি অপারগ, তবু নিশ্চিত করতে চেয়েছেন অমলার ভালো-থাকাকে।
বিচ্ছেদের এই সময়ে দেখা হত না তাঁদের। তবু নিঃস্ব কাঙাল প্রেম এ রিক্ততার মাঝেও নির্মাণ করে নিল এক নিজস্ব শামিয়ানা। তুলনারহিত এক আদান-প্রদান। একে অপরকে তাঁরা ফোন করতেন বছরে তিনবার। একে অন্যের জন্মদিনে। আর তাঁদের বিয়ের দিনটিতে। বর্তমানকে আগলে রাখতে পারেননি, তা বলে ধূলিধূসরিত হতেও দেননি অতীতকে। একদিন এলেন উদয়শঙ্কর, অমলার কাছে। সেদিন অমলার জন্মদিন। ফুল এনেছিলেন। সঙ্গে এনেছিলেন আরো একটা উপহার। একসময় খুব সুন্দর সব আংটি ছিল উদয়শঙ্করের। ছদ্ম-রাগে কখনো-কখনো তাঁকে বলতেন অমলা, আপনার এত আংটি, বিয়ের পর আমাকে দিলেন না একটাও। উদয় হেসে বলতেন, সবই তো তোমার। কিছু টাকা আর একটা নবরত্ন আংটি সেদিন উদয়শঙ্কর তুলে দিতে চাইলেন অমলার হাতে। জীবনের উপকূলে দাঁড়িয়ে উদয় কি শুধু এসেছিলেন ওই গহনাটুকুই দিতে? না কি ছল করা সেই মান-অভিমান, মধুর সে প্রেমপলকে তিনি অন্তরে ধারণ করে আছেন আজও, বিস্মৃত হননি এতটুকু মনে করাতে চেয়েছিলেন সেই কথাখানা? অমলা নিলেন শুধু ফুলটুকুই।
উদয়ের সাতাত্তরতম বছরে প্রতিবারের মতো, এবারেও বিবাহবার্ষিকীতে অমলা ফোন করলেন তাঁর স্বামীকে। বললেন, জন্ম-জন্মান্তরে যেন শুধু আপনাকেই পাই স্বামী হিসেবে। অমলাশঙ্কর জানিয়েছিলেন, খুব অভিভূত হয়ে গেলে, বলার মতন কিছু ভেবে পেতেন না উদয়শঙ্কর। তখন শুধু বলতেন, থ্যাঙ্ক ইউ। সেদিনও তাই বললেন।
১৯৭৭-এ বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন উদয়শঙ্কর। সেপ্টেম্বর মাসে উদ্বেগ্নজনক হয়ে উঠল অবস্থা। মহানগর ছুটল এই দুর্দিনে। শিল্পীকুল, সরকার, গুণগ্রাহী, সর্বোপরি শঙ্করদের পরিজনবর্গ সবাই দাঁড়াল অসুস্থ উদয়শঙ্করের কাছে। আশঙ্কা আর দ্বিধায় পৌঁছতে পারলেন না শুধু অমলা। নিজস্ব কিছু মসৃণতা যেমন ছিল, ছিল হাজারো বাহ্যিক সংকটও। উথাল-পাথাল তোলপাড় হৃদয়, তবু অপেক্ষা করতে হল তাঁকে। শেষে ডাক্তারদের সাহায্যে তিনি পৌঁছলেন রোগীর ঘরে। ওই প্রবল অসুস্থতা তবু অমলাকে দেখে ভারি সুন্দর হাসলেন উদয়। যেন ধস নামল অভিমানের পাহাড়ে।
আরও পড়ুন
অমলা বাড়ি ফিরে দেখলেন শূন্যগৃহ
অসুস্থতার আবর্তে সে কটা দিন পুরোনো আবেগ এসে জায়গা করে নিল রোগীর ঘরে। সন্তানদের নিয়ে কতদিন পরে অমলা রইলেন স্বামীর সঙ্গে, স্বামীর কাছটিতে। ফিরে এল সেই বিশ্বাস-ভালোবাসা। আর অনুরাগও। অমলাশঙ্কর ফিরে বসলেন তাঁর প্রেম-স্বীকৃত আসনটিতে। একদিন অমলা রয়েছেন উদয়ের ঠিক পাশটিতে। উদয় ধীরে-ধীরে অমলার মাথাটা রাখলেন নিজের বুকের ওপর, হাতটা অতি সন্তর্পণে রাখলেন মাথার ওপর, তারপর বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ ডার্লিং, থ্যাঙ্ক ইউ। অমলা ভেসে যায় অশ্রুজলে।
আরও পড়ুন
উদয়শঙ্করের কাছ থেকে দর্শক ফিরলেন শূন্য হাতে
সেদিন উদয়শঙ্করের ব্যক্তিগত ডাক্তার নিজে এসে পৌঁছলেন অমলাশঙ্করের কাছে, খবরটা দিলেন তিনিই। ১৯৭৭, ২৬ সেপ্টেম্বর ভোরবেলায় চলে গিয়েছেন উদয়শঙ্কর। দুর্বহ এ বেদনা। অবরুদ্ধ পড়ে থাকে উনকোটি জীবনবাসনা, অযুত আকাঙ্ক্ষায় যেন খিল এঁটে দেয় সিংহদুয়ার। তবু মৃত্যু এল সুন্দরতর বেশে। জীবনের উপান্ত্যে যত গ্লানি সব সঙ্গে নিয়ে গেল সে। জাগিয়ে দিয়ে গেল সেই সদ্যযুবা উদয়শঙ্করের মূর্তিটিকে, ঐতিহ্যের বিস্তারে তাঁর অতুলনীয় অভিযাত্রাটিকে। মৃত্যু এসে পুনর্জন্ম দিল উদয়শঙ্করকে।
আরও পড়ুন
উদয়শঙ্করকে রাখা হল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে
নৃত্যশিল্পী রূপে নয়, চিত্রশিল্পীরূপে শুরু হয়েছিল তাঁর যাত্রা। লন্ডনের রয়্যাল আর্ট কলেজে সদ্যযুবা উদয়শঙ্করের চিত্রগুণে মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং স্যর উইলিয়ম রটেস্টাইন। কিন্তু সেই চিত্রে রটেনস্টাইন খুঁজছিলেন আরো কিছু, খুঁজছিলেন ভারতবর্ষকে। চাইছিলেন পৃথিবীর যাবতীয় বোধচর্চা যেন গভীরভাবে দেখতে শেখায় তাঁর নিজের দেশকেই। ব্রিটিশ মিউজিয়মে চিঠি লিখে, তিনি ব্যবস্থা করে দিলেন ভারতশিল্প-চিত্রকলা বিষয়ে উদয়ের পড়াশোনার জন্য। গভীর এই জীবনবোধের সংস্পর্শে সেদিন ভিনদেশে শুরু হয়েছিল উদয়ের স্বদেশ-সন্ধান। লন্ডনের ওয়েমব্লে স্টেডিয়মে তখন ইন্ডিয়া ডে-র আনন্দ-সমারোহ। পিতা শ্যামশঙ্করের আগ্রহে উদয়ের পদক্ষেপ ঘটল মঞ্চে। নৃত্যে রীতিমতো তালিম আর দস্তুরমতো শিক্ষালাভ কোনোদিনই ঘটেনি তাঁর জীবনে। উদয়ের শিক্ষা তাঁর অণুবিশ্ব আর মহাবিশ্বকে আন্তরিক পরখ করার মেধাবী দক্ষতা। বয়ে চলে স্মৃতিস্রোত। আলোর ফুলকি ঝরা নিকষ রাতে মর্মে ঢেউ-জাগানিয়া অন্ত্যজ মাতাদিনের সেই নাচ, গোলাপজলের গন্ধ-জড়ানো ঘাগড়া-চোলিতে নসরতপুরের সেই মেয়ের ভ্রু-ভঙ্গি, ঝালোয়ারে তারা-ধরা নিশীথবেলা রাজসমারোহে রাজনর্তকীর সেই নিবেদনকে অন্তরে ধারণ করেছিলেন উদয়, সে-ই তাঁর শিক্ষা। ধ্রুপদি আর লোকায়ত নৃত্যের বাইরে সেদিন জন্ম নিল এক নতুন ধারা। মনে রাখতে হয় উদয়ের জীবনেতিহাস, এক ভারতশিল্পেরও জন্মবৃত্তান্ত।
আরও পড়ুন
একাকী ভ্রমণ বদলে দিল অমলার জীবন
১৯২২-এ রুশ কিংবদন্তি আনা পাভলোভা আর উদয় সাজলেন রাধা-কৃষ্ণ। ধন্য-ধন্য করল দর্শক। মঞ্চ আর দর্শকাসনের তাৎপর্য উদয়ের মনে গেঁথে উঠল চিরদিনের তরে। আশ্চর্য এই দিনটি নৃত্যগাথায় হয়ে রইল চিরসমকালীন। রটেনস্টাইনের মতো আনাও তাঁকে শিখিয়েছিলেন শিল্পবোধে ওতপ্রোত হয়ে থাকে মানুষের দেশ। আনার সঙ্গে পরিভ্রমণ, সে যাত্রা উদয়শঙ্করের আত্ম-অভিযান। জীবনের সমস্ত প্রান্ত থেকে উদবোধিত হয়েছেন উদয়। আনন্দ কেন্টিস কুমারস্বামী তাঁকে দিলেন স্বকৃত অভিনয়-দর্পণের অনুবাদ। পুরাকালে অভিনয়ের গুপ্তধনকে পুনরুদ্ধার করলেন উদয়, তাঁর মুদ্রায়। বিস্ময়ের ছিল আরো একপ্রান্ত। ক্লিন্ন ক্যাবারের সেই দিনগুলিতে, আলো-আঁধারি মত্ত-মুখরতার বিপরীতে ক্ষণিক দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই রমণী, শরীরে-মুদ্রায় যাঁর লাস্যের সম্ভার, বলেছিলেন, এখানে তোমাকে মানায় না শঙ্কর।
এলেন ভুবনখ্যাত ভাস্কর অ্যালিস বোনার। আবহমান ভারতবর্ষকে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি রঙে-রেখায়। সেই অ-পূর্ব অন্বেষণে তিনি লাভ করলেন উদয়কেও। একই যাত্রায় একজন খুঁজছিলেন নানাখানায় চিত্র-বিচিত্র, মূর্ত-বিমূর্ত হয়ে থাকা এক দেশ। আর বিদেশে নবলব্ধ এক বোধের উত্তরাধিকারে আরেকজনের অন্বিষ্ট তাঁর সত্য-স্বদেশ। দেশের ভেতর উদয় তন্নতন্ন খুঁজলেন সুর-তাল-বাদ্য, চিনলেন প্রত্যন্তে হারিয়ে-থাকা তাঁর বৃহত্তর ‘স্বজন’কে। শিল্প-ঐতিহ্যের শোণিতধারায় এই দেশকেই তিনি করে তুললেন তাঁর বিরাট ঘর।
জগৎজুড়ে ছড়িয়ে তখন তাঁর নাম, তিনি এলেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথের স্নেহ আর অসন্তোষ তিনি গ্রহণ করলেন দুটিকেই। ধীর, শান্তচিত্তে। উপেক্ষিত-অবমানিত এই শিল্পকে বিলাসীর জলসাঘর থেকে সুকুমার শিল্প-আবর্তে উন্নীত করতে চাইছিলেন রবীন্দ্রনাথ। উদয়শঙ্করের নৃত্যকে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন, ‘অতীত যুগের অনুবৃত্তি’ আর ‘প্রাদেশিক অভ্যস্ত সংস্কারে’র বাইরে, মুক্ত চেহারায়। মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্ববন্দিত রবীন্দ্রনাথ, ‘এই পণ্যজীবিনী নৃত্যকলাকে তার দুর্বলতা থেকে তার সমলতা থেকে উদ্ধার করো। সে মন ভোলাবার জন্যে নয়, মন জাগাবার জন্যে।’ তাঁর নির্দেশকে উদয় গ্রহণ করলেন পরম নিষ্ঠায়, পরম শ্রদ্ধায়। নিজেকে দেখলেন ‘নিরন্তর অসন্তোষ’ আর নিরন্তর পরিমার্জনে।
তাঁর জীবনে এলেন ঈশ্বরের দূত আলাউদ্দিন খান সাহেব। এলেন গুরু শঙ্করণ নাম্বুদ্রি, গুরু কণ্ডাপ্পা পিল্লাই, গুরু অমোবি সিং। ভারতভক্ত আর রবীন্দ্রগুণমুগ্ধ এলমহার্স্টের উদার প্রশ্রয় আর ভালোবাসা পেলেন উদয়শঙ্কর। ভারতের মাটিতে যেন নির্মিত হল স্বর্গের গন্ধর্বনগর। খণ্ডকালের সাপেক্ষেও ভারতশিল্পের ইতিহাসে আশ্চর্য এক দৃষ্টান্ত হয়ে রইল আলমোড়ার কলাকেন্দ্র।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নিজের অসামান্য অভিনব নিরীক্ষাটিকেও উদয়শঙ্কর পৌঁছে দিলেন বিশ্বলোকে। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা ‘কল্পনা’ চলচ্চিত্রে তিনি জন্ম দিলেন এক ভারতজিজ্ঞাসাকে, এক অখণ্ড ভারতবোধকে। গড়ে দিয়েছিলেন জাতীয় নৃত্যশৈলীর এক ভাষাসন্ধান সূত্রকে। নিজের বর্ণময়, রত্নমণ্ডিত চালচিত্রের প্রেক্ষাপটে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠলেন উদয়শঙ্কর। অমলা ফিরে পেলেন তাঁর কাব্যলোকের অনুপম নায়ককে।
পুনশ্চ
অমলাশঙ্করকে আমরা পেয়েছি যখন, তিনি মধ্য নব্বুই। অমলিন সেই হাসি, আত্মদীপ্তিতে চির উজ্জ্বল, সুন্দর তিনি। অনাবিল-অনায়াস, গহন এক প্রসন্নতাই তাঁর স্বভাব, তাঁর চারিত্র্যও। কী আশ্চর্য আন্তরিক আর স্নেহময়। তাঁর বিচরণ জুড়ে বিছিয়ে থাকত অনন্যরূপ এক বিভা। শঙ্করদের জীবনস্রোতে যদি খানিক সময়ও নিরবিচ্ছিন্ন শুধু তাঁকে নিয়েই চলত কথা, শান্তস্বরে, বদলে দিতেন কথার-পথচলা। মৃদু, সংহত উচ্চারণে বলতেন, আমার কথা নয়, উদয়শঙ্করের কথা বোলো। উদয়শঙ্করের কথা।উদয়শঙ্করের কর্মকাণ্ড নিয়ে শুরু হোক বিস্তারিত তন্নিষ্ঠ গবেষণা, সেই আশায় পাঠকের দরবার থেকে আজ বিদায় নেওয়ার পালা।
Powered by Froala Editor